সমুদ্র সম্পদে ‘আকর্ষণীয় প্যাকেজ’

৭ জুলাই আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের পর বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি পরিষ্কার চিত্র পেয়েছে। এর ফলে এই নির্দিষ্ট সীমার ভেতর বাংলাদেশ জাতীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় সম্পদ নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণে সক্ষম। কিন্তু কাগজ-কলমে জমির মালিক হলেও বাংলাদেশের বহু মানুষ যেমন প্রবল ক্ষমতাধর দখলদারদের জন্য সেই জমি নিজের দখলে রাখতে পারেন না, বা তা নিজের অবস্থা উন্নয়নে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হন, তেমনি সমুদ্রসীমার ওপর শুধু আইনগত স্বীকৃতি এই সমুদ্রের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কর্তৃত্ব এবং এই বিপুল সম্পদ দেশের মানুষের কাজে লাগানো নিশ্চিত করে না।
এই সংশয় ও উদ্বেগ বাংলাদেশের সরকারগুলোর ভূমিকা থেকেই সৃষ্টি হয়। দক্ষিণ তালপট্টি নিয়ে এখন বাদানুবাদ হচ্ছে। কিন্তু গত তিন দশকে কোনো সরকারই এই দ্বীপের ওপর বাংলাদেশের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ, গবেষণা, সংলাপ, আদালত কোনো কিছুই
করেনি। এখন পরিষ্কার হচ্ছে, এই অমনোযোগ ও নির্লিপ্ততার জন্য বাংলাদেশ কত ঝুঁকির মুখে পড়েছিল এবং সম্ভাব্য কত সম্পদ ও এলাকা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হলো।
২০১৩ সালের ২৬ নভেম্বর ভারতের ডিফেন্স ফোরাম ইন্ডিয়াতে প্রথমে এই খবর প্রকাশিত হয় যে ভারত ২০০৬ সালেই হাড়িয়াভাঙ্গার মুখের ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণের খাড়িতে ১০০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সন্ধান পেয়েছে, যেটি বাংলাদেশ-ভারতের বিরোধপূর্ণ এলাকা।একটি একক কেন্দ্রে এটি ভারতের সর্বোচ্চ মজুত।এর আগে কৃষ্ণ গোদাবরি অববাহিকায় যে মজুত পাওয়া গিয়েছিল, তার পরিমাণ জানা গিয়েছিল ৫০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট।গত বছরের ২৭ নভেম্বর ভারতের দৈনিক টেলিগ্রাফ-এও এই খবর প্রকাশিত হয়।
<http://www.telegraphindia.com/1131127/jsp/nation/story_17616878.jsp#.U8TYGZSSzmt> এই সূত্রেই সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি রায়ের পর এই অঞ্চলে ভারতের দখল নিশ্চিত হওয়ায় সে দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ভারতের স্বস্তির কথা জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ কথিত দক্ষিণ তালপট্টি এবং ভারত কথিত নিউমুর এই এলাকাতেই অবস্থিত। অর্থাৎ বাংলাদেশ তার আদি দাবি অনুযায়ী যদি দক্ষিণ তালপট্টির ওপর তার মালিকানা রাখতে পারত, তাহলে এই গ্যাসসম্পদের মালিক হতো, যা বর্তমান প্রমাণিত মজুতের ১০ গুণ।সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা বরাবর এই ছোট্ট দ্বীপ দক্ষিণ তালপট্টি আবিষ্কৃত হয় ১৯৭৪ সালে। এর পরপরই বাংলাদেশ এই দ্বীপের ওপর সার্বভৌম অধিকার দাবি করেছিল।১৯৭৯ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে এই বিষয়ে আলোচনা হয়। ১৯৮০ সালের ১৮ আগস্ট ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরের পর দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়, ‘হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর উপকূলে নতুন জেগে ওঠা দ্বীপ (নিউমুর/দক্ষিণ তালপট্টি/পূর্বাশা) নিয়েও দুই পক্ষের আলোচনা হয়েছে। দুই পক্ষই এই মর্মে সম্মত হয়েছে যে দুই সরকারের মধ্যে আরও তথ্য বিশ্লেষণ ও বিনিময়ের পর যথাশিগগির শান্তিপূর্ণভাবে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য আরও আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।’
(www.hcidhaka.gov.in/bi_doc/24.doc)
কিন্তু এই বিষয়ে পরে আর আলোচনার খবর পাওয়া যায় না। ১৯৮১ সালে ভারতের সেনাবাহিনী সেখানে ভারতের পতাকা উত্তোলন করে।বাংলাদেশের নৌবাহিনীও সে সময় খবর পেয়ে যে দ্বীপ পর্যন্ত যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, তা বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খুরশেদ আলম জানিয়েছেন।
২০১০ সালে তালপট্টি বিলীন হওয়ার কথা জানা গেলেও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার জেলেদের স্মৃতিতে দক্ষিণ তালপট্টি খুব ভালোভাবেই আছে। ২০১০ সালের ৬ আগস্ট প্রথম আলোর এক রিপোর্টে এক জেলে আজগর শেখের বরাত দিয়ে ইফতেখার মাহমুদ জানিয়েছেন, ‘তাঁর দুঃখ একটাই, দক্ষিণ তালপট্টি আর নেই। সমুদ্র থেকে উঠেছিল, সমুদ্রেই গেছে তলিয়ে। কেওড়াগাছের সারি, নানা পাখপাখালির অবাধ ওড়াউড়ির কথা মনে পড়ে তাঁর। ওখানে গেলে সুন্দরবনের স্বাদ পেতেন তিনি।’
সে জন্যই সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আদালতে নিষ্পত্তির সময় বাংলাদেশ দক্ষিণ তালপট্টি হারায়নি, হারিয়েছে বহু আগেই। ভারত এর ওপর কর্তৃত্ব রেখেছে এবং বাংলাদেশের কোনো সরকারই এটা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করেনি। এমনকি বাংলাদেশের কোনো মানচিত্রেও দক্ষিণ তালপট্টিকে নিজেদের সীমায় দেখানো হয়নি। সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে শুনানির সময় তাই বাংলাদেশের অবস্থান ছিল প্রমাণ করা যে এই দ্বীপের অস্তিত্ব নেই।আর ভারতের প্রতিনিধিদল চেষ্টা করেছে এটা প্রমাণ করতে যে এই দ্বীপের অস্তিত্ব আছে। যদি ভারতীয় ভূমি হিসেবে দ্বীপের অস্তিত্ব থাকত, তাহলে বাংলাদেশের আরও এলাকা ছেড়ে দিতে হতো। কারণ, দ্বীপের
ওপর মালিকানার সুবাদে সীমারেখা টানতে ভারতের জন্য বাড়তি সুবিধা নিশ্চিত হতো। আর এই দ্বীপ যদি বাংলাদেশের মালিকানায় থাকত, তাহলে বাংলাদেশ সমুদ্রের আরও বেশি অঞ্চল নিজের দখলে আনতে পারত।
তাহলে হেগে আন্তর্জাতিক আদালতে যে শুনানি হয়েছে এবং যে রায় হয়েছে সেটা কি আরও ভালো হতে পারত? আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে হলো কেন বাংলাদেশকে? দ্বিপক্ষীয় সংলাপে কেন ফয়সালা হলো না? রায়ের বিস্তারিত বিবরণ থেকেই তা স্পষ্ট হয়। আদালতে ভারত যে দাবিনামা উত্থাপন করেছিল, দ্বিপক্ষীয় সংলাপ হলে, অভিজ্ঞতা বলে, ভারতকে সেখান থেকে নড়ানো যেত না। অভিন্ন নদী, সীমান্ত হত্যা, ট্রানজিট, বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার অভিজ্ঞতা ভালো নয়। ভারত কখনোই বহুপক্ষীয় আলোচনায় উৎসাহী নয়, কোনো ক্ষমতাধর রাষ্ট্রই সেটা পছন্দ করে না।
একই কারণে তুলনামূলক দুর্বল রাষ্ট্রের জন্য দরকার বহুপক্ষীয় আলোচনা। দরকার আন্তর্জাতিক আইন ও ফোরামের সব সুযোগ সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা।আমাদের দাবি থেকে ছাড় দিতে হয়েছে বেশ উল্লেখযোগ্য অংশ, ২০০ নটিক্যাল মাইলের পর বহিঃসমুদ্রে প্রবেশাধিকার সংকুচিত হয়েছে। এসব দুর্বলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সমুদ্রসীমায় যতটুকু অর্জন করেছে, তা সম্ভব হয়েছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি, খুরশেদ আলমসহ কজন ব্যক্তির আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক আদালতের কারণেই। অভিন্ন নদী নিয়ে সমস্যা নিষ্পত্তির জন্যও আমাদের তাই আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী অগ্রসর হওয়া ছাড়া উপায় নেই। অথচ এখানেও প্রস্তুতিহীনতা ও উদ্যোগহীনতার সমস্যা প্রকট।
সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির পর সমুদ্র বিষয়ে মহাপরিকল্পনা, জাতীয় নিরাপত্তা ও সম্পদ উত্তোলনে জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের কাজটিই গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া আইনগত কর্তৃত্ব কার্যকর কর্তৃত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে না। সমুদ্র মানে শুধু ব্লক নয়। যতটা জানা তার চেয়ে অনেক বেশি অজানা বিশাল সম্পদের আধার এই সমুদ্র। সমুদ্র সার্বভৌমত্বের অন্যতম ক্ষেত্র। এই সমুদ্রসীমায় বাংলাদেশের কর্তৃত্ব নিশ্চিত করা এবং সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের কথা না বলে বিদেশি কোম্পানিকে কতটা ‘আকর্ষণীয় প্যাকেজ’ দেওয়া যায়, সেটা নিয়েই সরকার তৎপর। ইতিমধ্যে ভারত, রাশিয়া, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন তেল কোম্পানির লবিস্টরা ব্যতিব্যস্ত। তাঁদের উচ্চকণ্ঠ আর অট্টহাসির মধ্যে বাংলাদেশের স্বার্থ নিয়ে কথা বলা ও শোনা কঠিন। মনে হচ্ছে এই সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি এসব কোম্পানিরই বিজয়।
খনিজ সম্পদ নিয়ে দুনিয়াজুড়ে কী হচ্ছে তা আমাদের জানতে হবে। খনিজ সম্পদ উত্তোলন নিয়ে

( জুলাই ১৮, ২০১৩ তারিখে প্রথম আলোতে প্রকাশিত)