মুক্তিযুদ্ধের বিষয় আলোচনায় সাধারণভাবে প্রধান দুটি প্রবণতা দেখা যায়। একটি হল, মুক্তিযুদ্ধ মানে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ যেটা নির্ধারণ করবে সেটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আওয়ামী লীগ সমর্থন মানেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ। আরেকটা প্রবণতা হল, এর মধ্যে নানা বহিঃস্থ বিষয়কে প্রধান করে তোলা। এই ধারার বক্তব্য, ভারত কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বার্থসিদ্ধির মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এই দুটো চিন্তাধারার সাথেই আমি একমত নই।
এটা ঠিক যে, এখানে ভারতের নানারকম হিসাব-নিকাশ ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নেরও নানা বিবেচনা ছিল। এটাও ঠিক যে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের বলে যুদ্ধে যারা রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের যুদ্ধ কিংবা স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো সমন্বিত দিকনির্দেশনা ছিল না, সে কারণে তাঁদের মধ্যে অনেক রকম দ্বন্দ্ব-সংঘাতও ছিল। ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, কী রকম একটা খুবই সূক্ষ্ম তারের উপর পুরো যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছে। তাজউদ্দিন আহমেদকে পাই এমন একটি চরিত্র হিসেবে যিনি স্বাধীনতাযুদ্ধকে সফল করবার জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করেছেন। কিন্তু অনেক ধরনের চাপ ও বৈরিতা তাঁকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। স্বাধীনতার পরও তাঁকে সে সবের চাপ বহন করতে গিয়ে ক্ষতবিক্ষত হতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক হয়েও তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগ সরকারে টিকতে পারেননি, মুশতাক পেরেছিলেন। কিন্তু নেতৃত্বের অবস্থা ও অবস্থানের জন্য, আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের নিজস্ব সমীকরণের জন্য, একটা বর্বর সেনাবাহিনীর আক্রমণ মোকাবিলা করতে গিয়ে বাংলাদেশের জনগণের যে শক্তি, সাহস, তার চেতনা, প্রত্যাশা ও স্বপ্ন তা ছোট হয় না, এগুলোর গুরুত্ব কোনভাবেই খর্ব হয় না। সেজন্যই আমি বারবার বলতে চাই যে, ১৯৭১ সাল মুক্তিযুদ্ধের শুরুও নয়, ১৯৭১ সাল বাংলাদেশের মানুষের মুক্তিযুদ্ধের শেষও নয়। বাংলাদেশের কিংবা এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের মুক্তিযুদ্ধের একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল ১৯৭১, সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ।
অর্থাত্ ১৯৭১ সালের যুদ্ধ এই জনপদের মানুষের দীর্ঘদিনের মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতার একটি অংশ। ’৭১-এর যুদ্ধে সমাজের বিভিন্ন অংশ বিভিন্নভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। একটি চেতনাই তখন প্রাধান্যে ছিল যে, এমন একটি দেশ হবে যা পাকিস্তানের মত হবে না। নতুন কোন পাকিস্তান আর হবে না, একটা নতুন ধরনের দেশ হবে। মানুষের মধ্যে ভূমিহীন, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত কিংবা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র চাই— নতুন রাষ্ট্র, মানে নতুন ব্যবস্থা চাই। এই নতুন সমাজে পাকিস্তানের মত জাতি বর্ণ ধর্ম শ্রেণি বৈষম্যমূলক যে ব্যবস্থা তার অবসান ঘটবে। সেটা একটা সমৃদ্ধ সমাজ হবে।
একটি জনগোষ্ঠীর এই সাহস বা শক্তি একটা নির্দিষ্ট সময়ে তৈরি হয় না, তার একটা ধারাবাহিকতা থাকে। ১৯৭১ সালে যখন যুদ্ধ হচ্ছে আমরা তখন মানুষের মুখে ক্ষুদিরামের গান শুনি কিংবা সূর্যসেনের গল্প শুনি, ব্রিটিশ-বিরোধী লড়াই, তেভাগা আন্দোলন, তেলেঙ্গানা আন্দোলন তাকে শক্তি দেয়। শুধুমাত্র দেশের অতীত থেকে শুনি তা না, ভিয়েতনামের গল্প আসে, চীনের দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, ব্রিটিশ-বিরোধী ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের যারা স্মরণীয় তাদের কথা আসে, গল্প আসে, উপন্যাস আসে, এমনকি প্রাচীনকালের দাসবিদ্রোহ থেকে শুরু করে ফরাসি বিপ্লব, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মিথ— সবকিছুই আমাদের কোনো না কোনভাবে উত্সাহিত করে, শক্তি দান করে। এই যোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটা অঞ্চলে, একটা এলাকায়, একটা ধারাবাহিকতায়, একটা পরম্পরায় যে লড়াইগুলো হয় সেই লড়াইগুলো অচেতনে থেকেই যায়, নিঃশেষ হয়ে যায় না। অনেক লড়াই আছে যা আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়। প্রকৃতপক্ষে অনেক ব্যর্থতার উপরেই সাফল্য দাঁড়ায়।
সাইমন বলিভার ল্যাটিন আমেরিকান বিপ্লবী, তাঁর নামেই সেই অঞ্চলে এখন ‘বলিভারিয়ান রেভ্যুলিউশন’ একটি লক্ষ্য হিসেবে জনপ্রিয়। সেই বলিভার সারা জীবনের লড়াই ও সাফল্যের পরও মৃত্যুর সময় বলেছিলেন, ‘কী করলাম আমি সারা জীবন’? ল্যাটিন আমেরিকা তখন ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে মুক্ত হয়েছে, কিন্তু নতুন সমাজের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। সেই লড়াইয়ে তিনিই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, কিন্তু মৃত্যুবরণ করছেন গভীর অতৃপ্তি নিয়ে। মৃত্যুর সময় তিনি তাই বলছেন, ‘একমাত্র স্বাধীনতাটাই আমরা পেলাম আর সবকিছুই হারালাম।’ কী মর্মান্তিক উচ্চারণ! মৃত্যুর মুখে এসে তিনি গভীর বেদনায় আরও বলছেন, ‘আমি কি সারা জীবন সমুদ্রের পানিতে চাষ করলাম?’
সমুদ্রের পানিতে চাষ, সমুদ্রে চাষ মানে কী? সমুদ্রের পানিতে লাঙল দিয়ে চাষ করার কোনো অর্থ নেই। সাইমন বলিভার এরকম একটা ব্যর্থতার যন্ত্রণা নিয়ে মারা গেলেন। শেষ হয়ে গেলেন? না। এখন পুরো ল্যাটিন আমেরিকায়, বিপ্লবী যত ধরনের তত্পরতা বা লড়াই হচ্ছে, সাম্রাজ্যবাদকে মোকাবিলার যতরকম যা কিছু লড়াই হচ্ছে, সেখানে সাইমন বলিভার হচ্ছেন অন্যতম প্রধান প্রেরণার উত্স। যদি এরকম হতো, ক্ষমতায় এসে যদি তিনি সাফল্যে, সন্তুষ্টিতে ডুবে থাকতেন তাহলে হয়তো এরকম প্রেরণার উত্স হতে পারতেন না। যদি সাফল্যের দম্ভে গণবিরোধী ভূমিকা নিতেন তাহলেও এটা হতো না। কিন্তু তার সাফল্য, বিপ্লবী চেতনা এবং সেইসঙ্গে অসম্পূর্ণতার যে বেদনা সমস্ত কিছুই পরবর্তী আরো লড়াই বিকশিত করার তাগিদ ঐ সমাজেই তৈরি করেছে।
সুতরাং প্রত্যেক পর্যায়, প্রতিটি লড়াই আসলে একেকটা সমাজে বা একেকটা জনপদে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চেতনার ধারাবাহিকতা তৈরি করে, তার স্পিরিট তৈরি করে, তার সাহস তৈরি করে, শক্তি তৈরি করে। সেই ধারাবাহিকতাতেই তৈরি হয় মানুষের পথ।
যাহোক, ১৯৭১ সালে মার্চ মাসে প্রস্তুতির অভাব এবং সিদ্ধান্তহীনতা দিয়ে যার শুরু, সেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় পুরোটা জুড়েই ছিল সমন্বিত দিকনির্দেশনার অভাব। শুধু অভাব নয়, সংঘাতও ছিল। সেনাবাহিনী ও রাজনীতিবিদদের মধ্যেও বিরোধ, অনাস্থা ও টেনশন ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করেছে। এসবের অনেক কিছুর ধারাবাহিকতা স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত নানাভাবে অব্যাহত আছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি আমরা বলি, তাহলে চেতনার একটা দিক তো ছিল বটেই একটা নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। পাকবাহিনীর কতিপয় সহযোগী বাদে সবাই একমত ছিলেন যে, বাংলাদেশ হবে অসামপ্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এই এতটুকুই। কিন্তু অসামপ্রদায়িক রাষ্ট্র হয়েছে সেটা আমরা বলতে পারি না। শ্রেণি, বর্ণ, ধর্ম, জাতিবৈষম্য থেকে মুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে সেটাও বলতে পারি না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সেটা তো নয়ই। যে রাষ্ট্র এখন দেখছি এর জন্য বাংলাদেশের মানুষ লড়াই করেনি। এগুলো হয়নি বলে যদি কেউ আবার এরকম সিদ্ধান্ত টানেন যে, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ বা লড়াই করে কী লাভ হলো? এটার সাথেও আমি একমত নই। আমাদের বলতে হবে মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা এখন পর্যন্ত চলছে। আমরা মুক্তির যুদ্ধের মধ্যেই আছি। এখন যত ধরনের লড়াই হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির লড়াই, সাম্রাজ্যবাদসহ বিদেশি আধিপত্য, লুণ্ঠন, দখল, পাচারবিরোধী লড়াই কিংবা মানুষের নতুন সমাজের জন্য লড়াই, দেশ ও দেশের সম্পদের ওপর জনগণের মালিকানার লড়াই, শ্রেণিগত-লিঙ্গীয়-জাতিগত-ধর্মীয় বৈষম্য ও নিপীড়ন-বিরোধী লড়াই, সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী লড়াই, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি— সবগুলো লড়াই মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতার অংশ।
বাংলাদেশের ভবিষ্যতে কোনো বড় ধরনের লড়াই অগ্রসর হবে না ১৯৭১কে হিসেবের মধ্যে না নিয়ে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যে স্পিরিট সাহস বা চেতনা তাকে স্পর্শ না করে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির লড়াই দাঁড় করানো যাবে না। আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যে গণতান্ত্রিক অসামপ্রদায়িক. বৈষম্যহীন, কিংবা জনকর্তৃত্বের যে চেতনাগুলো তৈরি হয়েছিল সেগুলো অস্বীকার করা, জনবিরোধী রাজনীতিকে বৈধতা দেবার জন্য তার ওপর মুক্তিযুদ্ধের আবরণ দেয়া, ১৯৭১-এর লড়াইকে সেই সালের মধ্যেই আটকে রেখে তাকে একটা অলংকার বানানো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু নয়।
একদিকে বাণিজ্য, অন্যদিকে জনবিরোধী রাজনীতির বর্ম হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহারের চেষ্টাই এখন জোরদার। এর বিপরীতে মানুষের মুক্তির যুদ্ধকে অব্যাহত রাখায় নিজ নিজ ভূমিকা পালনই আমাদের এই সময়ের দায়িত্ব।