হরতাল, অবরোধ, বোমা, আগুন, গুলি, ক্রসফায়ার, গাছকাটা, সম্পদ ধক্ষংস, অচলাবস্থা, নিরাপত্তাহীনতা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে মানুষ আরও ডুবছে, ডুবতে যাচ্ছে দেশ। এর মধ্যে ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ এর রেকর্ড ছাড়িয়ে নির্বাচন নামের আরেকটি মহাপ্রহসন জোরকদমে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে দেড় শতাধিক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত! এর মধ্যে হত্যা, চাঁদাবাজী, দখল, লুন্ঠনের দায়ে অভিযুক্ত অনেকেই আছে। এই অনির্বাচিতরাই এখন ‘নতুন’ সরকার গঠনে সক্ষম, কোন আইনগত বাধা নেই!! এতে কি বিদ্যমান সংকটের সমাধান হলো? না। আমরা শুনতে পাচ্ছি অধিকতর সহিংসতা আর অনিশ্চয়তার পদধ্বনি।
ইকনমিস্ট পত্রিকা বাংলাদেশের বিদ্যমান সংকটকে অভিহিত করেছে ‘ব্যাটল অব টু বেগমস’ বা ‘দুই বেগম-এর লড়াই’ বলে। সমাজের মধ্যে থেকেও প্রায়ই ‘দুই মহিলা’ ‘দুই মেয়ে-মানুষ’ ‘দুই ঝগড়াটে নারীর’ উদ্দেশ্যে তিরস্কার শুনি। অনেকে বলেন এই দুই নেত্রী গেলেই দেশ বাঁচবে। আসলে কি তাই? এই দুজনের জন্যই কি এতো সমস্যা? ‘মাইনাস টু’ প্রকল্পের কথাও শোনা গিয়েছিলো ২০০৭-০৮ এ। অনেকে দুই প্রধান দলের অব্যাহত কর্মকান্ডে দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে এভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। যারা এভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তাঁরা যে খুব চিন্তাভাবনা করে এগুলো বলেন তা মনে হয় না। অনেকসময় সুবিধাভোগীরা সামনে তোয়াজ করলেও পেছনে এই নারী নেতৃত্ব নিয়েই কটাক্ষ করেন। তবে এসব কথাবার্তা তাদেরই অবস্থান শক্তিশালী করে যারা মনে করে নারী নেতৃত্ব কখনোই সফল হতে পারেনা বরং তা সমস্যা সৃষ্টিকারী, সুতরাং অবশ্যই পরিত্যাজ্য। নেতৃত্বের কাজ কখনোই নারীর নয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাজে যে প্রচলিত এধরনের বক্তব্য সম্পর্কে সজাগ, তা বোঝা গেলো গত ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় দেয়া তাঁর বক্তৃতায়। এর আগে আমি তাঁর কম প্রচারিত একটা সাক্ষাৎকারেও দেখেছিলাম তিনি এধরনের বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু তাঁর এই সজাগ অবস্থানের সাথে খালেদা জিয়ার প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত আক্রমণের ভাষা মেলে না। কেননা সেসব আক্রমণে রাজনৈতিক বিষয়বস্তুর চাইতে নারী হিসেবে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি কটাক্ষ থাকে বেশি। বলাইবাহুল্য, এসব বক্তব্য নারীনেতৃত্ব হিসেবে তাকেও আক্রান্ত করে। নেত্রীর এসব বক্তব্যে কর্মীরা তাদের মনের ভাব প্রকাশে উৎসাহিত হয়। এবং ক্রমে দুইদলের কর্মীদের মধ্যে অপরদলের নেত্রীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কুৎসা ও নারী বিদ্বেষই প্রকাশিত হয় বেশি। সবমিলিয়ে সমাজে প্রচলিত নারীবিদ্বেষী চিন্তা ও কথাই উৎসাহিত হয়। রাজনৈতিক পার্থক্য, বিতর্ক পরিণত হয় নারী বিষয়ক যৌনগন্ধী আলোচনায়। সমাজের রাজনৈতিক বোধ বিষাক্ত হয়। এটাই হয়ে আসছে বছরের পর বছর। তাতে সমস্যার গোড়ায় যাওয়া যায় না, পথের সন্ধানও মেলে না
প্রকৃতপক্ষে ১৯৮১-৮২ থেকেই এই দুই নারী বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ১৯৯১ থেকে তাঁরা পালাক্রমে দেশের সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। এই সময় অর্থনীতি, রাজনীতি, বিশ্বনীতিতে যা যা ঘটেছে, বাংলাদেশের যা কিছু ভালোমন্দ ঘটেছে এগুলোর দায়দায়িত্ব ও কৃতিত্ব নিজ নিজ সময়কাল অনুযায়ী তাঁদের ওপর নিশ্চয়ই বর্তাবে। কিন্তু এর কোনটিই নারী হিসেবে নয়, নির্দিষ্ট রাজনীতির নেতা হিসেবেই তাঁদের ওপর বর্তায়। যে উন্নয়ন নীতি ও দর্শনের দ্বারা আমরা পরিচালিত হচ্ছি তার সাথে তাদের সম্পর্ক সরকার প্রধান হিসেবে, নারী হিসেবে নয়। এইসব নীতি ও দর্শন বিশ্ব পুঁজির স্বার্থে প্রণীত, আমাদের দেশের শাসক শ্রেণীর স্বার্থে গৃহীত ও বাস্তবায়িত। দুপক্ষেরই নেত্রী নারী। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শাসনামলে নেতা কর্মী ও সহযোগী সুবিধাভোগীদের দখল, লন্ঠন, দুর্নীতি, কমিশনের ঘটনাবলীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ কিংবা প্রায় সকলেই পুরুষ। সরকারি ক্ষমতার মদদে যারা রামদা আর অস্ত্র নিয়ে সন্ত্রাস বিস্তার করছে তারাও পুরুষ। উপদেষ্টা বা নীতি নির্ধারকরা পুরুষ। পর্দার আড়ালেও বহু পুরুষ নীতি নির্ধারণীতে ভূমিকা পালন করেন।
এই সময়কালে শহর গ্রাম, কর্মস্থল, শিক্ষাঙ্গন, পথঘাট এমনকি ঘরবাড়িতে যৌন নিপীড়ন ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে। প্রতারণা, বলপ্রয়োগ ও জালিয়াতির মাধ্যমে নারীপাচারের ঘটনাও অব্যাহত আছে। এই দুর্বৃত্তরা সবাই পুরুষ, সহযোগী হিসেবে কোথাও কোথাও দু’একজন নারী পাওয়া যাবে। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক সরকারি দলের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এই দুর্বত্তরা এসব কর্মকান্ড অব্যাহত রাখতে পারে না, কিংবা শাস্তির উধের্ক্ষ থাকতে পারে না। যদিও আন্তর্জাতিক জনমত ও দেশে আন্দোলনের চাপে বেশ কিছু আইন হয়েছে। এই সময়কালে মেয়েদের শিক্ষা, সরকারি প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্বকালীন ছুটির সময়সীমা বৃদ্ধি, বাবার সাথে মার নাম লেখার বাধ্যবাধকতা এগুলো হয়েছে। কিন্তু সমাজে ক্ষমতার বিন্যাসে পরিবর্তন না আসায়, দুইদশকেরও বেশি সময় নারীনেতৃত্ব থাকা সত্ত্বেও, নারীর নিরাপত্তাহীনতার ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য সৃষ্টি হয়নি। কেননা নারী হলেও তাঁরা দুজনই পুরুষতন্ত্র দ্বারা আচ্ছন্ন, বর্তমান ক্ষমতার বিন্যাসের সঙ্গে যা মানানসই। তবে সরকার প্রধান নারী হবার কারণে কিছু ইতিবাচক ঘটনা ঘটেছে, তার একটি হল তাঁরা ইচ্ছা করলেও, নারী হবার কারণেই, এরশাদের মতো পীর, মসজিদকে নিজেদের রাজনীতির কাজে ব্যবহার করতে পারেন নি। বাংলাদেশের মানুষ একটি বড় প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।
তাহলে কেনো বাংলাদেশে এই রাজনৈতিক সংকট? আমার মূল বক্তব্য হলো, ব্যক্তি বা নেতার দায়দায়িত্ব অবশ্যই আছে, কিন্তু এই সংকট কেবল দুজন ব্যক্তির সমস্যা, বিশেষ করে দুজন নারীর বিষয় হিসেবে দেখলে এই দুইজন নিয়ে হাজার দিনরাত আলোচনা বিতর্ক বা রসালাপ হতে পারে, কিন্তু সংকট বোঝা বা তার ভার থেকে উদ্ধারের পথ তৈরি হবে না। এটা অবশ্যই ঠিক যে, এই দুইজনই বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় ও পরিণত নেতৃত্বের স্বাক্ষর রাখতে পারেননি। কিন্তু তাঁদের স্ব স্ব দলে, কিংবা এই দলগুলোর বাইরে যে অসংখ্য পুরুষ নেতা আছেন তাঁরা এর চাইতে পরিণত কী নেতৃত্বের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছেন কিংবা চ্যালেঞ্জ হতে পেরেছেন? বরং আমরা সবাই জানি যে এই দুই নারীই নিজ নিজ দলের সংকটকালে দল ও দলের ঐক্যরক্ষার জন্য নেতৃত্বের দায়িত্ব নিতে বাধ্য হয়েছেন। সব লক্ষণই বলছে দুই নেত্রীই তাদের আসন স্ব স্ব পুত্রের হাতে ছেড়ে দেবার আয়োজন করছেন। তাতে কি পরিস্থিতির উন্নতি হবে? মানুষ তো এই তরুণ ও পুরুষ নেতৃত্ব দেখে আরও ভীতসন্ত্রস্ত। তাই যদি হয়, তাহলে মানুষ যখন হাসিনা – খালেদার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তখন তা আসলে নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে নয়, যে রাজনীতি ও অর্থনীতি, যে দলীয় ভূমিকা মানুষকে পীড়িত করছে, মানুষ আসলে তারই প্রতিবাদ করছে। নিজের কাছে তা পরিষ্কার না থাকলেও।
বাংলাদেশ যেভাবে চলছে তার মধ্যে এই বছর সহিংসতা, খুন, আগুন, আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ৪২ বছর আগেই যে যুদ্ধাপরাধের শাস্তি নিশ্চিত হওয়া উচিৎ ছিলো তা এখনও শেষ তো হয়ইনি, বরং দেশের রাজনীতিতে একটি বড় বিষফোঁড়া হয়ে আছে। সামরিক শাসনের প্রশ্রয়ে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী সংগঠিত হয়েছে। আবার প্রধান দুইদলের স্বীকৃতি পেয়ে ৮০ দশকে ’গণতান্ত্রিক’ আন্দোলনের শরীক হয়েছে। ১৯৯১ থেকে এই দুই নেত্রীর নেতৃত্বাধীন দলগুলো বিভিন্ন সময় তাদের সাথে আঁতাত করায় তাদের বিপদভঞ্জন হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতার অংশীদার করে তাদের আরও ক্ষমতাশালী করেছে। এছাড়া ধর্মকে বিভিন্নসময় ভোটের রাজনীতিতে ব্যবহারের কারণে নিপীড়কবান্ধব ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ডালপালা ছড়িয়েছে।
যেসময়ে যে রাজনীতির প্রক্রিয়ায় দেশে যুদ্ধাপরাধীদের দাপট বেড়েছে, নিপীড়কবান্ধব ধর্মভিত্তিক রাজনীতির শক্ত ভিত তৈরি হয়েছে, সেইসময়ে সেই রাজনীতির আধিপত্যের মধ্য দিয়েই তৈরি হয়েছে লুটেরা কোটিপতি, বেড়েছে দুর্নীতি ও সম্পদ পাচার, দখল লুন্ঠনে বনজঙ্গল, নদী খাল উন্মুক্ত জমি জনগণের হাতছাড়া হয়েছে, কমিশনভোগীদের দাপটে স্বাক্ষরিত হয়েছে নানা জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি। এগুলোই সম্মিলিতভাবে দেশকে এক ভয়ংকর অনিশ্চয়তায় নিক্ষেপ করেছে। কোন প্রতিষ্ঠান দাঁড়ায়নি, স্বচ্ছতা দাঁড়ায়নি। সংবিধানের ধারাবলে একব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে দেশি ও বিদেশি লুটেরা গোষ্ঠী, জনগণকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে, যা খুশি তাই করবার স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এইকারণেই এই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ধরে রাখা বা তা দখলে নেয়ায় তৈরি হয়েছে উন্মাদ জনধক্ষংসী রাজনীতি।
আসলে এই জনধক্ষংসী লুটেরাবান্ধব রাজনীতির ঘোড়ায় যে নেতা হিসেবে চড়বে তারই ভূমিকা হবে একইরকম। এখানে নারী পুরুষ বা হাসিনা – খালেদা বা জয় – তারেক মূল সমস্যা নয়, তাই সমাধানও নয়। তাদের সামনে রেখে যেসব দেশি বিদেশি শক্তি দেশকে ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছে তাদের দিকেই দৃষ্টি দিতে হবে। মানুষ যতোদিন ব্যক্তিকেন্দ্রিক মনোযোগ ছেড়ে রাজনীতি ও মতাদর্শকে প্রশ্ন না করতে শিখবে, জনপন্থী রাজনীতির শক্তি হিসেবে নিজেরা সরব ভূমিকা নিয়ে দাঁড়াতে না পারবে, ততোদিন এই বিষাক্ত বৃত্ত থেকে মুক্তি নেই। বলা দরকার যে, এই জনপন্থী রাজনীতির বিকাশে নতুন মুক্ত নারী নেতৃত্বকেই বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।।
(ডিসেম্বর ১৭,২০১৩ তারিখে আমাদের বুধবার এ প্রকাশিত)