বাঁশখালীতে আবারও পুলিশের গুলিতে সাতজন নিরস্ত্র, খেটে খাওয়া মানুষ নিহত হলেন। এস আলম গ্রুপ ও চীনা কোম্পানির যৌথ বিদ্যুৎ প্রকল্প ঘিরে দখল, বঞ্চনা, প্রতারণা এবং জনগণের ওপর দমন-পীড়ন-নির্যাতন এমনকি গুলি করে হত্যার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগেও ২০১৬ সালে এ রকম হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। সে সময় জনগণকে উন্নয়ন সম্পর্কে মিথ্যাচার করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জমি দখল করছিল এসব কোম্পানি। সে সময়ই এলাকার মানুষ এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তখনও গুলি চালিয়ে কমপক্ষে চারজন মানুষকে খুন করা হয়েছিল। জখম ও ঘরছাড়া হয়েছিলেন বহুজন। এর পর যৌথ বাহিনী মোতায়েন করে জবরদস্তির ওপর কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করা হয়। যে শ্রমিকরা এখানে কাজ করছিলেন তাদের কর্মঘণ্টা ও মজুরি পরিশোধে ভয়ানক জবরদস্তি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে এ বছর ন্যায্য দাবি জানিয়েছিলেন শ্রমিকরা। দাবি-দাওয়া পূরণের বদলে প্রথমে হুমকি, পরে পুলিশের গুলি। কমপক্ষে সাতজন নিহত ছাড়াও কতজন জখম, তার হিসাব এখনও হয়নি। জীবননাশী এসব প্রকল্পের জন্য বারবার মানুষকে জীবন দিতে হচ্ছে। রক্তের ওপর তৈরি হচ্ছে ‘উন্নয়নের’ সৌধ!
২০১৬ সালে নিহতদের পরিবার, আহতসহ এলাকাবাসীর ওপরেই চাপানো হয় মামলা। শুরু হয় আরেক দফা হয়রানি। এর পর হত্যাকাণ্ডে প্রশাসন এবং এস আলম গ্রুপের ভূমিকা আড়াল এবং কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পকে একটি পরিবেশবান্ধব প্রকল্প হিসেবে হাজির করতে বিজ্ঞাপন ছাড়াও শুরু হয় যথেচ্ছ মিথ্যাচার। ঘটনাগুলো একই রকমে এবারেও ঘটে যাচ্ছে। ২০১৬ সালে তদন্ত, বিচার কোনো কিছুই আর অগ্রসর হয়নি। এ বছরও শুরু হয়েছে পাইকারি মামলা, হয়রানি ও মিথ্যা প্রচার। ২০২১ সালের হত্যাকাণ্ড বুঝতে গেলে তাই ২০১৬ সালের ঘটনাবলির নিবিড় পর্যবেক্ষণ দরকার।
বস্তুত এলাকায় নতুন অশান্তির শুরু আইনকানুন-নিয়মনীতি ভঙ্গ করে প্রতারণা ও জবরদস্তির মাধ্যমে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার চেষ্টা থেকে। কয়েক বছর আগেই চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপকূলীয় এলাকা গণ্ডামারা বড়ঘোনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপকে সরকার অনুমতি দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় চীনা কোম্পানি। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে এস আলম গ্রুপ সেপকো ইলেকট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন নামে একটি চীনা কোম্পানির সঙ্গে এই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। তার তিন বছর পর ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সরকার এস আলম গ্রুপের দুটো সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ১২২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতি কিলোওয়াট ৬.৬১ টাকা দরে বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তি স্বাক্ষর করে।
তিন বছর ধরে এসব ঘটনা ঘটতে থাকলেও এলাকার মানুষ এ সম্পর্কে অবগত হন ২০১৬ সালে। সে সময় কোনো পরিবেশ অভিঘাত সমীক্ষাও করা হয়নি। পরিবেশ অভিঘাত সমীক্ষা ছাড়া এমন প্রকল্প কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, এ সমীক্ষা থেকেই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব কোন প্রকল্প কতটা ক্ষতি করবে আর কতটা লাভজনক হবে; আদৌ তা গ্রহণযোগ্য কিনা।
গুরুতর অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া যায় সরকারি অফিসের একটি প্রতিবেদন থেকেই। ৫ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে বাঁশখালী উপজেলার ভূমি অফিস এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ প্রতিবেদনই স্পষ্ট করে- এস আলম গ্রুপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা গোপন রেখে টেক্সটাইল মিলস ও ভেজিটেবল অয়েলের নামে জমি কিনছিল। ভূমি অফিস গণ্ডামারা, পশ্চিম বড়ঘোনা ও পূর্ব বড়ঘোনা মৌজায় মাত্র ১৫০টি বসতবাড়ি দেখিয়ে জমি হস্তান্তরের পক্ষে খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করিয়েছিল। প্রতিবেদন অনুযায়ী এ অঞ্চলে পাঁচ হাজার একর জমি নিজ কর্তৃত্বে আনার প্রয়োজন জানিয়েছে এস আলম গ্রুপ, যার মধ্যে ১৭২৮ একর খাসজমি। তা ছাড়া যে ১৭০০ একর খাসজমি অব্যবহূত দেখানো হয়েছিল, সেগুলোও ভূমিহীনরা বিভিন্ন অর্থনৈতিক কাজে ব্যবহার করছেন। তা ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত আইন অনুযায়ী খাসজমি কেবল ভূমিহীনরাই পেতে পারেন; কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান নয়।
আমরা তখনই জেনেছি, প্রকল্পের স্থান নির্বাচন, জমি ক্রয়, অধিগ্রহণসহ নানা অনিয়ম ও প্রতারণার বিরুদ্ধে এলাকার মানুষ প্রতিবাদ করে আসছিলেন বেশ কিছুদিন ধরে। সন্ত্রাসী ও দালালদের দাপটে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন মানুষ। বারবার হামলা-হুমকির ঘটনা ঘটেছে। হয়রানি বৃদ্ধির এক পর্যায়ে ২০১৬ সালের ৩ এপ্রিল এলাকার সাতজন মানুষকে গ্রেপ্তার ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়। তার প্রতিবাদেই ৪ এপ্রিলের সমাবেশ ডাকা হয়েছিল।
২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল বাঁশখালীর গণ্ডামারায় চারজন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হওয়ার মাসের অধিক সময় পর ১০ মে সরকারি প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে। তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। সদস্য ছিলেন অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি এবং চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের সহকারী সুপার। খুবই বোধগম্য কারণে কমিটি এ হত্যাকাণ্ডের দায় আন্দোলনকারীদের ওপর চাপিয়েছে।
২০১৬ সালের হত্যাকাণ্ডের ১২ দিন পর ১৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় জেলা প্রশাসকও স্বীকার করেছিলেন- ‘প্রথমে বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারছি, গণ্ডামারায় জমির মালিকরা প্রকৃত মূল্য পায়নি। মাঝখান থেকে কিছু বাটপাড় দালাল টাকা নিয়ে গেছে। ফলে এলাকাবাসীর মনে ক্ষোভ জন্মেছে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘সেখানের অবস্থা এত খারাপ, সেটা আমরা বুঝতে পারিনি। কারণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বাঁশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিষয়টি তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছেন।’ কেন এবং কার স্বার্থে তারা এ ভূমিকা রেখেছেন, সেটা নিয়েই এলাকাবাসীর ক্ষোভ।
তখনও বিভিন্ন প্রচারণায় ‘দুপক্ষের সংঘর্ষে’ চারজন নিহত হয়েছেন, বলা হয়েছিল। আমরা প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানে কোনো সংঘর্ষের আলামত পাইনি। বরং জেনেছি, অভিযুক্ত এস আলম গ্রুপের অফিস থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে একটি সমাবেশ শুরুর আগেই পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের গুলিতে গ্রামের মানুষ নিহত হন; আহত হন গর্ভবতী, শিশুসহ অনেকে। আহত সবাই নানা রকম হয়রানির শিকার হন। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যেতেও বাধা দেওয়া হয়। যারা গিয়েছিলেন গুরুতর জখম নিয়ে, তাদের গ্রেপ্তার করে হাতকড়া পরানো হয়। এ বছরও সন্ত্রাসী-পুলিশ যৌথভাবে আক্রমণ করেছে বলে অভিযোগ আছে। হয়রানি মামলাও একই রকম। না, ২০১৬ সালে বাঁশখালী হত্যাকাণ্ডে জড়িত কেউ ২০২১ পর্যন্তও গ্রেপ্তার হয়নি। গ্রেপ্তার হয়েছে নিহত ও আহত পরিবারের লোকজন, হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদী মানুষেরা।
এসব জোর-জুলুম, নির্যাতন এমনকি হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা বলতে গেলেই কয়লা বিদ্যুতের উপকারিতা বিষয়ে সরকারের নানা পর্যায় থেকে ভুল তথ্যভরা একগুঁয়ে বক্তৃতা শুনতে হয় সব সময়। কেউ যদি কয়লা বিদ্যুৎ অপরিহার্যও মনে করেন, তাকে কেন অনিয়ম, দুর্নীতি, জোর-জুলুম ও হত্যাকাণ্ডের পক্ষে দাঁড়াতে হয়? কেন নূ্যনতম নিয়মনীতি ভঙ্গ করে প্রকল্প করতে হয়? ‘উন্নয়ন’ যদি সত্যিকারেই হয়, তাহলে পরিবেশ অভিঘাত সমীক্ষা না করে জবরদস্তি কেন? তা নিয়ে মানুষের কথা শুনতে অসুবিধা কী? মানুষের প্রতিবাদে সরকারের ভয় কোথায়? খবর প্রকাশে এত বাধা কেন? খোলাখুলি কথা বলতে অসুবিধা কী? শ্রমিকদের কেন অব্যাহত নিপীড়ন ও বঞ্চনার মধ্যে রাখতে হবে? রাখলে তার প্রতিবাদ করা যাবে না কেন? না; কেউ কথা বলতে পারবে না- কোনো সভা-সমাবেশ করা চলবে না। সন্ত্রাসী আর পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় বাহিনী লাগানো হবে জনগণের বিরুদ্ধে। এটাই রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে তথাকথিত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে। একই চেহারা আমরা দেখেছি ফুলবাড়ীতে; এখন দেখছি সুন্দরবন, রূপপুর, মাতারবাড়ী, বাঁশখালীসহ নানা স্থানে। বাঁশখালীতে তার চরম পরিণতিতেই বারবার রক্তক্ষয় হচ্ছে; এখনও ত্রাস অব্যাহত আছে। এ প্রকল্পে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রমিক আনা হয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। কর্মঘণ্টা, মজুরি; কোনো কিছুরই ঠিক ছিল না। শ্রমিকদের রাখা হয়েছে বদ্ধ জায়গায়। করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধির বিপরীত ব্যবস্থা চলেছে এখানে। রমজানে সব কর্মস্থলে সরকারের বিধি অনুযায়ী কর্মসময় পুনর্বিন্যাস করা হয়। কিন্তু এখানে কর্মঘণ্টা পুনর্বিন্যস্ত করা হয়নি।
জোর-জবরদস্তি, প্রতারণা, ভয়ভীতি, দুর্নীতির ওপর ভর করে ‘উন্নয়ন’ নামের ভূমি গ্রাস, দুর্নীতি ও ধ্বংসের তৎপরতা চললে তা নিয়ে অসন্তোষ সৃষ্টি হবেই। যথাযথ স্বচ্ছতা, জনসম্মতি এবং জনস্বার্থ নিশ্চিত না হলে জনগণ কোনো প্রকল্পই গ্রহণ করবে না। কোম্পানি, সন্ত্রাসী আর সরকারের যদি যোগসাজশ থাকে তাহলে যথেচ্ছাচার চলতেই থাকবে। তবে ভয়ভীতি কতদিন মানুষকে চুপ করিয়ে রাখতে পারবে? খুনিদের বিচার হবে না; প্রাণপ্রকৃতি বিনাশী তৎপরতা চলবে; শ্রমিকের মজুরি বকেয়া থাকবে; সর্বজনের জমি-বন দখল চলতে থাকবে আর কত দিন?
[২৬ এপ্রিল ২০২১ তারিখে দৈনিক সমকালে প্রকাশিত]