নতুন নেতৃত্বের জন্ম

২৮ বছর পর ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে অনেক কেলেঙ্কারি হয়েছে, কিন্তু এর পাশাপাশি উজ্জ্বল ভরসা তৈরি হয়েছে অনেক ঘটনায়। বেশ কয়েকটি ছাত্রী হলে শক্তিশালী প্রতিরোধ তৈরি করেছেন ছাত্রীরা। যেখানে অনিয়ম–জালিয়াতি প্রতিরোধ হয়েছে, সেখানেই সরকারি ছাত্রসংগঠন পরাজিত হয়েছে। ছাত্রীসহ শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধ, কোটা সংস্কার আন্দোলনের নির্যাতিত নেতা নুরুল হকের ভিপি হিসেবে নির্বাচিত হওয়া নতুন মাত্রা যোগ করেছে তরুণ–সক্রিয়তায়। ডাকসু পুনর্নির্বাচনের যৌক্তিক দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীরা এখনো সরব।

বাংলাদেশে তরুণ শিক্ষার্থীদের সক্রিয়তায় বিভিন্ন ধরন আছে। সুন্দরবন আন্দোলনে দেখেছি, কিশোর–তরুণদের ভেতর দেশ, প্রাণ–প্রকৃতি, জন–অধিকার নিয়ে মনোযোগ ক্রমেই বাড়ছে, তাঁরা সক্রিয় ভূমিকা পালনে পথসন্ধানী। কোটা সংস্কার আন্দোলনে কাজের খোঁজে তরুণদের উদ্বেগ ও দুর্নীতি-বৈষম্যবিরোধী প্রতিবাদের জোয়ার দেখেছি। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে দেখেছি কিশোর বিদ্রোহীদের সক্ষমতা। বরাবরই তরুণদের সক্রিয়তা বিশেষত ‘ছাত্ররাজনীতি’র দুটি ধারা প্রধান: একটি ধারা ক্ষমতাসীন শ্রেণি ও গোষ্ঠীর রাজনীতি এবং সামাজিক সম্পর্কের কাছাকাছি থাকে, আর অন্যটি তাদের বদলানোর জন্য লড়াই করে। প্রথম ধারাটি ক্ষমতাসীন দলকে প্রতিনিধিত্ব করে, আর দখলকারী, লুটেরা ও দুর্নীতিবাজদের ভাড়াটে সৈনিকের মতো ভূমিকা পালন করে। এই ধারা তরুণদের শক্তির অবক্ষয় নির্দেশ করে। দ্বিতীয় ধারাটি দৃঢ়ভাবে সংগঠিত নয়, পৃষ্ঠপোষণ পায় না, রাষ্ট্র বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে, তারা অবিরাম নিপীড়ন ও বৈরিতার শিকার হয়। কিন্তু এই দ্বিতীয় ধারাই সমাজের নতুন প্রজন্মের শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে।

বর্তমানে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সরকারি ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের একক আধিপত্য। হলগুলো পুরো তাদের নিয়ন্ত্রণে। হল প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকেরা নেহাতই অলংকার। অধিকাংশ হলে রুম বিতরণ ও ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ নেতাদের ইচ্ছামাফিক হয় বলে হলে থাকতে বাধ্য শিক্ষার্থীরা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন। ভয়ের রাজত্ব তৈরি করে মিটিং, মিছিল, হামলা ইত্যাদিতে তাঁদের রিজার্ভ আর্মি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ব্যক্তিত্ব চুরমার করে দিয়ে দাস বাহিনী বানানোর জন্য গণরুমসহ অনিশ্চিত আশ্রয় এবং অবিরাম নির্যাতনের কৌশল ব্যবহার করা হয়। তাদের একাধিপত্যের সঙ্গে অনিবার্যভাবে আসে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, যৌন হয়রানি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ–বাণিজ্য ইত্যাদি অপরাধ। এর পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে কতিপয় শিক্ষক চেয়ার পেতে চেষ্টা করেন।

সরকারি ছাত্রসংগঠনের এ রকম ভূমিকা নতুন নয়। বস্তুত ছাত্রলীগ এখন যা করছে, তা পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানদের ছাত্রসংগঠন এনএসএফেরই ধারাবাহিকতা। এনএসএফ তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকারীদের মধ্যে ত্রাস ছড়াত, এমনকি শিক্ষকদেরও রেহাই দিত না। স্বাধীনতার পর এই ধারার অবসান ঘটবে—এটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র দখল ও ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

জিয়ার শাসনামলে গঠিত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সে সময় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান ছাত্রসংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এরশাদ আমলে গঠিত জাতীয় ছাত্র সমাজ শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে দাঁড়াতে পারেনি। এই দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র ছিল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। সে কারণেই নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে তখন। ১৯৯১ সালে নির্বাচিত সরকারের জমানা শুরুর পর যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ছাত্রসংগঠনের একচেটিয়া যথেচ্ছাচারের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। তার মানে, একবার ছাত্রদল আরেকবার ছাত্রলীগ— এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করেছে। এই সময়ে কোনো ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। গত ১০ বছরে ছাত্রলীগ একচেটিয়া ক্ষমতায় আছে।

সরকারি ছাত্রসংগঠনের এ রকম সর্বব্যাপী ক্ষমতার মুখে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ প্রকাশে নতুন ধরনের সাংগঠনিক কাঠামোর উদ্ভব দেখা যেতে থাকে ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে। প্রথম উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে সময় ক্যাম্পাসে যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের প্রতিবাদ করার জন্য সেখানে শিক্ষার্থীদের একটি নতুন জোট তৈরি হয়। যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ছিলেন সরকারি ছাত্রসংগঠনের নেতা। বাম ছাত্রসংগঠনের পক্ষে এককভাবে তঁাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করার অবস্থা ছিল না। তবে তাদের সক্রিয় ভূমিকায় গড়ে ওঠা আন্দোলনে ছাত্রসংগঠনের বাইরের শিক্ষার্থী, বিশেষত নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ এতই ব্যাপক ও কার্যকর ছিল যে তাদের উচ্চকণ্ঠ প্রতিবাদকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন হুমকি ও ভীতি দিয়ে চুপ করাতে পারেনি। এই আন্দোলনে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর ধারাবাহিক অংশগ্রহণ থাকলেও মূল শক্তি আসে সংগঠনবহির্ভূত সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। নতুন নেতৃত্বও জন্ম নেয়। আর আন্দোলনের বিষয়ও ছাত্র আন্দোলনে নতুন মাত্রা দেয়। এই আন্দোলন একই সঙ্গে ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ ও ‘সামাজিক আন্দোলন’-এর নতুন রাজনৈতিক তাৎপর্য উপস্থিত করে।

পরবর্তী বছরগুলোয় বিভিন্ন নিপীড়ন ও অবিচারের বিরুদ্ধে অন্যান্য ক্যাম্পাসেও একই ধরনের আন্দোলন গড়ে ওঠে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে (১৯৯৮-৯০), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের সহিংসতা ও ত্রাস সঞ্চারের বিরুদ্ধে (২০০০), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলে পুলিশের হামলার বিরুদ্ধে (২০০২) আন্দোলন অন্যতম। পরবর্তী দশকে সাধারণ শিক্ষার্থী ও বামপন্থী সংগঠনের জোটের মাধ্যমে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, টিউশন ফি বাড়ানোর বিরুদ্ধেও আন্দোলন বিস্তার লাভ করে। যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের দৃষ্টিগ্রাহ্য ফলাফলের মধ্যে আছে এ বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা এবং প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা’ গ্রহণ।

সর্বজনের স্বার্থ ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা আরেকটি ক্ষেত্র, যেখানে গত দুই দশকে গড়ে ওঠা জাতীয় আন্দোলনে তরুণ শিক্ষার্থীরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি, গ্যাস রপ্তানি, গ্যাস-বিদ্যুতের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি, ফুলবাড়ী উন্মুক্ত কয়লাখনিসহ বিভিন্ন দেশবিনাশী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গত আট বছরে ব্যাপক জনভিত্তি লাভ করেছে সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলন। এই আন্দোলনেও তরুণদের অংশগ্রহণই ছিল প্রধান। বিভিন্ন ব্যানার নিয়ে তারা এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছে।

 ‘সাধারণ ছাত্রদের ঐক্য’, ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমরা’, ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’, ‘নিপীড়ন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ’, ‘বেতন-ফি বৃদ্ধিবিরোধী ছাত্র ঐক্য’, ‘ভ্যাট নাই’, ‘ধর্ষণ প্রতিরোধ মঞ্চ’, ‘সুন্দরবনের জন্য আমরা’, ‘জাতীয় সম্পদ রক্ষা তরুণ সমাজ’, ‘ছাত্র সংসদের দাবিতে ছাত্রসমাজ’, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’, ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’ ইত্যাদি ব্যানারের অধীনে নতুন নতুন মঞ্চ দেখা গেছে গত কয়েক বছরে। যদিও 
এসব মঞ্চের কোনো স্থায়ী সাংগঠনিক কাঠামো নেই, তবু প্রতিবাদের নতুন শক্তি নির্মাণ, নতুন সংগঠক ও নেতৃত্বের জন্ম এসবের মধ্যে দিয়ে উল্লেখযোগ্য 
মাত্রায় ঘটছে।

বহু প্রতিকূলতার মধ্যেও বাম সংগঠনগুলো শিক্ষাঙ্গনে নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই অবিরাম চালিয়ে গেলেও তারা কেন বড় অংশ শিক্ষার্থীর সমর্থন নিয়ে বৃহৎ সংগঠন হিসেবে দাঁড়াতে পারে না—এ রকম প্রশ্ন প্রায়ই ওঠে, এখন আরও বেশি বেশি করে উঠছে। তাদের তো দুর্বলতা আছেই, কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে, নানা রকম দুর্বলতা থাকলেও এই সংগঠনগুলোর অবিরাম কাজই অন্যায়ের প্রতিবাদের একটা শক্তি জিইয়ে রাখা। আর রাজনৈতিক সংগঠনের বাইরে নানা সম্মিলিত উদ্যোগের পেছনে সংগঠিত শক্তি হিসেবেও অনেক ক্ষেত্রে তারাই প্রধান ভূমিকা পালন করে।

তাই ডাকসু নির্বাচন যেমনই হোক, তাতে প্রশাসনে যুক্ত শিক্ষকদের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখে যতই কালি পড়ুক, ঘোষিত ফলাফল যেমনই হোক, সরকার ও প্রশাসনের মদদে সরকারি ছাত্রসংগঠন যতই দাপট দেখাক, এই সময়ের একটি বড় সাফল্য—অন্যায়, নিপীড়ন, জালিয়াতি প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে—নতুন নেতৃত্ব সামনে আসা। এভাবেই আন্দোলন যখন তার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করে, যখন তা জনসম্পৃক্ততা লাভ করে, তখনই জন্ম হতে থাকে নতুন নেতৃত্বের। এই আন্দোলনের আরও সাফল্য—সামনে এসেছে নারী নেতৃত্ব, নেতৃত্বে যোগ হয়েছে শ্রমজীবী মানুষের সন্তান।