আনু মুহাম্মদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক। তেল-গ্যাস–খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ৪০টির বেশি বই রয়েছে। জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবের নানা দিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ
প্রথম আলো: এবারের বাজেট কেমন হলো?
আনু মুহাম্মদ: একটি দেশের অর্থনীতিতে বাজেট নতুন করে কোনো নির্দেশনা দেয় না। একটি দেশের যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, নীতি ও দর্শন দিয়ে পরিচালিত হয়, তার অংশ হিসেবে প্রতিবছর একটি বাজেট আসে। ফলে বাজেট থেকে আমাদের এমন প্রত্যাশা করা উচিত নয়, যা আমাদের নতুন কিছু দেবে। এই সরকার যে শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছে, যে দর্শন দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে, তার একটি অভিব্যক্তি এই বাজেটের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছি। এই অভিব্যক্তির প্রকাশ দেখা যায় মূলত দুটি বিষয়ের ওপরে। একটি হচ্ছে সরকার কোথা থেকে সম্পদ বা অর্থ সংগ্রহ করে আর কোথায় ব্যয় করে। এমনকি বিদেশ থেকেও অর্থ নেওয়া ও দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন দেশের ওপরে একটি সরকার নির্ভরশীল হচ্ছে, তা দেখেও অনেক কিছু বোঝা যায়।
সেই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখি সরকারের সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে পরোক্ষ কর। আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নানা কেনাকাটা ও ব্যয়ের সময় সরকারকে নানাভাবে কর দিই। এই পরোক্ষ কর সংগ্রহের ক্ষেত্রে সরকার বাজেটে বেশ বড় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। আরেকটি হচ্ছে সরাসরি আয়কর। এই আয়কর দেওয়ার ক্ষেত্রেও আমরা দেখি দেশের সীমিত আয়ের পেশাজীবী ও মধ্যবিত্তরা মূলত এই কর দিচ্ছে। কিন্তু দেশের ধনিকশ্রেণি যাদের সম্পদ বেশি তাদের কাছ থেকে কর আদায় হয় খুবই কম। কিন্তু তাদের স্বার্থের পেছনে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয়ের পরিকল্পনা বরাবরের মতো আমরা এই বাজেটেও দেখেছি। ফলে অর্থনৈতিক দর্শনের দিক থেকে এই বাজেটে নতুন কিছু নেই।
প্রথম আলো: উন্নয়ন বাজেটে ব্যয়ের খাতগুলোকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আনু মুহাম্মদ: বাজেটে সরকারের দর্শনের সবচেয়ে বড় প্রতিফলন আমরা দেখি উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দ দেখে। যেমন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শিক্ষা খাত। এই খাতে বিনিয়োগ করলে তার ফলাফল সবচেয়ে ভালো পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা দেখেছি আগের বাজেটগুলোর মতোই শিক্ষা খাতে বরাদ্দ খুবই কম। সরকারের দায়িত্ব শিক্ষাকে জনগণের জন্য সহজলভ্য করা ও উন্নত শিক্ষার ব্যবস্থা করা। জিডিপির অনুপাতের দিক থেকে বিশ্বে তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের উন্নয়ন বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ সবচেয়ে কম।
একই কথা বলা যায় স্বাস্থ্য খাত নিয়ে। সরকার দুই বছর ধরে স্বাস্থ্য খাতে করোনা বিষয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে। তার বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে টিকা ও যন্ত্র কেনাকাটায়। কিন্তু এই কেনাকাটার ক্ষেত্রে আমরা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অনেক অভাব দেখেছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ঋণ নিয়ে অনেক অপ্রয়োজনীয় যন্ত্র কিনতে দেখেছি। সেগুলো বিমানবন্দরে দীর্ঘদিন পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছিল, পরে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর তা ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে দেখেছি। স্বাস্থ্য খাতকে জনগণের অধিকার হিসেবে দেখা উচিত। তা দেখা হয়নি। দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা, চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় ওষুধের ক্ষেত্রে এই বাজেটেও আমরা খুব বেশি বরাদ্দ দিতে দেখিনি।
প্রথম আলো: এবারও তো অবকাঠামো ও মেগা প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
আনু মুহাম্মদ: এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বড় বড় প্রকল্পের দিকে মনোযোগ দিতে দেখেছি। সরকার থেকে বলা হয়, এসব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে। বলা হয়, বিশ্বব্যাংক-এডিবির মতো প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে এগুলো করা হচ্ছে। কিন্তু এসব সংস্থার দেওয়া অর্থ দিন শেষে জনগণের দেওয়া কর ও আয় থেকে নেওয়া হয়। আর বাস্তবে আমরা এমন সব প্রকল্প নিতে দেখেছি, যেগুলো জনগণের স্বার্থে কোনো কাজে লাগে না। বরং জনগণের ওপরে করের বোঝা বাড়ানো হয়। সুন্দরবনের পাশে রামপাল, পাবনায় রূপপুর ও পটুয়াখালীতে পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো প্রকল্পগুলো দিন শেষে জনগণের বিপক্ষে যায়। এসব প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি হতে আমরা দেখেছি। এই বাজেটেও সরকার মেগা প্রকল্পে বরাদ্দ রেখেছে, যার অনেকগুলোই আসলে জনগণের কোনো কাজে আসবে না, বরং ক্ষতিকর হবে এবং দীর্ঘ মেয়াদে মানুষের ওপরে করের বোঝা বাড়াবে। যেমন দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এক লাখ কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। এই টাকা রাশিয়া দিলেও তা আবার জনগণের কাছ থেকে আদায় করে সুদসহ ফেরত দিতে হবে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্প দেশের পরিবেশের ক্ষতি করছে, দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
প্রথম আলো: কিন্তু দেশের উন্নয়নে তো অবকাঠামো জরুরি?
আনু মুহাম্মদ: দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং চাহিদাকে মাথায় রেখে অবকাঠামো নির্মাণ করলে তো কোনো সমস্যা ছিল না। বাস্তবে আমরা দেখেছি অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে চীন বা ভারতের তুলনায় তো বটেই, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের মতো ধনী দেশের তুলনায় আমাদের সব ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ খরচ বেশি। সেতু থেকে শুরু করে সড়ক—সব খাতে আমরা দেখেছি মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে। তাই অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে যদি চুরি বা দুর্নীতি বেশি গুরুত্ব পায়, তাহলে তা জনগণের লাভের চেয়ে বোঝা বেশি হয়।
যেমন বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতিতে রেল ও নৌপথে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। স্বাধীনতার পর দেশের নৌপথ অর্ধেকের বেশি কমেছে। রেলপথও গুরুত্ব পায়নি, বরং রেলযাত্রার ওপরে বাড়তি করের বোঝা চাপানো হয়েছে। বাজেটে গুরুত্ব পেয়েছে সড়কপথ। স্বাধীনতার পর প্রতিটি সরকার বাজেটে সড়কপথের পেছনে বরাদ্দ বাড়িয়েছে। ফলে সড়কপথ কয়েক হাজার গুণ বেড়েছে। এসব সড়কের মান ও ব্যয় নিয়েও দুর্নীতির কথা বেশি উঠে এসেছে।
প্রথম আলো: অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ নিয়ে অনেক কথা উঠছে।
আনু মুহাম্মদ: বাজেটে অভ্যন্তরিন উৎস থেকে অর্থাৎ দেশীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলো থেকে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা ঋন, এবং বিদেশ থেকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা ঋন নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যা বাজেট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আরও বাড়তে পারে। এই ঋণের বড় অংশ নেওয়া হয়েছে মেগা প্রকল্পের জন্য। এসব ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে এবারের বাজেটে নতুন নতুন খাতে করের বোঝা চাপানো হয়েছে। অনেক প্রয়োজনীয় খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। যেমন সরকার বাজেট ঘোষণার আগে আগে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। এর ফলে গ্যাসের সঙ্গে সম্পর্কিত বিদ্যুৎ ও শিল্পপণ্যের খরচ বাড়বে। ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়বে। বাজেটের পর ভোজ্যতেলের দাম বাড়াতে দেখেছি। এতে করে দিন শেষে জনগণের পকেটের টাকা সরকারের হাতে জমা হচ্ছে। আর সরকার মেগা প্রকল্পের পেছনে তা অপব্যয় করছে বলা যায়।
প্রথম আলো: দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় তো বাড়ছে বলা হচ্ছে।
আনু মুহাম্মদ: সরকারি হিসাবে দেশে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮০০ ডলার বলা হচ্ছে। সরকারের খানা জরিপের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী ২৫ শতাংশ মানুষের আয় মাসে ২০ হাজার টাকার কম। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের বাইরে মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে দেশের বেশির ভাগ সম্পদ রয়েছে। তাদের স্বার্থে সরকার বাজেটে বরাদ্দ রাখছে, বড় প্রকল্প করছে। সেখান থেকে ওই ধনীরা আমদানি ও রপ্তানির নামে তাদের হাতে জমা হওয়া অর্থ বিদেশে পাচার করছে।
অর্থমন্ত্রী এবারের বাজেটে ওই পাচার হওয়া অর্থ দেশে আনার সুযোগ দিয়েছেন। সাধারণ আয়করের চেয়ে কম আয়কর দিয়ে তা দেশে আনা যাবে বলে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন। সাধারণত বিদেশে যারা অর্থ পাচার করেছে, তা দেশে আনার কথা নয়। একটি বিশেষ গোষ্ঠী বিদেশে পাচার করা অর্থ রাখা নিরাপদ বোধ করছে না। তাদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে ওই অর্থ দেশে আনার সুযোগ করে দিয়ে অর্থমন্ত্রী দেশের ওই গোষ্ঠীকে একটি বার্তা দিয়েছেন। তা হচ্ছে অর্থ পাচার করলে কোনো শাস্তি হবে না, বরং সুবিধা পাওয়া যাবে।
প্রথম আলো: কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এই বাজেট কতটুকু ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন?
আনু মুহাম্মদ: বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য অধিদপ্তর সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এর জন্য অধিদপ্তর সৃষ্টির তো দরকার নেই। সরকার গত কয়েক বছরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি তো করেইনি, বরং কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান নষ্ট করেছে। করোনার মধ্যে দেশের ২৫টি পাটকল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একের পর এক চিনিকল বন্ধ করছে। অথচ আমরা হিসাব করে দেখেছি পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলে সব কটি পাটকল চালু করা সম্ভব। এটিসহ কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির কয়েকটা পথ সরকারের হাতেই আছে। যেমন দেশের বিপুলসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক, হাসপাতালে নার্স, ডাক্তার, দুর্ঘটনা রোধে ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রায় সাড়ে চার লাখ লোকের কর্মসংস্থান সম্ভব। এতে জনগণের উপকার হবে, অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে। এসব উদ্যোগের পেছনে বাজেটে কোনো বরাদ্দ বা নির্দেশনা নেই। এই সরকার যে দর্শন ও পরিকল্পনার মধ্যে কাজ করে তাতে তার বাজেট সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সম্পদ কিছু গোষ্ঠীর কাছে নিয়ে যায়, এটাই স্বাভাবিক।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
আনু মুহাম্মদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
[১১ জুন ২০২২ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত]