রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দিয়ে অচলাবস্থা কাটবে না

1 122554বর্তমান অচলাবস্থা ও সহিংস পরিস্থিতির কেন্দ্রে অন্যতম বিষয় হলো নির্বাচন। ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন না হলে অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতা দখল করতো, তাতে বিপদ আরও বাড়তো’, সরকারি দলের লোকজনের এ যুক্তি খুবই শক্তিশালী। কিন্তু যেভাবে নির্বাচন হয়েছে তার বিকল্প ‘নির্বাচন না হওয়া’ ছিল না, ছিল ‘যথাযথ নির্বাচন হওয়া’। আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ার যে দশা, সমাজে চোরাই টাকা আর সন্ত্রাস যেভাবে রাজনীতির পরিচালিকা শক্তি, তাতে সব দলের অংশগ্রহণ হলেও যথাযথ নির্বাচন আশা করা যায় না। অর্থ, সহিংসতা, সাম্প্রদায়িকতা ও কু-রাজনীতিই নির্বাচন প্রক্রিয়াকে দখল করে রাখে। কিন্তু এসব আছে বলেই আমরা বলতে পারি না, নির্বাচন অর্থহীন, তখন বরং নির্বাচন যাতে প্রকৃতই জনপ্রতিনিধিত্বমূলক হয়, সেই রাজনীতি বিকাশের প্রয়োজনীয়তাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

যাহোক, স্বনির্বাচিত হওয়ার পর সরকার একচেটিয়া ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। কিন্তু একচেটিয়া ক্ষমতা কোনো দেশের জন্য ভালো নয়, যারা এ ক্ষমতা ভোগ করেন তাদের জন্যও নয়। একচেটিয়া ক্ষমতা ভোগ করার জন্য বর্তমান সরকারকে ছাড় দিতে হচ্ছে অনেক। নিজের দুর্বলতা ঢাকতে পুলিশ, র‌্যাবসহ নানা বাহিনী ও প্রশাসনকে তুষ্ট রাখতে হচ্ছে, যথেচ্ছাচারের সুযোগ দিতে হয়েছে। একই কারণে ভারত, চীন, রাশিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিদেশি নানা শক্তির দাবি ও আবদার পূরণ করতে হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াতও এ বিদেশিদের দিকেই তাকিয়ে তদবির ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলছে। বিএনপি করছে তার জন্য সুবিধাজনক নির্বাচনের আশায়; আর জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষাসহ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিদেশনির্ভর হয়ে আছে। ভারতের ভূমিকা এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছাও ভারত হয়েই কার্যকর হবে। অতএব ভারতের শাসকগোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করা ও সন্তুষ্ট রাখা রাজনীতির দুই পক্ষের এখন প্রধান তৎপরতা।

এর মধ্যে কারা পথেঘাটে, বাসে ও ট্রেনে নিষ্ঠুর প্রাণঘাতী হামলা চালাচ্ছে? এর উত্তরে সাধারণভাবে ধারণা করা হচ্ছে, সরকারও দাবি করছে, এগুলো করছে বিএনপি ও জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। হুকুমের আসামি হিসেবে খালেদা জিয়াসহ বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। শীর্ষ নেতারা গ্রেফতার হয়েছেন, খালেদা জিয়া প্রায় অন্তরীণ অবস্থায় আছেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়াসহ বিএনপি নেতাদের দাবি_ এসব সন্ত্রাসী ঘটনা সরকারই ঘটাচ্ছে, আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য। হাজার হাজার গ্রেফতার করা হলেও খুনি-হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করা ও তাদের বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে পুলিশ ও র‌্যাবের অগ্রগতি তুলনায় খুবই কম।

ঘটনা যারাই করুক, যেহেতু হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির মধ্যে এসব ঘটনা ঘটছে সেজন্য এর প্রধান দায়িত্ব বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের। তবে যারা ক্ষমতায় থাকেন ভালো-মন্দ সবকিছুর দায় তাদেরই নিতে হয়, নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের মূল দায়িত্ব সরকারের। পেট্রলবোমা সন্ত্রাসে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সরকারে যুক্ত ব্যক্তি-গোষ্ঠী বা কোনো বাহিনীরও ভূমিকা আছে কিনা, সেটা জানা গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের পক্ষে সম্ভব। কিন্তু এতটুকু পরিষ্কার যে, সরকারের গৃহীত দমনমূলক পথ ও পদ্ধতিগুলো পরিস্থিতির ভয়াবহতা দূর করতে কোনো কাজে আসছে না।

৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া অবিরাম সহিংসতায় ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩৩ দিনে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৮০ জন। এর মধ্যে পেট্রলবোমা ও আগুনে দগ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন ৪৯ জন। এদের মধ্যে শিশু, নারী, তরুণ, বৃদ্ধ, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী, পেশাজীবী ও শ্রমজীবী সবধরনের মানুষই আছেন। সংঘর্ষ ও ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ৩১ জন। এর মধ্যে ক্রসফায়ারে বা বন্দুকযুদ্ধের নামে পুলিশ বা র‌্যাবের গুলিতে নিহতের সংখ্যা ১৫ জন। ক্রসফায়ারে নিহতদের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী ছাড়াও দলহীন খুদে ব্যবসায়ী শ্রমজীবী মানুষ আছেন। গ্রেফতারের সঠিক সংখ্যা সরকার প্রকাশ করেনি। পত্রপত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী এর সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

মানুষের প্রতিদিনের প্রশ্ন : একদিকে সন্ত্রাস-চোরাগোপ্তা হামলা ও পেট্রলবোমা, অন্যদিকে বিধিনিষেধ, দমনপীড়ন এসবের শিকার কেন হবে এদেশের মানুষ? এদেশে ঘরে ঘরে মানুষকে আর কত রক্তক্ষরণ দেখতে হবে? পুলিশ-বিজিবির পাহারার মধ্যেই বাসের বহরে বোমা পড়ে, শিশুসহ কতজনের পোড়া শরীর দেখি আমরা। বাসের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকে আশ্রয়হীন হেলপার নামের গরিব শ্রমিক, তাকেও পুড়িয়ে মারে দুর্বৃত্তরা। হেলপারের কাজ করে নিজের শিক্ষা অব্যাহত রেখেছিল এক তরুণ, স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করত, সেও ক’দিন আগে পেট্রলবোমার আঘাতে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। পথে পথে আরও কত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, শরীরে ক্ষত নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন, তার কোনো হিসাব নেই। প্রতি মুহূর্তে আতঙ্ক। বেঁচে থাকা স্বজন কিংবা ক্ষত নিয়ে চলা মানুষদের হাহাকার তো চিরদিনের। পরিবহন শ্রমিক, দিনমজুর ও হকার, যাদের প্রতি ঘণ্টার শ্রমের ওপর নির্ভর করে তাদের পরের ঘণ্টা বেঁচে থাকা, তাদের এখন কর্মহীন, অনিশ্চিত সময়; আরও কতদিন সেটাও জানা নেই তাদের। জনগণের জীবন ও সম্পদ চেনা-অচেনা সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি, প্রতি মুহূর্ত প্রত্যেক নাগরিকের জন্য অনিশ্চিত, নিরাপত্তাহীন। কোথায় এর শেষ তা জানা না থাকা আরও ভয়ঙ্কর। দেশি-বিদেশি নানা গোষ্ঠী এর সুযোগ নিতে তৎপর। দুর্বৃত্ত ও সন্ত্রাসীদের দাপট ও শাসনে মানুষ আর কত পরাজিত দেখবে নিজেকে?

ঘরে-বাইরে, পথেঘাটে আতঙ্ক, সন্ত্রাসে মানুষের প্রশ্ন তাই এখন একটাই। বর্তমান অচলাবস্থার অবসান হবে কবে? কবে এ আগুনের অভিশাপ থেকে মুক্তি মিলবে? সমস্যা হলো, যারা এ পরিস্থিতি তৈরি করেছে সমাধান তাদেরই হাতে। সমাধানের প্রথমত আশু পথ_ বিএনপি জোট অবরোধ, হরতাল প্রত্যাহার করবে, সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ করবে, পেট্রলবোমা, চোরাগোপ্তা হামলা বন্ধ করে সভা-সমাবেশে আসবে। দ্বিতীয়ত, সরকার দমন-পীড়ন বন্ধ করবে, ঘোষিত-অঘোষিত সব অগণতান্ত্রিক বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করবে। ক্রসফায়ার গ্রেফতারবাণিজ্য বন্ধ করবে, আর তৃতীয়ত, নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলে এ বছরের মধ্যে স্বচ্ছ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধী, সন্ত্রাসী ও লুটেরা বাদে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে হবে।

অনেকেই এসব বিষয় সমাধানের জন্য সংলাপের কথা বলছেন। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে এবং তার উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় সংলাপের প্রস্তাবকদের পাগল বলে অভিহিত করেছেন। বস্তুত এ করণীয়গুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষ নিজ নিজ উদ্যোগ গ্রহণ করলে কোনো সংলাপের দরকারও হয় না। কিন্তু সেই পথে না গিয়ে সহিংসতা আর দমন-পীড়নের পথ অব্যাহত রাখলে তা শুধু পাগলামি হবে না, হবে জনগণের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অপরাধ।

(১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশে প্রকাশিত)