১.
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচয়ের আগেই তাঁর গানের সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে, সেগুলো আমাদের সক্রিয়তার অংশই ছিল। তাঁর সঙ্গে কথা বলার এবং মুখোমুখি তাঁর কন্ঠে গান শোনার সুযোগ হয়েছিল ১৯৮১ সালে, যখন তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেইসময় অনেকগুলো কর্মসূচিতে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও দলসহ তাঁকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠান করেছিলাম। তখন বাঙলাদেশ লেখক শিবিরের যে গণনাট্যদল ছিল সেখানে প্রধানত হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানই গাওয়া হত। সেসময় আজফার আজিজ এবং কামরুদ্দীন আবসার এই গানগুলো আমাদের কৃষক, শ্রমিক ও সাংস্কৃতিক সমাবেশে গাইতেন। এর মধ্য দিয়েই হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানগুলো ক্রমে বাংলাদেশে পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়। তাঁর বাংলাদেশ সফরের পর এই গানগুলোর পরিচিতি আরও বিস্তৃত হয়। অনেক শিল্পী ও সংগঠনই এই গানগুলোর ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠে।
বর্তমান সময়ে অনেকেই এই গানগুলোর সঙ্গে পরিচিত, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নাম না জেনেও। গানগুলোর মধ্যে ‘জন হেনরী’, ‘ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না’, ‘থাকিলে ডোবাখানা’, ‘কাস্তে টারে দিও জোরে শান’, ‘শঙ্খচিল’, ‘শহীদের খুনে রাঙা পথে দেখো হায়েনার আনাগোনা’, ‘সাম্যের গান গেয়ে রেল চলে’, ‘আন্তর্জাতিক’, ‘আরো বসন্ত বহু বসন্ত’‘আজব দেশের আজব লীলা’, ‘মাউন্টব্যাটেন মঙ্গলকাব্য’, ‘আমরা তো ভুলি নাই শহীদ’এখনও বাংলাদেশের মানুষের বিভিন্ন লড়াইয়ে, সমাবেশে গাওয়া হয়। এই গানগুলোর কোন কোনটি পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী কথা কিছুটা পাল্টে গেয়েছিলেন আজফার ও আবসার। এখনও তা হয়। এরশাদ স্বৈরশাসনের সময় কিংবা জেল হত্যা কিংবা শ্রমিক নিপীড়নের সাথে এগুলো মেলানো খুবই কার্যকর হয়েছিল। আজফার এখন আর সক্রিয় না থাকলেও বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের প্রধান গণসঙ্গীতশিল্পী কামরুদ্দীন আবসার এই গানগুলো জীবন্ত রেখেছেন দীর্ঘদিন। সম্প্রতি তিনি অসুস্থ হয়ে গানের জগৎ থেকে সাময়িকভাবে দূরে থাকলেও তাঁর মাধ্যমেই এই গানগুলো আরও শিল্পীর কাছে পৌঁছেছে। বলাইবাহুল্য, আরও নতুন নতুন গান ও শিল্পী এই ধারায় ক্রমে যুক্ত হচ্ছেন। ভাষা ও সুরেও অনেক বৈচিত্র এসেছে, পরীক্ষা নিরীক্ষাও চলছে।
২.
হেমাঙ্গ বিশ্বাস শুধু শিল্পী, গীতিকার, সংগ্রাহক, সুরকারই নন, তিনি গানের একজন তাত্ত্বিকও। ‘গানের বাহিরানা’(জানুয়ারি ১৯৯৮) গ্রন্থে অনেকগুলো নতুন ও পুরনো লেখায় তাঁর জনসমষ্টির সঙ্গীত জীবন আর তার সাথে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও গণসঙ্গীতের যোগ বিশ্লেষণ করেছেন। লোকসঙ্গীত হিসেবে পরিচিত সঙ্গীত সমুদ্রের সাথে শহুরে নানা বাণিজ্যিক তৎপরতার পার্থক্যকেও সনাক্ত করেছেন। তিনি বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রাণ ও গান জগতকে অভিন্নরূপে দেখেছেন এবং তাকে আবিস্কার করেছেন সকল ঘরানার উর্ধ্বে আবার বিভিন্ন ঘরানার সঙ্গে যার যোগও আছে। তিনি বলছেন, ‘গায়কীটা জলমাটি হাওয়ার, কিংবা পাহাড় ও উপত্যকার। গুরু একজন নয়- গণসমষ্টি। সুরের লহরের তুলিতে আঁকা সামগ্রিক সমষ্টিজীবনের চিত্রপট থাকে চোখের সামনে। একটি বাদ দিয়ে আরেকটিকে উপলব্ধি করা যায় না।’হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতে, ‘(অখন্ড) বাংলাদেশের পূর্ববঙ্গের মূল মেলোডি হলো ভাটিয়ালী,উত্তরবঙ্গের তেমনি ভাওয়াইয়া, মধ্যবঙ্গের মূল গীতরীতি হলো বাউল।’তাঁর সিদ্ধান্ত, গণসঙ্গীত জনগণের এই প্রাণের সুর ও কথার উপর ভিত্তি করেই বিকশিত হতে পারে।
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ভাষায়, ‘লোকসংগীত শুধু অতীত সন্ধানী নয়, লোকসংগীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতিষ্ঠান।’ সেজন্য লোকসঙ্গীত বা নির্দিষ্ট অঞ্চলে পরম্পরায় টিকে থাকা ভাব ভাষা অভিব্যক্তির উপর ভর করেই গণসঙ্গীতের মূল স্রোত তৈরী হয়। সেখানে নতুন যারা শিল্পী আসবেন তাদের এই জগৎকে বোঝার একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে যায়।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেন, ‘আমার নিবেদনের মুখ্য কথা, লোকসংগীত আয়ত্ত করতে হলে একান্ত হতে হবে। সেটা জীবনে জীবন যোগ করার সমস্যা। উৎপাদক মেহনতী মানুষই লোকসংগীতের স্রষ্টা। যে অন্নদাতা সেই সুরদাতা। যে হাত লাঙলের খুঁটি ধরে, যে হাত নৌকার বৈঠা ধরে, গুণ টানে, যে হাত জাল বোনে, সেই হাতই দোতারা বানায়, সেই হাতেই ঢোলের বোল ওঠে। সেই অবিচ্ছিন্ন জীবন থেকে সুরকে বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করলে ভুল হতে বাধ্য।’
হেমাঙ্গ বিশ্বাস অসংখ্য লোকশিল্পীদের সৃষ্টির দিকে, তাদের অসাধারণ ক্ষমতার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছেন। তিনি দেখেছেন এসব অসাধারণ প্রতিভাধর শিল্পী নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে, সামাজিক অর্থনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একই সুর একই প্রশ্নকে নতুনভাবে প্রকাশ করেন। লিখেছেন, ‘অর্ধাহার অনাহারের মধ্যেও জনতার মাঝখান থেকে অসংখ্য শিল্পী তৈরী হচ্ছেন, শহরের সংগীতবিদদের কাছে তাঁরা অজ্ঞাত। … আব্বাসউদ্দীনকে তাঁরা জানেন- জানেন না টেপু মিঞা বা বায়ন শেখদের। শচীন দেব বর্মণকে জানেন, কিন্তু নিরঞ্জন সূত্রধর বা কুনিয়া শীল বা মহানন্দ দাসদের কেউ জানেন না- যাঁরা শচীন দেব বর্মণের চেয়ে অনেক উঁচুদরের লোকশিল্পী। তাই গণপ্রতিভা আবিষ্কারের সাধনা নিয়েই গবেষককে ডুব দিতে হবে জনসমুদ্রে।’
জনসমুদ্রে ডুব দিলে, পরম্পরায় খোঁজ নিলে, আমরা দেখি নির্দিষ্ট পরিস্থিতি ছাড়া সরাসরি লড়াইকেন্দ্রিক গণসঙ্গীত সৃষ্টি না হলেও নানাভাবে, ধর্ম সংস্কৃতি, জীবন-জীবিকা, ব্যক্তির অনুভূতি, প্রেম, নারীর বেদনা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সমাজের বৈষম্য নিপীড়ন বঞ্চনা হাহাকারের প্রতিধ্বনি ঘটে। সুফী ধারার শিল্পী, বাউল শিল্পী যারা সমাজের নিয়ম শাসন কিংবা শাস্ত্রীয় ধর্মের কঠোর দেয়াল থেকে মানসিকভাবে মুক্ত, তাঁদের মধ্যে আমরা তাই প্রতিবাদ, সামাজিক বিধি অমান্য কিংবা বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা ও সুর পাই। লালন ফকির এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। জালাল বা বাউল করিম শাহসহ বাংলার অসংখ্য শিল্পীর গানে, পালা, যাত্রায়, বচনে, প্রবাদে আমরা এই চেতনার স্বাক্ষর পাই।
আর জনসমাজের সাথে ঘনিষ্ঠ শিল্পীরা তো বিচ্ছিন্নভাবে শিল্পকর্ম নিয়েই ডুবে থাকতে পারেন না। লালনের এক ভিন্ন ও অজানা ভূমিকার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। কাঙ্গাল হরিনাথের অপ্রকাশিত দিনপঞ্জীর সূত্রে তিনি বলছেন ‘কাঙ্গাল হরিনাথের অপ্রকাশিত দিনপঞ্জিতে দেখি সত্যি সত্যি লালন-চরিত্র ভোলা বাউল আবার প্রয়োজন হলে হতে পারেন জাঁদরেল লাঠিয়াল। হাতের একতারাটি রেখে জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লাঠিও ধরতে পারেন। কাঙ্গাল হরিনাথ তার পত্রিকা ‘গ্রামবার্তা’য় জমিদারের প্রজানিপীড়নের খবর ছাপানোর জন্য সেই জমিদার যখন কাঙ্গাল হরিনাথকে শায়েস্তা করার জন্য লাঠিয়ালের দল পাঠান, তখন লালন তাঁর দলবল নিয়ে নিজে লাঠি হাতে সেই লাঠিয়ালের দলকে আচ্ছা করে টিট করে সুহৃদ কৃষক-বন্ধু হরিনাথ রক্ষা করেন।’
জাত, পরকালমুখিতা, শ্রেণী বৈষম্য, মানুষের অপমান ধনী জমিদার শোষণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে লালনের অবস্থান খুব স্পষ্ট যদিও তা সবসময় উচ্চকিত নয়। তার অনুরাগীদের মধ্যে সবাই যে এই ধারাকে অব্যাহত রেখেছেন তাও নয়। এই জাতপাত ধর্ম ইত্যাদি পরিচয়ের বাইরে মানুষকে সনাক্ত করবার যে অবিরাম চেষ্টা আমরা লালনের মধ্যে দেখি তা সবসময় শান্তিপূর্ণ ছিল না। অনেক নারীপুরুষ এসব পরিচয় অতিক্রম করে যখন প্রেম সম্পর্কে সম্পর্কিত হন তখন তাদেরও সমাজের সাথে লড়াইয়ে নামতে হয়। আমরা জানি এরকম অনেক তরুণ তরুণী লালনের আখড়াতেই নিজেদের আশ্রয় খুঁজেছেন।
৩.
জীবনের প্রবহমান ধারাতেই গান জন্ম নেয়। জীবনের শ্রম, কাম, ঘাম, দাম, সব থেকেই সৃষ্টি হতে পারে গান। জীবনই গানের উৎস, গণসঙ্গীত সেই জীবনের বিশেষ মুহূর্তকে বিশিষ্ট করে তোলে। ব্যক্তির ক্রোধ, ক্ষোভ, আর্তনাদ, প্রেম, প্রতিবাদ, স্বপ্ন, আর লড়াইকে সমষ্টির সঙ্গে যুক্ত করে। সবদেশেই গণসঙ্গীত প্রধানত আশ্রয় করে লোকসঙ্গীতের উপর, কেননা সেখানে মানুষের প্রাণের টান থাকে, থাকে শেকড়ের যোগ। কিন্তু গণসঙ্গীত সেখানেই সীমিত থাকে না, তা অন্যান্য গানের ধারা, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের গানের কাঠামো, যন্ত্র, ভাব, কাহিনীকেও রূপান্তর করে সম্পৃক্ত করে। এটা গণসঙ্গীতে সম্ভব; কেননা, গণসঙ্গীত বিশ্বজনীন মানুষের লড়াইয়ের একটি ভাষা।
প্রচলিত গানই কীভাবে পরিস্থিতির টানে পাল্টে গিয়ে নতুন রূপে হাজির হয় তার অনেক দৃষ্টান্ত দিয়েছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। যেমন তিনি দেখেছেন, সারিগানে শোনা যেত –
‘সাবধানে গুরুজীর নাম লইওরে সাধুভাই
সাবধানে গুরুজীর নাম লইও।’
সেখানে শোনা গেল:
‘কাস্তেটারে দিও জোরে শান কিষাণ ভাইরে
কাস্তেটারে দিও জোরে শান।
ফসল কাটার সময় এল কাটবে সোনার ধান
দস্যু যদি লুটতে আসে কাটবে তাহার জান রে।…’
কিংবা ভাটিয়ালীতে পরিচিত কথার জায়গায় শোনা গেল:
‘ফিরাইয়া দে, দে, দে মোদের কায়ুর বন্ধুদেরে
মালাবারের কৃষক সন্তান
তারা কৃষক সভার ছিল প্রাণ
অমর হইয়া রহিবে দেশের দশের অন্তরে।
কৃষকসভার রাখতে ইজ্জতমান
তাঁরা ফাঁসী কাষ্ঠে দিল প্রাণ
ফিরিয়া পাব নারে মোদের কায়ুর বন্ধুদেরে।।’
সকল মানুষের গভীর ঐক্যের বাণী অজানা কবির সৃষ্টি গাজীর গীতিতে পাওয়া যায় –
‘নানা বরণ গাভীরে তার একই বরণ দুধ
জগত ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত।’
কিংবা
‘হেদু আর মোছলমান একই পিঞ্জর দড়ি
কেহ বলে আল্লা-রসুল কেহ বলে হরি
বিছমিল্লা আর গিরিবিষ্টু এক্কই গোয়াল
দোফাক করি দিয়ে পরভু রাম রহমান।’
কিন্তু এসব কথা শাস্ত্রীয় নেতারা, রাম রহমান, কেউই গ্রহণ করবে না। বরঞ্চ ক্রুদ্ধ হবে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলছেন, ‘মোল্লা মওলানার শরীয়ত শাসন কিংবা সনাতন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মনুর বিধানকে অবজ্ঞা করে, সমাজপতিদের লাঞ্ছনাকে অগ্রাহ্য করে, বৈষ্ণব, সুফী ও সহজিয়া বাউলের ভাবধারার সংমিশ্রণে এক অপূর্ব মানবতাও গড়ে উঠেছিল।’
বাংলার ভূমিতে এটাই হচ্ছে। লালন বলেন,
‘মানব তত্ত্ব যার সত্য হয় মনে
সে কী অন্য তত্ত্ব মানে।’
কিংবা
‘থাকে ভেস্তের আশায় মমিনগণ
হিন্দুরা দেয় স্বর্গেতে মন
ভেস্ত স্বর্গ ফাটক সমপান
কার বা তা ভালো লাগে।’
হেমাঙ্গ বিশ্বাস মদন বাউলের গানের কথাও বলেন,
‘তোমার পথ ঢেক্যাছে মন্দিরে মসজিদে
ও তোর ডাক শুনে সাঁই চলতে না পাই
আমায় রুখে দাঁড়ায় গুরুতে, মুরশেদে।’
ময়মনসিংহের ভাটিয়ালী একটি গানের উল্লেখ করেছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। গানটি ১৩৫০ বা ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষের পরিপ্রেক্ষিতে তৈরী। গানটি হল:
‘আমার দুঃখের অন্ত নাই
দুঃখ কার জানে জানাই
সুখের স্বপন ভাঙলোরে চুরাইবাজারে
ভাইরে ভাই . . . . . ১৩৫০ এর কথা
মনে কি কেউর পড়ে -রে
মনে কি কেউর পড়ে
ক্ষুধার জ্বালায় বুকের ছাওয়াল
মায়ে বিক্রী করে রে –
চুরাইবাজারে . . . . . . .’
প্রতিটি গণসঙ্গীতের এরকম একেকটি পরিপ্রেক্ষিত আছে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর গানগুলোর কোনটি নিজে রচনা ও সুরারোপ করেছিলেন, কোনটি সংগ্রহ করেছিলেন লোকসঙ্গীতের ভান্ডার থেকে, কোনটি কিছুটা পাল্টে নিয়ে চলতি লড়াইএর সাথে যুক্ত করেছিলেন। গণসঙ্গীত একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে রচিত হয় নিশ্চয়ই, কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে একটি গণসঙ্গীত যদি মানুষ ও তার লড়াইয়ের প্রাণ ধারণ করতে পারে তাহলে তা দীর্ঘদিন অন্যান্য লড়াইকেও উজ্জীবিত করতে সক্ষম হয়। কারণ শোষণ পীড়ন, বৈষম্য আর নিষ্পেষণ, অপমান বঞ্চনার বিরুদ্ধে কান্না ক্রোধ ও প্রতিবাদ, কিংবা মানুষের স্বপ্ন, সাহস, এবং আরও অসংখ্য মানুষের সাথে মৈত্রী সংহতির গান মানুষকে স্পর্শ করবেই। সেজন্য হেমাঙ্গ বিশ্বাস আমাদের কাছে এখনও জীবন্ত থাকেন।
৪.
গণসঙ্গীত যারা সৃষ্টি করেছেন, করছেন, যারা এসব গণসঙ্গীতকে মানুষের লড়াইয়ে হাজির করে তাতে প্রাণের স্পর্শ দিয়েছেন, তাদের জীবনও সংগ্রামের তাপ ও চাপকে মোকাবিলা করেই চড়াই উৎরাই পার হয়। এই শিল্পীদের জীবন অন্য সাধারণ শিল্পীদের মতো নয়। এঁরা শিল্পীজগত থেকেই আবির্ভূত হন। কিন্তু মানুষের জীবন ও লড়াইএর প্রতি তাঁদের তীব্র সংবেদনশীলতা তাঁদেরকে সাধারণ ব্যক্তিক তৃপ্তিতে ডুবে থাকা চরিত্রের শিল্পী থেকে অন্য এক মানুষে রূপান্তরিত করে। নন্দনতাত্ত্বিক সুখ নিয়ে তারা সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না, যদিও নন্দনতত্ত্বের পরীক্ষায় তাঁদেরকেও উত্তীর্ণ হতে হয়। হেমাঙ্গ বিশ্বাস এরকম উত্তীর্ণ একজন মানুষ।
আর শিল্পে ব্যক্তিক সাফল্য, প্রতিষ্ঠা, যশ তাদের আরাধ্য নয়, সমষ্টির লড়াইয়ে নিজের সক্ষমতা যোগ করে তাঁকেও নিতে হয় জীবনের ঝুঁকি। জীবনের সাফল্যের প্রচলিত ঘেরাটোপ থেকে বের হয়ে তৃপ্তি আর সাফল্যের নতুন সংজ্ঞা তাঁকে গ্রহণ করতে হয়। সেখানে প্রচলিত বিত্ত বৈভবের স্থলে অনটন, নিশ্চিত জীবনের বদলে দারিদ্র, জেল জুলুম সবকিছুরই সম্ভাবনা থাকে। এটা শুধু বাংলাদেশের নয় সবদেশেরই অভিজ্ঞতা।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস এরকম একটি চরিত্রের কথা বিশেষ করে তাঁর লেখা ও কথায় উল্লেখ করেছেন। তিনি বাংলাদেশে সুপরিচিত শিল্পী রমেশ শীল, যিনি একপর্যায়ে গণনাট্য আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তাঁর শুরুটা তা ছিল না।
সুফীবাদী দর্শনে অনুপ্রাণিত রমেশ শীল জীবনের প্রথম পর্যায়ে মাইজভান্ডারের মধ্যে জীবনের অর্থ খুঁজেছিলেন। গেয়েছিলেন:
‘দেখে যারে মাইজভান্ডারের আজব রঙের ফুল
ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে পড়ে আশেক অলিকূল।
ফুলের রং দেখেছে যারা, হয়ে গেছে মাতোয়ারা
দুনিয়ার সুখ চায় না তারা চায় না জাতিকূল।
সে ফুলের সুবাতাসে, দিল খোলে আর আঁধার নামে
নিত্তরসে চিত্ত বাসে প্রেমবাগে বুলবুল।’
কিংবা
‘ত্রিবেণীর ঘাটেতে মাঝি জোয়ার ধরি যাইও
ভান্ডারীর বর্জকে তরী ধীরে ধীরে বাইও।’
সেই একই রমেশ শীল নতুন জগৎ আবিষ্কার করলেন যখন তখন লিখলেন,
‘আমার খুলে মটর গাড়ি
তেতালা চৌতালা বাড়ি-
আমার খুলে রেডিও আর বিজলি বাতি জ্বলে।
আমি কৃষক, তুমি মজুর দিনে রাতে খাটি
দুই শক্তি এক হইলে তারা পিছু যাবে হটি।
একসঙ্গে নিঃশ্বাস ছাড়ি
পর্বত উড়াতে পারি
দুশমন চক্রে চাও না ফিরি কী আছে তার মূলে?’
রমেশ শীল গানের জন্য নিগৃহীত হয়েছিলেন, কারাবরণও করেছিলেন। হতাশার মধ্যেও আশার আলো নিয়ে শেষ বয়সে লিখেছিলেন,
‘অত্যাচারের প্রতিশোধ আমার নেওয়া নাইবা হবে
আমার পরে আসবে যারা বোধ করি তারাই নেবে।
সারাজীবন ধরে আমি তারই চেষ্টা করে যাব।
মনের কোণে সুর উঠিবে, কলম দিয়ে তাল বাজাব।
…..
হিংস্র জন্তুর ডাক থামিবে, পথের বাধা হবে শেষ
বুক ফুলিয়ে বলে উঠব, এইতো আমার দেশ।’