সুন্দরবন রক্ষায় বৈশ্বিক সংহতি

বাংলাদেশে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে সর্বপ্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ বহুভাবে আক্রান্ত। লুণ্ঠনমুখী উন্নয়নধারা নিশ্চিত করতে মানুষের চিন্তা, মতপ্রকাশ, সংগঠন, সমাবেশসহ সব তৎপরতার ওপর ভয়াবহ নিপীড়নমূলক চাপ জারি রাখা হয়েছে। গুম–খুন, আটক, হয়রানি নতুন নতুন রেকর্ড করেছে গত কয়েক বছরে। রাজনৈতিক নানা বিতর্ক আর জাতীয় নির্বাচন নিয়ে হুলুস্থুলের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে মানুষ ও প্রকৃতিবিনাশী নানা আয়োজন। দেশ ইতিমধ্যে নিপীড়িত উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা মানুষের অবিরাম প্রবাহে বিপর্যস্ত। কিন্তু সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্প, দেশবিনাশী রূপপুর প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এর চেয়ে বহুগুণ বেশি মানুষ দেশের ভেতরেই উদ্বাস্তু হবে। এর পরিণতি চিন্তা করাও কঠিন।

যে রাজনীতি আর উন্নয়ন মডেল বন-নদী-পাহাড়-বাতাস বিনষ্ট করে তা মানুষকে শৃঙ্খলিত করেই অগ্রসর হয়। মানুষ যখন শৃঙ্খলিত হয়, প্রাণ প্রকৃতি তখন দস্যুদের অবাধ আগ্রাসনের শিকার হয়। মানুষ যখন অবাধে খুন হয়, গুম হয়, চোখের আড়ালে তখন নদী–বন প্রাণবৈচিত্র্যও খুন হতে থাকে। এই অবিচ্ছিন্ন সম্পর্কের মানুষ ও প্রাণ প্রকৃতির ওপর জুলুম বন্ধ করার দাবি সামনে নিয়ে ১০ নভেম্বর বাংলাদেশ-ভারতসহ বিশ্বজুড়ে ‘সুন্দরবনের জন্য বৈশ্বিক সংহতি’ (Global Solidarity for Sundarban) কর্মসূচি পালন করার আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় কমিটি।

এর মধ্যে মহাপ্রাণ সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন সপ্তম বছর পার হয়ে অষ্টম বছরে পা দিয়েছে। কয়েক বছরে ভয়ভীতি, নিপীড়ন, হামলা-ত্রাস সত্ত্বেও এই আন্দোলন বিস্তৃত হয়েছে, নতুন বহু মাত্রা যোগ করেছে; সুন্দরবনের জন্য গভীর উদ্বেগ ও দৃঢ় সংহতির জায়গা তৈরি হয়েছে বিশ্বজুড়ে। দেশে যার যা আছে তাই নিয়ে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে জানা–অজানা অসংখ্য মানুষ। শিশুরা ছবি এঁকেছে, গান গেয়েছে, ছবি এঁকেছেন তরুণ শিল্পীরা, নতুন নাটক তৈরি হয়েছে, নাট্যকর্মীরা নাটক নিয়ে পথে পথে ঘুরেছেন, গানের শিল্পীরা নতুন নতুন গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন, নতুন শিল্পী তৈরি হয়েছে, তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছে, লেখক-বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞরা কাজ করেছেন।

অনেক দামে কেনা কোম্পানিমুখী প্রচারকদের প্রচারণার জবাবে এই আন্দোলনে কত তরুণ যে কতভাবে শ্রম ও সময় দিয়েছেন, তার সংখ্যা বলা কঠিন। জাতীয় কমিটির বাইরেও ব্যক্তি, সংগঠন, গ্রুপ থেকে সাইকেল র‍্যালি, গানের মিছিলসহ অসংখ্য প্রতিবাদী উদ্যোগ দেখা গেছে কয়েক বছরে। ফেসবুকসহ সামাজিক গণমাধ্যমেও প্রতিবাদী তৎপরতা বিস্তৃত হয়েছে। প্রাণের শক্তি মোকাবিলা করেছে টাকা আর ক্ষমতার শক্তিকে। প্রতিষ্ঠিত অনেক বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বিশেষজ্ঞের নীরবতা, ভীরুতা যখন দৃষ্টিকটু; সুবিধার সন্ধান করতে গিয়ে যখন দাসত্বের জোয়াল তাদের অনেকের ঘাড়ে, তখন সুন্দরবন আন্দোলনের মূল শক্তি তরুণ রাজনৈতিক কর্মী, বিজ্ঞানী, লেখক, শিল্পীরা নতুন ভরসার জায়গা তৈরি করেছেন।

আমরা দেখেছি, রামপাল প্রকল্পের পক্ষে প্রচারণার নানা কৌশল, বিজ্ঞাপনী সংস্থা-কনসালট্যান্টসহ ব্যয়বহুল তৎপরতা সত্ত্বেও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সুন্দরবনবিনাশী সব প্রকল্প বাতিলের পক্ষে জনসমর্থন নিরঙ্কুশ। বিভিন্ন সংবাদপত্রে জনমত জরিপ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একাধিক জরিপে ভয়ভীতি, বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও শতকরা ৯০ ভাগের বেশি মানুষ এই প্রকল্প বাতিলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। আমরা নিশ্চিত হয়েই বলেছি, মানুষ যদি যথাযথভাবে নিজেদের মতামত প্রকাশ করার সুযোগ পায়, তাহলে শতকরা ৯৯ ভাগের বেশি মানুষ সুন্দরবনবিনাশী প্রকল্প বাতিলের পক্ষে মত দেবে।

বাংলাদেশ, ভারত ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিশেষজ্ঞদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এ পর্যন্ত দেশ–বিদেশের বহু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি, অনেকের গবেষণা বিশ্লেষণ অধ্যয়ন করেছি। রামপাল প্রকল্প বা সুন্দরবন ঘিরে ফেলা বনগ্রাসী, ভূমিগ্রাসী প্রকল্পের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে ব্যক্তিস্বার্থে যুক্ত মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি বা ‘বিশেষজ্ঞ’ ছাড়া আর সবাই সুন্দরবনকে নিয়ে এই সর্বনাশা মুনাফাখোরি আয়োজনের প্রবল বিরোধী। সব বৈজ্ঞানিক তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ একই উপসংহারে এসেছে। সেই কারণে ইউনেসকো একাধিকবার সুন্দরবনের জন্য নিশ্চিত ঝুঁকিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে। সরকারের দিক থেকে অনেক দেনদরবার, তদবির এবং লবিস্ট নিয়োগ ইত্যাদি সত্ত্বেও ইউনেসকোর সিদ্ধান্তের কোনো পরিবর্তন হয়নি।

একাধিক লংমার্চ, মহাসমাবেশ, অসংখ্য সমাবেশ–মিছিল ছাড়াও জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে আমরা বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি প্রদান করেছি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে প্রদত্ত চিঠিতে আমরা বলেছি, ‘…আমরা সুই থেকে রকেট সবই তৈরি করতে পারব, কিন্তু এ রকম অসাধারণ জীববৈচিত্র্য ভরা বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত সুন্দরবন আরেকটি তৈরি করতে পারব না। এই সুন্দরবন আমাদের বিপুল সম্পদ জোগান দেয়। এই সুন্দরবন লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করে, জীববৈচিত্র্যের অসাধারণ আধার হিসেবে আমাদের সকলের প্রাণ সমৃদ্ধ করে। এই বন প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাকৃতিক বর্ম হিসেবে উপকূলীয় অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষের প্রধান অবলম্বন। এই বন জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের টিকে থাকার প্রধান শক্তি। সে জন্যই আমরা বারবার বলি, বিদ্যুৎ উৎপাদনের বহু বিকল্প আছে কিন্তু সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নাই।…’

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে খোলা চিঠিতে বলা হয়, ‘… বিধিনিষেধ ও পরিবেশসচেতনতার কারণে আপনার সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও গ্রিন ট্রাইব্যুনাল গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ ও খনি প্রকল্প স্থগিত বা বাতিল করেছে। অথচ একই রকম প্রকল্প করে বিনাশ করা হচ্ছে সুন্দরবন। বাংলাদেশে ভারতীয় কোম্পানি যে ভারতের আইন ও বিধিমালা ভঙ্গ করেই এই বিদ্যুৎকেন্দ্র করছে, সে বিষয়েও আমরা এই চিঠির মাধ্যমে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। … দুই দেশের মানুষের স্বার্থ এবং বিশ্বের এক অসাধারণ প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যৌথভাবে আপনি এই প্রকল্প বাতিলে দ্রুত উদ্যোগ নেবেন বলে আমরা আশা করি।’

কয়েক বছরে দেশের পাশাপাশি কলকাতা, দিল্লিসহ বিশ্বের বহু শহরে সুন্দরবন রক্ষায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবিতে বহু সভা–সমাবেশ হয়েছে। প্রবাসীরাও সোচ্চার হয়েছেন সুন্দরবনের পক্ষে, এর বিনাশের বিরুদ্ধে। ২০১৭ সালের ৭ জানুয়ারি বিশ্বব্যাপী সুন্দরবনের জন্য বৈশ্বিক প্রতিবাদে তাই শামিল হন বহু দেশের মানুষ। সেই ধারাবাহিকতায় ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবসে পালিত হচ্ছে সুন্দরবনের জন্য বিশ্ব সংহতি দিবস।

তথ্য, যুক্তি, বিশেষজ্ঞ মত, জনপ্রতিবাদ সবকিছু অগ্রাহ্য করে মুনাফার টানে আর রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতার বলে সুন্দরবনবিনাশী প্রকল্প ছাড়াও পুরো উপকূলীয় অঞ্চলে সর্বনাশা সব প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সরকার। উপরন্তু রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে বাংলাদেশকে এক ভয়াবহ বিপদ ও ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হচ্ছে। উন্নয়নের উন্মাদনা তৈরি করে আড়াল করা হচ্ছে লুণ্ঠন আর ধ্বংসের আয়োজন। বিদ্যুৎ উৎপাদন আমাদের দরকার, কিন্তু এ কারণে দেশকে মহাবিপদে নিক্ষেপ করার দরকার নেই। ২০১৭ সালের ২২ জুলাই জাতীয় কমিটি যে বিকল্প খসড়া মহাপরিকল্পনা প্রকাশ করেছে, তা থেকে স্পষ্ট যে কম খরচে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ এসব প্রকল্প ছাড়া আরও ভালোভাবে সম্ভব।

সে জন্য রামপাল-রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সরকারি মহাপরিকল্পনায় (পিএসএমপি-২০১৬) বর্ণিত ব্যয়বহুল, আমদানি ও ঋণনির্ভর, প্রাণ প্রকৃতিবিনাশী বিদ্যুৎকেন্দ্রমুখী পরিকল্পনা বাতিল করে সুলভ, টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জাতীয় কমিটির বিকল্প খসড়া প্রস্তাবনার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ একদিকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে পারে; অন্যদিকে সবার জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জোগান দিতে পারে। ১০ নভেম্বর ‘সুন্দরবনের জন্য বিশ্ব সংহতি দিবস’ তাই প্রাণ প্রকৃতি ও মানুষের পক্ষে উন্নয়নধারার নতুন যাত্রার আহ্বান নিয়েই পালিত হতে যাচ্ছে।