২০১৫ এ কী কী হতে হবে? প্রস্তাব কিংবা ইচ্ছাতালিকা

6e3cd8c9d448fa4df7d9b4f1823fc399 4২০১৪ সাল শুরুই হয়েছিলো সাধারণ নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা আর সহিংসতা দিয়ে। সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়েই বর্তমান সরকার গঠিত হয়েছে। যেভাবে নির্বাচন হয়েছে তাতে বর্তমান সরকারকে স্বনির্বাচিত বলাই শ্রেয়। সরকারি দলের লোকজনদের এই যুক্তির সাথে আমি একমত যে, নির্বাচন না হলে অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতা দখল করতো, তাতে বিপদ আরও বাড়তো। কিন্তু যেভাবে নির্বাচন হয়েছে তার বিকল্প ‘নির্বাচন না হওয়া’ ছিলো না, ছিলো ‘যথাযথ নির্বাচন হওয়া’। আমরা সবাই জানি যে, বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ার যে দশা, সমাজে চোরাই টাকা আর সন্ত্রাস যেভাবে রাজনীতির পরিচালিকা শক্তি, তাতে সকল দলের অংশগ্রহণ হলেই যথাযথ নির্বাচন আশা করা যায় না। অর্থ, সহিংসতা, সাম্প্রদায়িকতা, কুরাজনীতিই নির্বাচন প্রক্রিয়াকে দখল করে রাখে। কিন্তু এসব আছে বলেই আমরা বলতে পারি না নির্বাচন অর্থহীন, তখন বরং অর্থপূর্ণ নির্বাচনের রাজনীতি বিকাশের প্রয়োজনীয়তা আমাদের সামনে হাজির হয়।

যাইহোক, স্বনির্বাচিত হবার পর সরকার একচেটিয়া ক্ষমতার অধিকারি হয়েছে। কিন্তু একচেটিয়া ক্ষমতা ভোগ করবার জন্য তাকে ছাড় দিতে হচ্ছে অনেক। নিজের দুর্বলতা ঢাকতে পুলিশ, র‌্যাবসহ নানা বাহিনী ও প্রশাসনকে তুষ্ট রাখতে হচ্ছে, যথেচ্ছাচারের সুযোগ দিতে হয়েছে। একই কারণে ভারত, চীন, রাশিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিদেশি নানা শক্তির দাবি ও আবদার পূরণ করতে হচ্ছে। বিএনপি জামাতও এই বিদেশিদের দিকেই তাকিয়ে, তদ্বির ও প্রতিশ্রুতি চলছে। বিএনপি করছে তার জন্য সুবিধাজনক নির্বাচনের জন্য; আর জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষাসহ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিদেশ নির্ভর হয়ে আছে। ২০১৪ সালে যুদ্ধাপরাধী বিচারে ধারাবাহিক অগ্রগতি হয়েছে। এই বিচারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের জামায়াত পৃষ্ঠপোষকতা, সমঝোতা ও যুগপৎ আন্দোলনের কলঙ্কমোচন কিছুটা হলেও হয়েছে।

রাজনৈতিক দিক থেকে ২০১৪ সাল আপাতভাবে শান্ত থাকলেও বিনাবিচারে হত্যা, গুম, অপহরণ, বেড়েছে। বেড়েছে টেন্ডার-রামদা সহিংসতা, চাঁদাবাজী, বন জমি নদী দখল। এছাড়া নিয়োগ বাণিজ্য এবং প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ ভর্তি নিয়ে নানামুখি বাণিজ্যও বেড়েছে। বছর শেষ হচ্ছে হরতাল সহিংসতা দিয়ে, নতুন বছর নতুন অশান্তির পর্বে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এই লেখাটি লেখার মুহূর্তে আমার সামনে পিকেটারদের আঘাতে নিহত শিক্ষক শামসুন্নাহার আর তাঁর সপ্তম শ্রেণী পড়ুয়া ছেলের ছবি। আর অগ্নিদগ্ধ মা ও ছেলের হাহাকার। আরও এরকম ছবি দেখার আশংকা এখন বাড়ছে।

রক্তাক্ত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ’ ব্যানার তুলে বিশ্বময় সন্ত্রাসী তৎপরতার বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্র এখনো সক্রিয়। তার বিশাল যুদ্ধ মেশিন শত্রু খোঁজে, না পেলে বানায়। আর সেই জালে বাংলাদেশসহ সবদেশই আটকা পড়েছে। এই বছরেই ইসরাইল দুহাজারেরও বেশি মানুষ হত্যা করলো, যার মধ্যে শিশুদের সংখ্যাই পাঁচশতাধিক। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল-সৌদী আরব এই ত্রয়ীর নানা কুটজালে বন্দী মধ্যপ্রাচ্য। যাদের ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক দখল করেছে, লিবিয়ায় আগ্রাসন চালিয়েছে, সিরিয়ায় তৎপরতা চালাচ্ছে তারাই এখন ‘ইসলামী খিলাফৎ’ ঘোষণার আওয়াজ দিয়ে ইরাকের দুর্বল জাতিগোষ্ঠীর নারী পুরুষদের ওপর বর্বরতা চালাচ্ছে। এই উন্মাদনায় যোগ দিয়েছে মার্কিন ইউরোপীয় নাগরিকেরাও। নাইজেরিয়ায় বোকো হারামের মতো বর্বর গোষ্ঠী বিনাবাধায় নারী অপহরণসহ ভয়াবহ অপরাধ করে যাচ্ছে। পাকিস্তানে মার্কিনীদের ড্রোন আঘাতে মরছে নিরীহ শিশুসহ নাগরিকেরা। আর এর প্রতিশোধের নামে তালেবানরা শতাধিক শিশুকে হত্যা করেছে। শিয়া সুন্নীসহ নানা ধর্মীয় সংঘাত পাকিস্তানে রক্তপাত ঘটাচ্ছে নিয়মিত। একইবছর ভারতে ধর্মবাদী রাজনীতি উন্নয়নের ঝান্ডা নিয়ে নতুন উদ্যমে যাত্রা শুরু করেছে। হিন্দুত্ববাদী ক্ষমতার দাপট অনেক বেড়েছে নির্বাচনী বিজয়ের পর।

বিশ্ব ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তনের সূচনাও স্পষ্ট হয়েছে এই বছর। এক হিসাবে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করেছে। চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা একজোট হয়ে আন্তর্জাতিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে যা বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এর একচ্ছত্র ক্ষমতার ভাঙন আনতে যাচ্ছে। সন্ত্রাস, বৈষম্য, আগ্রাসন বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্য চিত্রও আছে। এই বছরই যুক্তরাষ্ট্র পাঁচদশক ধরে ছোট্ট কিউবার বিরুদ্ধে অবরোধ চালিয়ে সেদেশকে কাবু করতে না পারার ব্যর্থতা স্বীকার করেছে এবং নীতি পরিবর্তনের সূচনা করতে চাইছে। অবরোধের মধ্যে থেকেও কিউবা তার আয়তনের চাইতে অনেক বড় প্রভাব বিস্তার করেছে ল্যাটিন আমেরিকায়। ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, নিকারাগুয়া মার্কিন নিপীড়ন লুন্ঠনের জাল থেকে বের হবার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করছে, অনেকখানি সফলও হয়েছে। সর্বশেষ খবরে জানা যায়, নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবার আগে “বলিভিয়া তার গ্যাসসম্পদের মুনাফার শতকরা মাত্র ১৮ ভাগ পেতো। আর চুক্তি ও নীতি পরিবর্তন করে এখন সেই দেশ মুনাফার শতকরা ৮২ ভাগ নিজেদের ভাগে আনতে পারে। শিক্ষা নিয়ে ব্যাপক কর্মসূচির পর ইউনেস্কো বলিভিয়াকে নিরক্ষরমুক্ত দেশ হিসেবে ঘোষণা করেছে।”( ফ্রন্টলাইন, ১৪ নভেম্বর ২০১৪)

ছোট ছোট প্রত্যাশার কথা
বিশ্বে অনেকরকম ঘটনাপ্রবাহ আছে, সমীকরণে পরিবর্তনও হচ্ছে অনেকরকম। তা যাই হোক না কেনো বাংলাদেশ কোথা থেকে শক্তি নেবে, কোন পথ গ্রহণ করবে তা নির্ভর করে মুখ্যত দেশের শাসক শ্রেণীর ওপর। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যে ক্ষমতার দাপটের মধ্যে আমরা বাস করছি তাতে নতুন বছরের জন্য কোন প্রত্যাশা দাঁড় করানো কঠিন। বিদ্যমান অবস্থায় একবছরে বড় কোন পরিবর্তন সম্ভবও নয়। তারপরও নতুন বছরে কী কী ঘটনা বা সিদ্ধান্ত আমরা দেখতে চাই, কী কী পরিবর্তন কম সময়েও সম্ভব, তার সংক্ষিপ্ত তালিকা তো করা সম্ভব। আমরা চাই, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে-

১। বিনাবিচারে হত্যাকান্ড আর তা নিয়ে রাষ্ট্রীয় অবিরাম মিথ্যাচার বন্ধ হবে। চাঁদাবাজী গুম অপহরণে পুলিশ র‌্যাব যুক্ত থাকবে না। সাগর-রুনী, ত্বকী হত্যাকারীদের ধরা হবে এবং বিচারপর্ব শুরু হবে। যুদ্ধাপরাধী বিচার শেষ হবে। সাম্প্রদায়িক, জাতিবিদ্বেষী সহিংসতা বন্ধ হবে।
২। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও শক্তিশালী ভূমিকা গ্রহণের জন্য পুনর্গঠিত হবে। সন্ত্রাসী, দখলদার, চোরাইটাকার মালিকেরা নির্বাচনে অযোগ্য বিবেচিত হবে। শান্তিপূর্ণভাবে সকলের অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
৩। ব্যাংক ও শেয়ারবাজার লুন্ঠনকারিরা সমাজের সর্বস্তরে ধিকৃত হবে। সরকার তাদের রক্ষক থাকবে না। টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসীদের প্রতি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ হবে।
৪। সুন্দরবনধ্বংসী রামপাল ও ওরিয়ন বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সব বাণিজ্যিক প্রকল্প বন্ধ হবে। সুন্দরবনের দায়িত্ব বনজীবী ও পশুপাখির ওপর ছেড়ে দেয়া হবে। নৌপথ বিপজ্জনক যানচলাচলের জন্য নিষিদ্ধ থাকবে। তেল দূষণে সৃষ্ট ক্ষতি দূরীকরণে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
৫। বঙ্গোপসাগরের মৎস্য ও খনিজ সম্পদ শতভাগ দেশের কাজে লাগানোর প্রস্তুতি শুরু করতে আত্মঘাতী পিএসসি প্রক্রিয়া বাতিল হবে। বঙ্গোপসাগরসহ দেশের বিশাল সম্পদের ওপর জাতীয় কর্তৃত্ব নিশ্চিত হওয়ায় বর্তমান ও ভবিষ্যতের জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। বিদেশি কোম্পানির আজ্ঞাবহ ভূমিকা থেকে মুক্ত হয়ে পেট্রোবাংলা স্বাধীন ও সাবালক হয়ে ওঠবে। ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানীর বিষয়ে ব্যাপক উদ্যোগ শুরু হবে।
৬। জ্বালানীখাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের ’দায়মুক্তি আইন’ এবং মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে ’আইসিটি আইন’সহ বিভিন্ন জনস্বার্থবিরোধী আইন বাতিল হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর ভর করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে।
৭। সর্বজনের শিক্ষা ও চিকিৎসা শক্তিশালী হতে থাকবে। নম্বরের ঢল, প্রশ্নপত্র ফাঁস , কোচিং, গাইড, বিরাট সিলেবাস, ইত্যাদি জাল থেকে শিক্ষার্থীরা মুক্ত হবে।
৮। ছলছুতা, বলপ্রয়োগ, হুমকি দিয়ে কৃষি ও বসতিজমি অধিগ্রহণ বন্ধ হবে। পাহাড়, নদী, জলাশয় লিজ দেয়া বন্ধ হবে। পাহাড়ে সহিংসতা বন্ধ হবে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগসহ সকল নদী বাঁচার পথ পাবে।
৯। সকল জাতি, ধর্ম ও ভাষার মানুষ বাংলাদেশকে নিজেদের দেশ ভাবতে পারবে। নারীর জীবন নিরাপদ হবে।
১০। সমাজে মানুষের গুরুত্ব বাড়বে। ভিআইপিদের অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা কমবে, প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রিত হবে।
১১। বৃহৎ ব্যয়ের প্রকল্প উন্মাদনা বন্ধ হবে। অসমাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে আগে। রেল দেশের প্রধান যান হিসেবে ঘোষিত হবে। আনফিট বাস, নৌযানের বদলে নতুন বহর আসবে। ফায়ার ব্রিগেডসহ দুর্যোগ মোকাবিলা এবং জাতীয় সক্ষমতার সকল ক্ষেত্র শক্তিশালী করবার কাজ শুরু হবে।
১২। রানা প্লাজা ও তাজরীন হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার হবে। বাঁচার মতো ন্যুনতম জাতীয় মজুরি চালু হবে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই ছোট ছোট প্রত্যাশার অসম্পূর্ণ তালিকাকেও অবাস্তব বা ইচ্ছাপূরণের গল্প মনে হতে পারে। কিন্তু তাই যদি হয়, এগুলো যদি অসম্ভবই হয় তাহলে এইদেশ নিয়ে ‘গণতন্ত্র’, ‘শান্তি’, ‘মানবাধিকার’ বা ‘উন্নয়নের’ কথাও অর্থহীন বাগাড়ম্বর। কিন্তু সম্পদ ও সম্ভাবনা বিচারে বাংলাদেশে উপরোক্ত তালিকা বাস্তবায়ন তো খুবই সম্ভব। সেজন্য এগুলো বাস্তবায়নে যদি নতুন বছরে সর্বজনের স্বার্থচিন্তা ও রাজনীতির বিকাশ ঘটে তাহলেই তৈরি হবে বিষচক্র থেকে বের হবার পথ। তরুণ প্রজন্ম কি এক্ষেত্রে অগ্রণী হবে?

(পরিমার্জিত। প্রথম প্রকাশ: প্রথম আলো, ২ জানুয়ারি ২০১৪)