গত ১৩ তারিখ থেকে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুত্বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির শরীক দলগুলো দুইভাগে সুন্দরবন রক্ষায় দুটো কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলো। ১৩ অক্টোবর থেকে ১৭ অক্টোবর সিপিবি-বাসদ এবং ১৬ অক্টোবর থেকে ১৮ অক্টোবর গণতান্ত্রিক বাম মোর্চাভুক্ত দলগুলো সুন্দরবন রক্ষায় রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত্ প্রকল্প বাতিলের দাবিতে সুন্দরবন অভিমুখে অভিযাত্রা ও রোডমার্চ কর্মসূচি নেয়। ১৬ অক্টোবর বামমোর্চা কর্মসূচির অংশ হিসেবে পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মীসহ মানিকগঞ্জে প্রবেশ করে। সেখানে নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী সমাবেশ স্থলে যেতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয় ও এক পর্যায়ে লাঠিচার্জ করে। সেখানে মিছিল করতেও বাধা দেয়া হয়। পরের দিন মাগুরা থেকেই শুরু হয় পুলিশি হামলা ও বাধাদান। পুলিশ মাগুরায় সভা ও মিছিলে বাধা দিতে গিয়ে আবারও লাঠিচার্জ করে। দুই দিনে বারবার পুলিশি হামলায় অনেক নেতা-কর্মী আহত হন। এরপর রোডমার্চ ঝিনাইদহে পৌঁছালে পুলিশ তাদের কার্যত বাসে অবরুদ্ধ করে, ঝিনাইদহে তাদের নামতে দেয়া হয়নি, যশোরেও পুলিশের সাথে সন্ত্রাসীরা তাদের কর্মসূচি করতে বাধা দেয়।
একটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে উপর্যুপরি সন্ত্রাস ও সশস্ত্র মহড়া চালিয়ে সরকার দেখাতে চায় তারা সুন্দরবন ধ্বংসে ‘অপ্রতিরোধ্য’, দেখাতে চায় তারা যা খুশি তাই করতে পারে; কিন্তু এতে প্রকাশিত হয় যে, সরকার সুন্দরবনধ্বংসী প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত। তাই যুক্তির কথা শুনতে, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেও তাদের ভয়। অপরাধী মন আতঙ্কে দিশেহারা হলেই কেবল এরকম আচরণ সম্ভব।
কদিন আগেও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পরিবেশ নষ্ট করে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হবে না। অথচ বিশ্বের ইতিহাসে একটি ভয়ংকর পরিবশেধ্বংসী প্রকল্প রক্ষার জন্য সরকারকে বরাবরই অসহিষ্ণু দেখা যাচ্ছে। আমরা বহুবার সরকারের এরকম আচরণের মুখে পড়েছি। সুন্দরবন নিয়ে সরকারের স্ববিরোধী ভূমিকা বরাবরই প্রকট। প্রধানমন্ত্রী একদিকে আন্তর্জাতিক বাঘ সম্মেলনসহ বিভিন্ন উপলক্ষে সুন্দরবন বাঁচানোর কথা বলেন অন্যদিকে তার সরকার দেশি-বিদেশি মুনাফাখোরদের স্বার্থে সুন্দরবনধ্বংসী নানা তত্পরতায় সক্রিয়। সুন্দরবনের সুরক্ষার জন্য আমরা সরকারের কাছে বার বার দাবি জানিয়েছি ক্ষতিকর সব পরিবহন এবং প্রকল্প বন্ধ করতে; কিন্তু সরকার সুন্দরবনের গুরুত্ব সম্পর্কে নির্লিপ্ত থেকে তার সুরক্ষার পরিবর্তে নিকটবর্তী নৌ-পথে বৃহত্ নৌ-পরিবহনের অনুমতি দিয়েছে, বিশাল কয়লাভিত্তিক একাধিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ করছে, নানা ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ভূমি দস্যুদেরকে জমি দখলের সুযোগ করে দিয়েছে। সুন্দরবন অঞ্চলে সরকারি ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের আরো বনজমি দখলের তত্পরতা সেকারণে এখন জোরদার। কদিন আগে মন্ত্রিসভা রামপালে আরেকটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্রের জন্য অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে।
সরকারের এসব ভূমিকা আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশ্নবিদ্ধ। ইতোমধ্যে ইউনেস্কো এবং রামসার সুন্দরবন ঘিরে একাধিক বিদ্যুত্ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন মুনাফামুখী তত্পরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। নরওয়ে সুন্দরবন ধ্বংসের এই প্রকল্পে যুক্ত থাকার অভিযোগ তুলে ভারতের এনটিপিসিতে অর্থযোগান বন্ধ করে দিয়েছে। কয়েকটি আন্তর্জাতিক ব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থ যোগান না দেবার ঘোষণা দিয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এর নিন্দা জানাচ্ছেন। আর দেশের ভেতরে শত বাধা সত্ত্বেও ক্ষোভ-বিক্ষোভ বাড়ছেই। কান্ডজ্ঞানহীন কিছু ব্যক্তি ছাড়া সকলেই এর বিরুদ্ধে।
কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করে বলেছেন, ‘সুন্দরবন নিয়ে আন্দোলনকারীরা কেবল ভারতের কারণেই এই বিদ্যুত্ প্রকল্পের বিরোধিতা করছে।’ খুবই ভুল কথা। আমরা বার বার বলেছি, যেসব প্রকল্প সুন্দরবনের জন্য ধ্বংসকারি তা ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন এমনকি যদি বাংলাদেশের কোনো কোম্পানিরও হয় আমরা তার প্রবল বিরোধী। তিনি আরো বলেছেন ‘আন্দোলনকারীরা মানুষকে রক্ষা না করে কেবল পশু-পাখি রক্ষায় আন্দোলনে নেমেছে।’ যে কোনো সুস্থ মানুষই জানেন যে, সুন্দরবন শুধু যে অমূল্য অনবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ তাই নয় এটি রক্ষার সাথে কোটি কোটি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা জড়িত। প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবন লাখ লাখ মানুষের জীবন রক্ষা করে। সুন্দরবন না থাকলে বাংলাদেশই অরক্ষিত হয়ে পড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বিস্তারিত তথ্য ও যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে, প্রাকৃতিক রক্ষাবর্ম হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ ও প্রকৃতিকে যে সুন্দরবন রক্ষা করে এবং অসাধারণ জীব বৈচিত্র্যের আধার হিসেবে যা প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখে সেই সুন্দরবনকে ধ্বংস করবে এই প্রকল্প। বিভিন্ন প্রকাশনা, গবেষণার মধ্য দিয়ে বিশেষজ্ঞরা কেনো এই কেন্দ্র বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থবিরোধী, সুন্দরবন ও মানববিধ্বংসী, তা বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ তথ্য যুক্তিসহ তুলে ধরেছেন।
কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটায় বলে সাধারণত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংরক্ষিত বনভূমি ও বসতির ১৫ থেকে ২৫ কিমি-এর মধ্যে কয়লা বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয় না। ভারতীয় কোম্পানি বাংলাদেশে সুন্দরবনের ৯-১৪ কিমির মধ্যে এই বিদ্যুত্ কেন্দ্রটি নির্মাণ করতে যাচ্ছে। বাফার জোন বিবেচনা করলে এই দূরত্ব ৪ কিমি। অথচ ভারতেরই ‘ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশান অ্যাক্ট ১৯৭২’ অনুযায়ী, বিদ্যুত্ কেন্দ্রের ১৫ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে এবং ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রণীত পরিবেশ সমীক্ষা বা ইআইএ গাইড লাইন ম্যানুয়াল ২০১০ অনুযায়ী, কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুত্ কেন্দ্রের ২৫ কিমি-এর মধ্যে কোনো বাঘ/হাতি সংরক্ষণ অঞ্চল, জৈব বৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য কিংবা অন্যকোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা অনুমোদন করা হয় না। ভারতীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ‘তাপ বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত গাইডলাইন, ১৯৮৭’ অনুসারেও কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২৫ কিমি-এর মধ্যে কোনো কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুত্ স্থাপন করা যায় না। এজন্য গত কয়েক বছরে ভারতের কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ ও তামিলনাড়ুতে তিনটি বিদ্যুত্ প্রকল্প বাতিল হয়েছে। অর্থাত্ ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসিকে বাংলাদেশে সুন্দরবনের যত কাছে পরিবেশ ধ্বংসকারী কয়লা বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ করতে দেয়া হচ্ছে, তার নিজ দেশ ভারতে হলে সেখানকার আইন অনুযায়ী তা তারা করতে পারতো না!
এই ধ্বংসাত্মক প্রকল্পের সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বলা হচ্ছে যে, এই প্রকল্পে সুপারক্রিটিকাল টেকনলজি ব্যবহার করা হবে, সেজন্য সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। আমাদের প্রশ্ন প্রথমত, এই প্রযুক্তিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শতকরা ১০ ভাগ ক্ষতি কম হয় ঠিক; কিন্তু তাতে সুন্দরবনের ধ্বংসের সামগ্রিক ক্ষতি কীভাবে কমবে? দ্বিতীয়ত, এই প্রযুক্তি যদি সুন্দরবন ধ্বংস ঠেকানোর মতো এতো নিশ্চিত প্রযুক্তি হয় তাহলে ভারতীয় কোম্পানি কেনো ভারতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সকল ক্ষতি দূরীভূত করে না? কেনো গত তিন বছরে তাদের তিনটি বিদ্যুত্ কেন্দ্র বাতিল হয়? তৃতীয়ত, একদিকে বলা হচ্ছে—এই বিদ্যুত্ কেন্দ্রের সব বিষাক্ত ফ্লাই এ্যাশ সিমেন্ট কারখানায় ব্যবহূত হবে। আর সারাদেশে সকল সিমেন্ট কারখানা বিজ্ঞাপন দেয় তাদের সিমেন্টে ফ্লাই এ্যাশ ব্যবহার করা হয় না। এই ধরনের প্রতারণা কেনো?
প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি জাতিসংঘের পরিবেশ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ’ পেয়েছেন। একহাতে এই পুরস্কার আর অন্য হাতে অতুলনীয় সম্পদ সুন্দরবনের মৃত্যু পরোয়ানা, এটা হতে পারে না। আমরা সরকারকে অনেক বিকল্প প্রস্তাব দেয়া সত্ত্বেও সরকার এতে কর্ণপাত করছে না। এই প্রশ্নটি অনেকেই জিজ্ঞাসা করেন যে, এই প্রকল্প নিয়ে সরকারের এতো জেদ কেনো? কেনো বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও বাংলাদেশে প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও ভারত এই প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হতে চায়? শোনা যাচ্ছে, ভারতের অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে এই প্রকল্পের কাছেই, আর এই এলাকাটি ভারতের জন্য কৌশলগতভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের কাছেই এর উত্তর থাকবে। বাংলাদেশকে অরক্ষিত এবং বিপর্যস্ত করে, নিজেদের কলঙ্কিত করে, সরকার আসলে কাদের স্বার্থ রক্ষা করতে চায়?
(১৯ অক্টবর, ২০১৫ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাক এ প্রকাশিত)