৩ জুলাই ঢাকায় অর্ধদিবস হরতালের প্রাক্কালে আমরা আজকের এই সমাবেশে মিলিত হয়েছি। গত ১৮ জুন হরতাল ঘোষণার পর থেকে ইতোমধ্যে আমরা ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন শেণীপেশার মানুষের সাথে যোগাযোগ করেছি। ৩ জুলাই সকালে সারা বাংলাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচী আছে, সকাল ১১-১২ টা কর্মবিরতি পালন করে ফেস্টুন-ব্যানার নিয়ে জনগণ রাস্তায় দাঁড়াবেন, প্রয়োজনে দাবীনামা বুকে লিখে জনগণ গণরায় প্রকাশ করবেন। এই গণরায় প্রকাশের মধ্য দিয়ে জনগণ জানাবেন এই জাতীয় সম্পদ লুন্ঠনের তৎপরতা জনগণ মেনে নেবে না, বাংলাদেশের জনগণ তার সম্পদকে রক্ষা করতে ঐক্যবদ্ধ হবে, এই সম্পদ রক্ষা করবে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য, শিল্পায়নের জন্য, কর্মসংস্থানের জন্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। আমরা বিভিন্ন দিক থেকে, টেলিফোনে, চিঠিপত্রের মাধ্যমে, বিবৃতিতে, সংবাদপত্রে লেখালেখির মাধ্যমে, সব শেণীপেশার মানুষের সমর্থণ পেয়েছি। এবং এই সমর্থণের মধ্য দিয়ে এটা পরিষ্কার হয়েছে যে বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদকে চোর-ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষার জন্য একটি জাতীয় জাগরণ শুরু হয়েছে।
এর মধ্যে কিছু ব্যাবসায়ী সংগঠন আমাদেরকে অনুরোধ করেছে হরতাল প্রত্যাহার করতে, এই সমাবেশের মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্যে আমরা বলতে চাই যে আপনারা যদি এই দেশে শান্তিতে ব্যবসাবাণিজ্য করতে চান, আপনারা যদি শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে চান তাহলে আপনাদের প্রয়োজন বিদ্যুৎ, আপনাদের প্রয়োজন গ্যাস, আপনাদের প্রয়োজন কয়লা। অথচ ধারাবাহিকভাবে একের পর এক সরকার যা করতে চাইছে তার অর্থ হল বাংলাদেশের গ্যাস-কয়লা বাংলাদেশের কাজে লাগবে না। তারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক তৎপরতা, শিল্প-কৃষিকে বঞ্চিত করে এই গ্যাস-কয়লা বিদেশে পাচারের ষড়যন্ত্র করছে। সুতরাং যারা চোরাই টাকার উপর নির্ভরশীল নন, যারা কমিশনভোগী নন, সেইসব শিল্পদ্যোক্তাদের প্রতি আমাদের আহবান আপনারা যদি এই আন্দোলনের মর্মকথা বুঝে থাকেন তাহলে আপনারা এই আন্দোলনে শামিল হোন। না হলে বাংলাদেশে শিল্পের জন্য ভবিষ্যতে গ্যাস থাকবে না, ভবিষ্যতে যে দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে তা দিয়ে কোন উৎপাদনশীল তৎপরতা সম্ভব হবে না।
৩ জুলাই রথযাত্রা। সেজন্য রথযাত্রা উদযাপন পরিষদ আমাদেরকে অনুরোধ জানিয়েছেন হরতাল প্রত্যাহার করতে। আমরা তাদেরকে জানিয়েছি, এই রথযাত্রা উৎসবের সাথে মানসিকভাবে আমরাও আছি। আপনাদের রথযাত্রার ক্ষেত্রে হরতাল কোন বাধা হবে না। সর্ব শ্রেণীপেশার মানুষের ঐক্য-জারগণ নিয়ে আমাদের যে কর্মসূচী সেই কর্মসূচী প্রচার হচ্ছে আমাদের লিফলেটের মাধ্যমে। আমাদের লিফলেট কোন বোমা নয়, আমাদের লিফলেট কোন ট্যাংক নয়, আমাদের লিফলেট কোন ডিনামাইট নয়, কোন স্টেনগান নয়; অথচ এই লিফলেট প্রচারে বারবার বাধা দেয়া হচ্ছে। কারণ আমাদের লিফলেট তথ্য-যুক্তির একটা সমাবেশ। সরকার এর মধ্যে কয়েক দফা পুলিশের মাধ্যমে লাঠিচার্জ করেছে, গ্রেফতার করেছে, গতকাল যাত্রাবাড়ীতে আমাদের দুজন কর্মী অনীক মাহমুদ ও আরমান হোসেন আবীরকে গ্রেফতার করে এখন পর্যন্ত আটকে রেখেছে।* লিফিলেট প্রচার, তথ্যযুক্তি প্রচার যেকোন দেশের মানুষের ন্যূনতম অধিকার, রাষ্ট্রের কোন আইনে এটা অপরাধ হিসেবে গণ্য হল? যেহেতু কোন আইনেই এটাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার উপায় নাই সেহেতু তাদেরকে ৫৪ ধারায়(সন্দেহজনক গতিবিধি) গ্রেপ্তার দেখানোর চেষ্টা চলছে। আমরা বরং ৫৪ ধারায় মামলা করার মত সন্দেহজনক তৎপরতার অনেক মন্ত্রী-উপদেষ্টাকে দেখতে পাচ্ছি। শুধুমাত্র ৫৪ ধারা নয়, দেশদ্রোহীতার দায়ে অভিযুক্ত করার মত মন্ত্রী-উপদেষ্টাকেও দেখতে পাচ্ছি। দেশের সম্পদ যারা কিছুটা কমিশনের বিনিময়ে বিদেশীদের হাতে তুলে দিচ্ছে আজকে না পারলেও জনগণ একদিন তাদের বিচার করবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে ৪০ বছর লাগলেও এই জ্বালানী অপরাধীদের বিচার শীঘ্রই জনগণ করবে।
এই হরতাল জনগণের সম্পদ রক্ষার হরতাল, ভবিষ্যৎ রক্ষার হরতাল। কনোকো ফিলিপসের সাথে যে চুক্তি করা হয়েছে আমাদের লিফিলেটে তার বিস্তৃত বর্ণনা আছে। মূল কথা হচ্ছে কনোকো ফিলিপসকে দু’টি ব্লক দিয়ে দেয়ার মাধ্যমে পুরো বঙ্গোপসাগরকে উন্মুক্ত করে দেয়া হচ্ছে, দেশকে বঞ্চিত করে এই সম্পদ বিদেশে পাচারের ব্যাবস্থা করা হচ্ছে। সাড়ে সাত ভাগ উত্তোলনের সীমা থাকা সত্বেও অতিরিক্ত উত্তোলনের অধিকার দেয়ার মাধ্যমে রপ্তানীকে অনিবার্য করে তোলা হচ্ছে। এবং সেগুলোকে যুক্তিযুক্ত করার জন্য নানারকম অপপ্রচার-কুৎসা রটনা করা হচ্ছে। তথ্য-যুক্তি মোকাবিলা করার শক্তি তাদের নাই সেজন্যই তারা মিথ্যাচার-কুৎসা-গ্রেপ্তার-লাঠিচার্জ-ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছে। কোম্পানীমুখী ষড়যন্ত্রের সর্বশেষ নমুনা হচ্ছে ইসলামী নামধারী একটি গোষ্ঠীও হরতালের কর্মসূচী ঘোষণা করেছে ৩ জুলাই। নির্দিষ্ট ইস্যু, স্পষ্ট দাবীতে ৩ জুলাই হরতালের কর্মসূচী আমাদের বহু আগে থেকেই ঘোষিত। এই ইস্যুতে এতদিনের প্রচারণায় যে জনমত তৈরী হয়েছে সেই একই দিনে ভিন্ন দাবী নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের ডাকা এই হরতালকে আমরা ষড়যন্ত্রমূলক বলে মনে করি। ঐ সপ্তাহে ৩ জুলাই ছাড়াও আরো দিন আছে। আপনাদের যদি কোন দাবী থাকে, জনগণ যদি তা গ্রহণ করে তাহলে আপনারা অন্যদিন হরতাল ডাকুন। ৩ জুলাই যে হরতালের কর্মসূচী সারাদেশে পরিচিত ও প্রচারিত হয়েছে সেই কর্মসূচীকে নস্যাৎ করার জন্য, কিংবা বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য, কিংবা বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর পক্ষে অপপ্রচার সৃষ্টির সুযোগ দেয়ার জন্য যখন এই গোষ্ঠী হরতাল ডাকে তখন আমরা বলতে বাধ্য যে এই গোষ্ঠী কোম্পানীর পক্ষে-সরকারের পক্ষে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই এই হরতাল ডেকেছে। আমরা আবারো অনুরোধ করছি আপনারা আপনাদের কর্মসূচী এই দিবস থেকে সরিয়ে অন্য দিনে নিয়ে যান।
বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ যারা আমাদেরকে সমর্থণ দিয়েছেন, বিভিন্ন সংগঠন যারা এইখানে সংহতি প্রকাশ করতে এসেছেন, ২৩ টি গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠন গতকাল বিবৃতি দিয়েছেন, সড়ক পরিবহন ফেডারেশন আমাদেরকে সমর্থণ দিয়েছেন, দোকান মালিকদের অনেকেই আমাদেরকে সমর্থণ জানিয়েছেন, শিক্ষক-সাংবাদিক-লেখক-পেশাজীবীরা সমর্থণ জানিয়েছেন। আমরা এমন একটা হরতাল করব এই হরতালে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যার যার অবস্থান থেকে প্রচারণা চালাবেন ও হরতাল সফল করবেন। অনেক সাধারণ মানুষ আমাদের কাছ থেকে অনুরোধ করে প্রচারপত্র নিয়ে বিলি করেছেন, ফেসবুকে শত শত কবিতা-গান-পোস্টার লিখিত হচ্ছে, প্রচারিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ছয় হাজারের বেশি সংখ্যক মানুষ তারা হরতালে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকবেন বলে ঘোষণা দিয়েছে। সুতরাং এধরণের একটি জাতীয় আন্দোলনের অংশ হিসেবে যে হরতাল পালিত হচ্ছে সেই হরতালের গণরায় সম্পুর্ন ভিন্ন রাজনীতি, ভিন্ন জনগণের শক্তির উৎপাদন ঘটাচ্ছে বলে আমরা মনে করি। এই জনগণের শক্তির বিকাশের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ রক্ষা, বাংলাদেশের উপর জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় শক্তির বিকাশ ঘটবে। হরতালই শেষ নয়, এই আন্দোলনে আপনারা যুক্ত হবেন, আরো মানুষ শামিল হবে, বাংলাদেশের ইতিহাস নতুনভাবে সূচিত হবে এই আহবান জানিয়ে বক্তব্য শেষ করছি, সবাইকে ধন্যবাদ।