সুন্দরবন ধ্বংস করে বাঘ রক্ষা করা যাবে না

ঢাকায় ১৪ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর বাঘ সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে নিউইয়র্কে শুরু হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক পরিবেশ সম্মেলন। বাংলাদেশ সরকার সবগুলোতেই সরব, ব্যয়বহুল অংশগ্রহণে কুণ্ঠাহীন। আমাদের যদি চোখ-কান সব বন্ধ থাকত কিংবা আমরা যদি দেশের বাঘ, প্রকৃতি ও মানুষের অবস্থা না দেখার ও না শোনার অবস্থায় থাকতাম, তাহলে আমাদের জন্য এগুলো খুবই স্বস্তির ও আনন্দের খবর ছিল। আমরা ভাবতাম, বাঘ রক্ষার জন্য বন রক্ষা ও বিস্তৃত করা হবে, তাতে মানুষের জীবন বাঁচবে, জীবনমান উন্নীত হবে। ভাবতাম, দেশের নদী-নালা, খাল-বিল দখলমুক্ত ও দূষণমুক্ত হবে৷ যারা এসব করে, তাদের দমন করা হবে, নদী জীবন্ত হবে, মানুষও জীবন ফিরে পাবে, প্রাণবন্ত হবে বহু মৃতপ্রায় বা মৃত জনপদ। কিন্তু চোখ-কান একটু খুললেই আমরা দেখি সবই প্রহসন। গাছের গোড়া কেটে বহু অর্থ ব্যয় করে গাছের ডালে পানি ঢালার আয়োজন।

1e1d377ab2c6ac222fe5793fb521fc9f-1
ঢাকার বাঘ সম্মেলন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ এক নির্মম পরিহাসের বিষয় যে বাংলাদেশের সরকার একদিকে বাংলাদেশে বাঘের একমাত্র আবাসস্থল সুন্দরবনের ধ্বংস নিশ্চিত করার মতো দূরত্বে একাধিক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করছে, ভূমিদস্যুদের দখল কার্যক্রম চলতে দিচ্ছে, আবার অন্যদিকে বাঘ আর সুন্দরবনকে বাঁচানোর গুরুত্বের কথা বলে আন্তর্জাতিক সম্মেলনও করছে।

সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী খুবই সঠিকভাবে বললেন, ‘বাঘ বাঁচায় সুন্দরবন, সুন্দরবন বাঁচায় বাংলাদেশ।’ তিনি বাঘ-প্রকৃতি-সুন্দরবন রক্ষায় বিশ্ব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বানও জানালেন। কিন্তু যে কথাটি তিনি বলেননি, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। যে সুন্দরবন বাংলাদেশকে বাঁচায়, যে সুন্দরবন বাঘের একমাত্র বসতি; উন্নয়নের নামে তার অস্তিত্ব বিলোপের মহাযজ্ঞ শুরু করছে এই সরকারই।
বাঘের বসতি আছে, এমন এলাকার পাশে শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ভারী স্থাপনা নির্মাণ না করার অঙ্গীকারসহ নয় দফা ‘ঢাকা ঘোষণা’ গ্রহণ করা হয়েছে। অথচ বিশেষজ্ঞসহ সব পর্যায়ের মানুষের প্রতিবাদ সত্ত্বেও সুন্দরবন তথা বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন, পানিসম্পদ ও প্রাণবৈচিত্র্য বিপর্যস্ত করে ভারতের এনটিপিসি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে সুন্দরবনের সন্নিকটে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে সুন্দরবন থেকে যে দূরত্বে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হচ্ছে, তা বস্তুত ভারতের পরিবেশ আইনেরই সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এই আইনের কারণেই ভারতে সুন্দরবনের চেয়ে অনেক ছোট বন ও জলাভূমি রক্ষার জন্য এনটিপিসির একাধিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল হয়েছে (বিস্তারিত দেখুন: www.ncbd.org <http://www.ncbd.org>)৷ বাংলাদেশে এসে ভারতের সরকার ও রাষ্ট্রীয় কোম্পানি লঙ্ঘন করছে নিজ দেশেরই আইন।

গত ১৩ মার্চ ভারতের ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল কর্ণাটকে এনটিপিসির প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবেশ ছাড়পত্র স্থগিত করেছে। স্থগিত করার কারণ হিসেবে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, ১. পরিবেশ ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য এনটিপিসি প্রকল্প এলাকার জমি সম্পর্কে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছে৷ দুই ফসলি জমিকে অনুর্বর ও পাথুরে জমি বলে চালিয়ে দিয়েছে, ২. ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন পরিকল্পনার প্রণয়নের আগেই পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল, ৩. কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষতিকর প্রভাব অনেক কম করে দেখানো হয়েছিল, ৪. স্থানীয় জনগণের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছিল।

এনটিপিসির বিরুদ্ধে যেসব গুরুতর অভিযোগ ভারতের কর্ণাটকের বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে উত্থাপিত হয়েছে, বাংলাদেশের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে তার চেয়ে আরও অনেক গুরুতর অনিয়ম, তথ্য গোপন, প্রতারণা ও বিভ্রান্তিকর প্রচারের তথ্য-প্রমাণ আছে। এগুলো বারবার বলা সত্ত্বেও সরকার তাদের হাতেই ছেড়ে দিচ্ছে সুন্দরবনের মতো অসাধারণ অনবায়নযোগ্য প্রাণরক্ষাকারী সম্পদ। এমনিতেই ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে সুন্দরবনসহ বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিপর্যস্ত, তিস্তাসহ নদী নিয়ে একতরফা ভূমিকার কারণে বাংলাদেশ ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে, সীমান্ত হত্যা চলছে, উপরন্তু সুন্দরবনধ্বংসী এই প্রকল্প অগ্রসর হলে যে বাংলাদেশে ভারতের প্রতি অসন্তোষ বহু গুণ বাড়বে, সে বিষয়টি মনে হয় দুই সরকারের কারও কাছেই গুরুত্বপূর্ণ নয়।
সর্বনাশা তৎপরতা এখানেই শেষ নয়। ভারতীয় কোম্পানির পর দেশের ওরিয়ন গ্রুপকে আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। সুন্দরবনের গুরুত্ব সম্পর্কে নির্লিপ্ত সরকারের এই ভূমিকায় উৎসাহিত হয়ে এলাকায় ভূমিদস্যুদের আগ্রাসী তৎপরতা বেড়েছে।

প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, যেহেতু বড়পুকুরিয়ায় তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ফলে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয়নি, সেহেতু রামপালেও হবে না। এই বক্তব্যের সত্যতা নেই। বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র ও সঙ্গের কয়লাখনি আকারে অনেক ছোট হওয়া সত্ত্বেও ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বিভিন্নমাত্রিক। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গিয়ে কৃষি ও খাওয়ার পানির সংকট দেখা দিয়েছে, এলাকার খাল-বিলের পানি বিষাক্ত হয়েছে, পানি ও বায়ুদূষণে এলাকাবাসীর স্বাস্থ্যহুমকি সৃষ্টি হয়েছে এবং আবাদি জমির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইতিমধ্যে গ্রাম উজাড় হয়েছে এবং সরকার তাদের দাবির মুখে ক্ষতিপূরণে শতাধিক কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। এসব ক্ষয়ক্ষতি অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেই আবার মানুষকে এলাকা থেকে সরিয়ে আরও ভয়াবহ উন্মুক্ত খনির চক্রান্ত চলছে।

প্রকৃতপক্ষে ক্ষতির মাত্রার দিক থেকে বড়পুকুরিয়ার সঙ্গে রামপালের কোনো তুলনা হয় না। বড়পুকুরিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্ট ২৫০ মেগাওয়াটের, প্রকৃত উৎপাদন ১০০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি। অন্যদিকে রামপালে পরিকল্পনা হলো, প্রথমে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট, পরের ধাপ ও ওরিয়নসহ সব মিলে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট, প্রায় ২৫ গুণ বেশি। বড়পুকুরিয়ায় নদী দিয়ে কয়লা আনতে হয় না, রামপালে পশুর নদীর দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে আনতে হবে। সর্বোপরি বড়পুকুরিয়ায় কোনো সুন্দরবন নেই, কিন্তু রামপালে সুন্দরবনের বিপজ্জনক সীমার মধ্যেই এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। সুতরাং রামপাল তথা বৃহত্তর সুন্দরবনে ক্ষতি তুলনায় সীমাহীন এবং এসব ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণযোগ্য নয়।

সুন্দরবনের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক এম এ বাশার বলেন, ‘পৃথিবীতে চারটি বাস্তুতান্ত্রিক অবস্থা (ইকো সিস্টেম) আছে: সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র, নদী বাস্তুতন্ত্র, মোহনা বাস্তুতন্ত্র ও স্থলজ বাস্তুতন্ত্র। এই সবগুলো বাস্তুতন্ত্রের সমন্বয়ে সুন্দরবন বাস্তুতন্ত্রের সৃষ্টি হয়েছে প্রাকৃতিকভাবে। আমাদের বঙ্গোপসাগরের পাড় ঘেঁষে বহু নদী মোহনার মিলনস্থলে এই বাস্তুতন্ত্রের অবস্থান, যার উদাহরণ ভৌগোলিকভাবে পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।’ (সর্বজনকথা, প্রকাশিতব্য, ২০১৪) এ রকম অসাধারণ অদ্বিতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ হেলায় ফেলায় আর দেশি-বিদেশি কিছু গোষ্ঠীর মুনাফা আর কমিশনের জন্য আমরা বিনাশ হতে দিতে পারি না।

বিদ্যুৎকেন্দ্র নানা জায়গায় নানাভাবে করা যায়, এমনকি তাজমহলও মানুষ চেষ্টা করলে আরেকটা বানাতে পারবে, কিন্তু আরেকটি সুন্দরবন বানানোর সাধ্য মানুষের নেই। সুন্দরবন যে কাজ করে, তা শত বছরের জিডিপি দিয়েও করা সম্ভব হবে না। সুন্দরবন রক্ষার নামে সম্মেলনে বিশ্বব্যাংক ও ইউএসএইডসহ বহু সংস্থার ব্যয়বহুল নানা প্রকল্প তৈরি হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষকে সরিয়ে কনসালট্যান্টদের প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত করা হচ্ছে। বনবাসী মানুষ ও পশুপাখি তাড়িয়ে অঞ্চল দখল নিচ্ছে ভারতীয় এনটিপিসি, বাংলাদেশের ওরিয়নসহ অনেক ব্যবসায়িক সংস্থা।

অভিজ্ঞতা বলে, বায়বীয়, ব্যয়বহুল ও বিদেশি ঋণনির্ভর এসব ‘রক্ষা’ প্রকল্প দিয়ে দেশি-বিদেশি অনেকের অর্থ উপার্জন হয়, কিন্তু সুন্দরবন কেন, কোনো বনই রক্ষা পায় না। বস্তুত সুন্দরবন কিংবা বাঘ রক্ষায় কোনো কনসালট্যান্ট, অর্থ ও প্রকল্প দরকার নেই। ভূমিদস্যুসহ ক্ষমতাবান গোষ্ঠী যদি সীমাহীন লোভ পূরণে দানবের ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয়, তাহলে সুন্দরবন নিজেই নিজেকে রক্ষা ও পুনরুৎপাদন করতে সক্ষম। সমস্যার কেন্দ্র হলো, সরকার এই দানবদের প্রতিহত না করে বরং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে।
বারবার বলা দরকার যে সুন্দরবন মানে নিছক কিছু গাছপালা আর পশুপাখি নয়, তাই সুন্দরবন ধ্বংস মানে শুধু বাঘ নিশ্চিহ্ন হওয়া নয়, বছরজুড়ে লাখ লাখ মানুষের জীবিকার বিনাশ, প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে লাখ লাখ মানুষকেও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া। সুন্দরবন নেই মানে বাংলাদেশ অরক্ষিত।

আশার কথা এই যে মুনাফালোভী কোম্পানি, তাদের কনসালট্যান্ট, ভূমিদস্যু ও কমিশনভোগী ছাড়া বাংলাদেশের সব মানুষই সুন্দরবনধ্বংসী এসব তৎপরতার বিরুদ্ধে।

আমরা কি এখনো এই আশা করতে পারি যে প্রধানমন্ত্রী তাঁর তথ্য ও যুক্তির ভ্রান্তি ও স্ববিরোধিতা বুঝতে পারবেন এবং সুন্দরবনধ্বংসী সব তৎপরতা বন্ধ করে সুন্দরবন বিকাশে যথাযথ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবেন? এর জন্য বড় বাজেট লাগবে না, বিদেশি ঋণও লাগবে না। শুধু লাগবে সুন্দরবনধ্বংসী তৎপরতার বিরুদ্ধে তথা বর্তমান ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ।

(সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৪ দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত)