জনগণের ওপর নতুন বোঝা, অর্থনীতির ক্ষরণ

কদিন আগে বিবিসির উপস্থাপক খবরে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি বিষয়ে আমার মন্তব্য প্রচারের সময় পরিচয়ে বললেন, ‘যিনি বরাবরই তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির বিরোধিতা করেন।’ শুনে খটকা লাগল। সব সময় বিরোধিতা মানে তো যুক্তি-অযুক্তির বিষয় নয়, গোঁয়ার্তুমি। এটা ঠিক নয়। মূল্যবৃদ্ধি যদি যৌক্তিক হয়, যদি এর মধ্য দিয়ে অর্থনীতির শক্তি বাড়ে, তাহলে তা অবশ্যই মেনে নেওয়া উচিত।
গ্যাস, তেল, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি আমরা মেনে নিতে পারি দুই কারণে। এক. যদি চুরি, দুর্নীতি বা জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি ছাড়া যৌক্তিকভাবে উৎপাদন খরচ বাড়ে; দুই. যদি বর্ধিত দাম থেকে প্রাপ্ত অর্থ জাতীয় সক্ষমতা এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আরও টেকসই আকারে আমাদের কাছে ফেরত আসে। উৎপাদন খরচ কম থাকলেও বর্ধিত দাম দিতে নাগরিক হিসেবে আমরা রাজি হতে পারি, যদি দেখি তা দিয়ে জাতীয় সক্ষম একটি ভিত্তি নির্মাণ করা হচ্ছে, যার ফলে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের মানুষই লাভবান হবে। কিন্তু যদি দেখি এই দুটোর একটিও নয়, যদি আমরা দেখি দাম বাড়ানো হচ্ছে জনগণ ও অর্থনীতিকে বিপদগ্রস্ত করে কতিপয় গোষ্ঠীর পকেট ভরার জন্য, দীর্ঘ মেয়াদে এই খাত আরও ক্ষতিগ্রস্ত করতে, তাহলে এই মূল্যবৃদ্ধি কেন আমরা মানব? অর্থনীতির ক্ষরণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেব না কেন?
গত ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। কমিশন গত ফেব্রুয়ারি মাসে তার এখতিয়ার অনুযায়ী তিন দিন ধরে গণশুনানি করেছে। সেই গণশুনানিতে প্রমাণিত হয়েছে বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। এখান থেকে কমিশনের একমাত্র যৌক্তিক সিদ্ধান্ত আসে মূল্যবৃদ্ধির জন্য আনা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান। কমিশন সরকারকে সেই সঙ্গে উপদেশ দিতে পারত আন্তর্জাতিক বাজারে যেভাবে তেলের দাম কমে গেছে, তার দিকে নজর দিয়ে দেশে তেলের দাম কমাতে। কমিশন আরও বলতে পারত ‘গ্যাস উন্নয়ন তহবিল’ নিয়ে লুকোচুরি না করতে। না, কমিশন এসব কিছুই বলেনি। আইন অনুযায়ী কমিশনের সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা গণশুনানির তিন মাসের মধ্যে। কমিশন তা-ও দেয়নি। সাত মাস পরে হঠাৎ সাংবাদিকদের সামনে কমিশন হাজির হয়েছে পুরো উল্টো সিদ্ধান্ত নিয়ে। বলছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর কথা। স্পষ্টতই এটি সরকারের পূর্ব সিদ্ধান্ত।
তাহলে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের দরকার কী? কেন ধুমধাম করে গণশুনানি? কিছু লোক পোষা কি শুধু জনবিরোধী সিদ্ধান্ত জায়েজ করতে? আন্তর্জাতিক বাজারে গত কয়েক বছরে তেলের দাম বাড়েনি বরং কমেছে, কমছে। কিন্তু এই সময়কালে বাংলাদেশে তেলের দাম কমানো হয়নি। ব্যারেলপ্রতি বিশ্ববাজারে তেলের দর যখন ১২০ ডলার ছিল, তখন লিটারপ্রতি আমাদের বাজারে তেলের দাম ছিল ফার্নেস অয়েল ৬০ টাকা এবং ডিজেল ৬৮ টাকা। বিশ্ববাজারে সেই তেলের দাম ক্রমেই কমেছে গত এক বছরেরও বেশি সময় এবং এখন প্রায় ৪০ ডলারে নেমে এসেছে। অর্ধেকেরও কম। অথচ এখানে তেলের দাম অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। দাম বাড়লে ‘সমন্বয়’ হয়, কমলে হবে না কেন? বাংলাদেশে লাফিয়ে লাফিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে। উচ্চব্যয়ের ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুতের বোঝা সৃষ্টির কারণে। যেহেতু আমদানি করা তেলের দাম কমেছে, সেহেতু এখানেও উৎপাদন ব্যয় অনেক কমানো সম্ভব। বিদ্যুতের দাম কমানোর পক্ষে সব তথ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সরকার করল মূল্যবৃদ্ধি।
সরকার থেকে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে আগের বছরগুলোর লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার জন্য তেলের দাম কমানো হয়নি। প্রথমত, যে বছরগুলোতে লোকসান দেখানো হয়েছে, সেখানেও অনেক বছরে সরকারের আদায়কৃত শুল্ক হিসাব করলে লোকসান থাকে না। দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতার পর এত দিনে কোনো রিফাইনারি করা হয়নি। সে জন্য পরিশোধিত তেল আমদানি করতে গিয়ে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়। তৃতীয়ত, তেলের দাম না কমিয়ে সরকার তার আয় বাড়াচ্ছে। ২০১৩-১৪ সালে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত তেল আমদানিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তেল আমদানিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। বছরেই বাড়তি থেকেছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এই সময়ে সরকার তেলের দাম কমিয়ে তা কার্যকর করলে বিনিয়োগ, উৎপাদনশীলতা, পরিবহন ও জীবনযাত্রায় যে প্রভাব পড়ত, তা এর চেয়ে অনেক বেশি হতে পারত। তেলের দাম হ্রাস পাওয়ার সুফল অর্থনীতিতে দেওয়ার সুযোগ সরকার গ্রহণ করেনি। সরকারের কোষাগারে আয় বেড়েছে, সেই আয় কোথায় যাবে কে জানে।
গণশুনানিতে পরিষ্কার হয়েছে, গ্যাসের বর্তমান দামেই সব প্রতিষ্ঠান লাভজনকভাবে চলছে। ছয় বছর আগে ২০০৯ সালেও প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক ছিল, যখন গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়, পরে আরেকবার সিএনজির দাম। তখন গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে এই যুক্তিতে যে এই বর্ধিত আয় দিয়ে ‘গ্যাস উন্নয়ন তহবিল’ করা হবে এবং তা দিয়ে দেশের জাতীয় সংস্থাকে বিকশিত করা হবে, জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানো হবে। অথচ জনগণের ওপর বাড়তি বোঝা চাপিয়ে যে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল করা হলো, সেই টাকার কোনো হিসাব নেই। কে তা নিয়ন্ত্রণ করবে, সেই নিয়ে চলছে নানা খেলা। ইতিমধ্যে জনগণের দেওয়া বর্ধিত অর্থ দিয়ে এই তহবিলে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা জমা হয়েছে। প্রতিবছর গ্যাস খাত থেকে সরকার রাজস্ব পায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা, উন্নয়ন তহবিলে আসে সুদসহ এক হাজার কোটি টাকা। পেট্রোবাংলাসহ বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে এফডিআর হিসেবে অলস পড়ে থাকে। অথচ টাকার অভাবের কথা বলে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির বদলে তা সংকোচনেরই ভূমিকা নিয়েছে সরকার। বাপেক্সকে বাদ দিয়ে দ্বিগুণ খরচে রুশ কোম্পানি গাজপ্রমকে কাজ দিয়েছে। বাপেক্সকে বানাচ্ছে এখন সাব-কন্ট্রাক্টর। বিদেশি কোম্পানিকে গ্যাসক্ষেত্র দেওয়া হচ্ছে, তাদের কাছ থেকে উচ্চ দামে গ্যাস কেনা হবে, আর বাপেক্স কম পয়সায় তাদের সব কাজ করে দেবে। সমুদ্রবক্ষের গ্যাসসম্পদ উজাড় করে তুলে দেওয়ার মতো চুক্তি করা হচ্ছে।
সরকারের লোকজন আরও কিছু যুক্তি দিচ্ছেন। যেমন বাংলাদেশে গ্যাসের দাম পৃথিবীর মধ্যে সর্বনিম্ন। সুতরাং এর দাম বাড়ানো দরকার। সঙ্গে এটাও বলতে পারতেন এই দেশে মজুরি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কম, তা বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আনতে হবে। না, তা তাঁরা বলবেন না। দুই পণ্যে দুই নিয়ম কেন? আসলে অন্য দেশের পণ্যের দামের সঙ্গে তুলনা করে দেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম নির্ধারিত হয় না। নির্ধারিত হয় উৎপাদন খরচের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে। তেলের দাম সেই কারণে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম। যেমন নরওয়েতে ব্যারেলপ্রতি দাম ৯ মার্কিন ডলারের বেশি, নাইজেরিয়াতে ২ দশমিক ২৬, আবার সৌদি আরবে শূন্য দশমিক ৪৫, ভেনেজুয়েলায় শূন্য দশমিক ০৪ ডলার, ইরানে ১ দশমিক ৪২, চীনে ৪ দশমিক ৬৮। বাংলাদেশে গ্যাসের উৎপাদন খরচ কম। সেই কারণে দামও কম।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে গ্যাসের উৎপাদন বা উত্তোলন খরচ আরও অনেক কমানো সম্ভব। এখন বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলনে ঠেলেঠুলে বিদেশি সংস্থার অংশীদারত্ব অর্ধেকেরও বেশি বানানো হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সরকার যখন হাজার ঘনফুট গ্যাস কেনে ২৫ টাকায়, তখন বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে কেনে কমপক্ষে ২৫০ টাকায়। বর্তমানে দেশি আর বিদেশি থেকে কেনার গড় হিসাব করলে দাম দাঁড়ায় হাজার ঘনফুটপ্রতি ১৩৭ দশমিক ৫০ টাকা। অথচ বাংলাদেশি সংস্থা পায় মাত্র ২৫ টাকা। সেই ২৫ টাকা দিয়েও তারা লাভজনক। কিন্তু শতভাগ গ্যাসক্ষেত্র যদি বাংলাদেশের হাতে থাকত এবং যদি জাতীয় সংস্থার গ্যাসের দাম চার গুণ বাড়িয়ে ১০০ টাকাও করা হতো, তারপরও উৎপাদন খরচ বর্তমানের তুলনায় কম হতো, আরও কম দামে গ্যাস দেওয়া যেত। এই অবস্থায় দাম কমা সত্ত্বেও চার গুণ দাম পেয়ে জাতীয় সংস্থার সক্ষমতা অনেক বেড়ে যেত, সেখানকার বিশেষজ্ঞসহ সবার কাজের সুবিধা, বেতন-ভাতা, যন্ত্রপাতি—সব দিকেই বড় উল্লম্ফন ঘটানো সম্ভব হতো। জাতীয় সক্ষমতার বিকাশের সম্ভাবনা কার্যকর করে বঙ্গোপসাগরের বিশাল সম্পদ শতভাগ দেশের কাজে লাগানো যেত। না, সে পথে যাবে না সরকার। ১০/২০/৩০ গুণ বেশি দাম দিয়ে হলেও বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে নিজেদের গ্যাস কিনতে হবে, ভর্তুকি দিতে হবে আর কয় দিন পরপর তার দাম বাড়াতে হবে। এটাই বর্তমান উন্নয়ন পথ!
আমি একমত যে ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য সিএনজির দাম বাড়ানো উচিত। চুলার গ্যাস অপচয় কমানোর জন্য মিটার বসানো উচিত। ক্যাপটিভ বিদ্যুতের জন্য গ্যাসের সরবরাহ শর্তসাপেক্ষ হওয়া উচিত। কিন্তু পাইকারিভাবে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্দেশ্য তো এসব নয়, উদ্দেশ্য দেশি-বিদেশি জ্বালানি ব্যবসায়ীদের জন্য রাস্তা তৈরি, সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবসার সম্ভাবনা বাড়ানো।
জনগণের জন্য এখন ফলাফল কী? ইতিমধ্যে বাস ও সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া বাড়ার আয়োজন চলছে। বাসাভাড়া, পরিবহন ব্যয়, বিনিয়োগ ব্যয়, উৎপাদন ব্যয়—সবই বাড়বে। জীবনযাত্রার ব্যয়ের নতুন বোঝা ঘাড়ে বইতে বইতে জনগণ সরকারের উন্নয়নের হাসি দেখবে।
(০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত)