‘উন্নয়নের’ রোল মডেল ও বাজেট

উন্নয়ন বলতে বোঝায় বিদ্যমান সম্পদ ও সক্ষমতাকে বাড়ানো, জীবনকে আরও সহজ, আরামদায়ক ও নিরাপদ করা, জ্ঞান বিদ্যা যোগাযোগ বিনোদনের জগৎ প্রসারিত করা। যদি দেখা যায় সম্পদ ও সক্ষমতা আরও বিপর্যস্ত হচ্ছে, যদি দেখা যায় জীবন আরও কঠিন, অনিশ্চিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে, যদি দেখা যায় চারপাশের জগৎ আরও বিপর্যস্ত হচ্ছে, তাহলে তাকে কি আমরা উন্নয়ন বলতে পারি?

সরকারের মুখে এখন হরদম শুনি ‘বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল’, আর চোখের সামনে দেখি নিমতলী-চুড়িহাট্টা থেকে বনানী, সড়ক থেকে ভবন, কারখানা থেকে অফিস, পথঘাট, সড়ক পরিবহন সর্বত্রই মৃত্যুকূপ। মুনাফা ও মূলধন সংবর্ধনের উলঙ্গ প্রক্রিয়াকে পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ায় কীভাবে মানুষের জীবন ও সম্পদ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়Ñ এসব ঘটনা তারই প্রকাশ। কোনোটাই ছক থেকে বাইরে যায় না। ঘটনা ঘটার পর ভাঙাচোরা উদ্ধারকাজ, হুমকি-ধমকি, কমিটি গঠন, রিপোর্ট প্রকাশে অঙ্গীকার এবং আবার সবকিছুর অন্ধ গহ্বরে প্রবেশ। প্রতিদিন সড়কে মানুষের লাশ, বছরে পাঁচ থেকে সাত হাজার। প্রবাসী শ্রমিকের লাশ দুই থেকে তিন হাজার। এবারের বাজেট এসব বিষয়ে কোনো পরিবর্তনের পথ দেখায়নি।

খাল-বিল, খোলা জায়গা ভরাট করে, দখল করে বহুতল ভবন উঠেছে অনেক। গত বছর রাজউক ঢাকা শহরে এক অনুসন্ধান চালিয়ে দুই লাখ ভবনের মধ্যে প্রায় দেড় লাখ ভবন ত্রুটিযুক্ত পেয়েছিল। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ২০১০ সালে হাইকোর্ট সরকারকে এক বছরের মধ্যে ‘ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি’ প্রতিষ্ঠা করে সারা দেশে তার মাধ্যমে সব নির্মাণকাজ তদারকির নির্দেশ দিয়েছিল। হয়নি। বছরের পর বছর সরকারি প্রতিষ্ঠান তার দায়িত্বের উল্টো কাজ করে যাচ্ছে। জনগণের ওপর নজরদারি বাড়ানোর জন্য শত হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করলেও কারখানা, ভবন, সড়কসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিধানের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নেই, সরঞ্জাম নেই, লোকবলের অভাব কাটে না। বর্তমান বাজেটেও এসব ক্ষেত্রে যথাযথ বরাদ্দ নেই।

বাংলাদেশের প্রাণ হলো নদী, দখল দূষণে অনেকগুলোই হয় ড্রেন নয়তো হাওয়া। ২০০৯ সালে ঢাকার চারপাশের নদ-নদী দখল রোধে হাইকোর্ট ১২ দফা নির্দেশনাসহ রায় জারি করে। ২০১১ সালে অন্য এক রায়ে হাইকোর্ট বুড়িগঙ্গায় বর্জ্য নিঃসরণ বন্ধ করতে নির্দেশ দেয়। টুকটাক উদ্যোগ নিলেও বাস্তবে এত বছরে এগুলো বাস্তবায়নের ব্যাপারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বোঝা যাচ্ছে, এসব আদেশ ঝুড়িতে ফেলে দিলে কিছুই আসে যায় না। বাজেট এ বিষয়ে নতুন কিছুই হাজির করেনি।

ঢাকার বায়ুদূষণ বিশ্বরেকর্ড করেছে। সব মাপকাঠিতে ঢাকার বায়ুদূষণ মাত্রাতিরিক্ত, বিশে^ সবচেয়ে খারাপ অবস্থায়। একদিকে অনিয়ন্ত্রিত ইটের ভাটা, পুরনো গাড়ি, বর্জ্য, অন্যদিকে গাছপালা কমে যাওয়া, মরা বা বিষাক্ত নদী, উধাও খাল, দখল করা খোলা জায়গা এই অবস্থা তৈরি করেছে। এর ফলাফল এক দিনে বোঝা যায় না, ফুসফুস, হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্কসহ মানুষের শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এই বিষে জর্জরিত হচ্ছে, শিশুরা শৈশব থেকেই বিষ নিয়ে বিকলাঙ্গ হওয়ার পথে। অসুখ-বিসুখ বেড়ে চিকিৎসাব্যয় বাড়ছে, জীবনীশক্তির ক্ষয় হচ্ছে। যে ধারায় ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে এই বিষাক্ত যাত্রা তারই ফল। বিশুদ্ধ নিরাপদ বাতাস, নিরাপদ পানি, নিরাপদ খাবার, নিরাপদ জীবনÑ সবই এখন নাগরিকদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। বাজেট এসব বিষয়ে নীরব

২০০৯ সালের শুরুতে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। বাজেট ঘোষণার আগে আগে খেলাপি ঋণ লাখো কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। আর মুছে ফেলা বা অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ এখন প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা। তার মানে ব্যাংক খাতের প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার খবর নেই। এর সমাধান হিসেবে অর্থমন্ত্রী খেলাফিদের আরও সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মোট ঋণের মাত্র ২ শতাংশ এককালীন জমা দিয়ে একজন ঋণখেলাপি নিয়মিত গ্রাহক হয়ে যাবেন। বাকি ঋণ শোধ করতে হবে ১২ বছরের মধ্যে। ঋণের সরল সুদহার হবে মাত্র ৯ শতাংশ। তার মানে যারা নিয়মিত ঋণশোধ করেছেন, তাদের জন্য শাস্তি, যারা ঋণ শোধ করবেন না, তাদের জন্য পুরস্কার। হাজার লাখো কোটি টাকা লুট ও পাচারের মাথা চোরাই কোটিপতিদের জন্য বাজেটে আছে উল্টো সুখবর।

এলএনজি এলপিজি বিদ্যুৎ ব্যবসা বাড়াতে গিয়ে গ্যাস-বিদ্যুতের অবিরাম অযৌক্তিক দাম বাড়ানো হচ্ছে, কৃষিশিল্প, গৃহস্থালি জীবনযাপন সবকিছুরই তাতে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি দেশ-বিদেশের কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখতে গিয়ে দেশকে মহাবিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। পারমাণবিক বিদ্যুতের ঝুঁকি ও বিপদের যেকোনো সীমা-পরিসীমা নেই তা সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশের মতো ঘন জনবসতি, পানি ও আবাদি জমির ওপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল একটি দেশে এই ঝুঁকি বিশে^র যেকোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি। পারমাণবিক বর্জ্য নিয়ে কোনো পরিষ্কার ব্যবস্থা নেই। সরকার একদিকে বলেই যাচ্ছে, রূপপুরে কোনো দুর্ঘটনা হবে না, অন্যদিকে যেকোনো দুর্ঘটনার দায় থেকে রক্ষার জন্য রাশিয়া-ভারতের এই প্রকল্পে যুক্ত ব্যক্তিদের জন্য করা হয়েছে দায়মুক্তি আইন।স

প্রাণপ্রকৃতি দেশবিনাশী আরেকটি বড় দৃষ্টান্ত সুন্দরবনবিনাশী রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এই প্রকল্পের সূত্র ধরে দেশের বনগ্রাসী ভূমিগ্রাসী কতিপয় গোষ্ঠী তিন শতাধিক বাণিজ্যিক প্রকল্প দিয়ে সুন্দরবন ঘিরে ফেলেছে। উপকূল রক্ষাকারী বন/পরিবেশ বিনাশ করে মহেশখালী, বরগুনা ও পটুয়াখালীতেও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। উপকূলজুড়ে কয়লা-বিদ্যুতের সম্প্রসারণের মাধ্যমে কমানোর বদলে সেই বিপদ আরও বৃদ্ধির মহাযজ্ঞ করছে সরকার। এদিকে এশিয়া এনার্জি বা জিএসএম বেআইনিভাবে ফুলবাড়ী কয়লাখনি দেখিয়ে লন্ডনে শেয়ারবাজারে ব্যবসা করে যাচ্ছে, এখন এই খনি নিয়েই তারা চীনের ‘পাওয়ার চায়না’র সঙ্গে চুক্তি করেছে। বাংলাদেশের সম্পদ নিয়ে বিদেশি কোম্পানি বেআইনিভাবে বিদেশে ব্যবসা করে সরকার কিছুই বলে না, আর এই চুক্তি বিষয়েও মন্ত্রণালয় বলছে তারা কিছুই জানে না। এসব প্রকল্প নিয়েই বাজেটে উন্নয়ন কর্মসূচি!

প্রবাসী শ্রমিক, গার্মেন্ট শ্রমিক আর কৃষক বর্তমান অর্থনীতির প্রধান শক্তি। প্রথম দুই গোষ্ঠী দেশে বৈদেশিক মুদ্রার পাহাড় তৈরি করছে, আর সরকার সমর্থিত সম্পদশালীরা তা লুট করে বিদেশে পাচার করছে, দেশে বিত্ত বিলাসের চকচকে জীবন দেখাচ্ছে। এভাবে দেশি ও প্রবাসী শ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তৈরি করা বিদেশি মুদ্রার মজুদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ খোরাক হচ্ছে চোরাই টাকার মালিকদের। তারপর এর ঘাটতি পূরণ করতে নেওয়া হচ্ছে দেশি-বিদেশি ঋণ। কৃষক ফসল ফলিয়ে সবার অন্ন জোগান দিচ্ছে। দাম না পেয়ে তার ঘরে কিংবা ফসলের মাঠে জ¦লছে আগুন। সর্বশেষ বাজেটে এই ধারাকে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

অনেকেই বলছেন, বাস্তবায়নই হচ্ছে বাজেটের আসল সমস্যা। আসলেই কি তাই? অনুসন্ধানে দেখা যাবে, বাস্তবায়নের সমস্যার অনেকখানি তৈরি হয় প্রকল্প নির্বাচন বা বাছাইয়ের মধ্যেই। ভুল, অপ্রয়োজনীয় বা ক্ষতিকর প্রকল্পের ভিড়। কারণ দলীয় নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা দেশি-বিদেশি নানা গোষ্ঠীর ইচ্ছায় প্রকল্প নির্বাচিত হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত আগে, বাছাই প্রক্রিয়া পরে। এসব প্রকল্পে অসম্ভব ব্যয়বৃদ্ধিতে টাকার অভাব দেখা যায় না, টাকার অভাব দেখা যায় সর্বজনের (পাবলিক) শিক্ষা ও চিকিৎসার বিকাশে, দেখা যায় জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে, প্রয়োজনীয় শিক্ষা-প্রশিক্ষণ-প্রতিষ্ঠান বিকাশে, দেখা যায় গবেষণায়, দেখা যায় জনস্বার্থ রক্ষার জনবল বিকাশে।

জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির অর্থ কী? জনগণের জীবনের গুণগত মান বৃদ্ধির পরিমাপ কই? পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি, কৃষিজমি নষ্ট করে ইটখোলা বা চিংড়িঘের, জলাভূমি ভরাট করে বহুতল ভবন, নদী দখল করে বাণিজ্য, পাহাড় উজাড় করে ফার্নিচার, শিক্ষা ও চিকিৎসাকে ক্রমান্বয়ে আরও বেশি বেশি বাণিজ্যিকীকরণ, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সবই জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারে। এগুলো আবার চোরাই টাকার আয়তনও বাড়ায়। দখলদারি অর্থনীতি, আতঙ্কের সমাজ আর সন্ত্রাসের রাজনীতি সবই পুষ্ট হয় উন্নয়নের এই ধারায়।
(দৈনিক দেশ রূপান্তরে ২২ জুন ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত)