আমরা কেন বিদ্যুতের বেশি দাম দেব?

সব যুক্তি তথ্য জনমত অগ্রাহ্য করে সরকার বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েই যাচ্ছে। এই দাম বাড়ানোর পক্ষে আছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ আর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত দখলে নিতে তৎপর দেশি-বিদেশি গোষ্ঠী। আর বিপক্ষে সর্বস্তরের মানুষ। কার ভোটে সরকার ক্ষমতায় যায়, আর কাদের কথায় চলে? জনগণের কাছ থেকে ভোট নেওয়ার সময় এই সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সন্ত্রাস দমন, দ্রব্যমূল্য হ্রাস। এগুলোর কোনোটিতেই সরকারের দক্ষতার পরিচয় পাওয়া গেল না। আগের সরকারের ধারাবাহিকতায় ক্রসফায়ার, গুম, খুন, সন্ত্রাস ঠিকই চলছে। একদিকে বড় লুটেরাদের রক্ষা করা এবং অন্যদিকে দখল লুণ্ঠন আর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোসহ জনগণের পকেট কাটায় নিত্যনতুন রেকর্ড করতে সরকার যেন বদ্ধপরিকর। ভোট চাওয়ার সময় জনগণের কাছে এক কথা বলা হবে, আর সেই ভোটে বলীয়ান হয়ে সরকারের কাজ হবে সেই জনগণেরই মাথায় বাড়ি দেওয়া? জনগণ এই ধারা আর কত দিন সহ্য করবে?
তিন বছরে বিদ্যুতের দাম শতকরা প্রায় ৩০০ ভাগ বাড়ানো অবিশ্বাস্য মনে হয়, অথচ এই কাজই করা হয়েছে ‘এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন’ নামে এক অর্থহীন অপচয়ের দোকান খুলে। যতই নির্বোধ মনে করা হোক না কেন, এই প্রশ্ন তো জনগণ করবেই, কী কারণে তারা বিদ্যুতের বেশি দাম দেবে? সরকার বলছে, বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, জনগণকে বিদ্যুৎ দিতে গেলে বর্ধিত দাম দিতেই হবে। বলছে, বিদ্যুৎও চাইবেন আবার বেশি দামও দেবেন না, তা কী করে হয়? উত্তরে বলব, হ্যাঁ, বিদ্যুৎও চাইব আবার বেশি দামও দেব না। কারণ, কম দামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ খুবই সম্ভব। জনগণকে বিদ্যুৎ দিতে গিয়ে তার উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, তা ঠিক নয়। উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে সরকারের ভুল নীতি আর দুর্নীতির কারণে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর মুনাফা বানানোর খাতে পরিণত করতে গিয়ে গ্যাস ও বিদ্যুৎ দুটোরই উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। আজ যদি দেখতাম, বর্ধিত বিদ্যুতের বেশি দাম দিলে তা বিদ্যুৎ খাতেই যাচ্ছে, বিদ্যুৎ খাতকে সরকার শক্তিশালী করছে, তা হলে অবশ্যই বেশি দাম দিতে কখনোই আপত্তি করতাম না।
গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের নাম করে যথেচ্ছাচার ও লুটপাটের পথ প্রশস্ত করার নীতি ও দুর্নীতি অব্যাহত থাকায় রাষ্ট্রীয় ব্যয় বহুগুণে বর্ধিত হয়েছে। শিল্প-কলকারখানা, কৃষি, লেখাপড়া, ব্যবসা, চিকিৎসা, ঘরগেরস্থালি সবই বিপর্যস্ত। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্টনির্ভরতা সৃষ্টি এবং বিদ্যুৎকে ব্যক্তি মুনাফার পণ্যে পরিণত করায় কিছু গোষ্ঠী লাভবান হলেও জনগণের পাশাপাশি প্রকৃত শিল্পোদ্যোক্তারাও সংকটে পড়েছেন।
দাম বেশি, তার পরও বিদ্যুৎ নেই। সরকারের হিসাব ঠিক হলে প্রশ্ন, তা হলে বিদ্যুৎ গেল কোথায়? বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্ল্যান্ট চুক্তি করা হলো। কিন্তু এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি চালু হয়নি কিংবা চুক্তি অনুযায়ী উৎপাদন করছে না। অথচ এগুলোতে তেল জোগান দিতে গিয়ে দেশ ঋণগ্রস্ত হয়েছে, অর্থনীতি ভারগ্রস্ত হয়েছে, অন্য অনেক উৎপাদনশীল তৎপরতা বন্ধ হয়ে আছে। আমরা ১৮টি কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট অনুসন্ধান করে দেখেছি, এগুলোর স্থাপিত ক্ষমতার তুলনায় উৎপাদন শতকরা ২০ থেকে ৪০ ভাগ। যদি ঋণ ও ভর্তুকি দিয়ে তেল আনা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ উৎপাদিত না হয়, তা হলে প্রশ্ন, ঋণ করে আনা তেল গেল কোথায়? কিংবা তেল যদি আনা না হয়ে থাকে, তাহলে ঋণের টাকার কী হলো?
সরকার যখন ক্ষমতায় আসীন হয়, তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ছিল প্রতি ইউনিট দুই টাকার কম, এখন তা ছয় টাকার বেশি। পিডিবির তথ্য অনুযায়ী গত তিন বছরে মেরামত না করার কারণে ১৪টি বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট বন্ধ হয়েছে। এর প্রায় সবই হচ্ছে গ্যাসচালিত। রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো চালু থাকলে সেখান থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যায় সর্বোচ্চ দুই টাকা ইউনিট দরে। আর বেসরকারি বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট থেকে কিনতে হয় চার টাকা, পাঁচ টাকা বা ছয় টাকা দিয়ে। আর রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে সেটা পড়ে ১২ থেকে ১৬ টাকা। রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট চালু রাখলে ও সম্প্রসারণ করলে অনেক সুবিধা। প্রথমত, সুলভ বিদ্যুৎ; দ্বিতীয়ত, নিশ্চিত ও নির্ভরযোগ্য জোগান; তৃতীয়ত, জিম্মি হওয়ার ঝুঁকি নেই। সর্বোপরি, এর জন্য তেল আমদানি করার দরকার হয় না। গ্যাসের জোগান থেকেই কেন্দ্রগুলো চলতে পারে। গ্যাসের জোগানেও সমস্যা নেই, যদি লাইন মেরামত হয় এবং বাপেক্স কাজের সুযোগ পায়।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত আরও কয়েকটি খবর সরকারের বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির অপরিহার্যতার দাবি খারিজ করে দেয়। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির জরিপ অনুযায়ী, অধিকাংশ শিল্প-কারখানার বয়লার পুরোনো ও জ্বালানি ব্যবহারে অদক্ষ হওয়ার কারণে ১৫ কোটি ঘনফুট গ্যাসের অপচয় হচ্ছে। তিতাসের আওতাধীন আবাসিক গ্রাহকদের ব্যবহূত চুলা জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষ হলে প্রতিদিন আরও পাঁচ কোটি ঘনফুট গ্যাস সাশ্রয় করা সম্ভব। বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের বর্তমান চাহিদার তুলনায় ঘাটতি মাত্র ২০ কোটি ঘনফুট। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জ্বালানি ব্যবহারে গড় দক্ষতা ৬০ শতাংশের মতো। একই পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করে শতকরা ৪০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব।
রিপোর্টে আরও বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে পুরোনো যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণে এক মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জ্বালিয়ে গড়ে পাঁচ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, যন্ত্রপাতির সংস্কার করে আট মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি পরিবর্তন করে একই পরিমাণ গ্যাসে অন্তত এক হাজার মেগাওয়াট বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। (প্রথম আলো, ১৬.১.১২)
সঞ্চালন লাইন ও কমপ্রেসরের সমস্যা দূর করলে নয়টি ক্ষেত্রে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এর মধ্যে শীর্ষে আছে জালালাবাদ, এরপর আছে মৌলভীবাজার, রশিদপুর, বিবিয়ানা, সেমুতাং, বিয়ানীবাজার, সালদা ও কৈলাসটিলা। নাইকোর সঙ্গে বিরোধের জের ধরে দুটি ক্ষেত্রে ছাতক (মজুদ প্রায় দুই টিসিএফ) ও ফেনী ক্ষেত্রে উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। (সমকাল, ২৫.১.১২) এই দুই স্থান থেকেই প্রতিদিন ৩০ কোটি ঘনফুট যোগ করা সম্ভব।
বন্ধ থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত সব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু এবং আরও কিছু কেন্দ্র মেরামত করলে সব মিলিয়ে প্রায় ১৭০০ মেগাওয়াটের মতো অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বর্তমান অবকাঠামো থেকেই পাওয়া সম্ভব। সরকারি প্রচারণার মধ্য থেকেও এই তথ্য খুব পরিষ্কারভাবেই ধরা পড়ে, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে ১২০০ মেগাওয়াট। পাশাপাশি প্রায় ১৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে রাষ্ট্রীয় প্ল্যান্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে। রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট মেরামত ও নবায়ন করলে এবং সেই সঙ্গে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় সংস্কার করলে এককালীন এক হাজার কোটি টাকাও খরচ হতো না, কিন্তু আমরা বাড়তি প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ পেতাম। তাতে ঋণের পাহাড় হতো না, বারবার তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হতো না।
কম দামে সারা দেশে অবিরাম বিদ্যুৎ সরবরাহ খুবই সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন: (১) বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানি তেল-গ্যাস-কয়লার শতভাগ জাতীয় মালিকানায় রাখা। (২) গ্যাস-কয়লা যাতে বিদেশে পাচার না হয়, তার জন্য ‘খনিজ সম্পদ রপ্তানি নিষিদ্ধ আইন’ পাস করা। কনোকো-ফিলিপসের সঙ্গে রপ্তানিমুখী চুক্তি বাতিল করা, যাতে বঙ্গোপসাগরের সম্পদ লুট না হয়, দেশের কাজে লাগা নিশ্চিত হয়। (৩) স্বল্প মেয়াদে রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট মেরামত, নবায়ন, মধ্য মেয়াদে গ্যাসভিত্তিক বৃহৎ বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মাণ করা। দীর্ঘ মেয়াদে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রতিষ্ঠান তৈরি করা। (৪) কম দামে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য পিএসসি প্রক্রিয়া বাতিল করে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এবং (৫) কয়লা সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য এশিয়া এনার্জি বহিষ্কার ও উন্মুক্ত খননপদ্ধতি নিষিদ্ধসহ ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন।
বিশ্বব্যাপী তেল, পারমাণবিক ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে গ্যাসভিত্তিক অথবা সৌরসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে প্রকাশিত এক রিপোর্টে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, এই পরিবর্তনের কারণ শুধু পরিবেশগত হুমকি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নয়, অর্থনৈতিক বিচারেও ক্রমেই এসব উৎসের বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি লাভজনক হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র তাই এখন গ্যাসের সন্ধানে মরিয়া। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থাতেই আছে, স্থলভাগে আর বঙ্গোপসাগরে যে গ্যাস সম্পদের সম্ভাবনা, জাতীয় মালিকানা নিশ্চিত থাকলে, তা দিয়ে কয়েক দশক বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে সমস্যা নেই। এর মধ্যে অফুরান উৎস সৌর-বায়ু থেকে বিদ্যুৎ আনার ব্যবস্থা খুবই সম্ভব। কিন্তু এই বঙ্গোপসাগরের দুটো ব্লক যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির দখলে গেছে, পিএসসি ২০১২-এর মাধ্যমে আরও যাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। এসব নীতি চলতে থাকলে বিদ্যুৎ, গ্যাস, তেল—সবকিছুর দাম বাড়তেই থাকবে, সংকটও কাটবে না। নিজেদের সম্পদ অন্যদের দখলে দিয়ে মানুষ কেন চিরস্থায়ী দুর্ভোগের শিকার হবে?

(সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১২ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত)