প্রফেসর সাহেব

ছোটবেলা থেকে আমরা তাঁকে এই নামেই চিনি। কেননা তাঁকে আমাদের দেখা-জানা সব লোকজন ‘প্রফেসর সাহেব’ নামেই ডাকতেন। বেশ কয়েকটি কলেজে শিক্ষকতা সূত্রে তাঁর এ পরিচয় তৈরি হয়। ছোটবেলায় রাগী, গম্ভীর ভাবমূর্তির এ মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার সাহস আমাদের ছিল না। তিনি আমাদের পিতা প্রফেসর মো. আজগর আলী (১৯২৭-২০০৩)। বিভিন্ন সময়ে তিনি নিজের জীবনের টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন, মৃত্যুর পর তাঁর সেসব নোটবই আমাদের হাতে আসে। পূর্ব বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া একজন মানুষ কঠিন প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করে কীভাবে নিজের জীবন তৈরি করেছিলেন, ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছেন, টুকরো টুকরো লেখা থেকে তার কিছু চিত্র পাওয়া যায়। আজকের লেখায় তার একাংশ উপস্থিত করছি।

প্রফেসর সাহেবের বাবা নাহের মুন্সী ছিলেন ক্ষুদ্র কৃষক, সেই সঙ্গে তিনি গ্রামের মসজিদে ইমামতি করতেন। মা সহিতুননেসা ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী, কম উপার্জনে বেশি মানুষের সংসার সামাল দিতে তাঁকে সবসময় ব্যস্ত থাকতে হতো। দাদা মহর মুন্সী বেশির ভাগ সময় পীরের দরবারেই থাকতেন, ওয়াজ মাহফিলেই তাঁর বেশি সময় কাটত, সংসারের কাজে তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। তবে ‘একটি বিশেষ গুণ তাহার মধ্যে ছিল, তাহা হইলো এই তিনি আমাদিগকে লেখাপড়া করার উৎসাহ দিতেন এবং তাহারই উৎসাহের কারণে আমরা লেখাপড়া করিতে পারিয়াছি।’ মায়ের উৎসাহও বড় অবলম্বন ছিল, ‘পড়াশুনা করার জন্য মা আমাকে সবসময় উৎসাহিত করিতেন। পড়ার জন্য শেষ রাত্রে ডাকিয়া দিতেন।’

বাবা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘বাড়ীতে খাওয়ার অনেক লোক ছিল, সংখ্যায় ১৫/১৬ জন। কিন্তু খাটুইয়া লোক ছিল মাত্র একজন। কেবল বাজান (লম্বা স্বাস্থ্যবান, শক্তিশালী), একাই ৪/৫ জনের কাজ করিতে পারিতেন। লোকেরা বাজানকে সমীহ করিয়া চলিত। বাজান অসম্ভব খাটুনী খাটিতেন কিন্তু সব সময় বিনয়-হাসিমুখে থাকিতেন। বাজানকে সবাই ভালবাসিত। বাজান একাই এত খাটুনী খাটিয়া কিভাবে যে এত বড় পরিবার চালাইতেন তাহা আমার বোধগম্য ছিল না।’

সে সময় গ্রামে স্কুলে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাই ছিল হাতেগোনা। মেট্রিক পাস করলে দূর দূর থেকে মানুষ আসত দেখতে। এর পরের শিক্ষার কথা ভাবা তাই ছিল দুঃসাহসিক ব্যাপার। এ রকম পরিবেশেও তিনি লিখেছেন, “পড়াশুনা আমার জীবনের চাওয়া পাওয়া ছিল। যখনই অবসর পাইতাম বই লইয়া বসিতাম। এমনকি কোন জায়গায় গেলে বা আত্মীয় বাড়ীতে গেলেও বই সঙ্গে লইতাম। সব সময় বড় করিয়া পড়িতাম। আমার পড়াশোনা দেখার জন্য পাড়ার লোকজন আসিত এবং আমাকে তাদের বাড়ী যাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করিত। বর্ষার সময় আমাদের বাড়ীর চারিদিকে পানি ছিল। বাড়ীর পাশ দিয়াই নৌকা চলাচল করিত। লোকেরা নৌকা থামাইয়া আমার ইংরেজী পড়া শুনিত। কেহ জিজ্ঞাসা করিলে ‘কেন নৌকা থামাইয়া রাখিয়াছ।’ তাহারা বলিত আজগরের ইংরেজী পড়া শুনি।”

আরামে লেখাপড়া করার উপায় ছিল না। বেশির ভাগ সময় বাবার সঙ্গে ক্ষেতে কাজ করতে, বিলে মাছ ধরতে যেতে হতো। তিনি লিখেছেন, ‘বাজানকে সাহায্য করার জন্য আমাকে সংসারের কাজ করিতে হইত। সংসারের সব রকম কাজ করিতাম। গরু রাখিতাম, হাল বাইতাম, নিড়াইতাম, ধান-পাট কাটিতাম, মলন দিতাম, রোয়া গাড়িতাম। আমি এত দ্রুত রোয়া গাড়িতাম যে আমার হাত দেখা যাইত না। লোকেরা দেখিতে আসিত। পরিবার বড় ছিল, ব্যয় ছিল অনেক। আমার জন্য যেন পরিবারের কষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখিতাম। জায়গীরে থাকার চেষ্টা করিতাম।’

এর মধ্যেও পড়াশোনার আগ্রহ কমে না, তাই ‘ক্লাশ সিক্স ভালভাবে পাশ করার পর হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পালা। মন চায় ভালো স্কুলে পড়িতে, যেমন জামালপুর সরকারী স্কুল বা নান্দিনা স্কুলে কিন্তু সামর্থ্য নাই। তখন বাধ্য হইয়াই ভাটারা স্কুলে খোঁজ খবর লওয়ার জন্য গেলাম, জায়গীর ছাড়া তো কোন উপায় নাই।’

স্কুলের ছাত্র থাকাকালেই তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘আমি কোন সময় বসিয়া থাকিতাম না। সব সময় কাজে লাগিয়া থাকিতাম। আরামনগর, সরিষাবাড়ীর রিয়াজ তালুকদার সাহেব প্রভাবশালী ব্যক্তি—ভূতপূর্ব এম.পি.এ ছিলেন। তাহার বাড়ীতে জুনিয়র মাদ্রাসা। ঐ মাদ্রাসাতে আমি কিছু সময় শিক্ষকতা করি। সেই সুবাদে তাঁহার ছোট ছেলে ব্যারিস্টার সালাম তালুকদার সাহেব আমার ছাত্র।’

অভাবসহ কঠিন বাধা-বিপত্তির সঙ্গে অবিরাম লড়াই করে তিনি মেট্রিক পাস করেন ১৯৪৪ সালে। পরিবারের মুরুব্বিরা চাচ্ছিলেন তিনি কাজে যোগ দিয়ে সংসারের হাল ধরবেন কিন্তু তাঁর ইচ্ছা লেখাপড়া করা। তাঁর খরচ জোগানোর অবস্থা দরিদ্র অভিভাবকদের নেই, উল্টো সংসারে তাঁর টাকা দেয়া দরকার। কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য নানা জায়গায় যোগাযোগ করেও কাজ হলো না। তিনি জানাচ্ছেন, “বাড়ীতে আসিলাম, পড়ার খরচের কথা বলিলাম। দুঃখের বিষয় খরচ দেওয়ার জন্য আমার পরিবার রাজি হইলেন না। এখন কি করি। কেবল দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটি করিতেছি। মোছাহেব আলী খান সাহেব আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন। তাহার নিকট আমার অবস্থা বর্ণনা করিলাম। তিনি বলিলেন, ‘তুমি কলিকাতায় গেলে খরচ চালাইবে কে?’ আমি তবুও সামান্য টাকা লইয়া (যাহা টিউশনী করিয়া, মাস্টারি করিয়া যোগাড় করিয়াছিলাম) মোছাহেব আলী খান সাহেবের সহিত কলিকাতায় রওনা হইলাম।’

এভাবেই ঢাকা দেখার আগে শিক্ষার টানে তাঁর কলকাতায় যাওয়া। সেখানে প্রথমে ভর্তি হলেন কমার্স কলেজে। কলেজের ‘পরিবেশ অত্যন্ত ভাল। চাটার্জী বাবু যিনি একাউন্টেন্সী বই লিখেছেন তিনি ঐ বইই ক্লাশ এ পড়ান। চাটার্জী বাবু আমাকে খুব স্নেহ করিতেন। কেন করিতেন আমার জানা নাই।’

কিন্তু টাকার অভাবে এই কলেজেও ‘আর পড়া হইলো না।’ সে সময় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, তার কারণে কলকাতায় জীবন আরো অনিশ্চিত। বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম আয়ও জোগাড় হচ্ছে না। বেকারত্ব আর যুদ্ধের আক্রমণ একসঙ্গে, ‘..চাকুরী না পাওয়াতে আমার জীবন বিষময় হইয়া উঠিল। খাওয়ার টাকা নাই, থাকার জায়গা নাই, বাড়ী হইতে টাকা আসিবে না, মানুষের বাড়ীর বারান্দায় থাকি। মাঝে মাঝে ঝাঁকে ঝাঁকে জাপানী প্লেন বোমা ফালাইতে, আক্রমণ করিতে আসিতো। জোরে সোরে সাইরেন বাজিতেছে। লোকেরা দৌড়াদৌড়ি করিয়া ঘরে যাইয়া আশ্রয় পাইতেছে। কিন্তু আমার তো কোন আশ্রয় নাই।’ 

এর মধ্যে হজ অফিসে খণ্ডকালীন কাজ পেয়ে ‘প্রথমে একটি মেছে উঠিলাম। রিপন কলেজে ভর্তি হইলাম। বাজান, ভাই-বোনেরা বাড়ীর লোকেরা অসুবিধায় আছে। ইহা আমার চোখে চোখে ভাসিত। চাকুরীর বেশির ভাগ টাকা বাড়ীতে পাঠাইতাম। মাত্র একটা পায়জামা, একটা হাফ শার্ট পরিয়া অফিস করিতাম। কলেজে ক্লাস করিতাম। মির্জাপুর স্ট্রিটে অবস্থিত জিন্নাহ হলে সীট পাইলাম।’

আইকম পাস করার পর ভর্তি হলেন সিটি কলেজে। নতুন কাজ পেলেন রেন্ট কন্ট্রোল অফিসে। লিখেছেন, ‘সিটি কলেজ কলিকাতার মধ্যে বাণিজ্য শাখার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। বই লেখকেরাই কলেজের শিক্ষক ছিলেন। এত হাই ক্যালিবারের শিক্ষক আর কোথায়ও ছিল না। এত বড় কলেজে এত ভাল কলেজে ভর্তি হইয়া আমি অত্যন্ত আনন্দিত হইলাম।’ কিছুদিনের মধ্যে চাকরি পেলেন কলকাতা করপোরেশনে। সব সংকট পার হয়ে যখন স্থিত হয়েছেন, তখনই বিপদ এল আরেক দিক থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘সব কিছুই ঠিকঠাক চলিতে লাগিল। কিন্তু ডাইরেক্ট এ্যাকশনে আমার কপাল ভাঙিল। রায়ট আরম্ভ হইল। এত লোক মারা গেল তাহা কল্পনা করা যায় না। কলিকাতার ড্রেনে পানি প্রবাহিত হয়, সেখানে রক্ত প্রবাহিত হইতে দেখিয়াছি।’

তিনি এর মধ্যে ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব নিয়েছেন। লিখেছেন, ‘কলিকাতার প্রায় কলেজ হিন্দু এরিয়াতে, রায়ট এর মধ্যে মুসলমান ছাত্রদের ক্লাশ করার উপায় নাই। আমরা ছাত্র নেতারা (আমি কমার্স ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলাম) সবাই মিলিয়া সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সহিত দেখা করিলাম। আমাদের দাবী ছিল মুসলিম এরিয়াতে আমাদের জন্য হোস্টেলের ব্যবস্থা করা, ইসলামিয়া কলেজে রাত্রে মুসলমান ছাত্রদের জন্য ক্লাশের ব্যবস্থা করা। ইসলামিয়া কলেজ মুসলিম এরিয়াতে ছিল। সোহরাওয়ার্দী সাহেব ইসলামিয়া কলেজে রাত্রে মুসলমান ছাত্রদের জন্য ক্লাশের ব্যবস্থা করিলেন এবং পার্ক লেন-এ (মুসলিম এরিয়া) এক বিরাট হোস্টেলের ব্যবস্থা করিলেন। আমরা ক্লাশ করিতে থাকিলাম। অতি কষ্টে অফিসও করিতে লাগিলাম।’

এর মধ্যে ‘দেশ ভাগাভাগি হইয়া গেল। সবার ঢাকায় আসার জন্য হিড়িক পড়িয়া গেল। আমি আগেও বলিয়াছি, আমার কপাল ভাঙিয়া গিয়াছে। হঠাৎ করিয়া জানটা কোনমতে লইয়া কলিকাতা ছাড়িয়া বাড়ী আসিলাম। বাড়ী আসিয়া দেখি সবাই কান্নাকাটি আর মিলাদের পর মিলাদ হইতেছে। আমাকে পাইয়া সবাই খুশি হইল। কিন্তু আমি খুশি হইলাম না। চিন্তা করিতেছিলাম যদি ঝুঁকি লইয়া কলিকাতায় থাকিয়া যাইতাম তবে কতইনা ভাল হইত। লেখাপড়া করিয়া মনের মত জীবনে প্রতিষ্ঠিত হইতে পারিতাম। কিন্তু তাহা আর হইল না। ভয়ে হুজুগে মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে খালি হাতে কলিকাতা ছাড়িয়া বাড়ীতে আসিতে হইল।’

শুরু হলো জীবনের আরেক পর্ব। তিনি লিখেছেন, ‘বাড়ীতে কিছুদিন থাকার পর ঢাকায় আসিলাম কিন্তু মনে হইল কলিকাতার আলো হইতে ঢাকার অন্ধকারে আসিলাম। ঢাকায় আসিয়া কোন কিছুই ঠিকমত করিতে পারিতেছিলাম না। না আছে চাকুরী, না আছে পড়াশোনার ব্যবস্থা, না আছে টাকা পয়সা। ঢাকায় সবই অপরিচিত। এদিক ওদিক থাকি, কোনমতে খাওয়া দাওয়া করি। তবে কলিকাতার মৃত্যুভয় হইতে বাঁচিলাম। ক্রমে ক্রমে ঢাকা ভাল মনে হইতে লাগিল। কেন হইবে না? ইহা যে আমার নিজের দেশ, বাংলাদেশ।’

নতুন করে জীবনগতি ঠিক করতে অনেক উদ্যোগের দরকার ছিল। উপার্জন করতে হবে, লেখাপড়াও চালাতে হবে। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈশ শিফট দরকার। তিনি লিখেছেন, ‘আমি আগেই বলিয়াছিলাম আমি কলিকাতায় ছাত্রদের কমার্স ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলাম। ঢাকাতে আন্দোলন করিয়া ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইভনিং ক্লাশ এর ব্যবস্থা করিলাম। কলিকাতা হইতে আগত সকল ছাত্র উপকৃত হইল। বি.কম পাশ করিলাম। এম.কমে ভর্তি হইলাম। ঢাকায় আসিয়া জায়গীর বাড়ী থাকিয়া ছাত্র-ছাত্রী পড়াই-খাই। অবসর সময়ে টিউশনী করি। টিউশনীর টাকা দিয়া চলি, বাড়ীতে পাঠাই।’

এ সময়েই ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। মিছিলে অংশ নিয়ে আহত হন আজগর আলী। এমকম পার্ট ওয়ান পাস করার পর জামালপুর কলেজে কমার্সের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। শুরু হয় তাঁর প্রফেসরজীবন।