বাংলাদেশে পাটশিল্প বিনাশের দায় কার

বছরের পর বছর পাটকল শ্রমিকদের দফায় দফায় রাস্তায় আসতে হচ্ছে নিজেদের পাওনা মজুরির দাবিতে। বারবার তাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা ভঙ্গ করা হয়েছে। গত কয়দিন ধরে ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রামে হাজার হাজার অভুক্ত শ্রমিক রাস্তায়। নতুন বেতন স্কেলে কর্মকর্তারা বেতন নিচ্ছেন; কিন্তু শ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি ঘোষণা তো দূরের কথা, বকেয়া মজুরিই শোধ করা হচ্ছে না। অন্যদিকে পাটকলগুলোতে লোকসানের বোঝা বাড়ছেই। কেন এই পরিস্থিতি? 

বাংলাদেশে পাটশিল্পের প্রধান কেন্দ্রগুলোর একটি খুলনা। খালিশপুর ও দৌলতপুরের পাটকলগুলো এই পুরো অঞ্চলে পাটচাষ ও কারখানা এবং সেহেতু কর্মসংস্থানের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল। খুলনাসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি অঞ্চলে পাটকলে শ্রমিকের সংখ্যা একসময় ৭০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। পুরো অঞ্চলে এখন অবশিষ্ট আছে ২০ হাজারেরও কম শ্রমিক। তাও কাজের নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। একে একে বড় পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে এসব অঞ্চল এখন প্রায় মরা প্রান্তর। ২০১৭ সালের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধান কয়েকটি দৈনিকে বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চলের অবশিষ্ট কয়েকটি পাটকলের তিনটির খবর প্রকাশিত হয়। এসব খবরে বলা হয়েছিল, ‘খুলনার স্টার, ক্রিসেন্ট ও প্লাটিনাম জুট মিলে কাজ করেন ১৪ হাজার স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিক। প্রায়ই তাদের মজুরি বকেয়া থাকে। এবারে কয়েক সপ্তাহ মজুরি বকেয়া থাকায় শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন।’ এসব কারখানা আগেও একাধিকবার লে-অফ করা হয়েছে। ২০০৭-০৮ সালে মিল চালু রাখার দাবিতে আন্দোলন করার অপরাধে নাম-ঠিকানাবিহীন হাজার হাজার শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা করে হয়রানি করা হয়েছে। শ্রমিক মিলের কলোনিগুলোর প্রতিটিতে দাঙ্গা পুলিশ প্রবেশ করেছে। হার্ট ও ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত শ্রমিক আর সেই সঙ্গে শিশু-কিশোরী, তরুণী, নারীদের রাইফেলের বাঁট, লাঠি দিয়ে নির্মম-নিষ্ঠুর-অমানবিক নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা থেকে বোঝাই যায়, সবসময় এমন একটি পরিস্থিতি তৈরিই তাদের লক্ষ্য থাকে, যাতে শ্রমিক-কর্মচারীরা, মজুরি বেতন পাক বা না পাক এলাকা ত্যাগ করে। তারপর একটা সুবিধাজনক সময়ে চিরতরে বন্ধ ঘোষণা করা হয় এগুলো। এর ধারাবাহিকতাই আমরা এখনও দেখতে পাচ্ছি। একদিকে পরিবেশবান্ধব পাটশিল্পের মরণদশায় প্রায় বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থান বিনাশ; অন্যদিকে কর্মসংস্থানের কথা বলে সুন্দরবনবিনাশী, নদীবিনাশী, মানুষবিনাশী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বাংলাদেশকেই এক বড় বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কীভাবে রাষ্ট্রীয় নীতি দিয়েই বিশাল সম্ভাবনাময় পাটশিল্পের এই অবস্থা করা হয়েছে, সেটাই এই লেখায় সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে। 

পাটশিল্পের উত্থানকাল : বর্তমান বিশ্বে প্রধান পাট উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশ, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার। বৃহত্তম পাটকল, বৃহত্তম পাট রফতানিকারকের অবস্থান থেকে বাংলাদেশ নেমে এসেছে। তবে বাংলাদেশ এখনও উৎকৃষ্ট পাট উৎপাদনের ভূমি এবং অন্যতম বৃহৎ কাঁচা পাট রফতানিকারক। অষ্টাদশ শতাব্দীতেই হাতে বোনা পাটতন্তু বাংলা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হতো। ডান্ডি কেন্দ্র করে পাটশিল্প গড়ে উঠতে শুরু করে ১৮৩৩ সাল থেকে। প্রথম ভারতীয় পাটকল নির্মিত হয় ১৮৫৫ সালে, হুগলী নদীর তীরে কলকাতায়। ১৯০০ সালের মধ্যে কলকাতাকেন্দ্রিক পাটশিল্প ইউরোপীয় পাটশিল্প ছাড়িয়ে যায়। এখানে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল প্রথম পাট ব্যবসায়ী কোম্পানি। একচেটিয়াভাবে তারাই দীর্ঘদিন এই ব্যবসা করে। ১৯৪৭-এর পর ভারতে প্রতিষ্ঠিত পাটশিল্প ব্রিটিশদের হাত থেকে সেখানকার মাড়োয়ারিদের হাতে আসে। তৎকালীন পাকিস্তানের অন্তর্গত পূর্ব বাংলা থেকে প্রথমদিকে কাঁচা পাট যেত। একপর্যায়ে তা বন্ধ হয়ে গেলে ভারতে পাট উৎপাদন শুরু হয়। ভারত এখন বৃহত্তম পাট উৎপাদক। ভারতের বৃহৎ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান টাটা-বিড়লার ব্যবসাও শুরু হয় পাট দিয়ে। মিত্তাল গ্রুপেরও অন্যতম ব্যবসা ছিল পাট। ১৯৫০ দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ও সমর্থনে পাটশিল্প প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন (্‌ইপিআইডিসি) এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আদমজী-বাওয়ানিসহ বিভিন্ন বৃহৎ ব্যবসায়িক গ্রুপ অল্প ইক্যুয়িটি দিয়ে ক্রমে এসব শিল্পের মালিকানা লাভ করে। এরপরও এসব মিল কারখানা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুবিধা ও ভর্তুকি পাওয়ার কারণেই অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকে ও বিকশিত হয়। ষাটের দশকে বাংলাদেশের পাট ছিল বৈষম্য ও নিপীড়নবিরোধী রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয়। পুরো পাকিস্তানের রফতানি আয়ের প্রধান উৎস ছিল পাট; কিন্তু এই বৈদেশিক মুদ্রার অধিকাংশ ব্যয় হতো তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে। স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম স্বপ্ন ছিল এই পাট ঘিরেই। ভাবনা ছিল, এই পাট বাংলাদেশের মানুষেরই কাজে লাগবে এবং তা বাংলাদেশকে যথাযথ উন্নতির পথে নিয়ে যাবে। কিন্তু তা যে হয়নি, তা আজকের কোথাও নিশ্চিহ্ন, কোথাও বিধ্বস্ত পাটকলগুলোর এলাকা আর ততোধিক বিধ্বস্ত মানুষ দেখলে বুঝতে কারও সময় লাগে না।যখন পাটশিল্প আরও বিকশিত হওয়ার কথা :বাংলাদেশে স্বাধীনতা লাভের পর ২৬ মার্চ ১৯৭২ এক অধ্যাদেশবলে পরিত্যক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। পাটকলগুলোর সামগ্রিক তত্ত্বাবধানের জন্য গঠন করা হয় বাংলাদেশ পাটকল সংস্থা (বিজেএমসি)। পাটকলসহ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রায়ত্তকরণ খুব সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত ছিল না। ব্যবস্থাপনা ছিল দুর্বল। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমে নতুন ধনিক শ্রেণি গড়ে ওঠার একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহূত হতে থাকে। এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে পাটশিল্প সম্পর্কে সরকারি উত্তরোত্তর অবহেলা, বিকাশের কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করা, সরকারি দলের প্রভাববলয় সৃষ্টির কাজে পাট শ্রমিকদের ব্যবহার, মিলগুলোতে ট্রেড ইউনিয়নের নামে সরকারি মাস্তান বাহিনী তৈরির মধ্যে। বিজেএমসির অধীনে ৭৭টি জুট মিল ছিল। ১৯৮২-৮৩ থেকে বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু হয়। প্রথম দফায় ৩৫টি জুট মিল তাদের আগের মালিকদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। যাত্রাপথের ক্রমনিম্নমুখী রেখায় ২০০২ সালে বন্ধ হয় বিশ্বের বৃহত্তম আদমজী পাটকল। ২০০৭-০৮ সাল নাগাদ সব বড় পাটকল বন্ধ হয়ে যায়। সবই হয় লোকসানের যুক্তি দেখিয়ে। এরপর কয়েকটি পুনরায় চালু হয় চুক্তিভিত্তিক। সেগুলোরও এখন জীর্ণদশা। বেসরকারি খাতের পাটকলগুলোও সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি। 

পাটকলে লোকসানের কারণ :পাট খাতের সমস্যা হিসেবে ২০০৮ সালে ঘোষিত পাটনীতিতে যেগুলো বলা হয়েছে সেগুলো হলো : বিশ্ববাজারে কৃত্রিম আঁশ ও পণ্যের সঙ্গে পাট ও পাটপণ্যের তীব্র প্রতিযোগিতা এবং বাল্ক্ব হ্যান্ডেলিং বিশ্ববাজারে প্রচলন বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রমশই পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা ও মূল্য হ্রাস। বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও ঘাটতিজনিত কারণে প্রায় ১০ শতাংশ উৎপাদন ক্ষতি। পুরনো মেশিন ও যন্ত্রাংশ পরিবর্তন না করায় উৎপাদনশীলতা হ্রাস। সরকারি পাটকলগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত শ্রমিক-কর্মচারী থাকায় এবং শ্রমিকরা কাজে অনুপস্থিত থাকায়, অবহেলা ও ফাঁকি দেওয়ায় এবং শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তাদের সময় সময় মজুরি-বেতন বৃদ্ধি করা। ব্যাংক ঋণের সুদহার বৃদ্ধি করায় পাটপণ্যের উৎপাদন ব্যয় ক্রমশ বৃদ্ধি। পাটকলগুলোর লোকসান দিন দিন বৃদ্ধিপ্রাপ্তি। 

লক্ষণীয়, এখানে শ্রমিকদের ওপর দায় চাপানোর আগ্রহটা বেশ, যার সমর্থনে কোথাও কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। এগুলো ক্রমান্বয়ে বলে আসল দায়দায়িত্ব যাদের, সেই নীতিনির্ধারকদের রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ পাট মন্ত্রণালয়েরই এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এক বছরের লোকসান ৪২১ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ৩০ কোটি টাকা শ্রমিক আন্দোলন থেকে সৃষ্টি। 

স্বাধীনতার পর থেকে পাটকলে যে লোকসান বাড়তেই থাকে, তার পেছনে বরং কয়েকটি কারণ সুনির্দিষ্ট করা যায় এভাবে :পাকিস্তান আমলে পাটশিল্পের জন্য যেসব সুবিধা ও ভর্তুকি ছিল, সেগুলো অব্যাহত না রাখা। যথাসময়ে পাট ক্রয়ের জন্য অর্থ বরাদ্দ না দেওয়ায় বিলম্বে দুই বা তিনগুণ বেশি দামে পাট ক্রয়। মেশিনপত্র কোনোরকম নবায়ন না করা। উৎপাদিত পণ্যে বৈচিত্র্য না আনা। বিদ্যুতের সংকট সমাধানে এমনকি বিকল্প জেনারেটর ব্যবহারেও উদ্যোগ না নেওয়া। দেশের মধ্যে পাটজাত দ্রব্য ব্যবহার বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ না নেওয়া। আন্তর্জাতিকভাবে পাটজাত দ্রব্যের নতুন চাহিদা তৈরি না করা। বিদ্যমান চাহিদার বাজার ধরার উদ্যোগ না নেওয়া। ব্যাংক ঋণ এবং চক্রবৃদ্ধি সুদের চাপ বৃদ্ধি। সরকারি দলের কাজে শ্রমিকদের কর্মসময় ব্যবহার করা। সরকারি দলের প্রভাব বৃদ্ধির জন্য শ্রমিক নেতার নামে সন্ত্রাসীদের লালন-পালন। মন্ত্রণালয় থেকে বিজেএমসি ও মিল ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত দুর্নীতিবাজদের আধিপত্য।

স্বাধীনতার পর থেকে এর মধ্যে আমরা অনেক রকম সরকার দেখেছি। তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে তুমুল বিরোধ থাকলেও যেসব বিষয়ে তাদের ভূমিকা অভিন্ন ছিল, তার মধ্যে এসব নীতিমালা অন্যতম। সে কারণে ক্রমবর্ধমান লোকসানের এই কারণগুলোর কোনো পরিবর্তন হয়নি। এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ না নিয়ে লোকসানের অপরাধে পুরো শিল্প খাতের ওপর নতুনভাবে আক্রমণ শুরু হয় আশির দশকের প্রথম থেকে। তখন কাঠামোগত কর্মসূচির আওতায় পুরো বাংলাদেশ। পাট খাতকে রাহুর হাত থেকে রক্ষার জন্য ওপরের বিষয়গুলোতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বৈশ্বিক কৌশলের শিকারে পরিণত করা হয় পুরো খাতকে। 

জনবৈরী উন্নয়ন দর্শনের শিকার : ২০০১ সালে আমার হাতে আসে বিশ্বব্যাংকের একটি দলিল। এর শিরোনাম ছিল- ‘বাংলাদেশ : জুট সেক্টর অ্যাডজাস্টমেন্ট ক্রেডিট, রিপোর্ট অ্যান্ড অ্যাডজাস্টমেন্ট ১৯৯৭’। এর মূল রিপোর্ট ১৯৯৪ সালের। অন্য অনেক দলিলের মতো এটিতেও চিহ্ন দেওয়া ছিল ‘কনফিডেন্সিয়াল’। বাংলাদেশের উন্নয়নের, বাংলাদেশের মানুষের দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য যে সংস্থাগুলো এত ব্যস্ত বলে আমরা শুনি তাদের গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র, চুক্তি পুরো বা আংশিক গোপন রাখা হয় বা তাতে প্রবেশাধিকার জটিল করা হয়। কেন? কারণ ঢোল পিটিয়ে যা বলা হয় তার সঙ্গে আসল কাজের সম্পর্ক আকাশ-পাতাল। বাংলাদেশে আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখি, যখনই বিশ্বব্যাংক মার্কা কোনো সংস্থা কোনো খাতের উন্নয়নে এগিয়ে আসে বা সহযোগিতার হাত বাড়ায়, বুঝতে হবে এই খাতের সর্বনাশের বেশি বাকি নেই। তাদের দলিলপত্র তাই চিনি দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। জনগণকে অন্ধকারে রাখা ছাড়া সরকার বা এসব সংস্থার মুখ রক্ষার আর কোনো পথ নেই। 

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যখন দুর্নীতি, লুণ্ঠন আর সরকারের বৈরী নীতির কারণে পাটশিল্পের জীর্ণদশা, তখন বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠী আনুষ্ঠানিকভাবে মাঠে প্রবেশ করে, যথারীতি ত্রাতা হিসেবে। পাট খাতে সংস্কার কর্মসূচির কথা বলে প্রথমে দুটি সমীক্ষা চালানো হয়। ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি ও সেপ্টেম্বরে পরিচালিত এই সমীক্ষা দুটির একটি হলো, ইইসির অর্থসংস্থানে ‘দ্য জুট ম্যানুফ্যাকচারিং স্টাডি’ এবং আরেকটি হলো, বিশ্বব্যাংকের আইডিএর অর্থসংস্থানে সমীক্ষা ‘বাংলাদেশ-রিস্ট্রাকচারিং অপশনস ফর দ্য জুট ম্যানুফেকচারিং ইন্ডাস্ট্রি’। 

বলা দরকার যে, এ রকম সমীক্ষা করে নিজেদের পছন্দসই পথ ও পদ্ধতিকে বৈধতা দেওয়া যে কোনো খাতে এই গোষ্ঠীর রাহুগ্রাসের চেনাজানা পথ। তাই এসব সমীক্ষার ধারাবাহিকতাতেই ১৯৯৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জুট সেক্টর অ্যাডজাস্টমেন্ট ক্রেডিটের আওতায় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হয়। এতে ঋণ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় ২৪৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই সময়কালেই প্রাইভেটাইজেশন বোর্ড গঠিত হয়। এর মধ্য দিয়েই শুরু হলো পাট খাতের ওপর সংগঠিত আক্রমণ। ট্রেড ইউনিয়নগুলো কবজা করারও নানা পথ নেওয়া হয়। নেতাদের বিদেশ সফর ছিল অন্যতম। ২৪৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী প্রায় ২০০০ কোটি টাকা দিয়ে যেসব কাজ করার চুক্তিতে বাংলাদেশ সরকার আবদ্ধ হয়, সেগুলোর মধ্যে পাটশিল্প নবায়ন, বৈচিত্র্যকরণ বা সম্প্রসারণের কোনো কর্মসূচিই ছিল না। যা ছিল তাহলো : ১. নয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত মিল বন্ধ ও দুটি সংকুচিত করে পুরো শিল্প সংকোচন করা; ২. ২০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করে ‘র‌্যাশনালাইজ’ করা; ৩. ১৯টি মিল বেসরকারিকরণ করা ও ৪. মজুরি বাড়ানো বন্ধ রাখা এবং মজুরির অনুপাত কমানো।

১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে বিশ্বব্যাংক অবিলম্বে পাঁচটি মিল বন্ধ, একটি সংকুচিত করা এবং ২৭০০ লুম বন্ধ করার জন্য জোর দেয়। বলা হয়, ১৯৯৬-এর শরতের মধ্যে অবশ্যই তিনটি মিল বন্ধ করতে হবে। বিভিন্ন কিস্তি পরিশোধের সময় কারখানা বন্ধ ও ছাঁটাইয়ের নতুন নতুন সীমা দেওয়া হয়। প্রথম কিস্তি- চারটি মিল বন্ধ, ১২ হাজার ছাঁটাই; দ্বিতীয় কিস্তি- পাঁচটি মিল বন্ধ, ৯টি মিল বেসরকারিকরণ; ৮ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই; তৃতীয় কিস্তি- নয়টি মিল বেসরকারিকরণ। 

বিশ্বব্যাংকের সেই সংস্কার কর্মসূচিতে আশাবাদ প্রচার করা হয়েছিল যে, সংস্কার শেষ হতে হতেই পুরো খাত ব্যক্তিমালিকানাধীনে চলে যাবে। বলা হয়েছিল, এসবের মধ্য দিয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে এবং এই খাতের উন্নয়ন ঘটবে। পরিস্কার দেখা গেল- অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, উৎপাদনশীলতা কমেছে, কর্মসংস্থান ৮০ শতাংশ কমে গেছে আর সব মিলিয়ে শিল্প প্রসারের বদলে গুরুতর সংকোচন ঘটেছে।