জনপন্থী আর পুঁজিপন্থী রাজনীতির কথা

এবারের নির্বাচনে বামপন্থী কয়েকটি দলের জোট ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’-এর প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কাস্তে, কোদাল ও মই প্রতীক নিয়ে। এই প্রার্থীদের মধ্যে নবীনেরাই প্রধান। গত কয় দশকে জনস্বার্থে বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রামে আমরা তাঁদের সক্রিয় দেখেছি। সাম্প্রতিক কালে রামপালসহ সুন্দরবন বিনাশী বিভিন্ন প্রকল্প বাতিল, দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে, ক্রসফায়ার, গুমখুনসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, শিক্ষার অধিকার, শ্রমিকদের অধিকার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলনে তাঁরা ছিলেন অগ্রণী। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে কিশোরতরুণদের পাশেও তাঁরাই ছিলেন সোচ্চার।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত একই অবস্থা: অবিরাম হামলা, মামলা, হুমকি আর নিয়ন্ত্রণের কারণে নির্বাচন ঘিরে উৎসবের বদলে চারদিকে ভয়ের পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ কারণে প্রার্থীদের প্রচার বাধাগ্রস্ত, নিরাপদে, নির্ভয়ে নাগরিকদের ভোট প্রদানের বিষয়টিও অনিশ্চিত। সরকারি দলের হুমকিহামলার শিকার হয়েছেন বামপন্থী দলের প্রার্থী ও কর্মীরাও। তবে বামপন্থী নামে পরিচিত কয়েকটি দলের প্রার্থীরা সরকারি দলের প্রতীক ও নেতাদের ছবি নিয়ে নির্বাচন করছেন। তাঁদের প্রচার অবশ্য ভালোমতোই চলেছে।

বাংলাদেশে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে পরস্পরবিরোধী দুটো সমালোচনা শোনা যায়। কখনো শোনা যায় বামপন্থীরা আওয়ামী লীগপন্থী। আবার ঠিক উল্টো অভিযোগও আসে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। তাদের কথা, বামপন্থীরা বিএনপির পক্ষে কাজ করছে। আসলে সত্য কী?

বামপন্থী হিসেবে পরিচিত কয়েকটি দল এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট হিসেবে আছে। তাদের দৃষ্টান্ত হিসেবে হাজির করেই গড়ে বামপন্থীদের কথা উল্লেখ করা হয়। আবার যেসব বামপন্থী দল সরকারের জনবিরোধী নীতি, তৎপরতা, চুক্তি, দুর্নীতি-দমন-পীড়ন ইত্যাদির বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে লড়াই করে, আওয়ামী সমর্থকেরা তাদেরই বিএনপি বলে কুৎসা করে আরাম পান। একই ভূমিকার জন্য বিএনপি–জামায়াত আমলে তাদের আওয়ামীপন্থী বলে কুৎসা করা হতো।

প্রকৃতপক্ষে বামপন্থী নামে পরিচিত হলেও, বিপ্লবের কথা বা সমাজতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি কাগজপত্রে থাকলেও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের অংশীদার হিসেবে যখন কোনো ‘বামপন্থী’ নামে পরিচিত ব্যক্তি বা দলের অবস্থান দেখা যায়, যখন তারা দেশের ব্যাংক ডাকাত, বন-নদী দখলকারী, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সহযোগী হিসেবে সক্রিয় থাকে, তখন বামপন্থী ধারণার মধ্যেই জটিলতা সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের মতো বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এ ধরনের ঘটনা আছে। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট পুঁজিপন্থী অবস্থান নিয়ে এখন জননিন্দিত। ইউরোপেও বামপন্থী কোনো কোনো দলের মধ্যে পুঁজিপন্থী ঝোঁক স্পষ্টতই দেখা যায়।

বাংলাদেশে সামরিক শাসনসহ বিভিন্ন জটিল রাজনৈতিক পর্বে বামপন্থীদের বিভিন্ন নেতার বৃহৎ দলে যোগদান কিংবা বিভিন্ন মাত্রায় বৃহৎ পুঁজিপন্থী দলগুলোর কারও না কারও লেজুড়বৃত্তির লাইন কেউ কেউ গ্রহণ করায় সমাজে পরিচয়ের বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন ধাপে দল ও আদর্শ ত্যাগ করায় এখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাদের মধ্যে সাবেক বামপন্থীদের সমাবেশ দেখা যায়, যাঁদের বিভিন্ন জনবিরোধী ক্রিয়াকলাপ সমাজে ‘বামপন্থী’দের কাজ হিসেবেই নিন্দিত।

বামপন্থী বা সমাজতন্ত্রীদের মূল ভূমিকা হওয়ার কথা সব রকম বৈষম্য, নিপীড়ন ও আধিপত্য থেকে মুক্ত একটি সমাজের জন্য লড়াই করা, সেই লক্ষ্যে বিদ্যমান অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করা। আর ডানপন্থী বলতে বোঝায় সেই মত বা চিন্তা, যা নির্দিষ্ট ধর্ম ও জাতি–পরিচয়ের পক্ষে অন্যান্য ধর্ম ও জাতির ওপর নিপীড়ন ও বৈষম্য সমর্থন করে। সাম্প্রদায়িকতা, জাতিবিদ্বেষ, লিঙ্গীয় বৈষম্য তাই তাদের মজ্জাগত। পুঁজির কেন্দ্রীভবনের পক্ষে মুনাফাকেন্দ্রিক উন্নয়ননীতি তাদের আদর্শ। এ কারণে প্রাণ, প্রকৃতি, মানুষ বিনাশে তাদের কোনো দ্বিধা নেই, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে যুদ্ধ-সন্ত্রাস-হামলা-আগ্রাসন-ধ্বংসমুখী নীতিই তাদের রাজনীতি।

সে জন্য বামপন্থী-ডানপন্থী পরিচয়ের চেয়ে বরং আমরা যদি রাষ্ট্রনীতি মতাদর্শিক ভিত্তিতে দুটো ধারাকে যথাযথভাবে শনাক্ত করতে চাই তাহলে বরং নাম হওয়া দরকার জনপন্থী ও পুঁজিপন্থী। বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে জনপন্থী রাজনীতিকে যেসব বৈশিষ্ট্য নিয়ে দাঁড়াতে হবে সেগুলো হলো: প্রথমত, এই রাষ্ট্রের কাঠামোতে বসবাসরত সব জাতি, ভাষা ও ধর্মের মানুষদের স্বীকৃতি, জাতি-ধর্ম-শ্রেণি ও লিঙ্গীয় বৈষম্য-নিপীড়নবিরোধী অবস্থান নিশ্চিত করা, সবার মুক্তির লড়াইয়ে শামিল থাকা; দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ভারতের বৈশ্বিক আঞ্চলিক আধিপত্যের নানা আয়োজন থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত রাখা। তৃতীয়ত, ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, আফগানিস্তান, পাকিস্তানসহ এই অঞ্চলের নিপীড়িত জনগণের সঙ্গে সংহতির ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক দক্ষিণ এশিয়ার জন্য অগ্রসর হওয়া; চতুর্থত, সব প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সর্বজনের মালিকানা প্রতিষ্ঠা; পঞ্চমত, মানুষ ও পরিবেশকে কেন্দ্রে রেখে, সামাজিক মালিকানাকে গুরুত্ব দিয়ে, শিক্ষা–চিকিৎসায় সর্বজনের অধিকার নিশ্চিত করে উন্নয়নের নতুন পথনকশা প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়নের লড়াই এবং ষষ্ঠত, সব পর্যায়ে সর্বজনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা।

বামপন্থী সম্পর্কে সমাজে বেশ কিছু ধারণা বা সমালোচনা জারি আছে। এগুলোর অনেকটাই উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়ানো। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো বামপন্থীরা ধর্মবিশ্বাসী নয়, তারা নাস্তিক। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এই অভিযোগ তুলেই বামপন্থীদের খারিজ করার চেষ্টা হয়। ধর্মীয় বিভিন্ন সমাবেশে এসব সমালোচনা বেশি হলেও ধর্মচর্চার সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীও বামপন্থীদের দ্বারা আক্রান্ত বোধ করলে, এসব অভিযোগ পাল্টা আক্রমণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।

জমি, মজুরি, নারী অধিকার, পরিবেশ, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা, শ্রমিকের নিরাপত্তা, শিক্ষার্থীর অধিকার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বামপন্থীরা যখন সক্রিয় হয়, তখনই প্রতিপক্ষের মুখে এসব অভিযোগ বেশি শোনা যায়। বাংলাদেশের পুঁজিপন্থী বিভিন্ন দলের নেতার মুখে অভিযোগ, বামপন্থীরা ইসলাম ও মুসলমানবিদ্বেষী। ভারতের বিজেপিসহ হিন্দু কট্টরবাদীদের অভিযোগ, বামপন্থীরা হিন্দু দেবদেবী মানে না, তারা শুধু মুসলমানদের স্বার্থ দেখে। ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী শাসকদের প্রচার হলো বামপন্থীরা ইহুদিবিরোধী। খ্রিষ্টান কট্টরপন্থীদেরও অভিযোগ, বামপন্থীরা নাস্তিকতা প্রচার করে। কিন্তু ভারতসহ সারা দুনিয়ায় মুসলমানেরা যেখানে যেখানে সংখ্যালঘিষ্ঠ, সেখানে সেখানে তাদের পক্ষে, তাদের ওপর নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সেই সেই দেশের বামপন্থীরাই শক্তভাবে দাঁড়ায়। একইভাবে বাংলাদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা বরাবর সোচ্চার।

তার মানে ধর্মপরিচয় নয়, যেকোনো ধর্ম ও জাতির মানুষ নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হলে এর বিরুদ্ধে বামপন্থীদেরই পাওয়া যায়। ধর্মবিরোধিতা বা ধর্মবিদ্বেষ বামপন্থীদের লক্ষ্য নয়, শোষণ–পীড়ন–বৈষম্য আধিপত্যের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের লড়াই দানা বাঁধলে ধর্মকে বর্ম হিসেবে হাজির করে ডানপন্থীরা। মাওলানা ভাসানী বাংলাদেশের মুক্তির আন্দোলনের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যিনি বামপন্থীদের নেতা ছিলেন। এ রকম অনেক মানুষ বাম আন্দোলনে আছেন, যাঁরা দেশের শোষক–নিপীড়ক আর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে ধর্মের কাজই মনে করেন। নিপীড়কের ধর্ম আর নিপীড়িতের ধর্ম যে আলাদা, সেটাই এখানে স্পষ্ট হয়।

পুঁজিপন্থী দলগুলোর নেতাদের মতো প্রকৃত জনপন্থীরা উন্নয়নের নামে লুণ্ঠন বা প্রাণ, প্রকৃতির বিপর্যয় বা স্বৈরতন্ত্রী ব্যবস্থা সমর্থন করবে না। তারা চোরাই টাকা, সাম্প্রদায়িকতা, গুম–খুন, দেশের সম্পদ লুট ও পাচার, জাতি-ধর্ম-লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেবে। কতিপয় দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর অর্থ বানানোর জন্য দেশের সর্বনাশকে তারা উন্নয়ন বলার বিরোধিতা করবে, তারা দেশকে মানুষের বাসযোগ্য ভূমি বানাবে, বর্তমান শিশু-কিশোর–তরুণদের জন্য নিরাপদ সম্মানজনক ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে। পুঁজিপন্থী রাজনীতির বিপরীতে জনপন্থী রাজনীতির স্বাতন্ত্র্য যত স্পষ্ট হবে, তত তাদের জনভিত্তিও শক্তিশালী হবে এবং প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদের ধারণ করার মতো নতুন রাজনীতিরও বিকাশ স্পষ্ট হবে।

(30 ডিসেম্বর 2018 তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত)