দেশে যে এতো সহিংসতা আর অনিশ্চয়তা, তাতে দেশের সকল পর্যায়ের মানুষের জীবন বিপন্ন হলেও দেশি বিদেশি লুটেরা দখলদারদের এতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বরং অনেকক্ষেত্রে মনোযোগ সরে যাওয়ায় তাদের সুবিধাই হচ্ছে। অনেকের জন্য এই অনিশ্চিত সময় আশির্বাদ! সেজন্য দেখছি, দেশের হুলস্থুল অবস্থার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করে নানা চুক্তি স্বাক্ষরের কাজ ঠিকই চলছে। আর এগুলোতে ‘বিরোধী’ প্রধান দলগুলোর মৌনতাও সম্মতি হিসেবে কাজ করছে। হলমার্ক ব্যাংক লুটকারিদের উদ্ধার তৎপরতা চলছে, শেয়ারবাজার লুন্ঠনকারিরা নিরাপদে, এশিয়া এনার্জির মতো জালিয়াতদের লবিষ্টরা সক্রিয়। ত্বকি হত্যাকারীর মতো সন্ত্রাসী মাফিয়ারা আড়ালে। সুন্দরবন ধ্বংসের প্রকল্প আয়োজন চলছে। নদী, জমি, পাহাড় দখলদাররা মহানন্দে দখল চালিয়ে যাচ্ছে। আর কনোকো ফিলিপসসহ নানা বিদেশি কোম্পানির দখলে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগর। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে সভা করছে, সন্ত্রাসের স্থায়ীভূমি বানানোর পরিকল্পনা ছাড়া তা আর কী হবে? পুড়ে যাওয়া গার্মেন্টস শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদানে মালিক বা বিজিএমইএ কারও এখন মাথাব্যথা নাই। সরকারের দমনপীড়ন বা বিরোধীদের হরতাল, সহিংসতা বা বিক্ষোভ মিছিল এদের কারও বিরুদ্ধে নয়! এসব বিষয় নিয়ে টিভি চ্যানেলগুলোর সময় নাই, সংবাদপত্রের স্থান নাই। যেসময়ে জনগণের জীবন বিপন্ন, সেসময়ই জনশত্রুদের মহা নিশ্চিন্ত সময়!
সরকার এখন বঙ্গোপসাগরে গভীর ও অগভীর সমুদ্র সীমায় ১২টি ব্লক বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা দেবার জন্য ‘পিএসসি ২০১২’ অনুযায়ী বিডিং করছে। ইতিমধ্যে অগভীর সমুদ্রে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ওএনজিসি এবং যুক্তরাষ্ট্রের কনোকো ফিলিপস একতরফা ভাবে তিনটি ব্লকে কর্তৃত্বে পেয়ে যাচ্ছে। ‘বিপুল ব্যয় বহুল’ বলে প্রচারিত এই কাজে ভারতীয় কোম্পানি ৮ বছরে ৯ ন¤¦র ব্লকে তিনটি কূপ খননসহ অনুসন্ধানকাজে বিনিয়োগ করবে ৫০০ কোটি টাকারও কম, কনকো ফিলিপস ৭ ন¤¦র ব্লকে এরকম সময়ে একইকাজে ব্যয় করবে মাত্র ৩১০ কোটি টাকা (নিউ এজ, ৩ এপ্রিল ২০১৩)। এই অর্থকেই ‘বিশাল বিনিয়োগ’ হিসেবে প্রচার করা হয়! এই বিনিয়োগে তাদের কাছে যাবে সাগরের বিপুল সম্পদ। শুধু তাই নয়, গভীর সমুদ্রের জন্য পিএসসি সংশোধন হচ্ছে বিদেশি কোম্পানির চাহিদা অনুযায়ী। যার ফলে বঙ্গোপসাগরের গ্যাস আমদানি করা দামে আমাদেরই কিনে নিতে হবে। আর প্রাপ্তি বেশি হলে তা রফতানি হবে, বাংলাদেশ চিরতরে তার সম্পদ হারাবে, লাভ হবে কোম্পানির।
নিজেদের ‘টাকা আর সামর্থ্য নেই’ এই যুক্তি তুলে স্থলভাগ ও সমুদ্রের সম্পদ এভাবেই বিদেশি কোম্পানির হাতে বারবার তুলে দেয়া হচ্ছে। যাদের আবার ঋণ করতে ব্যাংক গ্যারান্টি দিচ্ছে সরকার, তাদের কর মওকুফ করা হচ্ছে, তাদের স্বার্থ অনুযায়ী নানা সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট মেরামতের জন্য, সমুদ্র বা স্থলভাগে সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে নিজেদের দায়িত্ব গ্রহণে সক্ষমতা বৃদ্ধি, গবেষণা, সর্বজন (পাবলিক) শিক্ষা বা চিকিৎসা খাতে ব্যয় এগুলোতে অর্থবরাদ্দ করতে গেলেই অর্থমন্ত্রী আর টাকা খুঁজে পান না। দেশের অর্থনীতির প্রয়োজনে ২শ’, ৪শ’, ১হাজার কোটি টাকাও তাঁর কাছে অসম্ভব বেশি, কিন্তু হলমার্কের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা লুটের কথা যখন প্রকাশিত হল তখন তিনি বললেন, ‘এই টাকা কিছুই না।’ ব্যাংকের অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটে জড়িতদের নিয়ে কথা উঠলে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর সব ব্যাংকেই এটা হয়।’
অন্য কিছু হয় না পৃথিবীর অন্যান্য দেশে? পৃথিবীর বহুজায়গায় তো জাতীয় সংস্থার মাধ্যমে নিজেদের সম্পদ নিজেদের উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়। ভারতের ওএনজিসি এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে, ভারতের সামান্য একটু অংশ বাদে বাকি অনুসন্ধান ও উত্তোলন তারাই পরিচালনা করছে। বাংলাদেশের বয়স ৪২ বছর। ওএনজিসি-কে সক্ষম প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে ভারতের এর অর্ধেক সময়ও লাগে নাই। নরওয়ে তার বিশাল তেল সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনকাজ জাতীয় সংস্থা স্টেটওয়েল দিয়েই পরিচালনা করছে। এর ফলে নরওয়ের তেল সম্পদের পুরো সুফল এখন পাচ্ছে সেখানকার মানুষ। এই প্রতিষ্ঠান আর বাংলাদেশের পেট্রোবাংলার বয়স সমান, মালয়েশিয়ার পেট্রোনাসও তাই। কিন্তু তারা দেশের সম্পদ সুরক্ষা করে এখন বিশ¡জয় করছে, আর বাংলাদেশে পেট্রোবাংলাকে বানানো হচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানির স্থানীয় কর্মচারি।
রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট মেরামত ও নবায়নে ৭০০ কোটি টাকার সংস্থান হয় নাই, বিশ¡ব্যাংকের কাছে ধর্না দিয়েছে সরকার। জানা কথা যে, বিশ¡ব্যাংক তার নীতিগত অবস্থানের কারণে রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের ভূমিকা বাড়ানোর চাইতে তা খর্ব করতেই বেশি আগ্রহী থাকবে। সেটাই হয়েছে। বিশ¡ব্যাংক অর্থ দেয় নাই। আর এই অজুহাত দেখিয়ে বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোও ঠিক হয় নাই। ৭০০ কোটি টাকার সংস্থান হয় নাই। কিন্তু রেন্টাল কুইক রেন্টালের জন্য বাড়তি তেল আমদানি ও বিদ্যুতের বাড়তি দাম মিলিয়ে ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি বাড়তি বোঝা নিতে সরকার বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো দ্বিধা হয় নাই। কারণ তাতে লাভ হচ্ছে কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর। বোঝা তো জনগণের ওপর চাপানোই যাচ্ছে। ঋণগ্রস্ততা বেড়েছে, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, ভর্তুকি বেড়েছে।
ঋণ নিতে অর্থমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহ। পদ¥া সেতু নিয়ে দীর্ঘ জটিলতার সৃষ্টি হল, সমাধান এখনও হয় নাই। পদ¥া সেতুর জন্য সার্বভৌম বন্ডের উদ্যোগ নেবার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। অনেক ঝুঁকি তৈরি হবে তাতে। অন্যদিকে ভারতের ঋণের আগের বোঝা টানতে বহু মন্ত্রণালয় অস্থির, কিন্তু ঠিকই পদ¥া সেতুর জন্য আবার ২০ মিলিয়ন ডলার ঋণ, যা প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই নয়, তাই নিয়ে পুরো প্রকল্পকে নানা শৃঙ্খলে জড়ানো হয়েছে। এর আগে ভারতের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারের চাইতে বেশি দামে রেলওয়ে কোচসহ বিভিন্ন কেনাকাটা হচ্ছে। শুধু ৭০টি রেলওয়ে কোচ কেনার জন্য ৩০০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হযেছে। আর চীনের সঙ্গেও চলছে নানা অঘটন, তাদের কাছ থেকে নেয়া ঋণের টাকায় আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ দামে কেনার কারণে বাড়তি খরচ হচ্ছে ৬৭০ কোটি টাকা। আইএমএফ এর কাছ থেকে তিন বছরে কয়েক কিস্তিতে ১০০ কোটি ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে। তারজন্য কয়েক দফা তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। আরও বাড়ানোর জন্য পথ খোঁজা হচ্ছে।
গল্প বলে, কৃষক গণিমিয়া ঋণ করে সর্বশান্ত হয়েছিলেন, ঘি খাওয়ার পরিণতিতে তাঁকে অনাহারে দিন কাটাতে হয়েছিল। তবে নিজের ঋণের দায় তিনি নিজেই নিয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রী একদিকে অনাবশ্যক ও বাজে শর্তে ঋণের জালে জড়াচ্ছেন দেশকে, অন্যদিকে শেয়ারবাজার হলমার্ক সহ দুর্নীতি, লুন্ঠনের সবগুলো ক্ষেত্রে উদার পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন। এর পরিণতি তো তাঁকে বহন করতে হচ্ছে না, তাঁর ‘ঘি খাওয়ায়’ কখনোই টান পড়বে না। এসবের শিকার হচ্ছে এদেশের মানুষ, এইদেশের অর্থনীতি। শুধু বর্তমানেরই নয়, ভবিষ্যত প্রজন্মকেও এসব অপকর্মের বোঝা টানতে হবে।।
(এপ্রিল ১০,২০১৩ তারিখে আমাদের বুধবার এ প্রকাশিত)