যে দেশে মানুষের জীবন সবচাইতে তুচ্ছ, সেখানে নতুন আক্রমণ শুরু হয়েছে জনগণের বিরুদ্ধে। ৬ জানুয়ারি থেকে ৩৪ দিনে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন মোট ৮৫ জন। এরমধ্যে পেট্রোল বোমা ও আগুনে দগ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন ৫১ জন। এদের মধ্যে শিশু, নারী, তরুণ, বৃদ্ধ, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী, পেশাজীবী শ্রমজীবী সবধরনের মানুষই আছেন। সংঘর্ষ ও ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ৩৪ জন। এরমধ্যে ক্রসফায়ারে বা বন্দুকযুদ্ধের নামে পুলিশ বা র্যাবের গুলিতে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯ জন। গ্রেফতারের সঠিক সংখ্যা বলা কঠিন। পত্রপত্রিকার বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে ধারণা করা যায়, এর সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশকে সর্বজনের জন্য উপযুক্ত বাসভূমি হিসেবে গড়ে তুলতে, সামনে অগ্রসর হতে, আমাদের যখন দরকার আরও অনেক গুরুতর বিষয়ে সমাজে বিতর্ক, রাজনৈতিক লড়াই, সাংগঠনিক প্রস্তুতি তখন ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া’ এবং ‘যুদ্ধাপরাধীর বিচার’ এই দুটো অনিষ্পন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র রাজনীতি এক বিষচক্রের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। একমাসেরও বেশি অতিক্রান্ত হলো অনিশ্চিত, নিরাপত্তাহীন, প্রায় অচল অবস্থায় দেশ ‘চলছে’। পেট্রোল বোমা, সহিংসতা, খুন, আগুন, আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণে মানুষ দিশেহারা। পরিস্থিতি ভয়াবহ আরও এই কারণে যে, এর শেষ কোথায় তার কোন কূলকিনারা নেই তাদের সামনে। হিংসা, প্রতিহিংসা জমে জমে ক্রমেই আরও ভয়ংকর চেহারা নিচ্ছে। দু:স্বপ্নের যেনো শেষ নেই।
কারা পথেঘাটে বাসে ট্রেনে নিষ্ঠুর প্রাণঘাতী হামলা চালাচ্ছে? এর উত্তরে সাধারণভাবে ধারণা করা হচ্ছে, সরকারও দাবি করছে, এগুলো করছে বিএনপি ও জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। হুকুমের আসামি হিসেবে খালেদা জিয়াসহ বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। শীর্ষ নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হয়েছেন, খালেদা জিয়া প্রায় অন্তরীণ অবস্থায় আছেন। কয়েক হাজার নেতাকর্মী আটক। তারপরও হামলার কমতি নেই। অন্যদিকে খালেদা জিয়াসহ বিএনপি নেতৃবৃন্দের দাবি, এসব সন্ত্রাসী ঘটনা সরকারই ঘটাচ্ছে আন্দোলনকে দুর্বল করবার জন্য। হাজার হাজার গ্রেফতার করা হলেও এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের সনাক্ত করা ও তাদের বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে পুলিশ র্যাবেরও তেমন কোন অগ্রগতি নেই। ঘটনা যারাই করুক, যেহেতু হরতাল অবরোধ কর্মসূচির মধ্যে এসব ঘটনা ঘটছে সেজন্য এর প্রধান দায়িত্ব বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের। তবে যারা ক্ষমতায় থাকে ভালো মন্দ সবকিছুর দায় তাদেরই নিতে হয়, নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের মূল দায়িত্ব সরকারের। এতোদিনে এতোটুকু পরিষ্কার যে, সরকারের গৃহীত পথ ও পদ্ধতিগুলো পরিস্থিতির ভয়াবহতা দূর করতে কোনো কাজে আসছে না।
গত ১৯ জানুয়ারি সরকারের অন্যতম মুখপাত্র মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছিলেন, ‘কথা দিলাম, আগামী সাত দিনের মধ্যে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’ ২৮ জানুয়ারি বিজিবির মহাপরিচালক বলেছিলেন, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক। আর কেউ বার্ন ইউনিটে আসবে না।’ পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তাদের মুখেও বেশ কয়েকবার কঠিন হুমকি ও আশ্বাস শোনা গেছে। বলেছেন, সব সন্ত্রাসীর তালিকা করা হয়েছে। শীগগিরই সব দমন করা হবে। দেখামাত্র গুলির কথা তাঁরাও বলেছেন। নেতা মন্ত্রীরাও বলেছেন, বলেছেন সরকারের এটর্নি জেনারেলও। পুলিশের ডিআইজি সবাইকে স্তম্ভিত করে গত ৭ ফেব্রুয়ারি বলেছেন, অপরাধীদের শুধু নয় তাদের বংশধরদেরও নিশ্চিহ্ন করা হবে। ‘দেখামাত্র গুলি’তে মানুষ মরছে, নির্বিচার গ্রেফতার হচ্ছে, দমনপীড়ন অব্যাহত আছে কিন্তু চোরাগুপ্তা হামলা কমছে না। পথেঘাটে পেট্রোল বোমা হামলার শিকার যেমন সাধারণ মানুষ, সাথে সাথে নির্বিচার গ্রেফতার ও দমনপীড়নের শিকারও সাধারণ মানুষই।
বিএনপির মূল দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। আর তার সঙ্গী জামায়াতের মূল এজেন্ডা যুদ্ধাপরাধী বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করা, ইতিমধ্যে শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মুক্ত করা। ৪৪ বছর হতে চলেছে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দাঁড়ায়নি। যে কারণে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রতিবারই অশান্তি ও সহিংসতা তৈরি হয়। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবির আন্দোলন কেন্দ্র করেই সৃষ্ট সহিংসতায় নিহত হয়েছিলেন ৮২ জন। নির্বাচন কেন্দ্র করে ২০০১ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ৯৬ জন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতে সৃষ্ট সহিংসতায় ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে ৩২ জন এবং ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ৮ ডিসেম্বর ৫৯ জন নিহত হন (তথ্যসূত্র: একটি পত্রিকার ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫-এর খবর)। এছাড়া জখম ও সম্পদ ধ্বংসের সব হিসাব পাওয়াও প্রায় অসম্ভব।
বহু আগেই যুদ্ধাপরাধের শাস্তি নিশ্চিত হওয়া উচিত ছিলো তা এখনও শেষ তো হয়ইনি, বরং দেশের রাজনীতিতে একটি বড় বিষফোঁড়া হয়ে আছে। সামরিক শাসনের প্রশ্রয়ে যুদ্ধাপরাধীরা সংগঠিত হয়েছে। ১৯৯১ থেকে দুই নেত্রীর নেতৃত্বাধীন দলগুলো বিভিন্ন সময় তাদের সাথে আঁঁতাত করায় তারা রাজনীতিতে ক্রমেই প্রভাবশালী হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতার অংশীদার করে তাদের আরও শক্তিদান করেছে। যে সময়ে যে রাজনীতির প্রক্রিয়ায় এগুলো ঘটেছে সেই একই রাজনীতির আধিপত্যের মধ্য দিয়েই তৈরি হয়েছে লুটেরা কোটিপতি, বেড়েছে দুর্নীতি ও সম্পদ পাচার। দখল লুণ্ঠনে বনজঙ্গল, নদী খাল খোলা জমি সর্বজনের হাতছাড়া হয়েছে। কমিশনভোগীদের দাপটে স্বাক্ষরিত হয়েছে নানা জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি। কোন প্রতিষ্ঠান দাঁড়ায়নি, স্বচ্ছতা দাঁড়ায়নি, জবাবদিহিতার জায়গাও তৈরি হয়নি। সংবিধানের ধারাবলে এযাবত্কালের সব সরকারই একব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে দেশ চালিয়েছে। এতে দেশি ও বিদেশি লুটেরা গোষ্ঠী, জনগণকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে, যা খুশি তাই করবার স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ক্ষমতায় যেতে পারলে লুণ্ঠন দখল আর যা খুশি তাই করবার স্বাধীনতা। এই কারণেই এই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ধরে রাখা বা তা দখলে নেয়ায় তৈরি হয়েছে উন্মাদ জনধ্বংসী রাজনীতি।
জনস্বার্থে কাজ করলে জনগণের উপরই ভরসা করতে পারতো সরকার, সভাসমাবেশ নির্বাচন কোনকিছু নিয়েই সরকারের ভয় থাকতো না। কিন্তু নিজ ভূমিকার কারণেই তার সেই ভরসা নেই, সেজন্য তাকে ভর করতে হচ্ছে বলপ্রয়োগের ওপর। সন্ত্রাসী রাজনীতি ও লুটেরা অর্থনীতির সাথে নাড়ির যোগ বিএনপি-জামায়াত জোটেরও। জনসমর্থনের ওপর ভর করলে তার ডাকে জনস্রোত নামতো, সব বিধিনিষেধ নিষেধাজ্ঞা অচল হয়ে যেতো। কিন্তু জনগণ আসেনি, নামেনি। কারণ তার কাছ থেকে ভিন্নকিছু প্রত্যাশা করবার মতো অভিজ্ঞতা তাদের নেই। তাই আমরা দেখি একদিকে জনগণ ছাড়া নির্বাচন, অন্যদিকে জনগণ ছাড়া আন্দোলন। বর্তমানকে দখল করতে গিয়ে ক্ষমতার রাজনীতির দুই পক্ষ বাংলাদেশের ভবিষ্যেক আরও ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ঘরে-বাইরে পথেঘাটে আতংক সন্ত্রাসে মানুষের প্রশ্ন এখন একটাই। বর্তমান অচলাবস্থার কী হবে? কবে এই আগুনের অভিশাপ থেকে মুক্তি মিলবে? সবাই বোঝেন বর্তমান অচলাবস্থা, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতার ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া কঠিন কিছু নয়। সমস্যা হলো, উদ্যোগ নিতে হবে তাদেরই যারা এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কী কী কাজ দরকার এখন? প্রথমত, বিএনপি জোট কর্তৃক অবরোধ হরতাল প্রত্যাহার, সন্ত্রাসী তত্পরতা বন্ধ করা। পেট্রোল বোমা আগুন চোরাগুপ্তা হামলা বন্ধ করে সভাসমাবেশে আসা। এটি নিশ্চিত করবার জন্য দ্বিতীয়ত, সরকারের দমনপীড়ন বন্ধ করা, ঘোষিত অঘোষিত সব অগণতান্ত্রিক বিধিনিষেধ প্রত্যাহার, ‘ক্রসফায়ার’ গ্রেফতার বাণিজ্য বন্ধ করা। আর তৃতীয়ত, নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলে এইবছরের মধ্যে স্বচ্ছ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। যাতে যুদ্ধাপরাধী, সন্ত্রাসী ও লুটেরা বাদে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
তার মানে সমাধানের পথ ঠিকই আছে। কিন্তু জনগণের জীবন অতিষ্ঠ হলেও সেই পথে আসছে না দায়ী গোষ্ঠীগুলো। চলছে উল্টোপথে। ফুলবাড়ী আন্দোলনের সহযোদ্ধা বন্ধু বাবলু সেদিন বলছিলেন, ‘জনগণ ছাড়া নির্বাচন’ আর ‘জনগণ ছাড়া আন্দোলন’ই এখন দুই প্রধান দলের রাজনীতির পরিচয়। সেটাই যখন বাস্তবতা তখন বর্তমান পরিস্থিতির সাময়িক সমাধানেই কাজ শেষ হবে না, জনগণকে তার নিজের স্বার্থে নিজের পথ তৈরিতে মনোযোগ দিতে হবে। নিজের শক্তি দিয়ে জনশত্রুদের তত্পরতা মোকাবিলা করতে হবে। নইলে জনবিনাশী রাজনীতি সন্ত্রাস সহিংসতা দিয়েই বার বার নিজের জমিন তৈরি করবে।
(১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত)