এ রকম প্রশ্ন খুবই সঙ্গত যে, একদিকে যখন সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের নতুন নতুন আওয়াজ, চুক্তি ও নীতি দেখা যাচ্ছে তখন অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসের বিস্তার কীভাবে একই সাথে ঘটতে পারে? দৃশ্যত, গত কয়েক দশকে বিশ্বের বহুদেশে কথিত ‘মৌলবাদী’ তত্পরতা বেড়ে গেছে অনেক। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এর সাথে প্রান্তস্থ দেশগুলোতে বিপন্ন দশা ও সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব ব্যবস্থায় যুদ্ধ অর্থনীতির বিস্তার সম্পর্কিত। যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ৮০ দশক পর্যন্ত ধর্মপন্থি শক্তিগুলোকে সমাজতন্ত্র ও সব রকম মুক্তির লড়াই-এর বিরুদ্ধে সফলভাবেই ব্যবহার করেছে। এই পর্যায়ের সর্বশেষ বড় উদাহরণ আফগানিস্তান। প্রথমে মুজাহেদীনদের মাধ্যমে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সমর্থিত সরকার উচ্ছেদ করে যুক্তরাষ্ট্র। সে সময় আফগান মুজাহেদীনদের সব রকম পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে তারা। প্রশিক্ষণ দিয়েছে, অস্ত্র দিয়েছে, অর্থ দিয়েছে। অর্থ দিয়েছে সৌদী আরবও। ইউএসএইড সরবরাহ করেছে ইসলামী উন্মাদনা সৃষ্টির মতো বই, শিশুদের পাঠ্যপুস্তক। সিআইএ-র এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে মাঠের ভূমিকা পালন করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। সামরিক শাসনের মাধ্যমে জেনারেল জিয়াউল হকের মতো একজনকে অধিষ্ঠিত করা সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের খুব কাজে দিয়েছে। এক পর্যায়ে আকস্মিকভাবে বিশাল শক্তি নিয়ে উদিত হয় তালিবান। মুজাহিদীনদের বিরুদ্ধে যাদের অস্ত্র, সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ এবং কৌশলগত সমর্থন সবই যোগান দিয়েছে সেই যুক্তরাষ্ট্রই।
২০০১ সালে নিউইয়র্কের ‘টুইন টাওয়ার’ হামলার পর থেকে ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের’ নামে এই কর্মসূচিরই অধিকতর বিস্তার ঘটে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ইসলাম ও মুসলমান বিদ্বেষী প্রচারণাও জোরদার হয়। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, সৌদীসহ মুসলিম রাজতন্ত্রকে ভর করেই এই সন্ত্রাসী আধিপত্য বিস্তৃত হয়। এই প্রচারণার প্রতিক্রিয়ায় ইসলামপন্থি রাজনীতির ক্ষেত্রও উর্বর হতে থাকে। গণহত্যা, অপমান, বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ক্ষোভে ইসলামপন্থি রাজনীতির নতুনভাবে প্রসার ঘটে। (বিস্তৃত আলোচনার জন্য দেখুন: সর্বজনকথা, নভেম্বর সংখ্যা, ২০১৫)
উত্তর উপনিবেশকালে প্রান্তস্থ দেশগুলোতে খুঁটি ধরে রাখতে, সমাজতন্ত্র ঠেকাতে পুঁজিবাদী কেন্দ্র বা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো ধর্মীয় শক্তি ব্যবহারে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে। মূলধারার চার্চ সাম্রাজ্যবাদের খুঁটি হিসাবেই বরাবর ভূমিকা পালন করেছে। একদিকে মুসলিম রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখা অন্যদিকে ইহুদিবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদ নিজেদের দীর্ঘমেয়াদী অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে বিশ শতকের প্রথম থেকেই। মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে ইসলামপন্থি দল ও ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র বিরোধী আতংক সৃষ্টি করবার কাজ খুবই উপযোগী হয়েছিলো। সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্পে লালিত-পালিত ধর্মপন্থিরা এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় সামরিক বেসামরিক স্বৈরশাসকদের সমর্থন দেবার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যের পথও সুগম করেছে।
কার্যত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সাম্রাজ্যবাদের নতুন শত্রুপক্ষ নির্মিত হয় ১৯৯১ সালে, প্রথম ইরাকের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। তারপর থেকে ক্রমান্বয়ে ‘ইসলামী সন্ত্রাসী’ বাড়তে থাকে এবং তার বিরোধী লড়াই একটি বৈশ্বিক এজেন্ডার রূপ দেয়। সোভিয়েত প্রভাবের বিরুদ্ধে ’৮০ দশকে ইসলামপন্থি জঙ্গী সশস্ত্র বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে ঐক্য তৈরি হয়, যেভাবে তার আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তোলা হয় তার ধারাবাহিকতা এখনও অব্যাহত। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বর্তমান সময়ে ক্রমবর্ধমান নৃশংসতার মধ্যেও পাওয়া যাবে। আইসিস, তালেবান, আল কায়েদা ইত্যাদি নামে পরিচিত যেসব গোষ্ঠীকে দমন করবার কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে দখলদারিত্বের নতুন জাল ফেদেছে তারা সবাই মার্কিনী-সৌদীদেরই সৃষ্ট বা লালিত-পালিত দানব। এগুলোর সূত্রে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন নতুন ভয়ংকর ঘটনা ঘটছে। ইসলামের নাম নিয়ে এইসব গোষ্ঠীর বর্বর দিগভ্রান্ত সন্ত্রাসী তত্পরতাকে কেউ কেউ ‘জিহাদ’ কেউ কেউ ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই’ বলে মহিমান্বিত করতে চান। তাদের ভূমিকা, কর্মসূচি ও ফলাফল বিচারে আনলে কেউ এই কথা বলবেন না।
অনেকে আবার এ রকম ভাবে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ’ পরিচালনা করছে ‘ইসলামী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে স্যেকুলার শক্তির পক্ষে। এটিও আরেকটি বড় ভ্রান্তি। বস্তুত নির্বাচিত স্যেকুলার সরকার উচ্ছেদেই মার্কিনী রেকর্ড অনেক। ’৭০ ও ’৮০ দশকে আফগানিস্তানে স্যেকুলার সরকারই ক্ষমতায় ছিলো। এই সরকারগুলো আফগানিস্তানে ভূমি সংস্কার, নারী অধিকার, শিক্ষা ও চিকিত্সা সংস্কারে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিলো। ইরাক ও লিবিয়াতেও স্যেকুলার সরকারই ছিলো ক্ষমতায়। শিক্ষা, চিকিত্সা, বিশুদ্ধ পানিসহ জন অধিকারের ক্ষেত্রেও তাদের অনেক সাফল্য ছিলো। যুক্তরাষ্ট্র সাদ্দাম ও গাদ্দাফীকে উচ্ছেদের পর সে সব ব্যবস্থা তছনছ হয়ে গেছে। আর সেখানে বিভিন্ন ইসলামপন্থি গোষ্ঠীর প্রভাব বেড়েছে। সর্বশেষ সিরিয়া।
২০০১ এর আগে ইরাক লিবিয়া সিরিয়ায় আল কায়েদা বা তালেবান ধারার কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিলো না। তথাকথিত ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ’ এই অঞ্চলকে চেনা-অচেনা সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। সর্বশেষ এই অঞ্চলে বিরাট শক্তি ও সম্পদ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে আইসিস যা ইসলামী রাষ্ট্র বা খিলাফত্ প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। নতুন শত শত গাড়ি, বার্ষিক ১৬ হাজার কোটি টাকার বাজেট এবং প্রায় ৩০ হাজার সশস্ত্র সদস্য নিয়ে আচমকা তারা হাজির। তারা ইরাক সিরিয়ায় একের পর এক অঞ্চল দখল করছে। তারা একের পর এক ভিন্নধর্ম ও মতাবলম্বী, সংখ্যালঘু জাতির মানুষদের ধরছে, গলা কাটা ও নির্যাতনের দৃশ্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রচার করছে। হঠাত্ করে এ রকম একটি বিশাল বাহিনীর জন্ম এবং ক্রমান্বয় বিজয় আফগানিস্তানে তালিবানদের আচমকা আবির্ভাব এবং দ্রুত আফগানিস্তান দখলের কথা মনে করিয়ে দেয়।
ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ছিন্নভিন্ন হবার ফলে এই দেশগুলোর মানুষদের নারকীয় অনিশ্চিত অবস্থায় পড়তে হয়েছে। ইউরোপে অভিবাসনে বিশাল স্রোত এরই ফলাফল। অন্যদিকে এর প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী তিনপক্ষ: সৌদী আরব, ইজরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার বৃহত্ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। তাদের কাছে ইরাকের সাদ্দামের অপরাধ স্বৈরশাসন ছিলো না; ছিলো তেল ক্ষেত্র জাতীয়করণ এবং সামরিক শক্তি হিসাবে সৌদী আরব ও ইজরায়েলের কর্তৃত্ব অস্বীকারের ক্ষমতা। লিবিয়ার গাদ্দাফিরও একই অপরাধ ছিলো। সৌদী রাজতন্ত্র বরাবরই তার ওপর গোস্বা ছিলো। জীবনের শেষ পর্যায়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক গড়ার লক্ষ্যে ‘নয়া উদারতাবাদী’ বলে পরিচিত পুঁজিপন্থি কিছু সংস্কারের পথে গেলেও গাদ্দাফীর বড় অপরাধ ছিলো সৌদী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্পষ্ট আক্রমণাত্মক কথাবার্তা। ২০১১ সালে গাদ্দাফী সরকারকে উচ্ছেদ করবার জন্য ন্যাটো বাহিনীর ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি এবং আল কায়েদাসহ বিভিন্ন ভাড়াটিয়া ইসলামপন্থিদের জড়ো করার কাজটি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশ ও সৌদী আরবের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়।
যুদ্ধবাজ ও দখলদার শক্তিগুলোর কাছে একইভাবে সিরিয়ার আসাদ সরকারেরও অপরাধ স্বৈরশাসন নয়, অপরাধ সৌদী আরব-ইজরাইল অক্ষের কাছে তার অগ্রহণযোগ্যতা। সিরিয়ার আসাদ সরকার উচ্ছেদের জন্য অতএব বিভিন্ন ক্ষুব্ধ গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় পশ্চিমা শক্তি ও সৌদী-কাতার-জর্ডান রাজতন্ত্র। ইরানকে কাবু করাও এর একটি উদ্দেশ্য ছিলো। আসাদ বিরোধী এসব গোষ্ঠীর অধিকাংশই আল কায়েদা ঘরানার বিভিন্ন গ্রুপ, ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী। সৌদী আরব, কাতার, তুরস্ক, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বিপুল অর্থ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র যোগানের ওপর ভর করেই এসব গোষ্ঠী শক্তিপ্রাপ্ত হয়। এর সাথে মার্কিন ব্রিটিশ ফরাসি ও ইজরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বিত ভূমিকা ছিলো উল্লেখযোগ্য। এদেরই অনেকে এখন গঠন করেছে আইসিস। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেন কিছুদিন আগে এক বক্তৃতায় মুখ ফসকে আইসিস এর পেছনে এই দেশগুলোর শত হাজার কোটি ডলারসহ নানা পৃষ্ঠপোষকতার কথা বলে ফেললেও পরে মিত্রদের ক্ষোভের মুখে মাফ চেয়েছেন। বাইডেন অবশ্য নিজেদের ভূমিকার কথা বলেননি। কিন্তু সত্য ঢাকা পড়েনি।
যারা সবচাইতে বড় সন্ত্রাসী তারাই বিশ্বজুড়ে দাপাচ্ছে ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ’ নাম দিয়ে। বাংলাদেশ এরই অন্তর্ভুক্ত একটি অঞ্চল, যাকে বিশ্ব সন্ত্র্রসের উর্বর ভূমি বানানোর চেষ্টাও খুব জোরদার বলে মনে হয়। এটা বিস্ময়কর মনে হতেই পারে যে, যেখানে ‘সন্ত্রাস বিরোধী তত্পরতা’র নামে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে, অস্ত্র যোগান বাড়ছে, নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর হচ্ছে, সেখানে কেনো নতুন নতুন দৃশ্যমান অদৃশ্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে, গোয়েন্দা সংস্থার দাপট বাড়ছে, সেসঙ্গে সন্ত্রাসও বাড়ছে, তা দমনে নতুন নতুন দমন পীড়নের আইন, বিধিনিষেধ তৈরি হচ্ছে? পুরো জাল খেয়াল করলে বিস্ময় কেটে যাবে।
প্যারিসে ভয়ংকর সন্ত্রাসী হামলার পর বিশ্বজুড়ে নিরাপত্তাহীনতার বোধ আরও বেড়েছে। তবে যথারীতি এই সন্ত্রাসী তত্পরতার শেকড় সন্ধান বা তার স্থায়ী সমাধানের চাইতে যথারীতি অধিকতর নিপীড়নমূলক আইন ও তত্পরতার বিস্তারে সক্রিয় বিশ্বপ্রভুরা। বস্তুত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামে নতুন পর্বের এই সন্ত্রাসী জগতেই আমরা প্রবেশ করেছি ২০০১ সালে। এমনই তার মহিমা, যতোই সন্ত্রাস দমনের নানা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে ততোই সন্ত্রাস আরও বিস্তৃত হচ্ছে। কিছুদিন পর পরই নতুন নাম, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হাজির হচ্ছে নতুন নতুন নামে, কোনো দেশ কোনো অঞ্চল আর সন্ত্রাসের আওতার বাইরে নেই। আর এর কারণে সকলের ওপর নতুন নতুন বিধিনিষেধ, নিয়ন্ত্রণ, করের বোঝা, দমন পীড়ন, আরও সামরিকীকরণ। মুসলিম, খ্রীষ্টান, ইহুদি, হিন্দু, বৌদ্ধ সকল সম্প্রদায়ে চরমপন্থি, মানুষ বিদ্বেষী গোষ্ঠীগুলো এই ‘অনন্ত যুদ্ধে’ আরও ক্ষমতাধর হয়েছে, হিংস্রতায় সক্রিয় হয়েছে। তাদের সবার পেছনেই ক্ষমতার আশীর্বাদ। অদৃশ্য ঘাতকদের মেলবন্ধন। সর্বশেষ শিকার প্যারিসের নিরস্ত্র শতাধিক মানুষ। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান তো বধ্যভূমি হয়েই আছে। এখন যুদ্ধ ও সন্ত্রাসের আরও বিস্তারের প্রস্তুতি। বাংলাদেশও এর অন্তর্ভুক্ত।
(লেখাটি ২৩ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত)