‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’: দেশ ও সম্পদে সর্বজনের মালিকানা

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই জনপদের মানুষের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ, বৈষম্য, শোষণ ও নিপীড়নবিরোধী যে চেতনা ও প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল তা বারবার পদদলিত করতে করতে দেশে চোরাই কোটিপতি লুটেরা নিপীড়ক সাম্প্রদায়িক জাতিবিদ্বেষী দখলদারদের শাসন পাকাপোক্ত হয়েছে। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাত থেকে দানবীয় অপশক্তির ভয়ংকর থাবার মধ্যে, নির্যাতন ও প্রতিরোধের যে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে এইদেশের মানুষ গেছেন, তা যারা দেখেননি তাদের পক্ষে বোঝা কঠিন। সেই অভিজ্ঞতা এই জনপদের সেইসময়ের ও পরবর্তী সকল প্রজন্মের জন্য অনেককিছুই পাল্টে দিয়েছে। পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনী ও তার বাঙালী দোসরদের ভয়ংকর কারাগার থেকে মুক্ত হবার আনন্দ নিয়ে একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর নিয়ে এসেছিল নতুন করে শ্বাস নেবার দিন। বেদনার পাহাড় বুকে নিয়েও মানুষের তখন অনেক স্বপ্ন।

কিন্তু একে একে দুমড়ে মুচড়ে যায় তার অনেককিছু। সবকিছু দখলে চলে যায় ক্ষুদ্র এক গোষ্ঠীর হাতে, তৈরি হয় লুটেরা কোটিপতি, স্বৈরশাসন আসে নানা রূপে। যুদ্ধাপরাধীদের দল আসে, ব্যবসা হয়, ক্ষমতা হয়, গাড়ি হয়,- তাতে উড়ে বাংলাদেশের পতাকা। সাম্রাজ্যবাদ নতুন করে খুঁটি বসায়। সাম্প্রদায়িকতা, জাতিবিদ্বেষ, সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীপুরুষের ওপর শোষণ নির্যাতন চলতে থাকে। পাহাড়ে সমতলে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বারবার বিপন্নতায় আক্রান্ত হতে থাকেন। অসম্পূর্ণ বিজয়ের পর একেকটা পরাজয় জমতে থাকে।

মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছরে বিজয় দিবস পালনের সময়ে তাই আমাদের সামনে দখল, লুন্ঠন, বিনাবিচারে হত্যাকান্ড, গুম খুন; সাম্প্রদায়িক আক্রমণ; আগুনে পুড়ে ভবন চাপা পড়ে শত হাজার শ্রমিকের খবর; বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের মহা বিপর্যয়ের কালো ছবি; ছাত্রলীগের রামদা, বছর পার করা বিশ্বজিতের বিস্ময়, চিৎকার আর রক্তাক্ত দেহের ছায়া; সাগর রুনী ত্বকীর হত্যাকারীদের গ্রেফতারের ব্যর্থ আর্তনাদ; সীমান্ত হত্যা; ফুলবাড়ী, সুন্দরবন, সমুদ্রের ব্লক নিয়ে লুন্ঠনের নতুন নতুন চক্রান্ত।

গত ৪৩ বছরে দেশের অর্থনীতির আকার অনেক বেড়েছে। টাকার পরিমাণে ডিডিপি বেড়েছে প্রায় ৪০০ গুণ। খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ৩ গুণেরও বেশি। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন এখনও মানুষের হয়নি। এখন অর্থনীতি ধরে রেখেছেন দেশের গার্মেন্টস শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমিক আর কৃষকেরা। দেশি ও প্রবাসী শ্রমিকেরা জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেশে বছরে আনেন প্রায় ৩৬ বিলিয়ন ডলার। এই প্রবাহ না থাকলে লুটেরাদের দাপটে অনেক আগেই ধ্বস নামতো অর্থনীতিতে।

আতংকের সমাজ, দখলদারী অর্থনীতি, জমিদারী রাজনীতি এটাই বর্তমান বাংলাদেশের প্রধান পরিচয়। এর জন্য তো মানুষ অসম্ভব সাহস ও ঝুঁকি নিয়ে জীবন দিয়ে বাংলাদেশ আনেনি। অথচ এর মধ্যেই এখন আমরা ‘আছি’। দুর্নীতি দখলদারিত্ব, নানা অগণতান্ত্রিক আইনী বেআইনী তৎপরতা, সন্ত্রাস-টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য ইত্যাদি বিস্তারের সুবিধাভোগী খুবই নগণ্য কিন্তু তারাই ক্ষমতাবান। যাদের ২৪ ঘন্টা রাষ্ট্রীয় অর্থে প্রতিপালিত নানা বাহিনীর পাহারায় কাটে, তারা ছাড়া বাকি কারও তাই আতংক আর কাটে না। নিজের ও স্বজনের জীবন নিয়ে, পথের নিরাপত্তা নিয়ে, জিনিষপত্রের দাম, জীবিকা, ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকন্ঠা দিনরাত। সবচাইতে বড় ভয়, দিনের পর দিন সবকিছুতে অনিশ্চয়তা। বাংলাদেশের মানুষের অবস্থা এখন এমনই যে, মানুষের জন্য মানুষের শোক, আতংক কিংবা উদ্বেগ নিয়েও একটু স্থির হয়ে বসা যায় না। নতুন আরেক আঘাত পুরনো শোক বা আতংককে ছাড়িয়ে যায়। টিভি বা সংবাদপত্রেরও ঠাঁই নাই সবগুলোকে জায়গা দেবার, কিংবা লেগে থাকার।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান দুইদল বা জোটের সংঘাত কখনোই জমিদারী লড়াই এর চরিত্র থেকে বের হতে পারেনি। যে অংশ ক্ষমতায় থাকে তাদের ইচ্ছা হয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নেবার। তাই একপর্যায়ে বিরোধ চরমে ওঠে। বস্তুত দুই দলের ব্যানার দেখে এই গোষ্ঠীর পরিচয় স্পষ্ট হবে না। দেখতে হবে ব্যানারের পেছনে দাঁড়ানো লুটেরা, দখলদার ও কমিশনভোগীদের। দলের ব্যানার আসলে ব্যবহৃত হয় এদের মুখ ঢাকার জন্য। মানুষ দল দিয়ে বিচার করে, দলের উপর ভরসা করে, দলের উপর বিরক্ত হয়, ক্ষুব্ধ হয়, ক্ষোভে-দুঃখে চিৎকার করে। দল আসে যায়। কিন্তু কমিশনভোগী, দখলদার, লুটেরাদের কোন পরিবর্তন হয় না। তাদের শক্তি ও অবস্থান আরও জোরদার হয়।

দুই দলের তীব্র সংঘাত চোখে পড়ে, আড়ালে দখল লুন্ঠন কমিশন সহ নানা তৎপরতায় অংশীদারীত্ব ঠিকই চলে বহাল তবিয়তে। ব্যাংক, শেয়ারবাজার, মুদ্রা পাচার, মিডিয়াসহ নানাজায়গায় তার প্রমাণ আছে। একেই বলে শ্রেণী ক্ষমতা। সহিংসতা বা অস্থিরতায় শতকরা ১ ভাগের হাতে আরও সম্পদ কেন্দ্রীভূত হতে কোনো বাধা নেই। পাহাড় নদী খোলামাঠ বন দখল কাজে কোন সমস্যা নেই। দেশের সমুদ্র, সম্পদ, অর্থনীতিতে দেশি বিদেশি লুটেরাদের আধিপত্য বৃদ্ধির আয়োজনে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। ক্ষমতাবানরা যখন এভাবে নিজের অর্থনীতি তৈরি করেন তখন রাজনীতি কেন জমিদারী থেকে আলাদা হবে? আমাদেরই বা সদা আতংক ছাড়া আর কী পাবার আছে?

যে কেউ বর্তমান সরকারের বা কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের অন্যায় নিপীড়ন বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ালে বর্তমান সরকারি দল বা কর্তাব্যক্তিদের একটা মোক্ষম ঢাল হল এটা বলা যে, এটা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত। শিক্ষক, গার্মেন্টস শ্রমিক, জমি ও সম্পদ রক্ষার আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা আন্দোলন, খুনের বিচার দাবি, সন্ত্রাসের প্রতিবাদ সবাইকেই এই গালি শুনতে হয়। কিন্তু রামদা হাতে সরকারি পান্ডা, নিয়োগ বাণিজ্যে নিয়োজিত মন্ত্রী এমপি, গুম খুনে সক্রিয় নানা বাহিনী, সরকারী হামলা নির্যাতন দখল, আর অদক্ষ বিচার প্রক্রিয়া ইত্যাদি ঠিক করবার কোনো আগ্রহ দেখা যায় না।

যদি সামনে বিএনপি জামাত বিশেষত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয় না থাকতো তাহলে যারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছেন তাঁদের ক্ষোভেই এই সরকার টালমাটাল হতো। আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এটাই আত্মরক্ষার প্রধান অবলম্বন। ক্ষুুব্ধ সমর্থকদের ধরে রাখায় বিএনপির-জামাতের ভয় এবং যুদ্ধাপরাধীদের অস্তিত্ব তাদের প্রধান ভরসা। বিএনপি-জামাতও এরকম ভয়ের অস্ত্রই বরাবর কাজে লাগিয়েছে। আওয়ামী আমলের ভীতি প্রচার, কৃত্রিম ভারত বিরোধিতা, ইসলাম ধর্ম বিপন্নতার প্রচারণা তাদের অনেক অপকর্ম জায়েজ করবার প্রধান অবলম্বন। যারা এখন আওয়ামী লীগ বা বিএনপির পেছনে আছে তাদের অধিকাংশ প্রকৃতপক্ষে অপছন্দ নিয়েই আছে, আছে অন্যদলের ভয়ে। অতএব জমিদারী রাজনীতির দুই ধারা পরস্পর পরস্পরের ভরসা, পরস্পর পরস্পরের জন্য অপরিহার্য। ঐক্য ও ধারাবাহিকতারও তাই কোন কমতি নেই। দেশি বিদেশি দখলদারদের জন্য দুই দলের পালাবদল খুবই সুবিধাজনক।

গত তিন দশকে কৃষি শিল্প শিক্ষা চিকিৎসা গ্যাস খনিজ সম্পদ বিদ্যুৎ বন্দর রেলওয়ে পাট পানি ইত্যাদি উন্নয়নের নাম করে বহু নীতি ও কর্মসূচি নেয়া হয়েছে দেশি বিদেশি লুটেরাদের স্বার্থে। এসব ক্ষেত্রে সরকার ভেদে তেমন কোন পার্থক্য হয়নি। কারণ এসব নীতি প্রণয়নে যারা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে তারা ছিল অভিন্ন। যুক্তরাষ্ট, ভারত, চীন, রাশিয়া ছাড়াও এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংস্থা হল বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ইউএসএইড, এডিবি।

এই অবস্থায় তাহলে কী হবে বাংলাদেশের? দুই জমিদার বা দুই ডাইনাস্টির আড়ালে, চোরাই টাকার মালিক সন্ত্রাসী প্রতারক দখলদার কমিশনভোগীদের হাতে, নিজেদের সর্বনাশ দেখতেই থাকবে শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ? তাহলে কি আর কোন উপায় নেই? শক্তিশালী মিডিয়া ও সুশীল সমাজের দরবারে এই বলয়ের বাইরে আলোচনারও সুযোগ কম। ভিন্নস্বর ভিন্নসত্য ভিন্ন সম্ভাবনা নিয়ে মানুষের চিন্তার সুযোগও তাই তৈরি হয় না। ফলে জনগণের মধ্যে এক অসহায়ত্বের বোধ এখন প্রায় স্থায়ীরূপ নিয়েছে। কিন্তু এই দুই ধারার একটির বদলে অন্যটি আমাদের বর্তমান অবস্থার যে কোন সমাধানই দেবে না তা বোঝার জন্য আর কত পালাবদল দরকার? আর কত ক্ষয় আর কত সর্বনাশ দেখতে হবে আমাদের? এই জমিদারি সংঘাত ও ঐক্য কোথায় নিয়ে যাবে দেশকে, ক্ষমতা তাদেরও হাতে থাকবে কি না, দেশি বিদেশি কারা অপেক্ষমান সবকিছুই এক ভয়ংকর অনিশ্চয়তা। এই বিষচক্র থেকে বাঁচার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সামরিক শাসন যে সমাধান নয় তার প্রমাণ বারবার হয়েছে। বরং এতে এই প্রক্রিয়ারই আরও শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। আর দুইজনের সংলাপ ও ঐক্য? তাতে এই ধারাবাহিকতা ও জনগণের অবস্থার পরিবর্তনের তো কিছু নেই। এসব দেখে বারবার প্রশ্ন আসে, তাহলে কি ৭১এর মুক্তিযুদ্ধে অগণিত নারী পুরষের অসম্ভব সাহস ও লড়াইএর অভিজ্ঞতা বৃথা? না।

১৯৭১ এর সেই সাহস এখনও আমাদের শক্তি। এই শক্তি নিয়েই যুদ্ধাপরাধী ও লুটেরাশক্তির, দখলদার ও জমিদারদের রাজনৈতিক মতাদর্শিক প্রভাব অতিক্রম করে জনগণের রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটানো সম্ভব। আর গুরুত্বপূর্ণ এ্ই যে, নিষ্ক্রিয়, আচ্ছন্ন আর সন্ত্রস্ত জনগণের মধ্যে ক্ষমতার বোধ বিকশিত হওয়া ছাড়া এটা সম্ভব নয়।

এখন শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপীই এই প্রশ্ন জোরদার হচ্ছে যে, প্রান্তস্থ দেশগুলোর মানুষের জীবন ও সম্পদ কি তাদের নিজেদের কর্তৃত্বে থাকবে না উন্নয়নের মুখোশে আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর মাধ্যমে বিশ্ব পুঁজি বা তাদের সহযোগী দেশি বৃহৎ পুঁজির দখলে যাবে? এসব দেশের মানুষের সম্পদ কি তাদের জীবনকে বিকশিত করবার কাজে লাগবে না কতিপয় লুটেরার ভোগদখলে যাবে? উন্নয়ন নীতি কি মানুষকে কেন্দ্র করে নির্ধারিত হবে না দেশি বিদেশি কতিপয় গোষ্ঠী দ্বারা চালিত হবে? বারবার ৭১ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বাংলাদেশের মানুষ, তা সে যতই দুর্বল অপুষ্ট হোক, জাগ্রত হলে যে কোনো দেশি বিদেশি দানবের মোকাবিলা করতে তারা সক্ষম। সামরিক বেসামরিক স্বৈরশাসন, নির্যাতন, দখলদারিত্ব, সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিভিন্ন লড়াইএ জনগণের শক্তির স্ফুরণ তারই বহিপ্রকাশ। তাই শাসক শ্রেণীর বিভিন্ন অংশের প্রতারণামূলক বাগাড়ম্বরের মধ্যে নয়, শোষণ বৈষম্য নিপীড়ন আধিপত্য বিরোধী সকল লড়াইএর মধ্যেই কেবল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত। আত্মসমর্পণ আর পরাজয়ের বিপরীতে তার অবস্থান।

বর্তমান সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেমন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করবার দাবি করে, তেমনি তা দাবি করে জনগণের সম্পদের উপর জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, দেশকে সর্বজনের মালিকানায় নিয়ে আসা, দেশের ভবিষ্যত নির্ধারণে জনগণকে সক্ষম, সক্রিয় ও ক্ষমতাধর করে তোলা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে ক্ষমতায় এলেও এই সরকারের ভূমিকায়ও এসবের প্রতিফলন নেই। বরঞ্চ উল্টো জ্বালানী সম্পদ, বিদ্যুৎ, বন্দর, রেলওয়ে, বীজ, পানিসম্পদের উপর বহুজাতিক পুঁজির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার যে নীতি আগের দু‘দশকে স্পষ্ট রূপ নিয়েছে তারই ধারাবাহিকতা, কোন কোন ক্ষেত্রে অধিকতর সক্রিয়তা, আমরা এই সরকারের সময় দেখতে পাচ্ছি যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

বাংলাদেশের ভবিষ্যতে কোন বড় ধরনের লড়াই অগ্রসর হবে না ১৯৭১ কে হিসাবের মধ্যে না নিয়ে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যে স্পিরিট সাহস বা চেতনা তাকে স্পর্শ না করে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির লড়াই দাঁড় করানো যাবে না। আবার মুক্তিযুদ্ধের লড়াইএর মধ্যে গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক. বৈষম্যহীন, কিংবা জনকর্তৃত্বের যে চেতনাগুলি তৈরি হয়েছিল সেগুলো অস্বীকার করে, জনবিরোধী রাজনীতিকে বৈধতা দেবার জন্য ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বুলি হবে নিছক প্রতারণা, ১৯৭১ এর লড়াইকে সেই সালের মধ্যেই আটকে তাকে একটা অলংকার বানানো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।

১৯৭১ সাল মুক্তিযুদ্ধের শুরুও নয়, ১৯৭১ সাল বাংলাদেশের মানুষের মুক্তিযুদ্ধের শেষও নয়। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের কিংবা এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ দিনের মুক্তির যুদ্ধের একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল ১৯৭১, স্বাধীনতা যুদ্ধ। বর্তমান সময়ে মুক্তির যুদ্ধের চেতনা মানে শ্রেণী, জাতি, ধর্ম ও লিঙ্গীয় বৈষম্য ও নিপীড়ন বিরোধী রাজনীতি-সংস্কৃতির বিকাশ; লুটেরাদের হাত থেকে জাতীয় সম্পদ রক্ষা, হীনমন্যতা থেকে মুক্তি, জাতীয় সক্ষমতার বিকাশ এবং সর্বজনের সম্পদের উপর সর্বজনের মালিকানা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। এর জন্য সাম্রাজ্যবাদ, ধর্মবাদ ও দেশীয় লুটেরা ধনিকশ্রেণীর সৃষ্ট সকল মতাদর্শিক আধিপত্য ও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিধিব্যবস্থার বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ করাই অতএব বর্তমান সময়ের ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’।

দখলদারদের দাপটে বাংলাদেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখাই এখন অসম্ভব মনে হতে পারে। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতার জালের আচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত হলে, নিজেদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতে সক্ষম হলে, জনগণ তার অন্তর্গত বিশাল শক্তিও অনুভব করতে সক্ষম হবে। তখন সম্ভব হবে পথের সন্ধান পাওয়া, সম্ভব হবে তার রাজনীতির বিকাশে স্বাধীন পথ গ্রহণ। মানুষ যদি নিজে মুক্ত না হয়, তার মুক্তির কোন সম্ভাবনা তৈরি হয় না।

(১৬ ডিসেম্বর ২০১৪, ফেসবুকে প্রকাশিত )