ভাড়াটে বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞাপনী সংস্থা আর অন্ধ কিছু অনুগত নিয়ে কি একটি সর্বনাশা প্রকল্প অব্যাহত থাকতে পারে? এটা ঠিক যে, মানুষকে সাময়িকভাবে অন্ধ করে রাখা যায়। উন্নয়নের কথা বলে, বিকাশের কথা বলে মানুষকে ফাঁকি দেওয়া যায় ততদিন পর্যন্ত যতদিন মানুষ নিজের স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন না হয়, নিজের জীবন এবং সম্পদের অধিকার সম্পর্কে নিজের সচেতনতা তৈরি না হয়। বাজারে টোটকা ওষুধ বিক্রি করতে বিক্রেতারা অনেক রকম মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে। সব অসুখ ভালো হয়ে যাওয়ার গ্যারান্টি দেয়। তাদের যারা বিশ্বাস করেন তারা যে বারবারই ঠকেন তার অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। এসব কাজ এনটিপিসির মতো কোম্পানিগুলো করে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশেরও কিছু স্বার্থগোষ্ঠী নানা ধান্ধায় সুন্দরবন ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে। তারা বলছে যে, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে কোনো ক্ষতি হবে না। ক্ষতি যদি নাই হয় তাহলে ভারতে এরকম প্রকল্প হলো না কেন? বলা হয়, এতে কর্মসংস্থান হবে। এই কর্মসংস্থান হবে ১০০০ বড়জোর ১৫০০ মানুষের এবং তাও কিছুদিনের জন্যÑ সেটা ৬ মাস কিংবা ১ বছরও হতে পারে। এরপর এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে আর কোনো কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। কিন্তু মানুষ কত কাজ হারাবে, কত মানুষ কর্মসংস্থান হারাবে সেই কথাটা তারা খুবই সযতেœ গোপন করে যাচ্ছে। মৎস্যজীবী মানুষ তাদের পেশা হারাবে। কারণ পশুর নদীসহ অন্যান্য নদী এত বেশি দূষণের শিকার হবে যে, সেখানে মৎস্যজীবী হিসেবে কারো পেশা ধরে রাখা সম্ভব হবে না। যারা বনজীবী তাদের পক্ষেও এই কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। আমরা হিসাব করে দেখেছি প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ মানুষ সুন্দরবনের ওপর তাদের জীবিকার জন্য নির্ভর করেন। এই মানুষরা তাদের কাজ হারাবেন এবং তাদের এই অঞ্চল ত্যাগ করতে হবে। তার মানে কর্মসংস্থান হবে সর্বোচ্চ ১ হাজার আর কর্মসংস্থান হারাবেন প্রায় ১০ লাখ মানুষ। এই দশ লাখের কথা না বলে কেবল ৫০০/১০০০ সংখ্যাটি নিয়ে এমনভাবে ঢোল পেটানো হয় যাতে মানুষ ভুলে যায় যে, সে কীসের বিনিময়ে কী পাচ্ছে। কী পেতে গিয়ে কী হারাচ্ছে। তার চেয়েও বড় কথা সুন্দরবন এই উপকূলীয় অঞ্চলের চার কোটি মানুষকে রক্ষা করে চলেছে। এখন জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে সারা বিশ্বে। ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস এগুলো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে এবং ফলে এই উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের বিপদ দিন দিন বাড়ছে। এমনিতেই সুন্দরবন অঞ্চলটি অনেকখানিই অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। উন্নয়নের নামে সেখানে বিশ্বব্যাংক প্রজেক্ট করছে, ইউএসএইড প্রজেক্ট করছে এবং ওই জায়গা থেকে মানুষ সরিয়ে পুরো কোম্পানির দখলে আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এমনিতেই নানারকম বাণিজ্যিক আগ্রাসন দিয়ে এই এলাকাকে বিপদাপন্ন করা হয়েছে। তার ওপর এই বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে ভয়াবহ সর্বনাশের কারণ। ওইখানকার জমিজমা বিক্রির তোড়জোড় চলছে। সেই সঙ্গে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে যদি তারা সক্ষম হয় তাহলে তা হবে মরণ কামড় বা মরণ আঘাত! কারা এই কাজগুলো করছে? যারা ভারতের মুনাফাখোর কিংবা বাংলাদেশের কিছু লোভী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, যারা দেশের জীবন বিপন্ন করে টাকা বানায়, যাদের এই দেশে বসবাস করার কোনো ইচ্ছা নেই। তারা এই দেশকে টাকা বানানোর জায়গা মনে করে এবং ভবিষ্যৎ দেখে বিদেশে। তাই সুন্দরবন শেষ হয়ে গিয়ে এখানে যদি কয়েক কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হয় তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। ভারতের বেশ কিছু সংগঠন ও পরিবেশবিদ বিজ্ঞানী বাংলাদেশের সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি নিচ্ছেন। নিচ্ছেন এই কারণে যে, সুন্দরবন যদি এই পাশে ধ্বংস হয় তাহলে ভারতের দিকে যে সুন্দরবন আছে সেটাও ধ্বংস হবে এবং সেটা তাদের অঞ্চলের মানুষের জীবনও বিপন্ন করবে। বাংলাদেশে গত মার্চ মাসে সুন্দরবন জনযাত্রায় এরকম কয়েকজন অংশ নিয়েছিলেন। তাদের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, যদি সুন্দরবন না থাকে তবে যে কেবল আমাদের সীমানার ভেতরে চার কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়, উপকূল অঞ্চলজুড়ে (যা পূর্ব উপকূল নামে পরিচিত) তার কৃষি বা সম্পদ সবকিছুই একটা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। তারা মনে করছেন, ভারত যেহেতু এই ধরনের সর্বনাশ করছে ফলে ভারতের জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে এই আন্দোলনে সংহতি জ্ঞাপন করাটা তাদের দায়িত্ব। যারা এ ধরনের সর্বনাশা প্রকল্প করে, তাদের দৃষ্টিতে টাকাই আসল, তাতে দেশ ও দশের কী ক্ষতি হলো তাতে কিছু আসে যায় না। তারা মাটি-পানি-মানুষ-বাতাস না দেখে কেবল টাকা দেখতে পায়। প্রাচীন এক উপকথা আছে যে, মানুষের লোভের কারণে কোনো এক সময় যখন নদীর মাছ মরে যাবে, পুরো বায়ু দূষিত হয়ে যাবে, যখন সব গাছ শেষ হয়ে যাবে কেবল তখনই তারা বুঝতে পারবে যে টাকা খেয়ে বেঁচে থাকা যায় না। টাকা দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া যায় না। জীবনরক্ষার জন্য লাগে বাতাস, পানি, গাছপালা ও মাটি। এই মাটি, পানি, বায়ু, গাছপালা এই সবকিছুকে গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন করার যে দৃষ্টিভঙ্গি সেটা আমাদের শাসকশ্রেণির নেই। তারা শুধু চোরাই কোটিপতিদের স্বার্থ দেখতে পারে, তারা সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ দেখতে পারে, যারা বৃহৎ ব্যবসায়ী তাদের স্বার্থ দেখতে পারে। জনগণের স্বার্থ দেখার চোখ, কান, মাথা তারা হারিয়েছে। তাদের মাথা বন্ধক দেওয়া রয়েছে দেশ-বিদেশের মুনাফাখোরদের কাছে। এরকম তথ্যও আমরা জেনেছি যে, সাংবাদিকদের এনটিপিসি বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, এনটিপিসি দরকার হলে আরেকটা সুন্দরবন বানাবে। কী অবিশ্বাস্য! যে সুন্দরবন তৈরি হয়েছে লাখো বছরে তা বানানোর মতো প্রতারণা কীভাবে সম্ভব? কিছু গাছ লাগালেই সেটা বন হয়ে যায় না। বন হচ্ছে বহু ধরনের জীববৈচিত্র্যের ফলাফল। সুন্দরবন হচ্ছে পৃথিবীর মধ্যে জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে, পরিবেশ শোধনের দিক থেকে; নদী, জল, জীব, সমুদ্র এবং স্থলভূমির সম্মিলনে একটা অসাধারণ সমন্বয়। যেখানে একটা অসাধারণ বাস্তুসংস্থান তৈরি হয়েছেÑ পৃথিবীতে এর তুলনা মেলা ভার। যে কোনো কা-জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ বুঝবে যে, এটি আর দ্বিতীয়টি তৈরি করা সম্ভব নয়। যা লাখো বছর লাগে তৈরি হতে তা নতুন করে তৈরি করা কী করে সম্ভব? মুনাফা আর স্বার্থ তাড়নায় মানুষ অন্ধ হলে কা-জ্ঞানও বিলুপ্ত হয়। বাংলাদেশের এ ধরনের ভয়াবহ উন্নয়ন দর্শনের কারণেই রূপপুরে দেশের ওপর ঋণ আর বিপদের বোঝা চাপিয়ে রাশিয়ান কোম্পানি দিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করার চেষ্টা হচ্ছে। বাঁশখালীতে মানুষের জনমত উপেক্ষা করে, কোনো বিচার-বিশ্লেষণ না করে, খুন-জখম করে চিনা কোম্পানি দিয়ে একই ধরনের তৎপরতা চালানো হচ্ছে। আমরা বলি, ‘রামপাল, রূপপুর, বাঁশখালী মডেল নয়, আমাদের বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের জন্য জাতীয় কমিটির সাত দফা’ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং এটিই কম দামে, পরিবেশসম্মতভাবে ঘরে ঘরে এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহের পথ। ভারত, চিন, রাশিয়া আর যুক্তরাষ্ট্র দেশকে ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়ার নাম উন্নয়ন নয়। সংকট সমাধানের পথ আছে কিন্তু তাতে সরকারের আগ্রহ নেই কারণ তাতে অর্থ খুব কম লাগে। ব্যয় করার সুযোগ থাকে কম। তারা করতে চায় হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প, যেটা থেকে অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, সাগর চুরি করা যায়। আমরা যে পথ দেখাচ্ছি তাতে কম পয়সায় মানুষের মাঝে বিদ্যুৎ পৌঁছানো যাবে এবং বাংলাদেশের সক্ষমতা দিয়েই বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান করা যাবে। সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনের প্রধান শক্তি হচ্ছে এর নৈতিক ভিত্তি, শক্তি হচ্ছে তথ্য, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। শক্তি হচ্ছে মানুষ, প্রাণ- প্রকৃতির পক্ষে লড়াইয়ের চেতনা। এই আন্দোলনে বিজয়ী হওয়া ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো বিকল্প নেই। সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই, তেমনি সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন অব্যাহত রাখা ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই। আমরা সরকারের উদ্দেশে বলিÑ বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প আছে, সরকারেরও বিকল্প আছে। ৫ বছর হোক, ১০ বছর হোকÑ সরকার বদলায়, মন্ত্রীরাও বদলায়; প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি সবারই বিকল্প আছে। তারা কেউই চিরস্থায়ী নন। কিন্তু সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই। সুন্দরবন হচ্ছে আমাদের প্রাণের, অস্তিত্বের, পরিচয়ের অংশ। সেই সুন্দরবনকে রক্ষা করা তাই আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।
(০৮ আগস্ট ২০১৬, দৈনিক আমাদের সময় এ প্রকাশিত)
সর্বশেষ প্রকাশিত
- বাঁচার মতো মজুরিও গণতান্ত্রিক অধিকার
- তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ, আইএমএফ ও জনগণের দুর্ভোগ
- তেলের মূল্যবৃদ্ধি, লোডশেডিং ও ভর্তুকির কথা
- তেলের মূল্যবৃদ্ধি, সংকট ও আইএমএফ
- Government’s decision to hike fuel prices will hurt every section of society
- বাংলাদেশে জ্বালানির সিদ্ধান্ত হয় লবিস্টদের শক্তিমত্তার ওপর নির্ভর করে
- ‘আমরা পারি’ কিন্তু ‘আমরা পারি না’
- বাজেটে সুবিধাভোগীদেরই স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছে, সাধারণ জনগণের সমস্যাকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি
- মেগা প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় করের বোঝা বাড়াবে
- রাষ্ট্র, ধর্মীয় রাজনীতি ও সন্ত্রাসের ভূমি
- GDP: A misleading measure of development
- We are the 99%: From factory workers to the new working middle class
- মে দিবসে ঐক্যসূত্র: কারখানা শ্রমিক থেকে নতুন শ্রমজীবী ‘মধ্যবিত্ত’
- গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ধর্মের উপস্থিতি
- ন্যাটো কেন এখনো টিকে আছে
- পূর্ববঙ্গের রাজনীতিতে মফস্বলের অভ্যুদয় ও নতুন নেতৃত্ব
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও বিশ্ব ব্যবস্থার বৈপরীত্য
- ত্বকী হত্যা: দুর্বৃত্ততোষণ ও বিচারহীনতার ব্যাকরণ
- ‘উন্নয়ন’ বিপর্যয়ের চট্টগ্রাম প্রেক্ষিত
- ভাষার হীনম্মন্যতা তৈরি করে বিদ্যাশিক্ষার দেয়াল