বৃহত্তর সুন্দরবনের অংশ রামপালে ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাকারীদের জ্ঞানের বহর নিয়ে সম্প্রতি জ্বালানি উপদেষ্টা সংশয় প্রকাশ করেছেন এবং তাঁদের পরামর্শ দিয়েছেন পড়াশোনা করতে। বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনার বলেছেন, সুন্দরবন ক্ষতি বা ধ্বংসের কথা একটা গুজব, আসলে কোনো ক্ষতি হবে না। পরিবেশমন্ত্রী বলেছেন, ক্ষতি হলে এ প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হবে। বিদ্যুৎসচিব বলেছেন, এ প্রকল্পে কোনো ক্ষতি হবে না বরং সুন্দরবন আরও সুরক্ষিত হবে! জ্বালানি উপদেষ্টা জেনে হয়তো খুশি হবেন, তাঁর পরামর্শ পাওয়ার আগেই এ বিষয় নিয়ে আমরা অধ্যয়ন করেছি, বিশেষজ্ঞদের গবেষণা দেখেছি, তাঁদের কথা শুনেছি। আমরা যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করেছি। সর্বোপরি, সুন্দরবনের দিকে এভাবে আগে কখনো মনোযোগ দিয়ে তাকাইনি, এবার তাকিয়েছি; এই বিশাল জগৎ সম্পর্কে জানা-বোঝার চেষ্টা এখন অব্যাহত রেখেছি। তবে এই পড়াশোনার কারণেই আমরা রামপাল প্রকল্পের ভয়াবহতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছি এবং তার বিরোধিতায় সক্রিয় হয়েছি। প্রকৃতপক্ষে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার আয়োজনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ আসে ‘রামপাল কৃষিজমি রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ’সহ সুন্দরবন এলাকার মানুষের কাছ থেকেই। ধারাবাহিক কর্মসূচির একপর্যায়ে তাঁরা আমাদের অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ করেন। আমরা তখন থেকেই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলা ছাড়াও ‘তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’র পক্ষ থেকে আমরা এলাকায় যাই; দিন, সপ্তাহ, মাস ধরে অনুসন্ধান করি; প্রতিবাদী মানুষের সঙ্গে কথা বলি। প্রকল্পের প্রধান স্থানীয় সংগঠক খুলনার সাবেক মেয়রের সঙ্গে কথা বলাও বাদ রাখিনি। তবে সরকারকে প্রথম থেকেই অসহিষ্ণু ও একগুঁয়ে দেখা গেছে। স্বচ্ছতা, যুক্তি, বিধি—এসব দিকে তাঁরা যাননি। সে জন্য এলাকায় গিয়ে আমরা সরকারের পুলিশ ও সন্ত্রাসী বাহিনী দ্বারা একাধিকবার আক্রান্তও হয়েছি। সব বিশ্লেষণ, অধ্যয়ন, গবেষণা, অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে আমরা যা পেয়েছি, সেগুলো হলো প্রথমত, এ প্রকল্প নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি অসম ও অস্বচ্ছ। দ্বিতীয়ত, এ প্রকল্পের জন্য যে স্থান নির্বাচন করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বের অমূল্য সম্পদ, দেশে ঘন ঘন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে শক্তিশালী প্রাকৃতিক রক্ষা বর্ম এবং অসাধারণ জীববৈচিত্র্যের আধার সুন্দরবনকে বাঁচানো যাবে না। আর তৃতীয়ত, এ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রথম থেকেই অনিয়ম, নিপীড়ন শুরু হয়েছে। প্রয়োজনীয় সমীক্ষার শর্ত পূরণ না করেই জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সন্ত্রাসী ও পুলিশ দিয়ে জোরপূর্বক গরিব মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। সুন্দরবন এমনিতেই বিপন্ন। সামগ্রিক অর্থনীতিতে দখলের প্রবণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরবনেও কাঠসহ বনজ সম্পদ নির্বিচারে লুণ্ঠন ও জমি দখলের প্রবণতা বেড়েছে। সুন্দরবনের এই বিপন্ন অবস্থার কারণ সরকারি নির্বিশেষে প্রশাসন-দখলদার-লুটেরা চক্রের ক্রমবর্ধমান তৎপরতা। এ-যাবৎকাল এসব তৎপরতা বেআইনিভাবেই চলেছে, এখন আইনি প্রক্রিয়াতেই সুন্দরবন অঞ্চল দখল, লুণ্ঠন ও ধ্বংস করার ব্যবস্থা চলছে। শিপইয়ার্ড, জাহাজভাঙা শিল্প ছাড়াও জমি দখলের শকুনি উৎসব দেখা যাচ্ছে। সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকায় গেলেই একটু পর পর ভূমিদস্যুসহ বিভিন্ন ব্যবসায়িক কোম্পানির সাইনবোর্ড দেখা যায়। সুন্দরবন ধ্বংস নিশ্চিত ও ত্বরান্বিত করতে সবচেয়ে বড় আক্রমণ নিয়ে এগিয়ে আসছে ‘রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প’। এ প্রকল্প যে সুন্দরবনকে ধ্বংসের ব্যবস্থা করবে, সে বিষয়টি বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ দল নিবিড় গবেষণা করে নিশ্চিত করেছে। পরিষ্কার দেখানো হয়েছে, কীভাবে এই প্রকল্প সুন্দরবন ও তার বেঁচে থাকার অবলম্বন পানি, বায়ু ও জীববৈচিত্র্যকে বিনাশ করবে। শুধু তা-ই নয়, এই দূষণ ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা শহরকেও বসবাসের অনুপযোগী করে তুলবে। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ মতামত, ভারতের অভিজ্ঞতা, পরিবেশ সমীক্ষা নিয়ে প্রহসন ইত্যাদি নিয়ে বিস্তৃত বিশ্লেষণ আমরা পুস্তিকাকারে প্রকাশ করেছি, যা এখন ওয়েবেও পাওয়া যাচ্ছে: <http://ncbd.org/?p=779> বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রায়ই ঘটে থাকে। এর শিকার হয় প্রধানত উপকূলীয় অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ। কয়েক বছর আগের সিডর, আইলার ভুক্তভোগী মানুষকে এখনো আশ্রয়হীন থাকতে হচ্ছে। যদি সুন্দরবন না থাকত, বিশেষজ্ঞরা বলেন, গত প্রাকৃতিক দুর্যোগেই তিন থেকে পাঁচ লাখ মানুষ সঙ্গে সঙ্গে নিহত হতো, আশ্রয়হীন-কর্মহীন মানুষের সংখ্যা হতো আরও কয়েক গুণ। তাহলে গত শত বছরে কত মানুষকে রক্ষা করেছে সুন্দরবন? আগামী শত বছরে কত কোটি মানুষের জীবন এই সুন্দরবন টিকে থাকার ওপর নির্ভর করে? যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলে সুন্দরবন তার আঘাত নিজে গ্রহণ করে, মায়ের মতো নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়েও সবাইকে বিপদ থেকে আগলে রাখে। প্রকৃতির আঘাত সুন্দরবনের মতো প্রাকৃতিক বন সহ্য করতে পারে, ঠিকই পুনরুৎপাদন করে নিজের জগৎকে। মানুষের সৃষ্ট আঘাত, বিশেষত তা যদি রামপাল প্রকল্পের মতো কিছু হয়, তার পক্ষে বহন করা দুঃসাধ্য। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র মারাত্মক পরিবেশদূষণ ঘটায় বলে সাধারণত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংরক্ষিত বনভূমি ও বসতির ১৫ থেকে ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয় না। ভারতের ‘ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশন অ্যাক্ট, ১৯৭২’ অনুযায়ী, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে এবং ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রণীত ‘পরিবেশ সমীক্ষা বা ইআইএ গাইডলাইন ম্যানুয়াল, ২০১০’ অনুযায়ী, কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বাঘ/ হাতি সংরক্ষণ অঞ্চল, জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান, বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য কিংবা অন্য কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা চলবে না। ভারতীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ‘তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন-সংক্রান্ত গাইডলাইন, ১৯৮৭’ অনুসারেও কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যায় না। এ জন্য গত কয়েক বছরে ভারতের কর্ণাটক, মধ্য প্রদেশ ও তামিলনাড়ুতে তিনটি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল হয়েছে (দেখুন, দ্য হিন্দু, ২৫ মে, ২০১২)। অর্থাৎ ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসিকে বাংলাদেশের সুন্দরবনের যত কাছে (সরকারের ষ্যমতো ১৪ কিলোমিটার, অন্য হিসাবে নয় কিলোমিটার) পরিবেশ ধ্বংসকারী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে দেওয়া হচ্ছে, তার নিজ দেশ ভারতে হলে সেখানকার আইন অনুযায়ী তা তারা করতে পারত না! যাঁরা বলছেন, এ প্রকল্পে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না, এখানে সুপারক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহূত হবে, তাঁরা যদি তাঁদের এসব যুক্তি ভারত সরকারকে বোঝাতে পারতেন, তাহলে ভারতে আরও তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ এখনই শুরু করা যেত! নিশ্চয়ই, বিদ্যুৎ আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকার। কিন্তু এটা তো সবাই স্বীকার করবেন, আমাদের বিদ্যুৎ দরকার দেশের উন্নয়নের জন্য, দেশকে ধ্বংস করার জন্য নয়। বিদ্যুৎ দরকার জীবনকে স্বচ্ছন্দ, আরামদায়ক ও সম্প্রসারণ করার জন্য, জীবনকে বিপর্যস্ত করার জন্য নয়। কিন্তু বারবার বিদ্যুৎ-সংকট সমাধানের নামে সরকার এমন পথে হাঁটছে, যা মুষ্টিমেয় কারও কারও জন্য লাভজনক হলেও দেশ ও জনগণের জন্য বিপদের পাহাড় তৈরি করে। এ কথাটা মাথায় গেঁথে নেওয়া দরকার যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প আছে, সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই। বিদ্যুৎকেন্দ্র অন্যত্র বানানো যায়, অন্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করা যায়, কিন্তু আরেকটা সুন্দরবন ইচ্ছা করলেই বানানো যায় না। বিদ্যুৎ-সংকট সমাধানে স্বল্প মেয়াদে, মধ্য মেয়াদে ও দীর্ঘ মেয়াদে বিভিন্ন পথ আছে। কম দামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের সহজ পথ সরকার কীভাবে গ্রহণ করবে, যদি দেশি-বিদেশি কিছু গোষ্ঠীকে ব্যবসা দেওয়া তার প্রধান অগ্রাধিকার হয়? একদিকে বঙ্গোপসাগরের বিশাল গ্যাসসম্পদ বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার আয়োজন, অন্যদিকে বিদ্যুতের মুলা ঝুলিয়ে সুন্দরবন ধ্বংসের ব্যবস্থা!
ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরকালে বলেছিলেন, দুই দেশকে যৌথভাবে সুন্দরবন রক্ষা করতে হবে। অথচ ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি নিজেদের দেশের আইন ভঙ্গ করে সুন্দরবনধ্বংসী এ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সব বিধিমালা ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে সরকার জোরজবরদস্তিমূলকভাবে এ ধ্বংসাত্মক প্রকল্প বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা ভারতের সজাগ মানুষের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি। তথ্য-যুক্তি দেখে, নিজেদের বিশেষজ্ঞদের মতামত জেনে তাঁরাও আতঙ্কিত, ক্ষুব্ধ। এই আন্দোলনে তাঁরাও শামিল হচ্ছেন। সুন্দরবন ধ্বংস হলে শুধু এপারের অংশই শেষ হবে না, ক্রমে ভারতের অংশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দুই দেশের সরকার যেখানে যৌথভাবে সুন্দরবন ধ্বংসে নেমেছে, সেখানে দুই দেশের জনগণকে সুন্দরবন রক্ষা করতে যৌথভাবে কর্মসূচি নিতেই হবে।
জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে তাই সুন্দরবন রক্ষাসহ সাত দফা দাবিতে দেশব্যাপী নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। সরকার যদি প্রকল্প বাতিল না করে, তাহলে আগামী ২৪ তারিখ ঢাকা থেকে সুন্দরবন অভিমুখে পাঁচ দিনব্যাপী লংমার্চ শুরু হবে। শুধু জাতীয় কমিটি নয়, অসংখ্য মানুষ, ছোট-বড় নানা সংগঠন সুন্দরবনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। ‘সুন্দরবন রক্ষা কমিটি’ গঠিত হয়েছে। সবাই নিজ নিজ উদ্যোগে নানা কর্মসূচি নিচ্ছেন। আর যে লাখ লাখ তরুণ সুন্দরবনের পক্ষে দিন-রাত খেটে ভোট সংগ্রহ করেছেন, তাঁরা সুন্দরবনকে এভাবে খুন হতে দেবেন কেন?
সুন্দরবন আমাদের অস্তিত্বের অংশ। তাকে আমরা কিছুতেই কিছু লোকের লোভের বলি হতে দিতে পারি না।
( সেপ্টেম্বর১৪, ২০১৩ তারিখে প্রথম আলোতে প্রকাশিত)