সুন্দরবন থেকে রূপপুর: ভুল তথ্য ও অস্বচ্ছতা

8424b30eb91c499080a654b14be21dbf 21৩ মে প্রধানমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে সুন্দরবনধ্বংসী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র–বিরোধিতাকারীদের উদ্দেশে আবারও বিষোদ্গার করেছেন। হাসিঠাট্টার ছলে তিনি যে বিষয়গুলো উত্থাপন করেছেন, সেগুলো গুরুতর অভিযোগ। যেমন তিনি বলেছেন, আন্দোলনকারীরা মানুষের স্বার্থ বাদ দিয়ে এখন পশুপাখি রক্ষার আন্দোলন করছে। স্মরণ করি, কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় আন্তর্জাতিক বাঘ সম্মেলন উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘বাঘ বাঁচলে সুন্দরবন বাঁচবে, সুন্দরবন বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে।’ খুবই সঠিক কথা ছিল সেটি। তাহলে প্রধানমন্ত্রী কি কয়েক দিন আগে বলা কথা নিজেই অস্বীকার করছেন? সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলন অবশ্যই পশুপাখি-গাছপালা রক্ষা করতে চায়। কিন্তু সেটাই প্রথম বা শেষ কথা নয়। বহু কারণে এই সুন্দরবন রক্ষার দায় আমাদের। কারণ, এই বিশাল সম্পদ (ক) পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, (খ) এটি বিশ্ব ঐতিহ্য, (গ) এর ওপর কয়েক লাখ মানুষের জীবিকা নির্ভর করে, (ঘ) এটি অসংখ্য প্রাণের সমষ্টি এক মহাপ্রাণ, (ঙ) এটি অসাধারণ জীববৈচিত্র্যের আধার হিসেবে মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন, সর্বোপরি (চ) এটি প্রাকৃতিক রক্ষা বাঁধ, যা প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে লাখ লাখ মানুষ বাঁচায়।

প্রধানমন্ত্রী এবারও বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনা টেনেছেন। এই দুটো যে তুলনীয় নয়, তা আমরা আগেও বহুবার বলেছি। প্রথমত, বড়পুকুরিয়ায় কোনো সুন্দরবন নেই; দ্বিতীয়ত, বড়পুকুরিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১০ ভাগের ১ ভাগ; তৃতীয়ত, ছোট আকারের হলেও সেই তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে এলাকায় পানির সংকট ক্রমেই বাড়ছে। একদিকে ওপরের পানি দূষিত হয়ে কুৎসিত আকার ধারণ করছে, অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নেমে যাওয়ায় খাবার ও কৃষিপানি দুর্লভ হয়ে উঠছে। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে এর ১০ গুণ বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র যদি সুন্দরবনের মতো প্রতিবেশগতভাবে সংবেদনশীল স্থানে হয়, তাহলে তার পরিণতি কী হবে!

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে সুন্দরবন থেকে ‘নিরাপদ দূরত্বে’। সরকারি দলিলেই বলা হয়েছে, সুন্দরবন থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার। বাফার জোন ধরলে মাত্র চার কিলোমিটার। ভারতে অনেক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে, নিজেদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই সেখানে আইন হয়েছে এই দূরত্ব কমপক্ষে হতে হবে ২৫ কিলোমিটার। এনটিপিসির পরে বাংলাদেশের কোম্পানি ওরিয়নকে আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা সুন্দরবনের আরও নিকটবর্তী। দূরত্ব নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এই নিশ্চিন্ত অবস্থানের সঙ্গে সম্প্রতি ইউনেসকোর কাছে বিদ্যুৎ বিভাগের পাঠানো চিঠির বক্তব্যের সম্পর্ক থাকতে পারে। এই চিঠিতে বলা হয়েছে, সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্য থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার দূরে। এই বক্তব্যের চালাকি হচ্ছে এই যে বিশ্ব ঐতিহ্য বলে ইউনেসকো সুন্দরবনের উপকূলসংলগ্ন একটি অংশকে নির্দিষ্ট করেছে, যার থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্র ঠিকই ৭০ কিলোমিটার দূরে। সরকার এটা বলে ইউনেসকোকে বুঝ দিচ্ছে, কিন্তু সরকার কি তবে সুন্দরবন বলতে তার ক্ষুদ্র একটি অংশকেই বোঝাতে চায়? সরকার কি তবে সুন্দরবনের বড় অংশ খরচের খাতায় ফেলছে? মানচিত্র দেখলে যে কেউ বুঝবেন, এভাবে ওই টুকরোটিও নিরাপদ হবে না। কয়লা পরিবহন হবে সমুদ্র থেকে পুরো সুন্দরবনের মাঝ দিয়ে, বিশ্ব ঐতিহ্য বলে চিহ্নিত অংশের পাশ দিয়ে। এই পরিবহনই ওই টুকরোসহ পুরো সুন্দরবনকে বিপর্যস্ত করার জন্য যথেষ্ট। এর সঙ্গে পুরো সুন্দরবনের প্রতিবেশগত সংকটের চক্রাকার ভূমিকা তো আছেই। আর এর মধ্যে একটাও যদি দুর্ঘটনা হয়, তাহলে কী পরিণতি হবে, তা সাম্প্রতিক তেলবাহী জাহাজ দুর্ঘটনাই তার প্রমাণ। এখনো ওই জাহাজ ওখানেই পড়ে আছে। এর মধ্যে আবারও জাহাজডুবি হয়েছে। এগুলোর কারণে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির যেসব লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তাতে সংবেদনশীল হলে অনেক আগেই সরকারের তৎপরতায় আমূল পরিবর্তন আসত।

সব যুক্তি-তথ্য অস্বীকার করে ‘উন্নয়ন’ হবে, কর্মসংস্থান হবে, বিদ্যুৎ আসবে, শহর হবে ইত্যাদি অসততা ও প্রতারণায় ভরা প্রচারণা চলছেই। গোপন করা হচ্ছে এই সত্য যে যত কর্মসংস্থান তৈরি হবে, তুলনায় কর্মসংস্থান নষ্ট হবে তার কয়েক গুণ। কাজের জন্য, মাছের জন্য, সুন্দরবন বাঁচার জন্য নদীর যে স্বাদু পানি মুখ্য ভূমিকা পালন করে, সেই পানি বিষাক্ত হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষের জীবন রক্ষার জন্য শত হাজার কোটি টাকা খরচ করে বাঁধ বানানো হয়। আর বাংলাদেশে তার তুলনায় বহুগুণ শক্তিশালী প্রাকৃতিক বাঁধ হিসেবে কাজ করে সুন্দরবন। এখন বহু হাজার কোটি টাকা খরচ করে এই সুন্দরবনের সর্বনাশ নিশ্চিত করা হচ্ছে। এই সর্বনাশ মানে কোটি মানুষের অসুস্থতা বৃদ্ধি, প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে লাখ লাখ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া।

সুন্দরবন রক্ষার অর্থ তাই শুধু পশুপাখি-গাছপালা নয়, মানুষের অস্তিত্বের জন্য সুন্দরবনকে বাঁচাতে হবে, এর সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে। সুন্দরবন একটাই, এর বিনাশ ঘটলে তা আর পুনরুৎপাদন করা যাবে না। সে জন্যই আমরা বারবার বলি, সুন্দরবন না থাকা মানে বাংলাদেশ অরক্ষিত হয়ে পড়া। বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প উপায় আছে, কিন্তু সুন্দরবনের বিকল্প নেই।

সরকারের একটাই বুলি, ‘কোনো ক্ষতি হবে না।’ ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ ভারত করবে না। আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর সরকার দেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো কাজ করবে না। এসব কথায় ভরসা করতে পারতাম যদি ক্ষমতাবানদের হাতে জমি, পাহাড়, বন, নদী, সর্বজনের সম্পদ অরক্ষিত না দেখতাম। বস্তুত বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে যেসব তৎপরতা চলছে, তাতে ইতিমধ্যে সুন্দরবন আক্রান্ত। সাইলো, সিমেন্ট কারখানা শুধু নয়, বন উজাড় করে ভূমিগ্রাসে এখনই লিপ্ত আছে সরকারঘনিষ্ঠ বিভিন্ন গোষ্ঠী। ওই এলাকার অধিকাংশ মানুষ গরিব ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু হওয়ার ফলে তাদের অনেকের হাত থেকে জমি কেড়ে নেওয়া সহজ হয়েছে। আবার এখন ঘাড়ের ওপর বানানো হচ্ছে বিমানবন্দর!

এলাকায় ভূমিদখল, সুন্দরবন বিনাশ ও প্রকল্প নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদেরও এখন কথা বলার উপায় নেই। বিদ্যুৎকেন্দ্রের এলাকা থেকে মানুষ সরানো হয়েছে ভয়ভীতি দেখিয়ে, জোর করে। এখন সেখানে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ঘের বসেছে। এই সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর সন্ত্রাসীরাই সব ধরনের আলোচনা মত বা প্রতিবাদের বিরুদ্ধে নিয়োজিত। জবরদস্তির এই চেহারা আমরা মাতারবাড়ী ও রূপপুর এলাকায়ও দেখছি। গত এক বছরে অন্তত ছয়টি ঘটনা জানি, যেখানে ঈশ্বরদী এমনকি পাবনায়ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ নিয়ে সভা-সমাবেশ দূরের কথা, মতবিনিময় সভাও করতে দেওয়া হয়নি। সাদাপোশাক, উর্দি পরা সরকারি বাহিনী থেকে স্থানীয় সন্ত্রাসী—সবাইকে ব্যবহার করা হচ্ছে এই প্রকল্প নিয়ে কোনো কথাবার্তা যাতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে।

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে যদি দেশের মঙ্গল হয়, তাহলে দেশের মানুষই তার সুবিধা পাবে; যদি অমঙ্গল হয়, তাহলে ভুগবে দেশের মানুষ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। তাহলে কেন তাদের কথা শুনতে বা কথা বলতে দিতে এত ভয়? সরকার যদি নিশ্চিত থাকে এগুলো ‘উন্নয়ন’ প্রকল্প, ধ্বংস বা লুণ্ঠন প্রকল্প নয়, তাহলে পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে অসুবিধা কী? জনগণের মুখোমুখি হতে অসুবিধা কী? সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন বা উদ্বেগের মোকাবিলা করতেই অনিচ্ছুক। বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা নিয়ে কথা ওঠায় একবার রুশ রাষ্ট্রদূত বললেন, এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এতই সুরক্ষিত থাকবে যে এখানে বোমা মারলেও এর কোনো ক্ষতি হবে না। সুনামি হলেও কোনো সমস্যা হবে না। এর পর থেকে সরকারের লোকজনও একই কথা পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছেন। বিপদের ঝুঁকি কীভাবে মোকাবিলা হবে বা পারমাণবিক বর্জ্য কীভাবে সরানো হবে, তার কোনো সন্তোষজনক জবাব মেলেনি। এর মাধ্যমে কয়েক কোটি মানুষকে যে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হচ্ছে, তার থেকে বাঁচার নিরাপত্তাকবচ কোথায়?

সুন্দরবনে আলট্রাসুপার টেকনোলজি কিংবা রূপপুরে বোমা বা সুনামি প্রতিরোধক প্রযুক্তি কি শুধু বাংলাদেশের জন্যই পাওয়া যাচ্ছে? নইলে যে ভারতীয় কোম্পানি বা বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে সুন্দরবনে বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাচ্ছে, তাদের নিজ দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে এত ভয়াবহ প্রতিবেদন কেন? কেন ভারতের গ্রিন ট্রাইব্যুনাল এই এনটিপিসির একাধিক প্রকল্প স্থগিত করেছে? কেন একই প্রযুক্তি নিয়ে রাশিয়ার ঋণে নির্মিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তামিলনাড়ুতে (কুডানকুলাম) বারবার বাধা ও অচলাবস্থার সম্মুখীন হয়েছে? কেন মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে সেখানে?

সুন্দরবন ও রূপপুরে দুই স্থানেই প্রকল্প গ্রহণ-প্রক্রিয়া অস্বচ্ছতায় পূর্ণ। রামপালে কয়লা কোথা থেকে আসবে, অর্থসংস্থান কীভাবে হবে, বিদ্যুতের দাম কত পড়বে, তা দেশের মানুষের কাছে এখনো পরিষ্কার করা হয়নি। রূপপুর প্রকল্পে রাশিয়ান ঋণ নেওয়া হয়েছে উচ্চ সুদে, কিন্তু তার ব্যবহার নিয়ে আর কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। এই দুই প্রকল্পে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে, তা বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতার ২০ ভাগেরও কম। অনেক পথ আছে এই বিদ্যুৎ উৎপাদনের। একটি বড় এবং দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উৎস হলো বঙ্গোপসাগর। এখানকার গ্যাস-তেল সম্পদ যদি জাতীয় সংস্থার মাধ্যমে শতভাগ নিজেদের মালিকানায় উত্তোলন করা যায়, তাহলে কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের জনগণকে সুলভে পরিবেশসম্মতভাবে বিদ্যুৎ জোগান দেওয়া সম্ভব। এর জন্য জাতীয় মালিকানার নীতি ও জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের কর্মসূচি নিতে হবে। কিন্তু সরকার সে পথে না গিয়ে মার্কিন, ভারতীয় ও চীনা কোম্পানির সঙ্গে এমন ধরনের চুক্তির পথে যাচ্ছে, যাতে এই গ্যাস আর দেশের সম্পদ থাকবে না, বোঝায় পরিণত হবে। অন্যদিকে, স্থলভাগে নিজেদের সক্ষমতা নিশ্চিত থাকা সত্ত্বেও গাজপ্রমসহ বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ স্থলভাগের অবশিষ্ট ব্লক। এ ছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি তো বাংলাদেশের জন্য অফুরন্ত সম্ভাবনা। উপরন্তু এর ব্যয়ও দ্রুত কমে আসছে। সেদিকেও বৃহৎ প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতির উদ্যোগ নেই।

সমাধানের যথাযথ পথ নিলে দেশ ও মানুষ টেকসই বিদ্যুৎব্যবস্থা পাবে ঠিকই, কিন্তু তাতে দেশি-বিদেশি কিছু গোষ্ঠীর কমিশন, দুর্নীতিসহ বৃহৎ লাভের সম্ভাবনা নেই। সে জন্যই কি বাংলাদেশের ঘাড়ে বিপদের প্রকল্প জমা হচ্ছে একের পর এক?

(৭ মে ২০১৫ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত)