আরেক বছরের ৯/১১ অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বর পার হলো। আমি এই সময়ে হারিয়ে যাওয়া আরেকটি ১১ সেপ্টেম্বরের কথাও বলতে চাই। সেই ঘটনা আরও আগের, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের। ১১ সেপ্টেম্বর বললেই এখন নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার ধ্বংসযজ্ঞ দৃশ্যাবলী মনে পড়ে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে ওসামা বিন লাদেন আল কায়েদা নামের মুসলিম ‘জঙ্গী’ দল বা ব্যক্তির চেহারা। আর সন্ত্রাস দমনের নামে মার্কিন সামরিক অভিযানের যৌক্তিকতাও সেই সঙ্গে হাজির হয়। কীভাবে এগুলো মানুষের মনোজগতে স্থায়ী হয়ে যায় সেটা বুঝতে গেলে মিডিয়ার দিকে তাকাতে হবে। সেই যে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সকালে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের খবর বলবার দুমিনিটের মাথায় সিএনএন সহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেল অপরাধীদের সনাক্ত করে কথা বলতে থাকলো তারপর সেটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এর মধ্যে কত বছর পার হয়ে গেছে এখনও পুরো বিষয়টি নিয়ে কোন তদন্ত দল সুনির্দিষ্ট জায়গায় আসতে পারে নি। কোনদিন আসতে পারবে বলেও মনে হয় না। কিন্তু কে আর এসব প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করে? অথচ এর উপর ভর করেই সারা বিশ্বে মার্কিনী সশস্ত্র তৎপরতা বেড়েছে। ইরাকে মানববিধ্বংসী অস্ত্র আছে এই অজুহাতে দেশটা ছিন্নভিন্ন হলো, কিন্তু প্রমাণ হলো পুরোটাই ডাহা মিথ্যা!
এই মিথ্যার উপরই আসলে দাঁড়িয়ে আছে তথাকথিত সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ। নানারকম ‘সন্ত্রাস বিরোধী’ নামে, কার্যত নতুন নতুন নিপীড়নমূলক সন্ত্রাসী আইনে এবং তার বাস্তবায়নে এক দমবন্ধ করা পরিবেশ তৈরি হয়েছে বিশ্বব্যাপী। সন্ত্রাস, হিংসা, বিদ্বেষ, অস্থিরতা সবই বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষও এর থেকে রক্ষা পাননি। একের পর এক সন্ত্রাসের ভয়াবহ গল্প, আতংক ছড়ানো নানা ঘটনা আর ঘরে ঢুকে এফবিআই এর যা খুশি করবার স্বাধীনতা মার্কিনী একদিকে প্রতিবাদী আর অন্যদিকে দুর্বল জনগোষ্ঠীর জীবন বিপর্যস্ত করে ফেলছে। এক পুলিশী রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজেই। যুক্তরাষ্ট্র অন্যকে যত শৃঙ্খলিত করতে যাচ্ছে নিজে হচ্ছে ততই শৃঙ্খলিত।
সাম্প্রতিক অনেক ঘটনা অনেকের ঢাকা চোখ এইক্ষেত্রে খুলে দিতে সক্ষম যে, যুক্তরাষ্ট্র নিজের ভেতর কীভাবে লালন করে তৃতীয় বিশ্ব, কীভাবে চাকচিক্যের আড়ালে শ্রেণী ও বর্ণগত বৈষম্য ক্রমাগত দগদগে রূপ নিতে থাকে। কীভাবে পুঁজিবাদের কেন্দ্রীয় দেশ সারা বিশ্বের সর্বত্র ধ্বংসকাজে চরম দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি একই অঞ্চলের মানুষদের বিপন্ন অবস্থায় চরম নির্লিপ্ত এবং অদক্ষ থেকে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র মানে তাই কেবল টুইন টাওয়ার নয়, ক্ষুধার্ত মানুষও। যুক্তরাষ্ট্র মানে কেবল হাজার মাইল দূরে মুহূর্তে একটি দেশ জনপদ ছিন্ন ভিন্ন করার, লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যার ক্ষমতাই নয়, নিজের দেশের ভেতরে বর্ণবাদী আর শ্রেণীগত নিপীড়নে লক্ষ কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন করবার ব্যবস্থাও। যুক্তরাষ্ট্রের দিকে নির্মোহ দৃষ্টিতে তাকালে এই ব্যবস্থার ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত মানুষ সেখানে আগেও দেখা যেতো। যাতে কারও সেই চোখ তৈরি না হয় সেজন্য আছে মিডিয়া। মিডিয়ায় যে যুক্তরাষ্ট্র উপস্থিত হয় তা এক মিথ। তা অনেককিছু ঢেকে ফেলে, অনেক কিছু অলঙ্কার দিয়ে উপস্থিত করে, একজনের চাকচিক্য দিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে ফেলে যাতে আর শতজনের কঠিন তাড়িত জীবন দেখা না যায়।
মিডিয়ার অব্যাহত প্রচারণায় যেমন টুইন টাওয়ার ধ্বংসের চিত্র মার্কিনী আগ্রাসন হত্যা যুদ্ধের যৌক্তিকতা তৈরি করতে সচেষ্ট হয় তেমনি মিডিয়ার সক্রিয় নীরবতায় ঢাকা পড়ে আরেক ১১ সেপ্টেম্বরের রক্তাক্ত ইতিহাস। সেই ৯/১১ তৈরি হয়েছিল ১৯৭৩ সালে, চিলিতে। সেইদিন সকালে প্রায় একই সময়ে আকাশে উঠেছিলো বহু যুদ্ধ বিমান, কোন বিদেশি আগ্রাসনকারির বিরুদ্ধে নয়, মাকিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে চিলির সেনাজেনারেলরা ট্যাংক বিমান নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিলো চিলির জনগণের বিরুদ্ধে, তাদের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আলেন্দের বিরুদ্ধে। যুদ্ধ চললো, একদিকে প্রায় নিরস্ত্র মানুষ আরেকদিকে তাদেরই করের অর্থে গড়ে উঠা চিলিরই সেনাবাহিনী যার পেছনে সিআইএ। যুদ্ধ করতে করতে নিহত হলেন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, তাঁর অপরাধ ছিল চিলির অর্থনৈতিক সম্পদ বহুজাতিক কোম্পানির হাত থেকে চিলির মানুষের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা। নিহত হলেন আরও বহু হাজার মানুষ, যারা চিলিতে এক নতুন জগত নির্মাণের জন্য আতœনিয়োগ করেছিলেন। নিহত ও আটক হলেন বহু লেখক শিল্পী শিক্ষক সংস্কৃতি কর্মী, যেকোন স্বৈরতন্ত্রী ব্যবস্থায় এদের কোন ভাবেই ছাড় দেয়া হয় না, কেননা এদের মধ্য থেকেই মানুষের শক্তির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। অসংখ্য মানুষ সেসময় উধাও হয়েছিলেন তার হিসাব এখনও পরিষ্কার নয়। মার্কিনী সেই আগ্রাসনে ক্ষমতাসীন হয়েছিল জেনারেল পিনোচেট, জেনারেল সুহার্তো জেনারেল মার্কোস এর মতো। এরপর চিলিতে রক্তক্ষরণ হলো প্রায় দশকেরও বেশি সময় ধরে। এখন মানুষ সেই সময়ের দুর্বত্তদের বিচারের চেষ্টা করছেন।
এসব ভয়ংকর ঘটনা মনে করিয়ে দিতে মার্কিনী মিডিয়ার গভীর অনাগ্রহ, এসব অনেক খবরও টিভি বা সংবাদপত্রে ঠিকমতো আসে না। আসে না এই কারণে যে, এরকম বহু হত্যা, ধ্বংস আর তান্ডবলীলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই জড়িত। এগুলো যদি মিডিয়াতে আসে তাহলে প্রতিদিন দেখা যাবে যুক্তরাষ্ট্রের সেই চেহারা যা ঢাকতেই বৃহৎ ব্যবসার একনিষ্ঠ সেবক টিভি সংবাদপত্র গবেষণা সংস্থা সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত।