আবারও সব যুক্তি-তথ্য অস্বীকার করে গ্যাস ও (এরপর বিদ্যুতের) দামবৃদ্ধির ফাইল নিয়ে সরকার নানা কায়দা-কানুনে ব্যস্ত। যুক্তি-তথ্যে না পেরে গায়ের জোরেই দামবৃদ্ধির আয়োজন করছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত নিয়ে সরকারের রোডম্যাপ মনে রাখলে কারও কাছে এটা বিস্ময়কর মনে হবে না। বরং এটা পরিষ্কার হবে যে, এটাই শেষ নয়, কিছুদিন পরপরই এরকম দামবৃদ্ধির বোঝা জনগণের ঘাড়ে পড়বেই। যৌক্তিক কারণে দামবৃদ্ধি হলে বা দামবৃদ্ধির মাধ্যমে পুরো খাত উপকৃত হলে আপত্তির কিছু থাকে না। কিন্তু সরকারের ভুল নীতি ও দুর্নীতির দায় কেন জনগণকে বহন করতে হবে? বিষয়টি পরিষ্কার করতে সংক্ষেপে হলেও পুরো খাত নিয়ে আলোচনা দরকার।
কোটি কোটি বছরের তৈরি হলেও তেল, গ্যাস, কয়লাসহ খনিজ-জ্বালানি সম্পদের ব্যাপক ব্যবহার মানুষ শুরু করেছে মাত্র কয়েকশ’ বছর আগে। জানাশোনা, দক্ষতা কোথাও আকাশ থেকে পড়েনি। মানুষ ক্রমে এগুলো অনুসন্ধান ও উত্তোলনে ক্ষমতা অর্জন করেছে। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবে কয়লা ছিল প্রাণ। উনিশ শতকে জ্বালানি তেল আবিষ্কার ও উত্তোলন শুরুর পর এর ওপর ভর করেই বিশ্ব অর্থনীতি বিস্তৃত হয়েছে। প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রাপ্তি এবং ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে আরও পরে। বিশ্বজুড়ে এসব সম্পদ ছড়িয়ে থাকলেও এর মালিকানা ও কর্তৃত্বের অসম বিন্যাস শক্তি ব্যবহারের বৈষম্য তৈরি করেছে, যুদ্ধ সহিংসতায় সভ্যতা বিপর্যস্ত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য দখল, গণহত্যা আর সংঘাতে দেশের পর দেশ যে ছিন্নভিন্ন, তার অন্যতম কারণ এ সম্পদ দখলে নিতে সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা। সীমিত এবং অনবায়নযোগ্য বলেই খনিজসম্পদ দখল থাকলে ব্যবসায়িক সংস্থাগুলোর মুনাফা বেশুমার। দখল ও মুনাফাকেন্দ্রিক উন্নয়নে জীবাশ্ম জ্বালানির অপরিমিত ব্যবহারে বিশ্বঅস্তিত্ব এখন বিপন্ন। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত কয়েক দশকে সূর্যরশ্মি, বাতাস এমনকি বর্জ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে ক্রমেই বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বিশ্বের জন্য যেমন, বাংলাদেশের জন্যও এ অসীম নবায়নযোগ্য জ্বালানিই ভবিষ্যৎ।
উর্বর আবাদি জমি ও পানিসম্পদ ছাড়াও উপরোক্ত উভয় ধরনের, অর্থাৎ নবায়নযোগ্য-অনবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদের দিক থেকে বাংলাদেশের অনেক শক্তির দিক আছে। তবুও শাসকদের জনবিরোধী নীতি ও দুর্নীতির কারণে সম্পদহীন, গরিব, অক্ষম হিসেবেই বাংলাদেশ এখনও বিশ্বে পরিচিত। বাংলাদেশের পূর্বদিক প্রধানত প্রাকৃতিক গ্যাসে সমৃদ্ধ, তেল পাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। উত্তরাঞ্চলে আছে অনেক কয়লাখনি। আর দক্ষিণে সমুদ্র। এ সমুদ্রে বিপুল সম্পদের মধ্যে প্রাণিজ নবায়নযোগ্য সম্পদ আছে, আবার তেল-গ্যাসের মতো অনবায়নযোগ্য সম্পদও আছে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, বঙ্গোপসাগরে বিশাল তেল-গ্যাসের ভাণ্ডার আছে। তাদের মত ও বিভিন্ন লক্ষণ বিবেচনায় নিলে বলতে হয়, আগামী শত বছরে জ্বালানি চাহিদা পূরণের মতো সম্পদ বঙ্গোপসাগরে আছে।
কিন্তু সম্পদ থাকলেই আর তা উত্তোলন করলেই একটি দেশ যদি উন্নত হতো তাহলে বর্তমান বিশ্বে আফ্রিকার দেশগুলো সবচেয়ে উন্নত থাকত। সিঙ্গাপুর, জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশ আছে যারা জ্বালানি সম্পদ খুব কম কিংবা না থাকা সত্ত্বেও জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ সংকটের টেকসই সমাধান করেছে। আবার মিয়ানমার, নাইজেরিয়া, ঘানা, ত্রিনিদাদসহ বহু দেশ আছে যারা বিপুল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র্য, বিদ্যুতের সংকট ও সামগ্রিক অনুন্নয়নের বিষচক্রে আবদ্ধ। এসব দেশে বিদেশী বিনিয়োগ হয়েছে অনেক, বহুজাতিক কোম্পানিরও ভিড় আছে, কিন্তু দারিদ্র্য, সহিংসতা আর দুর্নীতির বিষচক্রে আটকে থেকে এসব দেশ এখন ‘অভিশপ্ত সম্পদের দেশ’ হিসেবে বিবেচিত। বহু দেশের অভিজ্ঞতা, যদি কমিশনভোগী আর দুর্নীতিবাজরা দেশ শাসন করে তাহলে দেশের সম্পদই হয়ে দাঁড়ায় সর্বজনের বিপদের কারণ। বাংলাদেশকেও এ মডেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য গত প্রায় তিন দশক ধরে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, বহুজাতিক কোম্পানি ও তাদের দেশী কমিশন এজেন্ট দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-আমলা কনসালটেন্টরা ব্যস্ত। জনপ্রতিরোধের কারণে তাদের সব ইচ্ছা পূরণ না হলেও এ দুষ্টচক্র বিশ্ব দখল ও লুণ্ঠনের নানা প্রকল্প নিয়ে এখনও সক্রিয়।
বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সম্পদে মালিকানার চিত্র পাল্টেছে। ৭০ দশক পর্যন্ত এর ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল সেভেন সিস্টার্স বলে পরিচিত কিছু বহুজাতিক কোম্পানি এবং সেইসূত্রে যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনসহ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর। তখন পর্যন্ত তাদের দখলে ছিল বিশ্বের ৮৫ ভাগ তেলসম্পদ। গত চার দশকে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, ইউরোপের বহু দেশ তাদের জাতীয় সংস্থা বিকশিত করেছে। খনিজসম্পদের ওপর সার্বভৌম মালিকানা তাদের উন্নয়ন নীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর ফলে সর্বশেষ হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ৭৩ ভাগ তেলসম্পদ এসব দেশের জাতীয় সংস্থার মালিকানায়, উত্তোলনের ৬১ ভাগ তাদের নিয়ন্ত্রণে (অয়েল অ্যান্ড গভর্নেন্স, ২০১৪, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস)। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকা গত বছর সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের বাইরে নতুন সাতভগ্নীকে চিহ্নিত করেছে, যেগুলোর সবই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। এগুলো হল : সৌদি আরামকো, গাজপ্রম (রাশিয়া), চীনা কোম্পানি, ন্যাশনাল ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি, পেট্রোব্রাস (ব্রাজিল), ভেনিজুয়েলা তেল সংস্থা (পিডিভিএসএ), পেট্রোনাস (মালয়েশিয়া)। ইউরোপ বিবেচনায় নরওয়ের স্টেটঅয়েল অবশ্যই এ তালিকার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হবে। নরওয়ের কল্যাণমূলক অর্থনীতি এ তেলসম্পদের অর্থেই পরিচালিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের শাসকদের ‘রোডম্যাপ’ উল্টোদিকে। পেট্রোবাংলা উপরোক্ত পেট্রোনাস আর স্টেটঅয়েলের সমবয়সী হলেও প্রতিষ্ঠার ৪২ বছর পরও এ প্রতিষ্ঠানকে নিজের সক্ষম ভিত্তি দাঁড় করাতে দেয়া হয়নি। নির্লজ্জের মতো অক্ষমতার অজুহাতে, ‘পারি না পারব না’ এ আওয়াজের মাধ্যমে লুণ্ঠন ও দুর্নীতির প্রকল্প জায়েজ করা হয়েছে, হচ্ছে। বিশাল সম্ভাবনার বঙ্গোপসাগরের সম্পদ ‘আকর্ষণীয় প্যাকেজে’ এমনভাবে বিদেশী কোম্পানিকে দেয়া শুরু হয়েছে, এ সম্পদ দেশের উন্নয়নে কাজে লাগার পরিবর্তে হয়ে উঠতে যাচ্ছে বিপদ। আগেও পুঁজির অভাবের যুক্তি দিয়ে দেশের সম্পদ বিদেশী কোম্পানির হাতে দেয়া হয়েছে, যার কারণে ১০ থেকে ৩০ গুণ বেশি দামে গ্যাস কিনতে হচ্ছে। যে পরিমাণ পুঁজি নেই বলে এসব চুক্তি করা হয়েছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি অর্থ বিদেশী কোম্পানির পক্ষে প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। ঋণগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি, বারবার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে এসব ভুল নীতি ও দুর্নীতির কারণেই। এসব কাজে আইন আদালতের ঊর্ধ্বে থাকার জন্য সরকার প্রণয়ন করেছে দুর্নীতির দায়মুক্তি আইন।
এখন আবার দরপত্র ছাড়াই বঙ্গোপসাগরের বিশাল সম্ভাবনাময় ব্লকগুলো ‘পারস্পরিক বোঝাপড়ার’ ভিত্তিতে বিদেশী কোম্পানির মধ্যে বিতরণের আয়োজন করা হচ্ছে। এটি করা হলে এখানকার গ্যাস আমদানি দামের চেয়েও বেশি দামে কিনতে হবে। নিজেদের গ্যাস এভাবে অন্যদের হাতে তুলে দিয়ে করা হচ্ছে সুন্দরবনবিনাশী রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প কিংবা ঋণ ও ঝুঁকিনির্ভর রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প।
স্থলভাগে মার্কিন কোম্পানি শেভরনের মোট বিনিয়োগ ১.২ বিলিয়ন ডলার বলে সুখ্যাতি শুনি। কিন্তু তাদের কাছে মাগুরছড়ার ধ্বংসযজ্ঞের শুধু গ্যাসের জন্য পাওনা ২.৫ বিলিয়ন ডলার আদায়ের কথা শোনা যায় না। বরং তার কর্তৃত্ব ও সুবিধা বাড়ানো হয়। কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর কাছ থেকে টেংরাটিলা ধ্বংসযজ্ঞের জন্য প্রাপ্য সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ আদায় না করে আন্তর্জাতিক আদালতে তাকে মাঠ ছেড়ে দেয়া হয়। অথচ এ দুটি কোম্পানি বাংলাদেশের যে পরিমাণ গ্যাস সম্পদ নষ্ট করেছে তা প্রায় দুই বছরে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের সমান।
দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ আমাদের শিক্ষা দেয়, যেসব দেশ আজ উন্নয়নের নতুন দিশা তৈরি করছে তারা নিজস্ব সম্পদের ওপর জাতীয় মালিকানা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথ নিয়েছে, নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিয়েছে। প্রকৃত উন্নয়নের দিশা তৈরিতে বাংলাদেশের সেই অভিজ্ঞতা মনে রেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো নিতে হবে, সরকার না নিলে নেয়ার জন্য জনমত তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলোর মধ্যে আছে: প্রথমত, সমুদ্র ও স্থলভাগের গ্যাস সম্পদ শতভাগ জাতীয় মালিকানায় রেখে অনুসন্ধান ও উত্তোলন করা। যেখানে ক্ষমতার ঘাটতি আছে সেখানে প্রয়োজনে সাবকন্ট্রাক্ট দিয়ে, বিদেশী ও প্রবাসী বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগিয়ে ঘাটতি দূর করা। দ্বিতীয়ত, খনিজসম্পদ রফতানি নিষিদ্ধকরণ আইন করে শতভাগ সম্পদ দেশের অর্থনীতির কাজে লাগানো নিশ্চিত করা হবে। তৃতীয়ত, কয়লা সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে উন্মুক্ত খনি নিষিদ্ধসহ ফুলবাড়ি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করা। জাতীয় সংস্থার মাধ্যমে দেশের মাটি, পানি ও জনবসতি উপযোগী পদ্ধতি নির্ধারণ করা, নিজস্ব গবেষণা ভিত্তি দাঁড় করানো। নবায়নযোগ্য আবাদি জমি ও পানি সম্পদের সর্বনাশ করে জননিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা বিপর্যস্ত করে কোনো প্রকল্প গ্রহণ না করা। চতুর্থত, কুইক রেন্টালের মতো দুর্নীতিযুক্ত অদক্ষ-অকার্যকর পথে না গিয়ে রাষ্ট্রীয় খাতের বিদ্যুৎ প্লান্ট সঠিকভাবে পরিচালনা করা। পঞ্চমত, সুন্দরবনধ্বংসী বিদ্যুৎ প্রকল্প আর দুর্নীতিকে দায়মুক্তি দেয়ার আইন বাতিল করে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সর্বজনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদন করা। ষষ্ঠত, নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকে মূলস্রোত হিসেবে দাঁড় করার জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা। সপ্তমত, এসব কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের জন্য বিপর্যস্ত জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরুদ্ধার এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা।
এভাবে অগ্রসর হলে কম দামে সব নাগরিকের জন্য নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে, অর্থনীতির প্রয়োজনীয় বিকাশ সম্ভব হবে। রামপালে সুন্দরবনবিনাশী, রূপপুরে ঋণনির্ভর মহাবিপদের প্রকল্প করতে হবে না। বলাই বাহুল্য, এ পথে অগ্রসর হতে হলে সরকারের বিদ্যমান রোডম্যাপের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। দেশী-বিদেশী কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থে পরিচালিত না হয়ে জনগণের স্বার্থকে গুরুত্ব দিতে হবে। আসলে বাংলাদেশে সম্পদের অভাব নেই, অভাব জনপন্থী রাজনীতির।
(২৭ আগস্ট ২০১৬ তারিখে দৈনিক যুগান্তর-এ প্রকাশিত)