বদরুদ্দীন উমর: তিনি হার মানেননি

9f0db0485126183ad7c6c2365ddbd3ea 28বাংলাদেশের শিক্ষা, গবেষণা ও রাজনীতির অন্যতম দিকপাল বদরুদ্দীন উমরের আজ ৮৪তম জন্মদিন। ১৯৩১ সালের এই দিনে তিনি বর্ধমানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবা আবুল হাশিম এ অঞ্চলে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন, অখণ্ড বাংলার পক্ষে কাজ করেছেন, মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের নেতা হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের মধ্যে ১৯৫০ সালে তাঁরা সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে উমর সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। পরে এই আন্দোলনের গবেষণায় তিনি পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে উমর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন ও অর্থশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন, পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

ষাটের দশকে বদরুদ্দীন উমর সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে যে লেখাগুলো লিখেছিলেন, তা ‘বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের’ পথ দেখিয়েছিল। সে সময় বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজকে শিক্ষিত ও আত্মোপলব্ধিতে সক্ষম করে তুলতে, পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে তাদের ভূমিকা নির্দিষ্ট করতে উমরের এই কাজগুলোর প্রভাব ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। ষাটের দশকের শেষ থেকে তিনি ভাষা আন্দোলন নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার কাজ শুরু করেন। কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা ছাড়াই তিনি ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ নামের বৃহৎ গবেষণা সমাপ্ত করেন।

তিন খণ্ডে এটি প্রকাশিত হয়। আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘আর কিছু দরকার নেই, উমর যদি জীবনে আর কিছু না–ও করতেন, তবু এই গ্রন্থের জন্যই তিনি বাঙালি সমাজে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’ সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত অনুসন্ধানে তাঁর গবেষণা ও লেখার পদ্ধতি অসাধারণ। এরপরও তিনি আরও অনেক কাজ করেছেন, এখনো একই রকম সক্রিয়তায় করে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে তাঁর শতাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
শুধু লেখক, গবেষক ও শিক্ষক হিসেবে উমরের যে অবদান, তার তুলনাই খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু তিনি এর মধ্যেই নিজেকে সীমিত রাখতে পারেননি। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্য দিয়ে তাত্ত্বিক হিসেবে তাঁর যে বিপ্লবী অবস্থান তৈরি হয়, তার পূর্ণতার জন্যই তিনি সমাজের বিপ্লবী রূপান্তরের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। ষাটের দশকে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে লিখতে গিয়ে আইয়ুব-মোনেম সরকারের রোষানলে পড়ে তিনি এতটুকু উপলব্ধি করেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত থেকে তাঁর পক্ষে বেশি দূর কাজ করা সম্ভব নয়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হন।

পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় রক্তচক্ষু থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্যই তিনি শিক্ষকতা ছেড়েছিলেন। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা সংস্কৃতি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। সেই পত্রিকার নিয়মিত প্রধান লেখক ছিলেন বদরুদ্দীন উমর ও সইফ-উদ-দাহার। অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ লেখা সে সময় তাতে প্রকাশিত হচ্ছিল। কয়েক সংখ্যা প্রকাশের পরই জরুরি অবস্থার কারণে সংস্কৃতি বন্ধ হয়ে যায় ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে। ১৯৮১ সালে সংস্কৃতি আবার প্রকাশ শুরু হয়। মাঝখানে অনিয়মিত হয়ে গেলেও এখনো তা প্রকাশিত হচ্ছে।

আমাদের সমাজে বুদ্ধিবৃত্তি যেন বাণিজ্যের মধ্যে বসতি গেড়েছে। বাজার, সুশীল সমাজ বা এনজিও জগৎ—এই হলো এ ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের শুরু ও শেষ। এ ধরনের লোকের কাছে বুদ্ধিবৃত্তি তাই ফরমায়েশি বা তোষণমূলক বা অর্থ উপার্জনের মাধ্যম। সুবিধাবাদিতা, লেজুড়বৃত্তি কিংবা দেউলিয়াত্ব প্রগতি চিন্তা ও রাজনীতির প্রবল শক্তিকে এখনো আটকে রেখেছে। বদরুদ্দীন উমরের মতো ব্যক্তি এ রকম সমাজে অস্বস্তির কারণ হওয়ারই কথা। বাংলা ভাষায় মার্ক্সবাদী সাহিত্য উপস্থিত করায় উমর অগ্রণী, ইংরেজিতে পূর্ব পাকিস্তানের শ্রেণি সংগ্রাম ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যা লিখেছেন, তা বাংলাদেশের সমাজ ইতিহাস নিয়ে ইংরেজি ভাষার আগ্রহী পাঠক-গবেষকদের অনেক ভ্রান্তি দূর করবে নিশ্চিতভাবেই। বাংলাদেশে শোষণ, নিপীড়ন, বৈষম্য ও সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য নিয়ে উমরের ক্ষুরধার লেখা সমাজে অধিপতি চিন্তাকে বিরতিহীনভাবে মোকাবিলা করে যাচ্ছে।

সততা, নিষ্ঠা, আপসহীনতা, দৃঢ়তা—এসব শব্দই উমরের পরিচয়ে নির্দ্বিধায় যোগ করা যায়। উমরের জীবনে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ ও মানুষের মুক্তির রাজনীতির মধ্যে কোনো প্রাচীর নেই, একে অপরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। ষাটের দশকের শেষ থেকে উমর সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন। কৃষক-শ্রমিকদের সঙ্গেও অনেক কাজ করেছেন। এ দেশে বিপ্লবী আন্দোলন সংগঠন বিস্তারে ব্যর্থতা তো বিরাট, নইলে বাংলাদেশের চেহারা ভিন্ন হতো। ব্যর্থতা না থাকলে ১৬ কোটি মানুষ নিজেদের মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করত, মানুষ ও প্রকৃতি মিলে এক অসাধারণ জীবন আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারতাম। তবে সেই ব্যর্থতা সামষ্টিক, সবারই তাতে দায় আছে।

কিন্তু উমর যেখানে সফল, সেটা হলো তিনি হার মানেননি। বাংলাদেশে এখন বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষের যে লড়াই, তা উমরের ভাষায়, ‘৭১-এর অসমাপ্ত মুক্তিসংগ্রামের জের।’ পরাজয়, আত্মসমর্পণ আর দাসত্বের শৃঙ্খল প্রত্যাখ্যান করার শক্তিই এই সংগ্রাম এগিয়ে নেওয়ার পূর্বশর্ত। জীবনের এই পর্যায়ে এসে উমর গভীর তৃপ্তি আর প্রবল অহংকার নিয়ে বলতে পারেন, তিনি আজীবন বিরামহীনভাবে এই শক্তি নিয়েই কাজ করেছেন। তিনি তাঁর যথাসাধ্য ভূমিকা পালনে কিছুমাত্র দ্বিধা বা ক্লান্তি প্রদর্শন করেননি। ৮৪তম জন্মদিনে আজীবন শিক্ষক ও যোদ্ধা বদরুদ্দীন উমরকে গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
(২০ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত)