সুন্দরবনের আঙিনায় রামপাল বিদ্যুত্ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে ভারতের সাথে যৌথভাবে। এটা করতে গিয়ে অনেক রকম অনিয়ম করা হয়েছে, এখনও করা হচ্ছে। দেশের স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা এই প্রকল্পের ভয়াবহতা সম্পর্কে বহুবার সতর্ক করেছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞমত ও জনগণের বিরোধিতা উপেক্ষা করে, পরিবেশ অভিঘাত সমীক্ষা (ইআইএ) না করে, সরকার এলাকার মানুষের জমি দখল করেছে এবং মানুষ উচ্ছেদ করেছে। প্রতিবাদকারীদের উপর পুলিশ ও সন্ত্রাসী দিয়ে হামলা চালানো হয়েছে বহুবার। জমি অধিগ্রহণ ও প্রাথমিক চুক্তিসম্পন্ন করবার পরেই ইআইএ রিপোর্ট সম্পন্ন করা হয়েছে। আর একের পর এক ভুল তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। একদিকে বলপ্রয়োগ, হুমকি অন্যদিকে মিথ্যাচার দিয়ে এই সুন্দরবনধ্বংসী প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হবার চেষ্টা চলছে। এর সঙ্গে তাল দিয়ে বাংলাদেশের ওরিয়ন কোম্পানিও কয়লাভিত্তিক প্রকল্প নিয়ে হাজির হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বিস্তারিত তথ্য ও যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে, প্রাকৃতিক রক্ষাবর্ম হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ ও প্রকৃতিকে যে সুন্দরবন রক্ষা করে, এবং অসাধারণ জীববৈচিত্র্যের আধার হিসেবে যা প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখে সেই সুন্দরবনকে ধ্বংস করবে এই প্রকল্প। বিভিন্ন প্রকাশনা, গবেষণার মধ্য দিয়ে বিশেষজ্ঞরা কেনো এই কেন্দ্র বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থবিরোধী, সুন্দরবন ও মানববিধ্বংসী, তা বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ তথ্য যুক্তিসহ তুলে ধরেছেন। এটাও দেখানো হয়েছে যে, ভারতীয় কোম্পানি (এনটিপিসি) নিজ দেশের আইন ভঙ্গ করে বাংলাদেশের জন্য সর্বনাশা এই প্রকল্পে চালিকাশক্তি হিসেবে যুক্ত হয়েছে।
কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটায় বলে সাধারণত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংরক্ষিত বনভূমি ও বসতির ১৫ থেকে ২৫ কি.মি. এর মধ্যে কয়লা বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয় না। ভারতীয় কোম্পানি বাংলাদেশে সুন্দরবনের ৯-১৪ কি.মি.’র মধ্যে এই বিদ্যুত্ কেন্দ্রটি নির্মাণ করতে যাচ্ছে। বাফার জোন বিবেচনা করলে এই দূরত্ব ৪ কি.মি.। অথচ ভারতেরই ‘ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশান অ্যাক্ট ১৯৭২’ অনুযায়ী বিদ্যুত্ কেন্দ্রের ১৫ কি.মি. ব্যাসার্ধের মধ্যে এবং ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রণীত পরিবেশ সমীক্ষা বা ইআইএ গাইড লাইন ম্যানুয়াল ২০১০ অনুযায়ী, কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুত্ কেন্দ্রের ২৫ কি.মি.-এর মধ্যে কোন বাঘ/হাতি সংরক্ষণ অঞ্চল, জীব বৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য কিংবা অন্যকোন সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা অনুমোদন করা হয় না। ভারতীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ‘তাপ বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত গাইড লাইন, ১৯৮৭’ অনুসারেও কোন সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২৫ কি.মি.-এর মধ্যে কোন কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুত্ স্থাপন করা যায় না। এ জন্য গত কয়েক বছরে ভারতের কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ ও তামিলনাড়ুতে তিনটি বিদ্যুত্ প্রকল্প বাতিল হয়েছে। অর্থাত্ ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসিকে বাংলাদেশে সুন্দরবনের যত কাছে পরিবেশ ধ্বংসকারী কয়লা বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ করতে দেয়া হচ্ছে, তার নিজ দেশ ভারতে হলে সেখানকার আইন অনুযায়ী তা তারা করতে পারতো না!
ভারতীয় কোম্পানির মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা নিশ্চিত করতে ও দেশি কিছু সুবিধাভোগীর স্বার্থে প্রণীত এই ধ্বংসাত্মক প্রকল্পের সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বলা হচ্ছে যে, এই প্রকল্পে সুপারক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হবে, সে জন্য সুন্দরবনের কোন ক্ষতি হবে না। আমাদের প্রশ্ন প্রথমত, এই প্রযুক্তিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শতকরা ১০ ভাগ ক্ষতি কম হয় ঠিক, কিন্তু তাতে সুন্দরবনের ধ্বংসের সামগ্রিক ক্ষতি কীভাবে কমবে? দ্বিতীয়ত, এই প্রযুক্তি যদি সুন্দরবন ধ্বংস ঠেকানোর মতো এতো নিশ্চিত প্রযুক্তি হয় তাহলে ভারতীয় কোম্পানি কেনো ভারতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সকল ক্ষতি দূরীভূত করে না? কেনো গত তিন বছরে তাদের তিনটি বিদ্যুত্ কেন্দ্র বাতিল হয়? তৃতীয়ত, একদিকে বলা হচ্ছে এই বিদ্যুত্ কেন্দ্রের সব বিষাক্ত ফ্লাই এ্যাশ সিমেন্ট কারখানায় ব্যবহূত হবে। আর সারাদেশে সকল সিমেন্ট কারখানা বিজ্ঞাপন দেয় তাদের সিমেন্টে ফ্লাই এ্যাশ ব্যবহার করা হয় না। এই ধরনের প্রতারণা প্রচারণার সকল স্তরেই দেখা যায়।
দেশের শিল্প, কৃষি, ব্যবসা, শিক্ষা চিকিত্সা, জীবনযাপন এবং সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য সম্ভব মতো কম দামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত্ সরবরাহ অত্যাবশ্যক। এর জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাবলীর সুপারিশ আমরা বিভিন্ন সময়ে করেছি। আমাদের এসব সুপারিশের মূল কথা হলো জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের সম্পদ শতভাগ জনগণের মালিকানায় রেখে তার পুরোটা বর্তমানে ও ভবিষ্যতে দেশের কাজে লাগানো, খনিজ সম্পদ রফতানি নিষিদ্ধ করা, নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য জ্বালানির সংমিশ্রণে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। দেশ ও জনগণ এতে গ্যাস ও বিদ্যুত্ সংকট থেকে খুব দ্রুত মুক্ত হতে পারতো। কিন্তু এভাবে অগ্রসর হলে বহুজাতিক কোম্পানি, দেশি কতিপয় ব্যবসায়ী ও কমিশনভোগীরা বিরাট লুটপাট থেকে বঞ্চিত হতো সেটাই নীতিনির্ধারকদের জন্য সমস্যা।
কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র করতে গেলে কয়লা পরিবহন ও উত্পাদন পর্যায়ে তার বিষ উত্পাদন সুন্দরবনকে কীরকম বিপদে ফেলবে তার ছোট্ট নমুনা কয়েক মাস আগে তেলবাহী জাহাজ দুর্ঘটনার ফলাফল থেকে যে কেউ অনুমান করতে পারেন। গত ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী জাহাজ ডুবে গিয়ে জয়মনি, নন্দবালা, আন্ধারমানিক, মৃগমারী এলাকায় সাড়ে ৩ লাখ লিটার তেল ছড়িয়ে পড়ে। ঐ জাহাজ ফার্নেস তেল নিয়ে যাচ্ছিলো একটি তেলভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্রের দিকে। জোয়ার ভাটার টানে এই তেল ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। দুর্ঘটনার পর ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কোন উদ্ধার কাজ শুরু হয়নি। এই ছড়িয়ে পড়া তেল যে অপূরণীয় ক্ষতি করেছে তার নিরসনে কোন প্রস্তুতি বা ব্যবস্থা সরকারের ছিলো না। নদী থেকে তেল সরানোতে সরকারের ব্যর্থতা ও উদ্যোগহীনতার মুখে এলাকার বিভিন্ন বয়সী মানুষেরা জীবন ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে নিজেদের জানা বোঝা মতো তেল উঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারি আওয়াজ ও অকর্মণ্য ভূমিকা একই সঙ্গে অব্যাহত ছিলো, এখনও আছে।
এর আগে গতবছরের ১২ ও ৩০ সেপ্টেম্বর সিমেন্টের কাঁচামাল বহনকারী দুটো জাহাজ ডুবে গিয়েও অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এগুলোর পরিণতি নিয়েও সরকারি কোন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি, ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। সেজন্য ঐসব ঘটনার পরও সরকার এবিষয়ে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ৯ ডিসেম্বরের জাহাজ ডুবি পরবর্তী শ্যালা নদীসহ সুন্দরবনের অবস্থা সরেজমিনে বোঝা এবং এ ধরনের বিপর্যয় মোকাবেলায় কী করণীয় তা নির্দিষ্টকরণের জন্য এর পরপরই তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুত্-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর তানজিমউদ্দীন খান এবং প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা বিপর্যস্ত এলাকা সফর করেন। তাঁরা তাঁদের রিপোর্টে বলেন, “সামগ্রিকভাবে পুরো সুন্দরবনের প্রতিবেশ সংকটাপন্ন। এই প্রক্রিয়াটির সূত্রপাত শুধুমাত্র এই দুর্ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে ঘটেনি। ইতোমধ্যে রামপাল বিদ্যুত্ কেন্দ্র, ওরিয়ন বিদ্যুত্ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন শিল্পভিত্তিক কর্মকাণ্ড যেমন সাইলো নির্মাণ এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও ব্যবসায়ীদের সুন্দরবনের জমি কেনার হিড়িক ভীষণ সংবেদনশীল এই শ্বাসমূলীয় বন ও তার প্রতিবেশকে বিপন্ন করে তুলেছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি এতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, কোস্টগার্ডের মত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানও পিছিয়ে নেই। আমরা রামপাল বিদ্যুত্ কেন্দ্র এবং ওরিয়ন বিদ্যুত্ কেন্দ্র নিয়ে যেসব বিপর্যয়ের আশঙ্কা অনেকদিন ধরে করে আসছিলাম, শ্যালা নদীতে তেল নিঃসরণ সেই আশঙ্কাগুলোরই একটি বাস্তব নজির।”
সুন্দরবন নিয়ে সরকারের স্ববিরোধী ভূমিকা বরাবরই প্রকট। প্রধানমন্ত্রী একদিকে আন্তর্জাতিক বাঘ সম্মেলনসহ বিভিন্ন উপলক্ষে সুন্দরবন বাঁচানোর কথা বলেন অন্যদিকে তাঁর সরকার দেশি-বিদেশি মুনাফাখোরদের স্বার্থে সুন্দরবনধ্বংসী নানা তত্পরতায় সক্রিয় থাকছে। সুন্দরবনের সুরক্ষার জন্য আমরা সরকারের কাছে বার বার দাবি জানিয়েছি ক্ষতিকর সব পরিবহন এবং প্রকল্প বন্ধ করতে। কিন্তু সরকার সুন্দরবনের গুরুত্ব সম্পর্কে নির্লিপ্ত থেকে তার সুরক্ষার পরিবর্তে নিকটবর্তী নৌ-পথে বৃহত্ নৌ-পরিবহনের অনুমতি দিয়েছে, বিশাল কয়লা পরিবহনের উপর নির্ভরশীল একাধিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ করছে, নানা ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ভূমি দস্যুদেরকে জমি দখলের সুযোগ করে দিয়েছে। সুন্দরবন অঞ্চলে সরকারি ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের আরও বনজমি দখলের তত্পরতা এখন জোরদার। বিশ্বব্যাংক ও ইউএসএইডের তহবিলে তৈরি হচ্ছে নানা প্রকল্প।
বলাই বাহুল্য সরকারের এসব ভূমিকা আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ইতিমধ্যে ইউনেস্কো এবং রামসার সুন্দরবন ঘিরে একাধিক বিদ্যুত্ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন মুনাফামুখি তত্পরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। নরওয়ে সুন্দরবন ধ্বংসের এই প্রকল্পে যুক্ত থাকার অভিযোগ তুলে ভারতের এনটিপিসিতে অর্থযোগান বন্ধ করে দিয়েছে। দেশে সুন্দরবনধ্বংসী রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ প্রকল্প বাতিল ও বিদ্যুত্ সংকটের সমাধানে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে ঢাকা থেকে সুন্দরবন লংমার্চ ছাড়াও নানা প্রতিবাদী কর্মসূচি অব্যাহত আছে।
মহাবিপদের মুখে সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য আমাদের স্পষ্ট দাবি তুলতে হবে: (১) সুন্দরবনে তেলবাহী জাহাজ ডুবির ক্ষয়ক্ষতি জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে, মত্স্যজীবী বনজীবীদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। (২) শ্যালা ও পশুর নদীতে সুন্দরবনের জন্য হুমকিস্বরূপ নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে, দখলের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া নৌপথ দখলমুক্ত করতে হবে; এবং (৩) সুন্দরবনধ্বংসী কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত্ প্রকল্পসহ সব রকম ক্ষতিকর ব্যবসায়িক প্রকল্প বাতিল করে ‘সুন্দরবন নীতিমালা’ প্রণয়ন করে তার ভিত্তিতে এর যথাযথ সম্প্রসারণ ও বিকাশের উদ্যোগ নিতে হবে।
লুটেরা দখলদারদের মুনাফার জন্য কয়েক কোটি মানুষের প্রাকৃতিক রক্ষা বর্ম, বিশ্ব ঐতিহ্য, অসাধারণ জীববৈচিত্র্যের আধার এবং আমাদের অস্তিত্বের স্মারক সুন্দরবন ধ্বংস হতে দিতে পারি না। সুন্দরবন ধ্বংস করে বাংলাদেশকে অরক্ষিত করতে দিতে পারি না।
(০৭ এপ্রিল, ২০১৫ দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত)