সুন্দরবন আন্দোলনের অসংখ্য মুখ

বাংলাদেশে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে সর্বপ্রাণ প্রকৃতি-পরিবেশ বহুভাবে আক্রান্ত। লুণ্ঠনমুখী উন্নয়ন ধারা নিশ্চিত করতে মানুষের চিন্তা, মতপ্রকাশ, সংগঠন, সমাবেশসহ সব তৎপরতার ওপর ভয়াবহ নিপীড়নমূলক চাপ জারি রাখা হয়েছে। গুম-খুন-আটক-হয়রানি নতুন নতুন রেকর্ড করছে। আর বাড়ছে সড়ক, ভবন, কারখানায় অকালমৃত্যুর সংখ্যা। 

এর মধ্যে মহাপ্রাণ সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন সপ্তম বছর পার হয়ে অষ্টম বছরে পা দিয়েছে। কয়েক বছরে এ আন্দোলনের অনেক রকম ওঠানামা সত্ত্বেও তা অনেক বিস্তৃত হয়েছে, নতুন অনেক মাত্রা যোগ করেছে। সুন্দরবন গভীর উদ্বেগ ও দৃঢ় সংহতির জায়গা তৈরি করেছে। শুধু দেশের ভেতরে নয়, দেশের বাইরে প্রবাসে যারা আছেন তারাও সোচ্চার হয়েছেন। যার যা আছে তাই নিয়ে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে জানা-অজানা অসংখ্য মানুষ। শিশুরা ছবি এঁকেছে, গান গেয়েছে। ছবি এঁকেছেন তরুণ শিল্পীরা, নাট্যকর্মীরা নতুন নাটক নিয়ে পথে পথে ঘুরেছেন, গান-সংশ্নিষ্টরা নতুন নতুন গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন, নতুন শিল্পী ও তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছে, লেখক-বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞরা কাজ করেছেন। এই সুন্দরবন আন্দোলনে প্রধান শক্তি বিভিন্ন জনপন্থি রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, পাঠচক্রসহ তরুণরা। 

অনেক দামে কেনা কোম্পানিমুখী প্রচারকদের প্রচারণার জবাবে এ আন্দোলনে কত তরুণ যে কতভাবে শ্রম ও সময় দিয়েছে, তার সংখ্যা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। এসব তৎপরতায় যারা নিয়োজিত তাদেরকে কেউ নিয়োগ দেয়নি। এদের প্রায় সবাই তরুণ। প্রতিষ্ঠিত অনেক ব্যক্তির নীরবতা, ভীরুতা এখন দৃষ্টিকটু। সুবিধার সন্ধান করতে গিয়ে হয়তো দাসত্বের জোয়াল তাদের ঘাড়ে। এই তরুণরা তার থেকে মুক্ত। এরাই সুন্দরবন আন্দোলনের মূল শক্তি।

বস্তুত সরকারের একগুঁয়েমি, রামপাল প্রকল্পের পক্ষে প্রচারণার নানা কৌশল, বিজ্ঞাপনী সংস্থা-কনসালট্যান্টসহ ব্যয়বহুল তৎপরতার বিপরীতে তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সংগঠিত আন্দোলন এবং তার সঙ্গে সংহতি জানিয়ে জনগণের বিভিন্ন অংশ থেকে স্বতঃস্ম্ফূর্ততা দেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। কোনো সন্দেহ নেই, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সুন্দরবনবিনাশী সব প্রকল্প বাতিলের পক্ষে জনসমর্থন নিরঙ্কুুশ। এ বিষয়ে বিভিন্ন জরিপও হয়েছে। সংবাদপত্রে জনমত জরিপ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একাধিক জরিপে ভয়ভীতি, বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ এ প্রকল্প বাতিলের পক্ষে ভোট দিয়েছে। আমরা বিভিন্ন সময়ে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়েই বলেছি, মানুষ যদি যথাযথভাবে নিজেদের মতামত প্রকাশ করার সুযোগ পেত, তাহলে ৯৯ শতাংশেরও বেশি মানুষ সুন্দরবনবিনাশী এ প্রকল্প বাতিলের পক্ষে মত দিত। 

বাংলাদেশ, ভারত ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিশেষজ্ঞদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এ পর্যন্ত দেশ-বিদেশের বহু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি; অনেকের গবেষণা বিশ্নেষণ অধ্যয়ন করেছি। রামপাল প্রকল্প বা সুন্দরবন ঘিরে ফেলা বনগ্রাসী ভূমিগ্রাসী প্রকল্পের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে ব্যক্তিস্বার্থে যুক্ত মুষ্টিমেয় ব্যক্তি বা ‘বিশেষজ্ঞ’ ছাড়া আর সবাই সুন্দরবনকে নিয়ে এই সর্বনাশা মুনাফাখোরি আয়োজনের প্রবল বিরোধী। বৈজ্ঞানিক সব তথ্য-উপাত্ত একই উপসংহারে এসেছে। একই কারণে ইউনেস্কো একাধিকবার সুন্দরবনের জন্য নিশ্চিত ঝুঁকিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে। সরকারের দিক থেকে অনেক দেনদরবার, তদবির ও লবিস্ট নিয়োগ সত্ত্বেও ইউনেস্কোর সিদ্ধান্তের কোনো পরিবর্তন হয়নি। 

২০১৬ সালে জাতীয় কমিটির উদ্যোগে সুন্দরবনমুখী সর্বশেষ জনযাত্রা বা লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছিল সুন্দরবন রক্ষায় জাতীয় কমিটির তৃতীয় লংমার্চ। তা ছাড়া এর আগের বছর সিপিবি, বাসদ ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা আরও দুটি লংমার্চ করেছে। সুন্দরবন জনযাত্রায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল, পেশা ও বয়সের মানুষের পাশাপাশি অংশগ্রহণ করেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েকজন প্রতিনিধি। তাদের মধ্যে ছিলেন বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী ও তথ্যচিত্র নির্মাতা।

একই বছর কলকাতা ও দিল্লিতে রামপাল প্রকল্প বাতিলের দাবিতে দুটি সমাবেশ হয়। এক সমাবেশে বিজ্ঞানী সৌম্য দত্ত বলেন, ‘ভারতের কোম্পানি এনটিপিসি এই সর্বনাশা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ভারতীয় আরেক কোম্পানি এই কেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে। ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক এই বিষাক্ত প্রকল্পে অর্থ জোগান দিচ্ছে। ভারতীয় কোম্পানি কয়লা জোগান দিতে যাচ্ছে। অতএব, ভারতের নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব বিশ্বসম্পদ সুন্দরবনের ধ্বংস ঠেকাতে সোচ্চার ও সক্রিয় হওয়া। এ প্রকল্প বাতিল না হলে আরও বিপজ্জনক প্রকল্প দুই দেশকে মহাবিপদের দিকে নিয়ে যাবে।’ 

এর মধ্যে জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে আমরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে জনগণের দাবি ও তার বিশদ ব্যাখ্যাসহ খোলা চিঠি প্রদান করেছি। এই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেও আটক, টিয়ার গ্যাসসহ পুলিশি হামলা পীড়নের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে প্রদত্ত চিঠিতে আমরা বলেছি, ‘… আমরা সুই থেকে রকেট সবই তৈরি করতে পারব। কিন্তু এ রকম অসাধারণ জীববৈচিত্র্যে ভরা বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত সুন্দরবন আরেকটি তৈরি করতে পারব না। এই সুন্দরবন আমাদের বিপুল সম্পদের জোগান দেয়। এই সুন্দরবন লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করে, জীববৈচিত্র্যের অসাধারণ আধার হিসেবে আমাদের সবার প্রাণ সমৃদ্ধ করে। এই বন প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাকৃতিক বর্ম হিসেবে উপকূলীয় অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষের প্রধান অবলম্বন। এই বন জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের টিকে থাকার প্রধান শক্তি। সে জন্যই আমরা বারবার বলি, বিদ্যুৎ উৎপাদনের বহু বিকল্প আছে; কিন্তু সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই। আজ প্রয়োজন শুধু এর রক্ষা নয়; এর বিকাশে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা।… ‘ 

সুন্দরবনবিনাশী প্রকল্প বাতিলের দাবিতে বাংলাদেশের সব শহীদ মিনারে দিনব্যাপী অবস্থান হয়েছে একাধিকবার। জাতীয় কমিটির বাইরেও ব্যক্তি, সংগঠন, গ্রুপ থেকে অসংখ্য প্রতিবাদী উদ্যোগ দেখা গেছে বিভিন্ন বছর। এগুলোর সংখ্যা একদিকে বেড়েছে, অন্যদিকে ভীত-সন্ত্রস্ত সরকারের হামলা-মামলা-নির্যাতন, দমন-পীড়নও বেড়েছে। ঢাকায় সুন্দরবন রক্ষার দাবিতে সাইকেল র‌্যালির উদ্যোগ নিয়েছিল তরুণরা। এই র‌্যালিও যে সরকারের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছিল, তা বোঝা গেল সেদিন বিভিন্ন স্থানে সরকারি বাহিনীর ভূমিকা দেখে। এর মধ্যে ছিল ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে তরুণ সাইকেল আরোহী দেখামাত্র আক্রমণ, সাইকেল আরোহীদের পুলিশের আটক ও শহীদ মিনারে সন্ত্রাসী দিয়ে ঘিরে ফেলা। তারপর সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে যখন সাইকেল মিছিল বের হয়েছে, তখন পুলিশ হামলা করল জলকামান দিয়ে। এর প্রতিক্রিয়ায় কি তরুণরা ভয় পেয়ে থেমে গেল? না। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এর পরের তিন মাসে অন্তত ৫০টি সাইকেল র‌্যালি হয়েছে সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্প বাতিলের দাবি নিয়ে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশেও খোলা চিঠি দেওয়ার জন্য সমাবেশ ও মিছিল হয়। পুলিশি হামলা, জলকামান উপেক্ষা করে এই চিঠি ভারতীয় হাইকমিশনে পৌঁছানো হয়। এতে বলা হয়, ‘দেশি-বিদেশি স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের বিশ্নেষণ থেকে আমরা নিশ্চিত, এই কেন্দ্র সুন্দরবনের অস্তিত্বের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। এই কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে বনগ্রাসী বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে সুন্দরবনের ভেতর ও চারধারে হাজির হয়েছে প্রভাবশালী গোষ্ঠী। এর সম্মিলিত প্রভাবে সুন্দরবনের বিনাশ অনিবার্য হয়ে উঠবে।… মানুষ ও প্রাণ-প্রকৃতির এই ক্ষতি চিরস্থায়ী। আগামী বহু প্রজন্ম এর শিকার হবে। উন্নয়ন আমাদের দরকার, বিদ্যুৎ আমাদের দরকার। কিন্তু উন্নয়ন ও বিদ্যুতের নামে প্রাণঘাতী, মানুষ ও প্রকৃতির জন্য সর্বনাশা কতিপয় গোষ্ঠীর লোভের বাণিজ্য প্রকল্প কোনো সুস্থ মানুষ গ্রহণ করতে পারে না। সে জন্য আমরা অবিলম্বে সুন্দরবনবিনাশী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলে আপনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রত্যাশা করেই এ চিঠি লিখছি। … বিধিনিষেধ ও পরিবেশ সচেতনতার কারণে আপনার সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও গ্রিন ট্রাইব্যুনাল গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ ও খনি প্রকল্প স্থগিত বা বাতিল করেছে। বাংলাদেশে ভারতীয় কোম্পানি যে ভারতের আইন ও বিধিমালা ভঙ্গ করেই এই বিদ্যুৎকেন্দ্র করছে, সে বিষয়েও আমরা এ চিঠির মাধ্যমে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।…’ 

ফেসবুকসহ সামাজিক গণমাধ্যমে প্রতিবাদী তৎপরতা সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সরকার সর্বজনের অর্থ খরচ করে বিজ্ঞাপনী সংস্থা ভাড়া করেছে, প্রচুর অর্থ ব্যয় করে টিভিতে বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু করেছে, বিভিন্ন স্থানে ভাড়া করে নাটক-গানের আসর বসাতে চেষ্টা করেছে। এসব তৎপরতা ভেসে গেছে তরুণসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের স্বতঃস্ম্ফূর্ত উদ্যম, সৃষ্টিশীলতা ও অবিরাম সক্রিয়তার কাছে। বস্তুত টাকার সঙ্গে প্রাণের যুদ্ধে সরকারের টাকা আর ক্ষমতার বড়াই হেরে গেছে। 

চট্টগ্রামে আট মাসের বাচ্চা পেটে নিয়ে শহীদ মিনারে প্রতিবাদী অবস্থানে বসেছিলেন মিলি নামে এক নারী সুন্দরবনবিনাশী প্রকল্প বাতিলের দাবি নিয়ে। তার কথা খুব সহজ- ‘যে দেশে উন্নয়নের নামে সুন্দরবন ধ্বংস করা হয়, সে দেশে আমি কোন ভরসায় আমার সন্তান নিয়ে আসব? আমার সন্তানের জন্যই সুন্দরবন বাঁচাতে হবে।’ প্রকল্প বাতিল হয়নি, শিশু জন্ম নিয়েছে। পরে মিলি সেই শিশুকে কোলে নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার মহাসমাবেশে যোগ দিয়েছেন। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’- এটি অনেক প্রাচীন প্রার্থনা এই জনপদের মায়েদের। আর পেটে সন্তানের সাত মাস অনুষ্ঠান করলেন আরেক নারী মিথিলা ‘আমার সন্তান যেন থাকে সুবাতাসে, তাই সুন্দরবন ধ্বংস করে বিদ্যুৎকেন্দ্র চাই না’- এই প্রার্থনা দিয়ে। 

সুন্দরবন নিয়ে কত গান-কবিতা লেখা হয়েছে, কারা লিখেছেন গেয়েছেন, তথ্যচিত্র কতগুলো হয়েছে, এগুলো তৈরি করতে কারা কাজ করেছেন, কত তরুণ কত রাত জেগেছেন, কত তরুণ কতবেলা না খেয়ে থেকেছেন, কতজনে পেশাগত সমস্যায় পড়েছেন, তার পুরো তালিকা করা সম্ভব নয়। গায়ে-গতরে খেটে প্রাণের টানে নিজের জীবন ও জীবিকাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে অসংখ্য মানুষ নিজ নিজ ক্ষমতা ও আকাঙ্ক্ষা থেকে যেভাবে সুন্দরবন তথা দেশের জন্য দাঁড়িয়েছেন, তা এক নতুন দিশা আর বিশাল ভরসার জায়গা তৈরি করেছে। 

কয়েক বছরে দেশের পাশাপাশি বিশ্বের বহু শহরে সুন্দরবন রক্ষায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবিতে অসংখ্য সভা-সমাবেশ হয়েছে। দেশের সাতটি প্রান্ত থেকে ঢাকামুখী ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ কর্মসূচি শেষে ঢাকায় মহাসমাবেশ ও বিশাল মিছিল হয় একাধিকবার। ২০১৭ সালের ৭ জানুয়ারি এবং ২০১৮ সালের ১০ নভেম্বর বিশ্বব্যাপী সুন্দরবনের জন্য বৈশ্বিক প্রতিবাদে শামিল হন বহু দেশের মানুষ। বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষায় প্রচারাভিযান শুরু করে সর্বপ্রাণ সাংস্কৃতিক শক্তি। 

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত নিয়ে সরকারি মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকার সফল হতে থাকলে দ্রব্যমূল্য, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিতে মানুষের ভোগান্তিই শুধু বাড়বে না; দেশ আরও বড় বিপদের সম্মুখীন হবে। দেশ ইতিমধ্যে নিপীড়িত উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা মানুষের অবিরাম প্রবাহে বিপর্যস্ত। কিন্তু সরকারের সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্প, দেশবিনাশী রূপপুর প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এর চেয়ে বহু 

গুণ মানুষ দেশের ভেতরেই উদ্বাস্তু হবে। এর পরিণতি চিন্তা করাও কঠিন। 

এত প্রতিবাদ, তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মত সবকিছু অগ্রাহ্য করে মুনাফা আর রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতার বলে সরকার শুধু সুন্দরবনবিনাশী প্রকল্প নয়, উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে সর্বনাশা সব প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে বাংলাদেশকে এক ভয়াবহ বিপদ ও ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। উন্নয়নের উন্মাদনা তৈরি করে আড়াল করছে লুণ্ঠন আর ধ্বংসের আয়োজন। 

আমরা যখন বঙ্গোপসাগরের গ্যাস নিয়ে রফতানিমুখী চুক্তির বিরোধিতা করি, তখন সরকারের মন্ত্রী মিয়ানমারের তুলনা টানেন। গ্যাস-তেল রফতানি, কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎসহ যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত আর রাশিয়ার সঙ্গে মিলে দেশের ক্ষুুদ্র গোষ্ঠীর বিপুল মুনাফার স্বার্থে উন্নয়ন মডেল সাজালে পরিণতি কী হয়; বিপুল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি তার প্রমাণ। আমরা বারবার বলেছি, বাংলাদেশ নাইজেরিয়া হবে না, মিয়ানমারও হবে না।

তাই সরকার যখন পশ্চাৎমুখী, লুণ্ঠন ও ধ্বংসমুখী, নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক উন্নয়ন দর্শনের অধীনে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে, তখন প্রায় দুই দশকের জনআন্দোলনের শক্তি ও আকাঙ্ক্ষার ওপর দাঁড়িয়ে আমরা জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে ভবিষ্যৎমুখী, প্রগতি ও সমতামুখী, গণতান্ত্রিক, প্রাণ-প্রকৃতি ও জনপন্থি উন্নয়ন  চিন্তার কাঠামোতে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা  উপস্থাপন করেছি ২০১৭ সালে। তাতে পরিস্কার দেখায় যে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে রামপাল, রূপপুর, বাঁশখালীর সর্বনাশা প্রকল্পের দরকার নেই। আরও অনেক ভালো পথ আছে। 

ঠিক, সুন্দরবন আন্দোলন বিভিন্ন কারণে এখন স্তিমিত। কিন্তু তার তাগিদ যে জনগণের মধ্যে আছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সেই প্রবল তাগিদ নিয়ে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ তাদের সক্রিয়তা দিয়ে সর্বপ্রাণের আন্দোলনকে জোরদার করবে- এই প্রত্যাশা রাখি।