চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও বিশ্ব ব্যবস্থার বৈপরীত্য

‘অটোমেশনের দুটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পুঁজিবাদের সব ঐতিহাসিক স্ববিরোধিতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে। একদিকে এটি বস্তুগত উৎপাদিকা শক্তির চমত্কার বিকাশ নির্দেশ করছে, যা যান্ত্রিক, পুনরাবৃত্তিমূলক, একঘেয়ে ও বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী শ্রমদানের বাধ্যবাধকতা থেকে মানবসমাজকে মুক্ত করার ক্ষমতা ধারণ করে; অন্যদিকে এটিই আবার কর্মসংস্থান ও আয়ের ওপর নতুন হুমকি সৃষ্টি করে: নতুনভাবে উদ্বেগ, নিরাপত্তাহীনতা একটানা গণবেকারত্বে প্রত্যাবর্তন, ভোগ আয়ের পতন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানবিক অবনতিকে তীব্রতর করে। পুঁজিবাদী অটোমেশন তাই একই সঙ্গে শ্রমের উৎপাদিকা শক্তি এবং পণ্য ও পুঁজির বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী ও ধ্বংসাত্মক বিপুল বিকাশের চরিত্রসম্পন্ন হিসেবে তার বস্তুগত বৈরী দ্বন্দ্বকেই স্পষ্ট করে তুলছে।’
-আর্নেস্ট ম্যান্ডেল

এ রকম বৈপরীত্য বিশ্ব আগে কখনো দেখেনি। একদিকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের গল্প, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ বিভিন্ন বিস্ময়কর প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নিয়ে বিশ্বব্যাপী উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে দুই বছর ধরে চোখে দেখা যায় না, এ রকম ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নভেল করোনাভাইরাসে পুরো বিশ্ব কয়েক দফা অচল, বিপর্যস্ত এবং এখনো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে। ট্রিলিয়ন ডলারের যুদ্ধ অর্থনীতি, ডিজিটাল প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মুহূর্তে লাখো মানুষ হত্যার সরঞ্জাম সবকিছু নিয়ে বিশ্ব এখন অদৃশ্য করোনাভাইরাসের কাছে পুরোই অসহায়। এরই মধ্যে ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার নেতা যুক্তরাষ্ট্রের মতো সম্পদশালী দেশ সারা দুনিয়ায় শত শত সামরিক ঘাঁটি চালাচ্ছে, অথচ সেখানে এ পর্যন্ত ৯ লাখের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে এ ভাইরাসের আক্রমণে; যা সব দেশের মধ্যে শীর্ষস্থান। এক পর্যায়ে হাসপাতালে সিট ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবও দেখা দিয়েছিল সেখানে।

শুধু করোনাভাইরাস নয়; বিশ্ব যখন প্রত্যক্ষ করছে প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে বিশাল উল্লম্ফন, ঠিক একই সময়ে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, মানববিদ্বেষী সহিংসতা, সংঘাত এবং অভূতপূর্ব পরিবেশগত সংকট। সর্বশেষ ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা, ন্যাটোর সক্রিয়তা ও সম্প্রসারণের আয়োজন, যুদ্ধাস্ত্র বাণিজ্য, বিশ্বজুড়ে তেল ও খাদ্য সংকটের পদধ্বনি। এ সময়ে বিশ্বজুড়ে কথা হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের গতি-প্রকৃতি, সম্ভাবনা, ঝুঁকি, সীমাবদ্ধতা বুঝতে গেলে যে বিশ্বব্যবস্থার ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে আমরা বাস করছি তার পরিপ্রেক্ষিতেই এর বিচার করতে হবে। এ প্রবন্ধে তাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আলোচনার পাশাপাশি বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার অন্তর্গত সহিংসতা, বৈষম্য ও স্ববিরোধিতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

প্রযুক্তিগত উল্লম্ফন: বিভিন্ন পর্ব
প্রযুক্তিগত বিকাশের কয়েকটি স্তরকে নির্দিষ্ট করে সেগুলোকে একেকটি স্বাধীন ‘বিপ্লব’ হিসেবে দেখানোর রেওয়াজ আছে। প্রথমটি বাষ্পীয় ইঞ্জিন, দ্বিতীয়টি বিদ্যুৎ, তৃতীয়টি ইন্টারনেট, চতুর্থের ওপর ভর করে ডিজিটাল যুগ। অন্যভাবেও কয়েকটি পর্বে ভাগ করা যায়, যেমন প্রথমটি কয়লা, দ্বিতীয়টি তেল, তৃতীয়টি গ্যাস ও চতুর্থটি নবায়নযোগ্য জ্বালানি। অষ্টাদশ শতকে কথিত প্রথম শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয় স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে উৎপাদন ও পরিবহনের ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা হয়। জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহারই ছিল অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি। এ পর্বের এক পর্যায়ে ট্রেন সবচেয়ে অগ্রসর পরিবহন হিসেবে আবির্ভূত হয়। তেল ও বিদ্যুৎ ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত শিল্পায়ন, ব্যাপকভিত্তিক উৎপাদনের বিকাশকালকে বলা হয় দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ইলেকট্রনিকস এবং তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন ও যোগাযোগের সুযোগ বিস্তৃত হয়, যা তৃতীয় শিল্প বিপ্লব নামে পরিচিত। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কাল চিহ্নিত করা হয় ইন্টারনেটের অধিকতর বিস্তৃত ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন, বিতরণ, যোগাযোগের এক নতুন পর্বকে। তৃতীয় পর্ব থেকেই চতুর্থ পর্ব বিস্তৃত হলেও গুণগতভাবে এটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এ পর্বে বস্তুগত, ডিজিটাল ও জৈবিক সীমা একাকার। এর বিকাশের গতি আগেরগুলোর সঙ্গে তুলনীয় নয়। আগের পর্বগুলোয় শারীরিক শ্রমের যে গুরুত্ব ছিল, এ পর্বে তা ব্যাপকভাবে কমে সেখানে স্থান নিয়েছে মানুষের মেধাশ্রম ও যন্ত্র। মিন জু ও অন্যরা এ পর্বের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলো: (১) উৎপাদন ও বাজারের মধ্যে দূরত্ব হ্রাস, (২) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সর্বব্যাপী ব্যবহার, (৩) বিভিন্ন প্রযুক্তির মিশ্রণ (৪) দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় রোবটের ব্যবহার বৃদ্ধি, (৫) ইন্টারনেটের মাধ্যমে সবকিছু পরস্পর সম্পর্কিত।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার অটোমেশন, অনলাইন যোগাযোগসহ বহুমুখী তত্পরতা, মানবশ্রম ব্যাপকভাবে কমিয়ে স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা, বিপণন ও বিশ্লেষণের সুযোগ একদিকে অভূতপূর্ব সম্ভাবনা তৈরি করেছে, অন্যদিকে হাজির করেছে ভয়াবহ ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার শঙ্কা। সম্ভাবনার জায়গাগুলো হলো প্রথমত, জীবন্ত মানবশ্রম ছাড়াই বহু রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সমাধা করার পথ প্রশস্ত হচ্ছে; দ্বিতীয়ত, স্থানিক যোগাযোগ অতিক্রম করে বৈশ্বিক যোগাযোগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান-শিক্ষা-গবেষণা-চিকিৎসাসেবার সুযোগ তৈরি হয়েছে; তৃতীয়ত, পরিবহন ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে নিত্যনতুন সংযোজন দেখা যাচ্ছে; চতুর্থত, জিন প্রযুক্তি মানুষের সীমিত ক্ষমতা অতিক্রম করার সুযোগ এনেছে।

অন্যদিকে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার কয়েকটি দিক গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো কর্মসংস্থান, আরেকটি হলো অজানা ক্ষমতার আধিপত্য। এর বাইরে আছে তথ্যনিরাপত্তার প্রশ্ন, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে মানুষসহ জীবজন্তু, ফসল, ফল ইত্যাদির নানা পরিবর্তনের সক্ষমতা। গত দেড় বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি করোনাকালে বাধ্যবাধকতা তৈরি হওয়ায় বিশ্বজুড়ে শিক্ষা-গবেষণা, চিকিৎসা, বেচাকেনা, ব্যাংকিং, গান, নাটক, আলোচনা-সেমিনার-সম্মেলন-প্রতিবাদে অনলাইন প্রযুক্তির ব্যবহার বহুগুণে বেড়েছে, বাংলাদেশেও তার প্রসার ঘটেছে অভূতপূর্ব মাত্রায়। এই যে বিশাল শক্তির আবির্ভাব ঘটছে, তার সীমা নির্ধারণ করবে কে, কার মালিকানায় থাকবে এসব প্রযুক্তি, কী লক্ষ্যে এসব হস্তক্ষেপ ঘটবে, সর্বজনের ভূমিকা কী দাঁড়াবে—এগুলোই বড় প্রশ্ন।
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, আগামী কয়েক দশকে বিশ্বে প্রায় ৫০ শতাংশ কাজের ধরন বদলে যাবে, রোবটের ব্যবহার বাড়বে, ফলে কর্মসংস্থান হারাবে বিপুলসংখ্যক মানুষ। এতে বিনিয়োগকারীদের জন্য খরচ কমবে, উৎপাদন সীমা সম্প্রসারণ হবে, মুনাফার হার বৃদ্ধি পাবে—এ সম্ভাবনার কথা বলছেন অনেকেই। যন্ত্র সংখ্যা, যন্ত্রের ওপর নির্ভরতা, যন্ত্রের বহুমুখী কার্যক্রম দ্রুতহারে বিভিন্ন দিকে সম্প্রসারিত হচ্ছে। এক হিসাবে দেখা যায়, ২০১০ সালের মধ্যেই বিশ্বের ইন্টারনেট সংযুক্ত কম্পিউটরের সংখ্যা মানুষের সংখ্যা অতিক্রম করেছে। মানুষের জীবন ও তত্পরতা গত ১০ বছরে যেভাবে ইন্টারনেট যুক্ত মোবাইল ও কম্পিউটারের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে, তা আগে শুধু বিজ্ঞান কল্পকাহিনীতেই পাওয়া যেত।

পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার গতিমুখ
লেখক, গবেষক, সংগঠক নাওমি ক্লেইন কয়েক বছর আগে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন এ বিশ্বব্যবস্থার সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে। এর উপনাম ছিল ‘ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম’। অজানা বিপদ করোনাভাইরাস সারা বিশ্বকে অভূতপূর্ব মাত্রায় অস্থির করে তোলার পর নাওমি লিখেছেন ‘ফ্রম ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম’ টু ‘করোনাভাইরাস ক্যাপিটালিজম’।

বর্তমান সময়ে পুঁজিবাদের গতিমুখ সুনির্দিষ্টকরণের জন্য পুঁজিবাদের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান নজরদারি, পরিবেশ বিপর্যয় ও সন্ত্রাস-যুদ্ধকে যুক্ত করে দেখার, এগুলোর জৈবিক সম্পর্ক উপলব্ধি করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন অনেক তাত্ত্বিক। কেউ ‘সারভেইল্যান্স ক্যাপিটালিজম’, কেউ ‘ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম’ বা কেউ ‘ওয়ার ক্যাপিটালিজম’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করছেন। পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্যে এগুলো বৈশ্বিক প্রবণতা, তবে বিভিন্ন দেশে শাসকশ্রেণীর গঠনের পার্থক্যের সঙ্গে এর মাত্রাভেদ আছে।
নাওমি ক্লেইন তার উপরোক্ত গ্রন্থে বিভিন্ন দেশের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন কীভাবে পুঁজিবাদের বিস্তার প্রাণ-প্রকৃতি, মানুষ ও সম্পদের ভয়াবহ বিপর্যয় তৈরি করছে। নজরদারি পুঁজিবাদ বা Surveillance capitalism ধারণাটি প্রথম ব্যবহার করেন জন বেলেমি ফস্টার ও রবার্ট মেকচেসনি, ২০১৪ সালে। পরে এ বিষয় নিয়ে আরো বিস্তারিত লিখেছেন শুশানা যুবফ। তিনি দেখান এ নজরদারি পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছে অর্থকরী খাতের আধিপত্য, ক্ষমতা ও সম্পদের কেন্দ্রীভবন, নব্য উদারতাবাদী আগ্রাসনের সঙ্গে ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশের মধ্য দিয়ে; যা চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নামে পরিচিত। একসময় ফোর্ড ও জেনারেল মোটরস গণ-উৎপাদনের সূত্রপাত করিয়ে যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল, বর্তমান সময়ে প্রথমে গুগল ও পরে ফেসবুক বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা, প্রত্যেক ব্যক্তিকে নজরদারির মধ্যে আনার মধ্য দিয়ে তার চেয়েও আগ্রাসী একটি পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। যুবফ আরো বলেছেন,
‘অনলাইন জগৎ এখন পুঁজিবাদের নতুন দখল ক্ষেত্র। নতুন পণ্য উৎপাদনের বদলে ডাটা সংগ্রহ, ব্যক্তি তত্পরতার ওপর নিয়ন্ত্রণ, মহাশূন্য থেকে একান্ত ব্যক্তিগত জগতের মধ্যে আগ্রাসনের পথ ও পদ্ধতির প্রযুক্তি এখন পুঁজির করায়ত্ত।’

নজরদারি ব্যবস্থার একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা হচ্ছে প্রিজম (Prism)। যুবফ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার বক্তব্য থেকেই জানাচ্ছেন, নয়টি বৃহৎ নয়া প্রযুক্তিগত শীর্ষ প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট, অ্যাপল, গুগল, ইয়াহু, ফেসবুক, ইউটিউব, প্যালটক, স্কাইপ ও এওএল এ প্রিজমের আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর করা পার্টনার বা অংশীদার। বিনা ব্যয়ে সব নাগরিকের সব বিষয়ে তথ্যভাণ্ডার সংগ্রহের এক অভূতপূর্ব পথ তৈরি হয়েছে এ প্রযুক্তির মাধ্যমে।

কর্তৃত্ববাদী শাসন, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও একচেটিয়া পুঁজির আধিপত্যের কাজে এ প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষকে আরো অন্ধ, বিভ্রান্ত, ভোগবাদী, আত্মকেন্দ্রিক, অনুগত, অসহায় তথ্যদাতা বানানোর সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

প্রকৃতপক্ষে বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার প্রধান খুঁটি হচ্ছে চারটি: যুদ্ধ-সমরাস্ত্র, জীবাশ্ম জ্বালানি, আর্থিক খাত ও কৃষিতে বিষের বাণিজ্য। এ চার ক্ষেত্রেই গুরু হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যারা বিশ্বে এখনো সবচেয়ে পরাক্রমশালী। সারা বিশ্বে যুদ্ধ, গোয়েন্দা নজরদারি এবং পারমাণবিক-রাসায়নিক-জৈব অস্ত্র গবেষণা ও মজুদের যে ভয়ংকর চিত্র, তার পেছনে প্রধান শক্তি হচ্ছে এই দেশ। এত পরাক্রমশালী হওয়া সত্ত্বেও করোনাভাইরাসের আক্রমণে দেশটি এককভাবে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত।

সমরাস্ত্র উৎপাদন, সামরিকীকরণ, যুদ্ধ ও নজরদারি একদিকে মুনাফা আর ক্ষমতার অন্যতম মাধ্যম, অন্যদিকে এগুলোই হচ্ছে বিশ্বজুড়ে সম্পদ অপচয় ও বর্জ্য উৎপাদনের সবচেয়ে বড় ও বিধ্বংসী উৎস। পারমাণবিক বর্জ্য ভয়াবহ বর্জ্যের পাহাড় তৈরি করছে বিশ্বে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ, পারমাণবিক বোমা, ইউরেনিয়ামসহ বিভিন্ন খনিজ দ্রব্য উত্তোলন এবং এসব কেন্দ্র করে সামরিক বিভিন্ন কর্মসূচি থেকে যে বর্জ্য উৎপাদিত হয়, তা বিপজ্জনক মাত্রায় পানি, মাটিসহ পরিবেশকে সমাধান অযোগ্য মাত্রায় নষ্ট করছে। প্রাণবৈচিত্র্যের শক্তি বিনষ্ট করে বাস্তুসংস্থান ও পরিবেশগত ভারসাম্য বিপন্ন করছে। বিশ্বের কর্তা দেশগুলোয় কোটি কোটি টন রেডিও-অ্যাকটিভ বর্জ্য, ব্যবহূত পারমাণবিক জ্বালানি মজুদ হয়ে আছে। বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক বর্জ্য কীভাবে নিরাপদ ব্যবস্থাপনায় রাখা যাবে কিংবা কীভাবে এগুলোর বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে তার কোনো সন্তোষজনক সমাধান এখনো পাওয়া যায়নি। জৈব রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে গবেষণার প্রতিযোগিতা বাড়ছে, তা থেকে দেশে দেশে তৈরি হচ্ছে একেকটি ভয়ংকর বিপদের মজুদ। নভেল করোনাভাইরাস তার সর্বশেষ প্রকাশ। সামনে আরো বড় বিপদের আশঙ্কা।

গত কয়েক দশকে যুদ্ধসহ বর্জ্য উৎপাদনের ক্ষেত্র ক্রমেই প্রসারিত হয়েছে। ১৯৫০ সাল নাগাদ বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিক উৎপাদন ছিল ২০ লাখ টন, ২০১৬ সাল নাগাদ তা ২০০ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ কোটি টনে। এর মধ্যে ১৩ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্যই শেষ পর্যন্ত গিয়ে জমা হয় সমুদ্রে। প্লাস্টিকসামগ্রী ও বর্জ্যের এ রকম উচ্চহারে বৃদ্ধি ঘটছে পণ্যের প্লাস্টিক প্যাকেজিং ও ‘ওয়ান টাইম’ সামগ্রীর অনুপাত বৃদ্ধির কারণে। এটা ধারণা করা হচ্ছে যে এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিক উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ হাজার ৪০০ কোটি টন। বহু শিল্পোন্নত দেশ এখন রিসাইক্লিং বা পুনরুৎপাদনের জন্য তাদের প্লাস্টিক বর্জ্য প্রান্তিক দেশগুলোয় রফতানি করছে। ২০১৭ সালে নিষিদ্ধ করার আগে পর্যন্ত চীনই ছিল এসব প্লাস্টিক পণ্যের প্রধান ক্রেতা। এখন এসব পণ্যের প্রধান গন্তব্য হচ্ছে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ। বাংলাদেশে বেশির ভাগ প্লাস্টিক পণ্য নদীতে এবং তারপর সমুদ্রে গিয়েই জমা হয়। সমুদ্রে প্লাস্টিক জমার পরিমাণের দিক থেকে বাংলাদেশসহ চারটি দেশকেই এখন প্রথম ১০টির মধ্যে গণ্য করা হয়।

এছাড়া বিশ্বজুড়ে উচ্চহারে ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ কোটি টন ইলেকট্রনিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে তিন কোটি কম্পিউটার বাতিল করা হয়, ইউরোপে ১০ কোটি ফোন বাতিল হয়। এর ১৫-২০ শতাংশ পুনরুৎপাদনে যায়, বাকি পুরোটাই জমে মাটিতে, পানিতে। যুক্তরাষ্ট্রের পরেই চীনের স্থান। চীনে দেশের ভেতরে ই-বর্জ্য তৈরি হয় ৩০ লাখ টনেরও বেশি। এর পরিমাণ বৃদ্ধি শুধু চীন নয়, বিশ্বের প্রাণ-প্রকৃতির জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। কেননা এগুলোর বিষাক্ত প্রভাব দেশের সীমানায় আটকে থাকে না।

বিশ্বে প্রতি বছর সমরাস্ত্র ক্রয়, তা নিয়ে বিপজ্জনক ব্যয়বহুল গবেষণা, নজরদারি ইত্যাদিতে ব্যয় হয় প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার (বা ২ হাজার বিলিয়ন, ১ বিলিয়ন মানে ১০০ কোটি), যা বাংলাদেশের বর্তমান পরিমাণ অনুযায়ী প্রায় ৪০ বছরের মোট বাজেট অর্থের সমান। এর ১০০ ভাগের এক ভাগ খরচ করলে সারা বিশ্বের মানুষ বিশুদ্ধ নিরাপদ পানি পেতে পারে। কিন্তু মানুষ হত্যা, পরিবেশ বিনাশে যত সম্পদ ব্যয় হয়, মানুষ বাঁচাতে তার এক কণাও পাওয়া যায় না। সেজন্য চিকিৎসা গবেষণায়ও হয় খুবই অপ্রতুল বরাদ্দ। জানা অসুখ নিয়ে গবেষণাও যথেষ্ট নয়। সমরাস্ত্র খাতে যে অর্থ ব্যয় হয়, তার একাংশ যায় পারমাণবিক, জৈব রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে গবেষণায়। সেগুলো বিভিন্ন প্রাণী, সমুদ্র, বায়ুমণ্ডলে কী বিষ তৈরি করে তা অনুমান করা শক্ত নয়। তাই বর্তমান প্রবৃদ্ধিমুখী উন্নয়ন, কতিপয় অঞ্চল ও শ্রেণীর অতিভোগ আর মুনাফামুখী উন্মাদনা থেকে সৃষ্ট ভয়ংকর বর্জ্যের পাহাড় বহুরকম জানা-অজানা রোগের উর্বর ভূমি তৈরি করে। রাষ্ট্রীয় সীমানা দিয়ে এসব রোগ যে ঠেকানো যায় না, সেটাই দেখাচ্ছে বিভিন্ন ভাইরাস, সর্বশেষ নভেল করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এ মুনাফামুখী বর্বর তত্পরতার অধীনস্থ হওয়ায় তার বিভিন্ন সম্ভাবনা হুমকির মুখে।

বিশ্বায়নের টান: কাজের ধরন ও বৈষম্য
গত তিন দশকে বিশ্বায়ন নামে পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণ হয়েছে দ্রুত। কেন্দ্র দেশগুলোর বৃহৎ পুঁজিপতিরা মুনাফার উচ্চহার বজায় রাখার জন্য কারখানা নিয়ে গেছে কম মজুরির শ্রমিকদের দেশে। যেখানে কর কম বা কর ফাঁকি দেয়া যায়, যেখানে মজুরি কম, যেখানে মুনাফা সর্বোচ্চ করার সুবিধা বেশি, যেখানে দুর্নীতিবাজ সরকার ও আমলাদের দিয়ে যা খুশি করা যায়, পুঁজি চলে গেছে সেখানেই। বহু দেশে এর পক্ষে ‘অর্থনৈতিক সংস্কার’ করা হয়েছে, কোথাও দেনদরবার কোথাও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বৃহৎ পুঁজির পথ প্রশস্ত করা হয়েছে। বহুজাতিক একচেটিয়া পুঁজির ব্যবস্থাপক হিসেবে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ঋণের জালে আটকে দুর্বল দেশগুলোর আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় মুনাফামুখী সংস্কারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এডিবি, সিআইএ, থিংক ট্যাংক, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, প্রচার-প্রচারণা সবই কাজে লাগানো হয়েছে।

পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণের মধ্য দিয়ে যে গাড়ির কারখানা যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পায়নের আদি ভিত্তি তৈরি করেছিল, সেসব কারখানা চলে গেছে মেক্সিকোয়; ভারতে, দক্ষিণ কোরিয়া বা চীনে। প্রযুক্তিগত বিকাশের ফলে একটি নির্দিষ্ট পণ্যের উৎপাদন খণ্ড খণ্ডভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে, তুলনামূলকভাবে কম খরচে সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে একদিকে প্রান্তের দেশগুলোর উন্নয়ন হয়েছে বৈপরীত্য আর অসংগতিতে ভরা, অন্যদিকে কেন্দ্র দেশগুলোয় স্থিতিশীল কাজের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে। বেকারত্ব বেড়েছে, কাজের ধরনগুলো হয়েছে অনিশ্চিত। বেড়েছে খণ্ডকালীন চুক্তিভিত্তিক ভাসমান কাজ। এভাবে পুঁজিবাদের ভেতরে স্থিতিশীল কর্মসংস্থানের সংকট বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় কেন্দ্র-প্রান্ত সর্বত্র বেড়েছে। বারবার অতি উৎপাদন ও মুনাফার ক্রমাবনতির সংকট দেখা দেয়ায় মাঝেমধ্যেই লে-অফ, মার্জার আর শ্রমিক ছাঁটাই অব্যাহত আছে।

পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্র দেশগুলোয় তুলনামূলক কম মজুরির কাজে অভিবাসীদের অংশগ্রহণ বেশি, যাদের মধ্যে বাংলাদেশীদের অনুপাতও ক্রমেই বাড়ছে। কর্মসংস্থানের সংকটে জর্জরিত পুরনো নাগরিকদের কাছে এ অভিবাসীদের ভয়ংকর প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করা খুবই সহজ। চরম প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির জন্য এ পরিস্থিতি খুবই সুবিধাজনক হয়েছে। কর্মসংস্থানের সংকট থাকলেই যে মানুষ সব সাম্প্রদায়িক আর অভিবাসীবিদ্বেষী হয়ে যাবে তা নয়। কিন্তু যদি আতঙ্ক ছড়ানো যায়, যদি মিডিয়া, চলচ্চিত্র দখল করা যায়, যদি সন্ত্রাসী তত্পরতার সঙ্গে অভিবাসীর আগমনকে যুক্ত করা যায় তাহলে সমাজে তার প্রভাব পড়বেই। ইউরোপ, আমেরিকায় ট্রাম্পগোষ্ঠীর সামাজিক ভিত্তি এভাবেই নির্মিত হয়েছে। রাজনৈতিক আধিপত্যের ধরনের কারণেই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে অটোমেশন সব দেশেই বিপর্যস্ত বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য আশীর্বাদ না হয়ে হুমকি হিসেবে উপস্থিত হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত শিল্পোন্নত দেশগুলোয় প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্য হ্রাস দেখা গেলেও আশির দশক থেকে এ বৈষম্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। অক্সফামের বিশ্ব রিপোর্টসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন রিপোর্টে বৈষম্য বৃদ্ধির এ ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়। ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি বিশ্ব অর্থনীতির কয়েক শতকের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন,
‘১৯৭৭ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে ধনী শতকরা ১০ ভাগ জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির তিন-চতুর্থাংশ গ্রাস করেছে। সর্বোচ্চ ধনী শতকরা এক ভাগই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় আয়ের মোট বৃদ্ধির শতকরা ৬০ ভাগ হজম করেছে।’ তিনি আরো দেখিয়েছেন, গত ১০০ বছরে এ দেশের ১ শতাংশের আয় দ্বিগুণ হয়েছে দুবার, প্রথমবার ১৯২৮ সালে, দ্বিতীয়টি ২০০৭ সালে। দুটোই অর্থনৈতিক মহাসংকটের আগে আগে। বৃহৎ অর্থকরী বিনিয়োগ কোম্পানির প্রধানদের আয় অর্থনৈতিক ধসের আগের বছরে ১৫ লাখ ডলারের বেশি হয়েছিল। সব তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে যে কর স্বর্গগুলোয় পাচার করা অর্থের তিন-চতুর্থাংশই এসেছে ধনী দেশগুলো থেকে।

দেখা যায়, প্রযুক্তিগত বিকাশে সম্পদ পাচারও সহজ হয়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকালে উৎপাদন, বিপণন ও বিতরণের ব্যবস্থাবলি সম্পদ কেন্দ্রীভবনের এ ধারাকে তাই আরো জোরদার করেছে। বিশ্বজুড়ে কাজ ও মজুরির নিরাপত্তা নিয়ে লড়াইয়ের শক্তি ও সংগঠনও এখন দুর্বল হয়ে গেছে। আশির দশক থেকে পশ্চিমা বিশ্বে ট্রেড ইউনিয়নগুলোও ক্ষয়ের শিকার হয়। ১৯৫০ সালে যেখানে মোট কর্মশক্তির শতকরা ৩০ ভাগ ট্রেড ইউনিয়নে যুক্ত ছিল, সেখানে ২০১২ সালে তা শতকরা ১১-তে নেমে এসেছে। বেসরকারি খাতের শতকরা ৯১ ভাগের কোনো সংগঠিত অবস্থান নেই। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের ভাঙন, সামাজিক অধিকারের আন্দোলনে দুর্বলতার ফলে পুঁজির একচেটিয়া ক্ষমতার মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণীকে খণ্ড খণ্ড করে ফেলা সম্ভব হয়েছে। অস্থায়ী, চুক্তিভিত্তিক, খণ্ডকালীন কাজই হয়ে দাঁড়িয়েছে মূলধারা। বর্তমান অনলাইন প্রযুক্তি এ ধারাকে আরো শক্তিশালী করেছে।

ডিজিটাল যুগ নিয়ে জনপ্রিয় বক্তা টম গুডউইনের একটি বক্তব্য বহুল উদ্ধৃত, তিনি বলেছেন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্যাক্সি কোম্পানি উবারের নিজের কোনো ট্যাক্সি নেই, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিডিয়া ফেসবুক নিজে কোনো খবর তৈরি করে না, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাইকার আলিবাবার কোনো গুদাম নেই এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় আবাসন ব্যবসায়ী এয়ার বিএনবির নিজেদের কোনো বসতি নেই।’

ঠিক। আর্থিকীকরণ ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বৃহৎ পুঁজির বিনিয়োগ এমন জায়গায় বেশি হচ্ছে, যেখানে পুঁজি ও শ্রমের সম্পর্ক পরোক্ষ। যেখানে মালিক ও শ্রমিক পরস্পরের কাছে অজানা। যেখানে পুঁজি প্রকৃতই নিরাকার, ঈশ্বরের মতোই অদৃশ্য। আর শ্রম অনেক ক্ষেত্রেই বেগার। কিন্তু এই আর্থিকীকরণ, অদৃশ্যকরণ ও প্রযুক্তিকরণ পুঁজি ও শ্রমের সম্পর্কের মৌলিক সম্পর্কের সমীকরণ দূর করেনি। তবে শ্রমের আপেক্ষিক অবস্থান দুর্বল হয়েছে।

অন্যদিকে মানবশ্রমকে যন্ত্র দ্বারা প্রতিস্থাপন পুঁজির অন্তর্গত সংকটমুক্তি বা নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে পারে না। কেননা শ্রম যদি যন্ত্র দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, মানুষ যদি আরামের বদলে ব্যাপক বেকারত্বের মধ্যে পতিত হয় তাহলে উৎপাদনের পাহাড় ভোগ করবে কে, এগুলো বিক্রি হবে কোথায়?

বিশ্বব্যবস্থায় রাজনৈতিক কর্তৃত্ব: ঐক্য ও সংঘাত
বিশ্বব্যবস্থায় রাজনৈতিক কর্তৃত্বের জায়গায়ও বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন এনেছে প্রযুক্তিগত পর্ব রূপান্তরের প্রক্রিয়া কিংবা বলা যায় অর্থনৈতিক ও বিজ্ঞান প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যেও বদল দেখা যায়। যেমন ব্রিটেন প্রথম শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়েই পুঁজিবাদের কেন্দ্র শক্তি হয়ে উঠেছিল, দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের সময় যুক্তরাষ্ট্র শিল্প অর্থনীতি ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে যায়। তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রেই এবং এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রই পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার নেতৃত্বে আসীন হয়। প্রশ্ন উঠেছে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের গতি ধারণ করে চীন কি বিশ্বের প্রধান শক্তিতে পরিণত হতে যাচ্ছে? চীনের কিছু দিক খেয়াল করলে এ সম্ভাবনা বিবেচনায় আসতে পারে। এগুলো হলো: (১) শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বিশাল বিনিয়োগ, (২) লক্ষ্যপূরণের উপযোগী উন্নত প্রতিষ্ঠান ও শিল্পনীতি, (৩) বৈশ্বিক জোগানকেন্দ্রিক শিল্প উৎপাদন সক্ষমতা, (৪) বৈশ্বিক পর্যায়ে ভবিষ্যৎ মূল শিল্পধারার উপযোগী প্রযুক্তির জন্য ব্যাপক কর্মসূচি।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ২০১৮ সালে দেয়া বক্তৃতা এক্ষেত্রে তাত্পর্যপূর্ণ। জিনপিং বলেন, ‘অষ্টাদশ শতকে প্রথম শিল্প বিপ্লবের যান্ত্রিকীকরণ থেকে উনিশ শতকে দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের বিদ্যুতায়ন, বিশ শতকে তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের তথ্যকরণ—এর প্রতিটি পর্যায়ে নতুন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করেছে।’ তার মতে, ‘এক নতুন পর্বের প্রযুক্তিগত বিপ্লব এবং শিল্প পরিবর্তনে আগামী ১০ বছর নির্ধারণী দশক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডাটা, তথ্য, জৈব প্রযুক্তি সবকিছুই অনেক বেশি শক্তিশালী হচ্ছে। এগুলো দুনিয়া কাঁপানো পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে।’

২০২০ সালের জুলাইয়ে মার্কিন সিনেট শুনানিতে জানানো হয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পেছনে চীন যুক্তরাষ্ট্রের সমান বা বেশি ব্যয় করছে। করোনা বিপর্যয় শুরু হওয়ার পর চীনের জাতীয় কংগ্রেস আগামী পাঁচ-ছয় বছরে স্মার্ট সিটি বানানোর জন্য পঞ্চম প্রজন্মের ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক, ক্যামেরা ও সেন্সর ব্যবহার এবং শিল্পের সঙ্গে এগুলো যোগ করে স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং বিকাশের জন্য ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ অনুমোদন করেছে। ২০২০ সালের প্রথম দিকে চীন ২ লাখ ৫জি টাওয়ার চালু করেছে। লক্ষ্য হলো ৫০ লাখ পর্যন্ত করা। ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ কর্মসূচির অধীনে ১০টি হাইটেক শিল্প দ্রুত বিকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এগুলো হলো তথ্যপ্রযুক্তি, স্মার্ট শিল্প-কারখানা, অ্যারোস্পেস, মেরিটাইম ইঞ্জিনিয়ারিং, উন্নততর রেল, বৈদ্যুতিক গাড়ি, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, কৃষি যন্ত্রপাতি ও বায়োমেডিসিন। এ কর্মসূচির অধীনে চীন ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ‘ডিজিটাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্ল্যান’ গ্রহণ করেছে।

বলা বাহুল্য, চীন এখন পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থারই ঘনিষ্ঠ অংশীদার, তার পরও চীনের উত্থান ও কর্তৃত্ব নিয়ে পুরনো কেন্দ্রভুক্ত দেশগুলোর শাসকদের মধ্যে উদ্বেগ খুব স্পষ্ট। সদ্যসমাপ্ত জি৭ সম্মেলনে যেভাবে চীনবিরোধী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে, তাতে বিশ্বজুড়ে সংঘাত বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। তবে বিশ্বের পশ্চিমকেন্দ্রিক বহুজাতিক পুঁজি চীনের সঙ্গে এখন ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। চীনে ইউরোপীয় চেম্বার অব কমার্স জানাচ্ছে, মাত্র ১১ শতাংশ সদস্য চীন থেকে অন্যত্র সরে যাচ্ছে, বাকিরা চীনের সঙ্গেই কাজ করছে। অ্যামচেম বা যুক্তরাষ্ট্রের চেম্বার অব কমার্সও অভিন্ন চিত্র উপস্থিত করেছে। এর কারণ চীনে বিনিয়োগে বহু সুবিধা আছে, বহুমুখী যোগাযোগও সহজতর।

ক্ষমতা কার হাতে
প্রযুক্তির বিকাশ মানুষকে অনেক আরাম দিতে পারে, অনেক সক্ষম করতে পারে, অনেক সমৃদ্ধ করতে পারে, বিশ্বজুড়ে মানুষে মানুষে যোগাযোগ ও সংহতি বাড়াতে পারে, জীবন অনেক সহজ করতে পারে, বাধ্যতামূলক দীর্ঘ সময়ের শ্রমের বোঝা থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে, শ্রম সময় কমাতে পারে। কিন্তু তার বদলে পুঁজির কর্তৃত্বের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে প্রযুক্তিগত বিকাশ আরো অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে, তার ওপর নজরদারি বেড়েছে, প্রকৃতি ও মানুষের ওপর আক্রমণ বেড়েছে, বর্জ্য পাহাড় তৈরি হচ্ছে। আরো বিস্তৃত হয়েছে যুদ্ধ অর্থনীতি।

প্রথম শিল্প বিপ্লবকালে যখন ইউরোপে পুঁজিবাদ বিজয়ীর আসনে, বিশ্ব দখলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, সে সময় মার্ক্স বলেছিলেন, ‘উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ, যা শ্রমিকদের চূড়ান্ত সংখ্যা কমিয়ে দেয়, অর্থাৎ যা পুরো জাতিকে আগের চেয়ে কম সময়ে পুরো উৎপাদন সম্ভব করতে সক্ষম করে তোলে, তা প্রকৃতপক্ষে একটি বিপ্লব ঘটায়। কিন্তু পুঁজিবাদের অধীনে প্রযুক্তিগত বিকাশের এ সুবিধা অধীনস্থ থাকে মুনাফা বৃদ্ধির, সুতরাং এটা আবারো পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির নির্দিষ্ট প্রতিবন্ধক চরিত্রকে স্পষ্ট করে এবং দেখায় যে পুঁজিবাদী উৎপাদন কোনোভাবেই উৎপাদিকা শক্তি বিকাশের এবং সম্পদ সৃষ্টির চূড়ান্ত রূপ নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে তা এ বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে।’

সন্দেহ নেই, বর্তমান পর্যায়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিকাশের মধ্য দিয়ে দ্রুত একটি অতি উৎপাদনশীল প্রাচুর্যময় বিশ্বের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিকাশের মধ্য দিয়ে বিশ্ব এমন সুলভ ও নিরাপদ বিদ্যুতের দিকে যাচ্ছে, যাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রান্তিক ব্যয় শূন্যের কাছাকাছি চলে যাবে। প্রযুক্তির বিকাশে বহু বাজারের পণ্যের জোগান এত বেশি হতে থাকবে যে তার বিনিময় মূল্য হয়ে দাঁড়াবে প্রায় শূন্য। কিন্তু মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক অসীম ক্ষমতা বন্দি হয়ে আছে একচেটিয়া বাণিজ্যিক স্বার্থের হাতে। বৃহৎ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মুনাফা যেখানে নেই বা যে প্রযুক্তির বিকাশে তার মুনাফা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, তাকে সে পেটেন্ট করে আটকে রাখে, নষ্ট করে। মুনাফার টানে মানব উদ্ভাবিত উচ্চ প্রযুক্তি নিয়ে যায় ধ্বংস, অপ্রয়োজনীয় ভোগ আর অপচয়ের দিকে। যে প্রযুক্তির বিকাশের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের মানুষ নিজেদের ঐক্য ও সংহতি গড়ে তুলতে পারে, তাকে কাজে লাগানো হয় মানুষে মানুষে বিবাদ, হিংসা আর বিদ্বেষ ছড়ানোয়। যে প্রযুক্তি মানুষকে দিতে পারে অপার স্বাধীনতা, তাকে কাজে লাগানো হয় অবিরাম নজরদারি আর মানুষকে শৃঙ্খলিত করার জন্য।

পুঁজির বিশ্বযাত্রায় বর্তমান সময়ে প্রধান বাহন ডিজিটাল প্রযুক্তি। করপোরেট প্রচারণা, তথ্য বিকৃতি, ভুল তথ্য তৈরি ও দ্রুত প্রচার—সবই এখন অনেক দ্রুতগতিসম্পন্ন, এ যুক্ততায় মুনাফার হারও ঊর্ধ্বমুখী। যুবফ বলছেন, শিল্প পুঁজিবাদের গণ উৎপাদনে ভোক্তা বা নাগরিকদের পুঁজির মালিকানা ও কর্মতত্পরতা সম্পর্কে ধারণা ছিল। বর্তমান ডিজিটাল ক্ষেত্রে নাগরিক বা ভোক্তারা অদৃশ্য অজানা শক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়, প্রায় অজান্তেই তার শিকার বা দাসে পরিণত হয়।

পুঁজির বিশ্বযাত্রা এবং তার ভেতরের অস্থিরতা থেকে সামনের দিনের জন্য চারটি সম্ভাবনা শনাক্ত করা যায়। এগুলো হলো: (১) পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্র পরিবর্তন, (২) নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদের উদ্ভব, (৩) ফ্যাসিবাদের বিকাশ অথবা (৪) বিপ্লবী বিকল্পের শক্তিবৃদ্ধি। কেন্দ্র পরিবর্তন কিংবা বহু কেন্দ্র তৈরি হওয়া কিংবা বৈশ্বিক পুঁজির প্রতিনিধি হিসেবে বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের আত্মরক্ষার আরেকটি উপায় অধিকতর নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদের দিকে যাত্রা। এমনিতে সন্ত্রাস দমনের নামে যুক্তরাষ্ট্র সারা পৃথিবীতে একটা ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনে অধিকতর সক্রিয়, বিভিন্ন দেশে মাত্রাভেদে রাষ্ট্রের প্রকৃতি একই ধরন নিচ্ছে। বাংলাদেশও পরিস্থিতি ভিন্ন নয়। পুঁজির স্বার্থে অধিকতর নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকা রাষ্ট্রকে অধিকতর স্বৈরতন্ত্রী পথেই নিয়ে যেতে বাধ্য।

এ ব্যবস্থা অব্যাহত থাকলে বিশ্ব অধিকতর যুদ্ধ, ধ্বংস, দখলদারিত্বের দিকে যাবে; পরিবেশ দূষণ ভয়ংকর আকার নেবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনকে আরো নিরাপত্তাহীন করে তুলবে। শ্রেণী নির্যাতন ও বৈষম্য ছাড়াও জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গীয় বৈষম্য, নিপীড়ন নতুন নতুন সংঘাত, সহিংসতা ও নিষ্পেষণ তৈরি করবে। প্রকৃতি বিনাশের মধ্য দিয়ে তারা গোটা পৃথিবীর মানবজাতির অস্তিত্বকেই অসম্ভব করে তুলবে।
বিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের বুদ্ধিমত্তা, মস্তিষ্কের ক্ষমতার খুব কম অংশই এখন পর্যন্ত কাজে লাগানো হয়েছে। আরো অনেক ক্ষমতা কাজে লাগার অপেক্ষায়। প্রতিটি মানুষই প্রকৃতপক্ষে অসীম ক্ষমতাধর। মানুষকে অপমানিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত রেখে এ ক্ষমতার বিকাশ ঘটানো যায় না। বিশ্বজুড়ে এই মানুষদেরই বিপুল অংশ দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা, যুদ্ধ, নির্যাতন, বঞ্চনা, নিয়ন্ত্রণ আর অপমানের শিকার। আসল বুদ্ধিমত্তার মানুষ গুরুত্ব পেলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যন্ত্রসহ সব প্রযুক্তির বিকাশ দুনিয়াকে সত্যিই আনন্দময় করতে সক্ষম হবে। তবে সেই ক্ষমতা কাজে লাগাতে হলে জগত্টা মানুষের হাতে আনতে হবে।

আশার কথা এই, যে প্রযুক্তিগত বিকাশ ভৌগোলিক দূরত্বকে অপ্রাসঙ্গিক করে পুঁজির বৈশ্বিক বিস্তারকে বেগবান করেছে, তা একই সঙ্গে বৈশ্বিক প্রতিরোধ ও মুক্ত সমাজ নিয়ে মানুষের চিন্তার আদান-প্রদানকেও সহজ করেছে। একদিকে যেমন পুঁজির আগ্রাসন বেড়েছে, বৈষম্য বেড়েছে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বিদ্বেষ বেড়েছে, প্রাণ-প্রকৃতি বিনাশ বিপজ্জনক আকার নিয়েছে, অন্যদিকে তেমনি এসবের বিরুদ্ধে চিন্তা-লড়াইও নিজেদের যোগাযোগ বাড়াতে পারছে। পাঠ, চিন্তা, তত্ত্বচর্চা, সংগঠন, রাজনৈতিক সংস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যময় উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। দেশে দেশে শ্রেণীর পাশাপাশি লিঙ্গ-জাতি-বর্ণ-ধর্ম বৈষম্য, প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ বিনাশ এবং যুদ্ধ-সন্ত্রাসের বিরোধিতা, অভিবাসী অধিকারের আওয়াজ এখন বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে দুনিয়া পরিবর্তনকামীদের মতাদর্শিক শারীরিক তত্পরতার কেন্দ্রে। নাওমি ক্লেইন ঠিকই বলেছেন, পরিবেশ বিপর্যয়, জলবায়ু পরিবর্তনও এখন বিশ্বব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তনের ডাক দিচ্ছে।

[১৩ মার্চ ২০২২ বণিক বার্তায় পত্রিকায় প্রকাশিত]