শেভ্রন ও নাইকোর কাছে পাওনা অনাদায়ী কেন?

8617 4254922790321 1600471182 nজুন মাস বাংলাদেশে বাজেট ঘোষণা আর তা নিয়ে আলোচনার মাস। বাজেট আলোচনা কেন্দ্র করে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভাবনা, সংকট, প্রস্তাবনা ধরে অনেক আলোচনা আর বিতর্ক হয়। সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং অনেক বিশেষজ্ঞ দেশে যে সম্পদ সংকট আছে তার ওপরই জোর দেন এবং তা ধরে নিয়েই কথা বলেন। সম্পদ নেই, দক্ষতা নেই, ক্ষমতা নেই এগুলোই বারবার বলা হতে থাকে। একদিকে এই সম্পদ অভাবের এই কাঁদুনি শুনি আবার অন্যদিকে দেখি শুনি, বছর জুড়ে বিশেষত অর্থবছরের শেষের দুই মাসে, অপচয় আর লুন্ঠনের জোয়ার। দেখি সম্ভাবনা ও শক্তির জায়গাগুলো নষ্ট হতে। দেখি বাজেট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছ থেকে সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষের কাছে সম্পদ স্থানান্তরের বৈধতা তৈরি করতে।

বিশ্বজুড়েই অর্থশাস্ত্রের শিক্ষার অধিপতি ধরন এমনই যে অর্থনীতিবিদরা যতটা সংখ্যা নিয়ে মনোযোগী থাকেন ততটাই এর গুণগত দিক নিয়ে নির্লিপ্ত থাকেন। সেজন্য বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ, বিদেশি ‘সাহায্যের’ প্রবাহ নিয়ে তাদের অবিরাম দুশ্চিন্তা দেখি। যেনো এগুলোর পরিমাণগত প্রবাহ বৃদ্ধিই উন্নয়নের চাবি। কিন্তু বাংলাদেশে কী ধরনের উন্নয়ন হচ্ছে, কী ধরনের বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে, এর ফলাফল কী, তথাকথিত বিদেশি সাহায্যের কারণে কত জায়গায় অপচয় আর দুর্নীতি বাড়লো, কীভাবে পাটশিল্প বিপর্যস্ত হলো, কীভাবে জলাবদ্ধতা স্থায়ী হল, বন উজাড় হল, বিদেশি বিনিয়োগের ফলে কীভাবে গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়লো, কীভাবে বিনিয়োগের তুলনায দশগুণ বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হলো, কীভাবে কমদামে বিদ্যুৎ পাবার পথ বন্ধ হলো, সেগুলো নিয়ে কোনো মনোযোগ অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মধ্যে সাধারণত দেখা যায় না।

অথচ এই জুন মাসেই বিদেশি বিনিয়োগের সাথে সম্পর্কিত দুটো ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। একটি হল মাগুড়ছড়া, অন্যটি টেংরাটিলা। দুটোই গ্যাসক্ষেত্র, সিলেট অঞ্চলের দুটো গ্যাস ব্লক-এর অন্তর্ভূক্ত। মাগুড়ছড়ায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয় ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন; আর ছাতক-টেংরাটিলায় হয় ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি আবার ২৪ জুন। দুই গ্যাসক্ষেত্রের এই তিনটি বিস্ফোরণে বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত প্রমাণিত সর্বমোট গ্যাস মজুতের মধ্যে প্রায় ৫৫০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ধ্বংস হয়ে গেছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা (২০১৪) অনুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা ছিলো ৩২৮ বিলিয়ন ঘনফুট, এবং ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে এর পরিমাণ ছিলো ৩৭৯ বিলিয়ন ঘনফুট। তার মানে গত দেড়বছরে সারাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে পরিমাণ গ্যাসের চাহিদা ছিলো – এই দুটো ক্ষেত্রে তার বেশি পরিমাণ গ্যাস নষ্ট হয়েছে। অন্যান্য ক্ষতি তো আছেই। উক্ত গ্যাস সম্পদ দেশের অর্থনীতিতে উৎপাদনশীল কাজে লাগালে ২০-২৫ গুণ বেশি মূল্য সৃষ্টি সম্ভব ছিল। এতবড় ক্ষতি যারা করলো তাদের জন্য কী শাস্তি? না, কোন শাস্তি নাই, জরিমানা বা ক্ষতিপূরণের কথা নাই। বরং তাদের জন্য আছে আরও বাড়তি সুযোগ সুবিধা।

দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানুষের প্রয়োজনে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহারের উদ্যোগ না নিয়ে ‘সম্পদের অভাব’ এর যুক্তিতে দেশের খনিজ সম্পদ কীভাবে বিদেশি বহুজাতিক তেল কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া হয়েছে তা গ্যাস নিয়ে যেসব গোপন চুক্তি হয়েছে, জালিয়াতি হয়েছে, কয়লা নিয়ে এখনও যা চেষ্টা হচ্ছে সেগুলো খেয়াল করলে যেকোন বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষই বুঝবেন। উন্নয়নের নাম দিয়েই দেশি বিদেশি লুম্পেন বিশ্বজোট এসব সম্পদ করায়ত্ত করেছে এবং আরও করবার চেষ্টা করছে। এরশাদ সরকারের আমলে হরিপুর ও কাফকো চুক্তি দিয়ে এর শুরু। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯৩ সাল থেকে পিএসসি চুক্তি শুরু হয়, সর্বশেষ চুক্তি হয় ২০১৪ সালে। এই সময়ে পাঁচটি সরকার ক্ষমতায় এসেছে। দেশ শাসনে বিভিন্ন দল ও দুটি জোট এযাবত দায়িত্ব ‘পালন’ করেছে। এদের নিজেদের মধ্যে নানা বিবাদ মানুষকে অতীষ্ট করে তোলে। কিন্তু সম্পদ ধ্বংস, সম্পদ পাচার, কমিশনভোগী তৎপরতা, বিভিন্ন কোম্পানির লবিষ্টের ভূমিকা পালনে এদের মধ্যে গভীর ঐকমত্য দেখা যায় বরাবর। মাগুড়ছড়া ও ছাতক গ্যাসফিল্ডের টেংরাটিলায় ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ সত্ত্বেও অপরাধীদের রক্ষার ব্যাপারেও এই ঐকমত্যের পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া যায়।

১৯৯৩ সালে সরকার আটটি গ্যাস ব্লক আন্তর্জাতিক বিডিং এ দেয়। ১৯৯৫ সালের ১১ জানুয়ারি এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি, ১২, ১৩, ১৪ নম্বর ব্লক প্রদান করে মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টালকে। তাদের প্রথম গ্যাসকূপ খনন শুরুর ১২ দিন পর, ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন রাতে (১৫ জুন) মার্কিন তেল কোম্পানি অক্সিডেন্টাল এর ইজারাভুক্ত সিলেটের ১৪ নম্বর ব্লকের সুরমা বেসিনে মাগুড়ছড়ায় ভয়ংকর এক বিস্ফোরণ হয়। গ্যাসক্ষেত্র থেকে এই আগুন ৩০০ ফুট পর্যন্ত উপরে উঠে যায়। আশেপাশের বনজঙ্গল, কৃষিজমি, চাবাগান ও গ্রামও তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই বিস্ফোরণের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণে কোন তদন্ত কমিটি গঠনের আগেই তৎকালীন জ্বালানীমন্ত্রী ঘটনাস্থলে গিয়ে ঘোষণা দেন, ‘ক্ষতির পরিমাণ খুবই সামান্য’।

জনমতের চাপে তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তার কার্যক্রম নিয়ে নানা টালবাহানা শুরু হয় এবং একপর্যায়ে তদন্ত কমিটি রিপোর্ট জমা দিলেও তা ‘হারিয়ে যায়’। ১৯৯৯ সালে অক্সিডেন্টাল, আফগানিস্তান ও মায়ানমারে অনেক অপকর্মের জন্য অভিযুক্ত ইউনোকাল নামে আরেকটি মার্কিন কোম্পানির সাথে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ব্যবসা কার্যক্রম বিনিময় করে, চলে যায়। মাগুড়ছড়ার ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কোন ফয়সালা না করেই সরকার তাদের এই বিনিময় সম্পাদন করতে দেয়। পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা তখন জানান যে, তাদের ‘অজান্তেই এটি ঘটেছে’! ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব ইউনোকালের ওপর বর্তালেও ক্ষতিপূরণ আদায়ের কোন কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সমালোচনার মুখে তৎকালীন জ্বালানী বিষয়ক সংসদীয় কমিটি এবিষয়ে শুনানীর জন্য ইউনোকাল প্রধানকে ডাকার উদ্যোগ নিলেও ‘উপরের’ হস্তক্ষেপে, তৎকালীন জ্বালানী সচিব বর্তমান জ্বালানী উপদেষ্টা তৌফিক এলাহী চৌধুরীর প্রত্যক্ষ বাধায় তা থেমে যায়।

অবশেষে ২০০১ সালে তদন্ত কমিটির সেই ‘হারিয়ে যাওয়া’ রিপোর্ট উদ্ধার হয় পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান এর ফাইল কেবিনেট থেকে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী, রক্ষণশীল হিসাবেও বিস্ফোরণে মাগুড়চড়ায় গ্যাসসম্পদের ক্ষতি হয় প্রায় ২৪৫ বিলিয়ন ঘনফুট। এছাড়া পরিবেশ এর যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা দীর্ঘমেয়াদের এবং পুরোটা পরিমাপযোগ্য নয়। ২০০২ সালে পেট্রোবাংলা মাগুড়ছড়ার গ্যাস ধ্বংসের জন্য মাত্র ৬৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ চেয়ে ইউনোকালকে চিঠি দেয়! ইউনোকাল ১৯৯৮ সালে সম্পাদিত একটি সম্পূরক চুক্তির দোহাই দিয়ে বলে যে, ক্ষতিপূরণ আর দিতে তারা বাধ্য নয়। সেই চুক্তির একটি ধারা (৩ নং অনুচ্ছেদ) এরকম: ‘বিরূপ প্রচার হতে পারে বিধায় অক্সিডেন্টাল ব্যতীত এই চুক্তি বা চুক্তি সম্পর্কিত কোনো কিছুই জনসমক্ষে প্রকাশ করা যাবে না।’ এর মধ্যে ইউনোকাল-এর ব্যবসা গ্রহণ করে আরেকটি মার্কিন কোম্পানি শেভ্রন। সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ নিয়ে আর কোন কথা হয়নি। বরং তাদের এখন আরও অনেক বাড়তি সুবিধা ও কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে। উইকিলিকস ফাঁসকৃত তথ্য থেকে জানা যায়, মার্কিন দূতাবাস নিয়মিত শেভ্রন, কনকো ফিলিপস ও এশিয়া এনার্জির পক্ষে তদ্বির করে থাকে।

২০০২ এর পর আবারো সম্পদের অভাব দেখিয়ে, একটি জীবন্ত গ্যাসক্ষেত্রকে প্রান্তিক ঘোষণা করে, জালিয়াতি করে, ছাতক গ্যাস ফিল্ড কানাডীয় অখ্যাত কোম্পানি নাইকোর হাতে তুলে দেয়া হয়। সম্পদ বেদখল ছাড়াও ফলাফল হয় আরেকটি বিপর্যয়, টেংরাটিলা বিস্ফোরণ। টেংরাটিলা নামে পরিচিত ছাতক গ্যাসফিল্ডে ২০০৫ সালে জানুয়ারি ও জুন মাসে পরপর দুটো বিস্ফোরণ ঘটে। এই বিস্ফোরণের পরও, আগেরজনের মতো, তৎকালীন জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী ঘটনাস্থলে গিয়ে বলেন, ‘ক্ষতির পরিমাণ তেমন বেশি নয়’। প্রথম থেকেই বোঝা যাচ্ছিলো যে, কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতার জন্যই এই ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তারপরও প্রথমে তৎকালীন জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী এবং পরে তৎকালীন জ্বালানী উপদেষ্টার নেতৃত্বে সরকারি বিভিন্ন বিভাগ থেকে নাইকোর অপরাধ ধামাচাপা দেয়ার জন্য একের পর এক অপচেষ্টা দেখা যায়। দুজনই প্রথম থেকেই এই ক্ষয়ক্ষতি খুবই সামান্য বলে দেখানোর চেষ্টা করেন। পরে তাদের দ্বারা প্রভাবিত কমিটি এবং ‘বিশেষজ্ঞ’রাও একই কাজে শরীক হয়। সরকারি দিক থেকে এরকম ভূমিকার কারণে দেশের বিশিষ্ট ভূবিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, অর্থনীতিবিদরা ‘নাগরিক কমিশন’ গঠন করে ঐ অঞ্চল সফর করেন এবং ক্ষয়ক্ষতির কারণ ও পরিমাণ নির্ণয় করেন। তাঁদের হিসাব সরকারি কমিটি বা মন্ত্রী-উপদেষ্টার ভাষ্য থেকে অনেক গুণ বেশি।

টেংরাটিলার পুরো গ্যাসক্ষেত্র নষ্ট হলে পেট্রোবাংলার প্রতিবেদন মতে তার পরিমাণ ৩০৫.৫ বিসিএফ, বাপেক্স-নাইকো’র রিপোর্ট মতে ২৬৮ বিসিএফ, কোন কোন বিশেষজ্ঞের তথ্য মতে এর পরিমাণ ১.৯ টিসিএফ। তদুপরি বিস্ফোরণের কারণে একদিকে যেমন অনবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাসের ক্ষতি হয়েছে, অন্যদিকে তেমন আরও বহুক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুরো হিসাব করতে গেলে পানি, কৃষি জীব বৈচিত্রের বিনষ্টের ক্ষতি, রোগ-বালাই এর কারণে ক্ষতি, বাস্তুচ্যুতির ক্ষতি, জলাভূমির ক্ষতি, গ্রীনহাউস গ্যাসের কারণে ক্ষতি, থার্মাল দূষণের কারণে ক্ষতি, বংশপরম্পরা ক্ষতি, বিস্ফোরণের ফলে মাটির তলদেশে ফাটল সৃষ্টির কারণে গঠনগত পরিবর্তন হেতু ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ক্ষতি, যে গ্যাস নষ্ট হয়েছে সে গ্যাস অর্থনীতির বিভিন্ন খাত-ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে ব্যবহারে যে গুণিতক ফল পাওয়া যেত তা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ক্ষতি ইত্যাদিও বিবেচনা করতে হবে। সরকারি ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে যেখানে গ্যাসসম্পদের ক্ষতিই ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে সেখানে এসব ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় আনা তাদের চিন্তার মধ্যেও আসার কথা নয়।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি সেসময় টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ড বিস্ফোরণে আপাত নিরূপনযোগ্য আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ করেছিল। প্রতি একক গ্যাসের দাম ২.৫ মার্কিন ডলার ধরে এবং ক্ষতিগ্রস্ত গ্যাসের পরিমাণ উপরের স্তরের ১১৫ থেকে ৩১০ বিসিএফ বিবেচনা করে ২০০৫ সালের দামস্তরে আর্থিক ক্ষতি নির্ণয় করা হয়েছিল ৬,৩৫০ থেকে ১৫,২০০ কোটি টাকা। ছাতক (পশ্চিম) গ্যাসফিল্ডের সমস্ত গ্যাস-কাঠামো এবং মজুদ গ্যাস আর সেই সঙ্গে সহায়-সম্পদ, বিষয়-আসয় এবং পরিবেশের ক্ষয়-ক্ষতিকে বিবেচনায় এনে এই পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে বলে দাবি করা হয়েছিলো। উল্লেখ্য যে, হারানো গ্যাস সম্পদ পেতে গেলে গ্যাসের একক দাম ধরতে হবে আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ী।

সুতরাং পরিবেশ অধিদপ্তর, স্বাধীন বিশেষজ্ঞ দল, পেট্রোবাংলা এবং অর্থনীতি সমিতির হিসাব ও সমীক্ষা পর্যালোচনা করে আমরা দেখেছি, মাগুড়ছড়া ও টেংরাটিলায় গ্যাস সম্পদের ক্ষতির হিসাবে, গ্যাসের আন্তর্জাতিক দামের গত ১০ বছরের গড় ধরে, মার্কিন ও কানাডার কোম্পানির কাছে আমাদের পাওনা দাঁড়ায় কমপক্ষে ৫০ হাজার কোটি টাকা। একদিকে যখন আমরা সম্পদের অভাবের আহাজারি শুনি তখন এই পরিমাণ পাওনা আদায়ে সরকারের কোন কথাই শোনা যায় না। বাজেটেও কখনোই তার কোন উল্লেখ থাকে না। অথচ এই পাওনা টাকা চলতি অর্থবছরের মোট ঘাটতির কাছাকাছি, আগামী অর্থবছরে জ্বালানী ও বিদ্যুৎ খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তার প্রায় ৫ গুণ, যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ ও অনুদানের হিসাব করা হচ্ছে তার ৩ বছরের সমান। আমরা যদি দীর্ঘমেয়াদে জীববৈচিত্র বিপর্যয়সহ পরিবেশ ক্ষতি বিবেচনা করি, যদি মানবিক ক্ষতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিবেচনা করি, যদি এই গ্যাস সম্পদের অভাবে বর্তমান বিদ্যুৎ সংকটের হিসাব যোগ করি তাহলে ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বাড়বে।

বাংলাদেশে কোন জাতীয় প্রতিষ্ঠানে কয়েক কোটি টাকা লোকসান হলে বিশ্বব্যাংক সহ যেসব বিশ্বসংস্থা সেগুলো বন্ধ করবার চাপ দিতে থাকে, হাজার হাজার কোটি টাকা ধ্বংস করলেও অক্সিডেন্টাল,ইউনোকাল,শেভ্রণ বা নাইকো নিয়ে তাদের কখনোই কোন কথা শোনা যায়না কিংবা ক্ষতিপূরণ আদায় নিয়েও তাদের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়না। বিভিন্ন সরকার যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার কাছে সবসময় দয়া-দাক্ষিণ্য অনুগ্রহ প্রার্থণা করতেই অভ্যস্ত। কিন্তু তাদের কাছে আমাদের পাওনা দাবি সরকারের মধ্য থেকে কখনো উচ্চারিত হয় না। এই সম্পদ জনগণের, তাই এর প্রতিটি বিন্দুর হিসাব নিকাশ চাইবার অধিকার জনগণের আছে। যেসব বিদেশি কোম্পানি এই সম্পদ ধ্বংস করেছে, আর তাদের যারা রক্ষা করতে চেষ্টা করেছে, করছে, করবে- জনগণ তাদের কাছ থেকেই কড়ায় গন্ডায় সব হিসাব আদায় করবে, এরকম পরিস্থিতি নিশ্চয়ই একদিন সৃষ্টি হবে, সৃষ্টি করতে হবে।।

(জুন ১৭, ২০১৪ আমাদের বুধবারে প্রকাশিত)