ট্রানজিট ও কাঁটাতারের বন্ধুত্ব

671bd2e5325123ebef68f23b78c7f589 Felaniসম্প্রতি একটি গবেষণাপত্রে দেখানো হয়েছে- নয়াদিল্লি থেকে ঢাকায় ২০ ফুট একটি কনটেইনার সমুদ্রপথে নিয়ে যেতে (মুম্বাই, সিঙ্গাপুর অথবা কলম্বো হয়ে চট্টগ্রাম এবং পরে ট্রেনে ঢাকা) সময় লাগে ৩০ থেকে ৪০ দিন এবং খরচ লাগে ২৫০০ মার্কিন ডলার। এটি যদি সরাসরি দিল্লি থেকে ট্রেনে পরিবহন করা হয়, সময় লাগবে চার-পাঁচ দিন, খরচ হবে তিন ভাগের এক ভাগ, ৮৫০ মার্কিন ডলার। এছাড়া বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পণ্য পরিবহন করলে আগরতলা থেকে কলকাতা বা আসাম থেকে কলকাতার দূরত্ব যথাক্রমে ছয় ভাগের এক ভাগ ও চার ভাগের এক ভাগ দাঁড়াবে।

ভারতের জন্য এ ব্যবস্থাই পাকাপোক্ত হল ১৫ মে ২০১৬ থেকে। ‘ট্রানজিট’ নামে ভারতের পণ্যসামগ্রী বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে আবার ভারতেই নেয়ার আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা শুরু হল। ভারত থেকে রওনা হয়ে বাংলাদেশ অতিক্রম করে আবার ভারতেই প্রবেশ, ট্রানজিটের এ রকম দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যায় না। এর সঙ্গে তুলনীয় একমাত্র দেশ পাওয়া যায় দক্ষিণ আফ্রিকা ও লেসেথো। এ রকম দৃষ্টান্ত পাওয়া কঠিন হলেও এর আগে বাংলাদেশ অনেকবার ‘শুভেচ্ছাস্বরূপ’, ‘মানবিক’ কারণে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের অনুমতি দিয়েছে। তিতাস নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়েও ভারতের বিদ্যুৎ সরঞ্জাম নিতে দিয়েছে। এবারে শুরু হল শুল্ক বা মাশুলের মাধ্যমে। বিশেষজ্ঞ কমিটি এর হার নির্ধারণ করেছিল টনপ্রতি ১০৫৮ টাকা। ভারত-বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পণ্য পরিবহন করলে প্রকৃতপক্ষে তার খরচ কমবে শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ। এ খরচ কমিয়ে যে পরিমাণ লাভ হবে তাদের সেই তুলনায় টনপ্রতি ১০৫৮ টাকা অনেক কমই ছিল। তবে সরকার তা গ্রহণ করেনি, চূড়ান্তভাবে এ হার নির্ধারিত হয়েছে শতকরা ২০ ভাগেরও কম, টনপ্রতি ১৯২ টাকা। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান চেয়েছিলেন বিনা ফিতেই এসব পণ্য যেতে দিতে, তার ভাষায় এরকম মাশুল চাওয়া অসভ্যতা!

যৌক্তিক কারণেই বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট নামের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভারতের বৃহৎ পুঁজি এবং রাষ্ট্রের জন্য বহু কাক্সিক্ষত বিষয়। এতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ অঞ্চল থেকে বিপুল খনিজসম্পদ আহরণ, বাজার বিস্তার এবং সর্বোপরি ভারতের কেন্দ্রীয় শাসনের নিরাপদ ব্যবস্থা অনেকখানি নিশ্চিত হবে। এর মাধ্যমে ভারতের পূর্বাঞ্চলের জনবিন্যাস, স্থানিক বিন্যাস, অর্থনৈতিক বিন্যাসে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। ভারতের এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের যোগাযোগ খরচ ও সময় আগের তুলনায় শতকরা ১৫ থেকে ২৫ ভাগে নেমে আসবে। সুতরাং এটা ভারতের জন্য, বৃহৎ কর্পোরেট গোষ্ঠীর জন্য একটি বড় ঘটনা। সন্দেহ নেই, মূলধন সংবর্ধনে এটি এক বড় উলম্ফন ঘটাবে।

তবে এতে বাংলাদেশের ক্ষতির চেয়ে লাভ বেশি, না লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি, তা দেশবাসীর সামনে পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করার কোনো প্রয়োজনই সরকার বোধ করেনি। শুধু আমরা শুনতে থাকি, এতে বাংলাদেশের বিপুল লাভ হবে, কানেক্টিভিটি বাড়বে, ট্রাকচালকরা খাবার কিনবে, যাত্রীরা থাকবে- ঘুরবে, আমাদের রাস্তা-বন্দর কত কত ব্যবহারের সুযোগ পাবে, এতে অবকাঠামোর উন্নতি হবে ইত্যাদি! এগুলো সবই ‘বাইপ্রোডাক্ট’। ভারত দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে তাদের কর্তৃত্বে, তাদের জিনিসপত্র কিনে, তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী বাংলাদেশের রেল ও সড়কপথ, বন্দর উন্নয়নের জন্য। একেই বাংলাদেশের বিরাট অর্জন হিসেবে বলেন অনেকে! কিন্তু অবকাঠামোর নতুন বিস্তার করতে কতটা কৃষিজমি, জলাশয়, অরণ্য যাবে, সেটার হিসাব জনগণের জানা নেই। সড়ক, রেল ও নৌপথে ভারতের পণ্য পরিবহন পুরোদমে শুরু হলে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ কীভাবে হবে তারও হিসাব নেই।

অনেকে এ ধরনের যোগাযোগকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তুলনা করেন। প্রথমত, এ যোগাযোগ ভারত থেকে ভারতে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে এ রকম কোনো ঘটনা নেই, যেখানে এক দেশ দ্বিতীয় আরেক দেশের মধ্য দিয়ে নিজ দেশেই আবার যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ইউরোপের প্রতিটি দেশের সঙ্গে প্রতিটি দেশের স্বার্থ স্বচ্ছ চুক্তির মাধ্যমে সুরক্ষিত। সব সিদ্ধান্ত ও চুক্তি বহুল আলোচনা এবং বিতর্কের মাধ্যমে গৃহীত। এখানে তার কোনো লক্ষণ নেই। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের তুলনায় ভারত যে ক্ষমতা ও সুবিধা ভোগ করে, যে ভারসাম্যহীন ক্ষমতার সম্পর্ক, সে রকম অবস্থা কোনো দু’দেশের মধ্যে সেখানে নেই। আগেই বলেছি, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যা ঘটছে তা আসলে একমাত্র কিছুটা তুলনীয় হতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকা দিয়ে চারদিকে ঘেরাও থাকা দেশ লেসোথোর সঙ্গে। সেই অভিজ্ঞতা তিক্ত।

বাংলাদেশে ভারত থেকে গরু, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, চিনি, সার, কীটনাশক, ফেনসিডিল, কাপড়, প্রসাধনী, সিডি, রঙ, চাল, ওষুধ- প্রায় সবকিছুই আসে বৈধ ও চোরাচালানি দুই পথেই। বাস, ট্রাক, গাড়ি, অটোরিকশা, টায়ার-টিউব, যন্ত্রপাতি তো আছেই। বাংলাদেশ থেকে তেলসহ আমদানিকৃত অনেক পণ্যই চোরাচালানির মাধ্যমে ভারতে যায়। আশির দশকে ভারতে ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ ছিল। সে সময় বাংলাদেশ থেকে ক্যাসেট প্লেয়ার, রেডিও ইত্যাদি ধরনের অনেক পণ্য ভারতে চালান হতো। এখন এগুলো কম। চোরাইপথে আরও যায় ইট, তৈরি পোশাক, ওষুধ, সার, চাল। নারী-শিশু পাচারও চোরাই বাণিজ্যের অন্যতম দিক।

বলা হচ্ছে, কানেক্টিভিটির মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি কমবে। আকার, আয়তন ও ক্ষমতা-সব দিক থেকেই অনেক বড় অর্থনীতির দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি থাকতেই পারে। সমস্যাটা বাণিজ্য ঘাটতির নয়, সমস্যা ভারসাম্যহীন প্রবেশাধিকারের। বাংলাদেশে ভারত আইনি ও বেআইনি পথে সব ধরনের পণ্য নিয়ে আসতে পারে; কিন্তু ভারতের বাজারে বাংলাদেশ যেসব পণ্য নিয়ে যেতে সক্ষম, সেগুলোর প্রবেশে নানা রকম শুল্ক-অশুল্ক বাধা তৈরি করে রাখা হয়েছে। এসব প্রতিবন্ধকতা না থাকলে বাংলাদেশের পক্ষে ভারতে রফতানি বর্তমানের দ্বিগুণ করা সম্ভব হতো।

অনেকের ধারণা, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের আধিপত্য হ্রাস করার জন্য ভারতের সমর্থন দরকার। আবার কারও কারও মতে, ভারতের আধিপত্য দূর করতে চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রয় নিতে হবে। দুটো ধারণাই বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার গতি ও ব্যাকরণ সম্পর্কে খণ্ডিত বা ভ্রান্ত ধারণা থেকে উদ্ভূত। বাংলাদেশে জল, জমি, জঙ্গল, বাজার দখলে পুঁজির আগ্রাসনে তিন দেশই নানাভাবে সক্রিয়, এখানে দেশ ভাগ করা কঠিন। তিন দেশের পুঁজিতেই তিন দেশের যুক্ততা আছে। সামরিক বা কৌশলগত বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মধ্যে কিছু কিছু বিরোধ থাকলেও তা সাময়িক এবং সেগুলোর খুব দ্রুত নিরসনের সম্ভাবনা বেশি। এই তিনটি দেশই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সক্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। তারা কেউ যে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষার জন্য অন্য দেশের সঙ্গে বিরোধে জড়াবে না তা বলাই বাহুল্য। তাদের ঐক্য ও লড়াই দুটোই বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক হুমকি হতে পারে।

বাংলাদেশের সড়ক, রেল, নৌপথসহ বাণিজ্য ও অর্থনীতির বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব এখন আরও মজবুত হচ্ছে। এটি এখন যত নিশ্চিত ও স্থিতিশীল, ততটা ইতিহাসের কোনো সময়েই ছিল না। কারণ বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পক্ষই নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকার জন্য ভারতের শাসকশ্রেণীর সিদ্ধান্তকেই নির্ধারক মনে করছে। যুক্তরাষ্ট্র-ভারতকেন্দ্রিক আঞ্চলিক কৌশল আরও স্পষ্ট রূপ নেয়ায় এটি এখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। তার ফলে নিজেদের গোষ্ঠীগত স্বার্থে সার্বভৌমত্ব ও জনস্বার্থ ভারতের পক্ষে সমর্পণ করায় রীতিমতো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে দুই পক্ষ। এর ফলে ভারতের বৃহৎ পুঁজির অগ্রযাত্রা গতি পেলেও বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমান্বয়ে নাজুক হচ্ছে।

কানেক্টিভিটির কথা বললেও বাংলাদেশকে তিন দিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ডিসকানেক্ট করে রেখেছে ভারত। শুধু তা-ই নয়, ‘কানেক্টিভিটির’ এই কালে অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীগুলোর অবাধ পানিপ্রবাহকেও ডিসকানেক্ট করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক নদীর পানি মানবিকতা বা দয়াদাক্ষিণ্যের বিষয় নয়, আন্তর্জাতিক আইনস্বীকৃত অধিকার, যা থেকে দশকের পর দশক বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে ভারত। সুন্দরবনবিনাশী প্রকল্পের মাধ্যমে সর্বনাশ করতে উদ্যত হয়েছে দু’দেশের সরকার। কাঁটাতারের পেছনে বড় যুক্তি, বাংলাদেশ থেকে সন্ত্রাসী-জঙ্গির ‘অবাধ চলাচল’ ঠেকানো। বাংলাদেশের সন্ত্রাসীদের থেকে ভারতকে নিরাপদ করাই যদি কাঁটাতারের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে সেই সন্ত্রাসের ভূমি দেশের মধ্য দিয়ে ভারতের পণ্য ও যাত্রীবাহী যান চলাচল কীভাবে নিরাপদ হবে? কে নিশ্চয়তা দেবে? এই কাঁটাতার রেখে, নদী আটকে রেখে, সুন্দরবন ধ্বংস করে বন্ধুত্ব আর কানেক্টিভিটি কীভাবে সম্ভব, সেই প্রশ্নের সুরাহা হয়নি। কিংবা এই ‘বন্ধুত্ব’ আর অধস্তনতার তফাত কী, সে প্রশ্নেরও ফয়সালা হয়নি।

[লেখাটি ২৮ জুন ২০১৬ তারিখে দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত]