সুন্দরবন রক্ষার চলমান আন্দোলনের এক সমাবেশে আমি বলেছিলাম, ‘যে দেশের মানুষের সুন্দরবন রক্ষার মতো সংবেদনশীলতা বা দায়িত্ববোধ তৈরি হয় না, সে দেশে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা এবং সহিংসতা থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। যে দেশে এই সংবেদনশীলতা তৈরি হবে, সে দেশে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, মানুষের ওপর মানুষের নিপীড়নের ব্যবস্থা জায়গা করতে পারবে না।’
আশার কথা, সমাজের ভেতর চাপা থাকা সংবেদনশীলতা ও চিন্তাশক্তি ক্রমে প্রকাশিত হচ্ছে। সংহতি তৈরি হচ্ছে মানুষে মানুষে, দেশে ও সীমানার বাইরে। সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও নানা ব্যক্তির সক্রিয়তা ছাপিয়ে পুরো সমাজে স্বতঃস্ফূর্ত যে সাড়া দেখা যাচ্ছে, তা অভূতপূর্ব। স্কুলশিক্ষার্থী থেকে শুরু করে প্রবীণ মানুষ পর্যন্ত বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে সুন্দরবনবিনাশী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে নিজেদের সরব অবস্থান জানান দিচ্ছেন। নতুন নতুন গান-কবিতা-ছড়া তৈরি হচ্ছে। রাস্তায় মানববন্ধন, অনশন, সমাবেশ, গান, নাটক থেকে শুরু করে ফেসবুকে ছবি দিয়ে সব বয়সের মানুষ এক অসাধারণ গণজাগরণের চিহ্ন রাখছেন। শুধু দেশে নয়, প্রবাসী বাংলাদেশের মানুষরাও নিচ্ছেন নানা কর্মসূচি। পাশাপাশি ভারতের সজাগ মানুষরাও দাবি জানাচ্ছেন এ প্রকল্প বাতিলের। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের দুই শতাধিক সংগঠন এরই মধ্যে সুন্দরবন রক্ষার জন্য রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।
এত সব ঘটনা, মানুষের এই প্রবল বিরোধিতাতেও সরকারের হুঁশ হচ্ছে না। উল্টো সরকার কিছু ভাড়াটিয়া কনসালট্যান্ট, লবিস্ট আর দলীয় লোকজন দিয়ে এই সর্বনাশা প্রকল্পের পক্ষে নানা অসত্য, অতিরঞ্জিত, বিভান্তিকর তথ্য প্রচার করছে। ভাড়াটে কথায় কোনো লাগাম থাকে না, তাই তারা বলতে পারে: ‘এমন এক প্রযুক্তি ব্যবহার হবে যাতে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কোনোই বায়ুদূষণ হবে না। বরং বিবিধ দূষণ আরো কমে যাবে। পানি এতই পরিষ্কার হবে যে, তা পান করাও সম্ভব হবে!’ এখানে শুধু এই সরল প্রশ্ন রাখা যায় যে, যে এনটিপিসি ভারতে দূষণ আর অব্যবস্থায় দেশে ও বিদেশে ধিকৃত, সেই কোম্পানি নিজ দেশে কেন এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে না? কেন ভারতে তাদের একাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভারতেরই গ্রিন ট্রাইব্যুনাল প্রত্যাখ্যান করেছে? এ প্রযুক্তি থাকতে কেন ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক কয়লা প্রকল্প বাতিল করছে? এই বিশেষজ্ঞদের এ জ্ঞান কেন সেখানকার সরকার কাজে লাগাচ্ছে না? আরেকটি প্রশ্ন, কত টাকার বিনিময়ে এসব লোক দেশের মহাসর্বনাশ করতেও দ্বিধা করে না?
সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলন চলছে সুনির্দিষ্ট তথ্য-যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের আলোকে। তা খণ্ডন করতে না পেরে নানা দিক থেকে কুত্সা আক্রমণ চালানো হচ্ছে। প্রশ্ন তোলা হয়, ‘জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দেশে যখন অস্থিরতা তখন আপনারা কেন সুন্দরবন নিয়ে হইচই করছেন?’ ‘বন্যাত্রাণে যাচ্ছেন না কেন আপনারা?’ এর পাল্টা প্রশ্ন আমরাও করতে পারি যে, ‘দেশ যখন জঙ্গিবাদী আক্রমণে দিশেহারা, সে সময় কেন সুন্দরবনবিনাশী চুক্তি করা হয়? কেন রূপপুর চুক্তি করে দেশকে মহাবিপদের দিকে ঠেলে দেন?’ সরকার যদি জঙ্গিবাদকে নিজের নানা অপকর্ম ঢাকার কাজে ব্যবহার করে, তাহলে জনগণকে তো একই সঙ্গে ওগুলোর বিরুদ্ধেও সরব হতে হবে। যারা এ কাজ করবে না, তাদের জঙ্গি জঙ্গি খেলার গুটি হওয়া ছাড়া আর কোনো গতি নেই।
আসলে এ ধরনের প্রশ্নই ভুল কিংবা উদ্দেশ্যমূলক। কারণ যারা আজ সুন্দরবন রক্ষায় জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করছেন, তাদের মধ্যেই আছেন জঙ্গিবাদবিরোধী অন্দোলনের নেতাকর্মীরা। তাদের মধ্যে আছেন বন্যাত্রাণে অগ্রণী মানুষও। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির শরিক দলগুলো বরাবরই জঙ্গিবাদবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী এবং ধারাবাহিক ভূমিকা পালন করছে। সিপিবি-বাসদ, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ অন্য দলগুলো এর মধ্যে বহু কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এসব সংগঠনের অনেক কর্মসূচির খবর, অনেক বক্তব্য মূলধারার মিডিয়ায় আসে না বলে তাদের কর্মসূচি নেই— এ রকম ধারণা ঠিক নয়। যুদ্ধাপরাধী বিরোধী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ইত্যাদির পাশাপাশি জাতীয় সম্পদ রক্ষা আন্দোলন, শ্রমিক-কৃষক-শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষার আন্দোলনে তারা নিজ নিজ অবস্থান কিংবা ঐক্যবদ্ধভাবে সবসময়ই কমবেশি সক্রিয়। সরকারি দলের বয়ান ও এজেন্ডা অনুযায়ী যারা কাজ করে না, তাদের নিয়েই কুত্সারটনাকারীদের আপত্তি।
পরিস্থিতি এমন যে, সুন্দরবন রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক সুলতানা কামালকেও এখন এ প্রশ্নের জবাব দিতে হবে যে, ‘কেন আপনি জঙ্গিবাদের সময় সুন্দরবন রক্ষায় আন্দোলন করেছেন?’ আমার উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত আক্রমণ ও কুত্সার সীমা-পরিসীমা নেই। গত কয়েক বছরে কদর্য, হিংস্র, বিদ্বেষী বহু আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছি আমি। আমার হয়তো যিশু খ্রিস্টের মতোই ভাবা উচিত, ‘ওরা জানে না, ওরা কী করছে।’ অবশ্য সবার জন্য আমার এ ভাবনা পুরোটা ঠিক হবে না। কেননা ছোট একটি অংশ হলেও কিছু ব্যক্তি খুব সচেতনভাবে জেনে-বুঝে আন্দোলন সম্পর্কে বিভ্রান্তি তৈরি করার জন্যই এ ধরনের কুত্সা বা অপপ্রচারে লিপ্ত আছে। সেটা আজ নয়, অনেক দিন থেকেই। বিএনপি-জামায়াত আমলেও দেখেছি যেমন, আওয়ামী আমলেও তেমন। এর পেছনে সক্রিয় আছে জাতীয় সম্পদ নিয়ে ধ্বংসাত্মক প্রকল্পে লাভবান দেশী-বিদেশী গোষ্ঠী, তাদের সুবিধাভোগী, প্রচারক বাহিনী বা লবিস্টরাও। এদের বোঝানোর চেষ্টা, এদের কাছে যুক্তি-তথ্য হাজির করা বৃথা। আর নিজের কাজ নিয়ে ফিরিস্তি দেয়াও আমার রুচিবিরুদ্ধ। একজন মানুষ হিসেবে, একজন শিক্ষক হিসেবে মানুষের পক্ষে সাধ্যমতো কথা বলা, তাত্ত্বিক সূত্রায়ণ, বিশ্লেষণ এবং অবস্থান গ্রহণ আমি আমার দায়িত্ব বলে মনে করি। আমার কথা ও কাজ সবকিছুই সবার সামনে আছে— প্রবন্ধ বই ওয়েবসাইট। কেউ যদি আগ্রহী হন, একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন।
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে ‘এগিয়ে আসতে’ সরকার থেকেও বহুবার আহ্বান জানানো হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নিজেও আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু কীভাবে এগিয়ে আসবে মানুষ? কার সঙ্গে আসবে? যারা নদী দখল করছে, যারা চাপাতি-অস্ত্র নিয়ে সদম্ভে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যারা ত্বকীর মতো কিশোরকে হত্যা করছে, যারা সাম্প্রদায়িক হামলা চালাচ্ছে, জমি দখল করছে, যৌন নির্যাতন চালাচ্ছে, যারা একের পর এক জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি করছে, তাদের পক্ষে কি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে চলা সম্ভব? তারা কি চায় জঙ্গিবাদ দমন? সারা দুনিয়ার অভিজ্ঞতা থেকেই দেখছি, যারা ‘ইসলামপন্থী’ জঙ্গি তৈরি করেছে, তারাই ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ আওয়াজ দিয়ে সারা বিশ্বকে সন্ত্রাসের ময়দানে পরিণত করেছে। তাদের অপকর্ম থেকেই জঙ্গি তৈরি ও জোগান অব্যাহত থাকছে। আবার ‘জঙ্গি হামলা’ এসব সরকারকে নানা সুবিধা করে দিচ্ছে। যেসব সরকার লোভী দানবদের দ্বারা পরিচালিত হয়, তাদের জন্য ‘জঙ্গি’ খুব আরামদায়ক সঙ্গী, কারণ সব জঙ্গি অপারেশন আতঙ্ক উন্মাদনা তাদের ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ আর জনগণের অধিকার হরণের কাজেই সহায়ক হয়। তাই সময় সময় ‘জঙ্গি’ লালন-পালনও তাদের জন্য খুব দরকার!
জঙ্গিবাদী মতাদর্শ কারো কথা শোনে না, যুক্তি মানে না, সব বিষয়ে তাদের মতই চূড়ান্ত। এর থেকে ভিন্নতা যে-ই দেখাবে, তার ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন, খুন সবই তারা উচিত কাজ বলে মনে করে। সরকার জঙ্গিবাদ দমনের কথা বলছে, এজন্য নানা আয়োজন চলছে, কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেও পাওয়া যাচ্ছে একই উপাদান। সরকার মনে করে, ইতিহাস, উন্নয়ন, রাজনীতি কিংবা অর্থনীতি সম্পর্কে তাদের ভাষ্যই শেষ কথা। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলাও অন্যায়, অপরাধ। আইন করে মত তৈরি, মতের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অপরিমেয় ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তারা কাউকে ‘সন্ত্রাসী’ মনে করলে যেকোনো নির্যাতন, খুন করতে পারে, করছেও। আদালতের রায় অমান্য করে তারা হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে আটক করেছে। আটক করে টাকা দাবি, টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়ার কাহিনী সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়, লোকমুখেও শোনা যায়। এ পর্যন্ত সহস্র মানুষকে ক্রসফায়ার বা বন্ধুকযুদ্ধের গল্প বলে হত্যা করা হয়েছে। চোখের সামনে যা ঘটে, যা সবাই জানে, তাও সরকারি ভাষ্যে পাল্টে যায়। শ্যামলকান্তি ভক্তকে অপমান করায় এমপির ভূমিকার সব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও পুলিশের কাগজে তা ‘নাই’ হয়ে যায়। পুলিশ র্যাবের ভাষ্য এখন এ রকমই, তাই ইতিহাসের সবচেয়ে কম বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গায় এখন তাদের ভাষ্য।
তরুণরাই সমাজের মধ্যে জঙ্গিবাদসহ দেশের সব রকম বিপদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবচেয়ে সংগঠিত শক্তি হতে পারে। তাদের শৃঙ্খলিত দমিত আতঙ্কিত করে কীভাবে প্রকৃত প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারে? যারা প্রকৃতই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক সক্রিয়তা গড়ে তুলতে চান, তাদের এসবের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে না?
নানা চেহারার সন্ত্রাসীদের অনুকূল জমিন তৈরি হচ্ছে নানাভাবে। মনের ক্ষোভ, হতাশা অনেক কারণেই তৈরি হতে পারে। চারদিকে অন্যায়, বঞ্চনা আর অপ্রাপ্তির শেষ নেই, নিজের অবসাদ থেকে মুক্ত হয়ে আরো শক্তিশালী জায়গা কী করে খুঁজে পাবে যদি সে সমষ্টির শক্তির সঙ্গে নিজের যোগ খুঁজে না পায়? তখন যদি কোনো ‘বিগ ব্রাদার’ এসে ‘কোমল কণ্ঠে’ তার মস্তিষ্ক দখল করে, তাহলে তার রোবট খুনি হওয়া কে ঠেকাবে কিংবা জীবন-জীবিকার সন্ধান করতে গিয়ে সমাজের আর কোনো বড় ভাইয়ের ক্ষমতার গুটি হওয়া? বিশ্লেষণের ক্ষমতা না থাকলে একজন বুঝবে কী করে কোনটা ঠিক কোনটা ভুল?
বিদ্বৎ সমাজ মেরুদণ্ড নিয়ে দাঁড়ালে এবং জনপন্থী রাজনীতি তার দৈন্য দূর করতে পারলে জনস্বার্থবিরোধী লুণ্ঠন ও ধ্বংসের প্রকল্প এবং জঙ্গিবাদসহ সব ধরনের বিপদ মোকাবেলা করা বাংলাদেশের জনগণের জন্য খুবই সম্ভব। দরকার ধর্ম-বর্ণ-জাতিগত গণ্ডি অতিক্রম করে মানবিক নতুন পরিচয়ে নিজেদের সংহতি দাঁড় করানো, দরকার শ্রেণী-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-জাতিগত বৈষম্য ও নিপীড়নবিরোধী চিন্তা ও লড়াইয়ের বিস্তার ঘটানো। সৃজনশীলতায় মানুষ ও প্রকৃতির সঙ্গে নৈকট্য থেকেই সেই জনচৈতন্য দাঁড়াবে। সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন এ পথই খুলে দিচ্ছে।
[লেখাটি ১৪ আগস্ট ২০১৬ তারিখে বণিকবার্তায় প্রকাশিত]