সাগরচুরি থেকে বনবিনাশ

68f6b1511cf59ed226710eca93f2456a MUHAMMADবাজেট নিয়ে আলোচনায় মানুষের মনোযোগ এবার অনেক কম, বেশি হওয়ার কোনো যুক্তিও নেই। তা ছাড়া সন্ত্রাস, পাইকারি ধরপাকড়, দ্রব্যমূল্য, রোজা ইত্যাদি বিষয় উদ্বিগ্ন, ক্লান্ত মানুষের মনোযোগ অনেকখানি নিয়ে নিচ্ছে। বাজেট আসার আগেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এ নিয়ে অনেক আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে চেষ্টা করে। অর্থমন্ত্রী সংগঠিত কিছু গোষ্ঠীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন, তাদের মধ্যে প্রধানত অর্থনীতিবিদ ও বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থাকে। তবে শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর, নারী, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, প্রবাসীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসার বা তাঁদের কথা শোনার সময় হয় না। যাঁরা সৌভাগ্যবান হিসেবে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বসেছেন, তদবির করেছেন, সুপারিশের তালিকা দিয়েছেন, সেই ব্যবসায়ী নেতারাও দেখলাম এবার সন্তুষ্ট নন।

বাজেট উপস্থাপনের পর সংসদে এটা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হওয়ার কথা। বর্তমানে তারও কোনো গুরুত্ব নেই। কারণ, সরকারি দলের সাংসদেরা কতটুকু বলতে পারবেন তার সীমা খুব কঠিনভাবে নির্ধারিত। আর বিরোধী দলের কথা বলাই বাহুল্য। তারপরও যতটুকু আলোচনা হয়, সেই সময়ে সংসদে অর্থমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী প্রায়ই উপস্থিত থাকছেন না বলে সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে। কেনই বা থাকবেন? এসব আলোচনা যে বাজেটকে প্রভাবিত করবে না, সেটা তাঁদের থেকে ভালো আর কে জানেন? আর সংসদে যে তাঁরা সবকিছুই কণ্ঠভোটে পাস করে নিতে পারবেন, সেটাও তাঁরা ভালো জানেন। যতটুকু আলোচনার সুযোগ দেওয়া হয়, সেটা করুণা কিংবা ব্যয়বহুল নিয়ম রক্ষা।

তবে এক দিন অর্থমন্ত্রী তো ছিলেনই। ৭ জুন তিনি এক সাংসদের প্রশ্নের উত্তরে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বীকারোক্তি করেছেন, যা ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। তিনি সবার জানা কথাই স্বীকার করে বলেছেন, ‘আর্থিক খাতে পুকুরচুরি নয়, সাগরচুরি হয়েছে।’ এমনিতে বর্তমান অর্থনীতির গতি ও প্রকৃতি দুর্নীতি, কমিশন, ঘুষ, দখল, লুণ্ঠন তৎপরতা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। গত কয়েক বছরে তা অবিশ্বাস্য মাত্রা নিয়েছে। শেয়ারবাজার, হল-মার্ক বা সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, সম্প্রতি অগ্রণী ব্যাংক ইত্যাদিতে খুব রক্ষণশীল হিসাবেও অর্থ লোপাট হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এই টাকার পরিমাণ বাজেটে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে স্বাস্থ্য ও জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতে মোট যে ব্যয় ধরা হয়েছে তার সমান। এই পরিমাণ অর্থ কিছু লোক লোপাট করল, বিচার বা প্রতিকার তো দূরের কথা, তাদের আড়াল করার চেষ্টাই বরং বেশি। এখানেই তো শেষ না।

গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের ধনিক শ্রেণি গঠনে বিভিন্ন ব্যাংক, বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা মেরে দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেখান থেকে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকসহ নানা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে, বিদেশি ব্যাংকের ব্যবসা বেড়েছে, বিভিন্ন দেশে ঠিকানা তৈরি হয়েছে। এই লুটপাটে বিত্তবানদের গোষ্ঠী তৈরি হলেও ক্রমে এতে ব্যাংকগুলোর হিসাবে এক অচলাবস্থা দেখা দেয়। খেলাপি ঋণের ভারে ব্যাংকের অস্তিত্বের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠাই কঠিন হয়ে পড়ে। অবশেষে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকীয় সংস্কার কর্মসূচি এর একটি সমাধান বের করে। সেই সমাধান হলো বকেয়া ঋণের যে অংশ আর আদায় করা যাবে না বলে মনে করা হয় তা খাতা থেকে মুছে ফেলা, এর আনুষ্ঠানিক নাম হলো অবলোপন। যুক্তি হলো এতে ব্যাংকের হিসাবের চেহারা ভালো হবে। এই ব্যবস্থার ফলে অনেক ঋণ এখন আর ব্যাংকের কাগজপত্রে নেই।

এই ‘থেকেও নেই’ অর্থের পরিমাণ এখন ৪৯ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, এর সঙ্গে বর্তমান খেলাপি ঋণ যার পরিমাণ ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি। তার মানে জনগণের জামানতের এক লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যাংক থেকে চলে গেছে তথাকথিত আইনি পথেই। অর্থকরী খাতে অতএব কমপক্ষে ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি লোপাট হয়েছে। এই অর্থ আগামী অর্থবছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মোট বরাদ্দের সমান। যে বিপুল পরিমাণ অর্থ কতিপয় ব্যক্তি মেরে দিলেন, পাচার করলেন, তার কোনো খবর না করে, সেদিকে না তাকিয়ে বা এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিতে হাত-পা বাঁধা দেখে, অর্থ জোগাড়ে অস্থির হয়ে দিগ্বিদিক আক্রমণ চালিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। একই কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপকভাবে কমলেও বাংলাদেশে কমানো হয়নি। জনগণ ও দেশের অর্থনীতি তেলের দাম কমানোর বড় সুযোগ ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সরকার সেখান থেকে লাভের টাকা বানিয়ে তা সাগরচুরির ছিদ্রে ঢালতে চেষ্টা করেছে।

সাগরচুরির কথা স্বীকার করলেই তো কথা শেষ হয়ে যায় না। প্রশ্ন হলো, তারপর? সাগরচোরদের কী হবে? সরকারের তৎপরতায় সাগরচুরির গতি ও তৎপরতা পরিবর্তনের কোনো উদ্যোগ বা ব্যবস্থার লক্ষণ নেই। মুখে না বললেও বাস্তবতা এ রকমই যে, তারা বহাল তবিয়তে থাকবে এবং আরও চুরি বাড়াতে থাকবে। যদি আমাদের বোঝানো হয় যে, ‘এটাই উন্নয়ন, এভাবেই উন্নয়ন হয়’ আমরা কেন তা মেনে নেব? কেন সেই চুরি ও পাচারের ব্যবস্থায় বা তলাবিহীন পাত্রে আমরা আমাদের পরিশ্রমের অর্থ জোগান দিতে থাকব? স্বীকার করলেই তো আর দায়িত্ব শেষ হয় না, ঘাড়ে দায়িত্ব থাকবেই।

অর্থমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন, এসব সাগরচুরির সম্পূরক ব্যবস্থা হিসেবেই জনগণের ওপর ঋণ আর করের বোঝা বাড়াতে হচ্ছে। যারা বিত্ত অর্জন করছে সাগরচুরি করে, তাদের যেহেতু কাগজপত্রে অস্তিত্বই নেই, সে জন্য বোঝাটা জনগণের ওপরই ঢালতে হবে। নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা সাগরচুরির কর্তাদের ক্ষুধা তো শেষ হওয়ার নয়। তাই সত্যিকারের বঙ্গোপসাগর ডাকাতি করার দিকেও প্রকল্প তৈরি হতে থাকে। সুন্দরবনসহ বনবিনাশের মাধ্যমে বিত্ত গঠনে তার বিশেষ অস্থিরতা দেখা যায়। উন্নয়নের নামেই দেশের বনাঞ্চল এখন বিশেষভাবে আক্রান্ত ক্ষতবিক্ষত, নদী বিষাক্ত কিংবা ভরাট হয়ে দখলের জমিতে পরিণত।

রামপাল (এবং সেই সঙ্গে ওরিয়ন) বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সুন্দরবনের বিনাশ যে ঘটবেই, তা দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত হওয়ার কারণেই এর বিরুদ্ধে শুধু দেশে নয়, সারা বিশ্বেই প্রতিবাদ, ক্ষোভ বাড়ছে। ইউনেসকো এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে সতর্কীকরণ জানাচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরেই। ভারতেও এর বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশ শুরু হয়েছে। কারণ সুন্দরবন শুধু বাংলাদেশের সম্পদ নয়, ভারতের মানুষও এর ভাগীদার, এটি বিশ্বের ঐতিহ্য। সুতরাং এর বিনাশ ঘটলে বাংলাদেশের মানুষ হারাবে বিপদে, দুর্যোগে অসম্ভব শক্তিশালী এক আশ্রয়, অরক্ষিত হয়ে পড়বে বাংলাদেশ। আর বিশ্ব হারাবে এক অমূল্য সম্পদ।

প্রথম থেকেই অনিয়মে ভরা এই দেশধ্বংসী প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ সরকার অনেক রকম ছাড়ও দিচ্ছে। ২০১৩ সালের ১ জুলাই ঘোষিত বাংলাদেশ সরকারের এসআরও অনুযায়ী কোম্পানি ১৫ বছরের জন্য আয়কর মওকুফ পাবে, এখানে কর্মরত বিদেশি ব্যক্তিদের আয়কর দিতে হবে না কমপক্ষে তিন বছর, বৈদেশিক ঋণের সুদের ওপর কর প্রযোজ্য হবে না, প্রকল্প নির্মাণে নির্বাচিত ভারতীয় হেভি ইলেকট্রিক কোম্পানির যন্ত্রপাতি আমদানিতেও কোনো শুল্ক দিতে হবে না। বাঁশখালীতেও কোনো নিয়মকানুন নেই, পরিবেশ সমীক্ষা নেই, খুন করেও শেষ হয়নি, মানুষের ওপর জোরজুলুম চলছে। রূপপুরে ৯০ হাজার কোটি টাকার বিরাট ঋণের বোঝা নিয়ে এক ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনছে সরকার। নিরাপদ বিদ্যুতের জন্য বিশাল গ্যাসসম্পদের আধার আছে বঙ্গোপসাগরে। বিদেশি কোম্পানির কাছে সেই গ্যাসসম্পদ হারানোর চুক্তি করার জন্য নানামুখী চেষ্টা চলছে। শতভাগ গ্যাস নিজেদের কাজে লাগানোর, পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির অসীম সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান ও জনবল তৈরির জন্য বরাদ্দ নেই।

২০০৬ সালে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভারতের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল শ্রীলঙ্কার। কয়েক দিন আগে মানুষ ও প্রকৃতির ওপর এর ফলাফল বিবেচনা করে এবং মানুষের দাবির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে শ্রীলঙ্কার সরকার এই প্রকল্প বাতিল করেছে। শ্রীলঙ্কা পারলে বাংলাদেশ পারবে না কেন? বাংলাদেশের সুন্দরবন তো আরও বড় কারণ এ রকম প্রকল্প বাতিল করায়। শুধু তা-ই নয়, গত সপ্তাহে ভারতের জ্বালানি মন্ত্রণালয় ছত্তিশগড়, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র এবং ওডিশায় চারটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প একই ধরনের কারণে বাতিল করেছে। পাশাপাশি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সৌরবিদ্যুৎসহ ১৬ হাজার মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। (http://reneweconomy. com. au/ 2016 /india-cancels-four-major-new-coal-plants-in-move-to-end-imports-27494)

ভারত পারলে বাংলাদেশ পারবে না কেন? আমরা বারবার বলি, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনের বহু বিকল্প আছে, কিন্তু সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই’, ‘যা দেশকে বিপন্ন করে তা উন্নয়ন নয়’, ‘দেশধ্বংসী রামপাল, রূপপুর, বাঁশখালী প্রকল্প নয়, বিদ্যুৎসংকট সমাধানে জাতীয় কমিটির ৭ দফা বাস্তবায়ন করতে হবে।’ কিন্তু না, বাংলাদেশ সরকারের ইচ্ছা অতুলনীয় সম্পদ, চার কোটি মানুষের রক্ষা বাঁধ সুন্দরবন ধ্বংস করে ‘উন্নয়নের’ এক অভূতপূর্ব বিষাক্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেই হবে। বাজেটে এসব সাগরচুরি আর বনবিনাশী তৎপরতার সমর্থনে বরাদ্দ আছে, ছাড় আছে। নীতি নেই, বরাদ্দ নেই টেকসই বিদ্যুৎ সমাধানে জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের। ভুল নীতি আর দুর্নীতি তাই তৈরি করছে সাগরচুরি, নদী আর বনবিনাশের ‘উন্নয়ন’পথ।