মার্কিন নির্বাচন সম্পর্কে বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, ‘মার্কিন জনগণের ট্রাজেডী হল, তারা যাদের নির্বাচিত করে তারা দেশ চালায় না, আর দেশ যারা চালায় তাদের নির্বাচিত করবার কোন সুযোগ মার্কিন নাগরিকদের নেই।’ কারা তারা? এরা বৃহৎ সব বহুজাতিক সংস্থা আর এদের সহযোগী অস্ত্রব্যবসায়ী ও পেন্টাগনসহ মিলিটারী এস্টাবলিশমেন্ট, সবমিলিয়ে মিলিটারী ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স। গতমাসে ম্যাচাচুচেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হু ওউনস দ্য ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক বক্তৃতাতে এমআইটির প্রফেসর নোয়াম চমস্কিও একই কথা বললেন। এই কারণেই, চমস্কি বললেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে এদের অবস্থানে কার্যত কোন পার্থক্য দেখা যাচ্ছে না। এই দুইএর মধ্যে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত রাখতে মিডিয়াসহ সব আয়োজন শক্তিশালী।
মার্কিন দেশে এখন প্রায় ৩ কোট মানুষ কখনো না কখনো অনাহারে থাকেন। ৪.৭ কোটি মানুষ চিকিৎসা বীমার বাইরে, মানে চিকিৎসা সেবা নিতে অক্ষম। সমান কাজ হলেও নারীর জন্য মজুরি পুরুষের শতকরা ৭০ ভাগ। জিনিষপত্রের দাম বাড়তি। বেকারত্বের বোঝা কমেনি। নির্বাচনের আগে আগে সরকারি তথ্যেই দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ৪.৬ কোটি মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে। শিশুদের প্রতি ৫ জনের ১ জন দারিদ্র সীমার নীচে।
এই বিশাল অনাহারী মানুষদের জন্য কি এই সম্পদশালী দেশে সম্পদের অভাব? এটা ঠিক যে, অনাহারী মানুষদের খাদ্য সরবরাহের জন্য ফুড স্ট্যাম্প সহ নানা ব্যবস্থা আছে। এরজন্য বছরে বছরে খরচ বেড়েছে। ফুডস্ট্যাম্পসহ গরীবদের সমর্থনের নানা খাতে ব্যয় এখন প্রায় ৬০ বিলিয়ন ( ১ বিলিয়ন = ১০০ কোটি) মার্কিন ডলার, যা কমানোর চাপ আছে। কিন্তু এই দেশেরই কারাগারের পেছনে এখন দেশের বার্ষিক ব্যয় ৮০ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রই এখন বৃহত্তম কারাগার, অর্থাৎ বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রেই সবচাইতে বেশিসংখ্যক মানুষ কারাগারে বাস করে। গত ১ নভেম্বর আল জাজিরায় প্রদর্শিত এক তথ্যচিত্রে একজন মার্কিন গবেষক বলছিলেন, ‘বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রে যত কৃষ্ণাঙ্গ কারাগারে আছে সেই সংখ্যা দাসবাণিজ্যকালে যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চসংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের চাইতে বেশি।’ আর এই দেশেই ৭০০ বিলিয়ন ডলার প্রতিবছর খরচ হয় অন্যদেশ দখল, গোয়েন্দাবৃত্তি আর গণহত্যায়। এই ব্যয়ে লাভবান হয় শতকরা ১ ভাগেরও কম জনসংখ্যার খুবই ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী, তেল অস্ত্র নির্মাণ সহ বিভিন্ন কোম্পানি। নানারকম ভর্তুকি, কর সুবিধা, নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষতিকর বিনিয়োগ ও জালিয়াতি, দেশে দেশে অবাধ তৎপরতা এদের উচ্চ আয়ের উৎস।
সরকারি হিসাবই বলে, এই শতকরা ১ ভাগের আয় দেশের আয়ের শতকরা প্রায় ২৫ ভাগ, আর শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ সম্পদ তাদের দখলে। রাসেলের মতো উদারনীতিক দার্শনিক এদের ক্ষমতার প্রতিই ইঙ্গিত করেছিলেন। এদের খাই পূরণ করতে গিয়ে বিশ্ব এখন স্থায়ী সন্ত্রাসের ভ’মি আর যুক্তরাষ্ট্র নিজেই সবচাইতে বড় ঋণগ্রস্ত দেশ। এখন মার্কিন ঋণ প্রায় তার বার্ষিক জিডিপির সমান। ঋণের মাত্রা যা আগে নির্দিষ্ট করা ছিল কিছুদিন আগেই কংগ্রেস তা বৃদ্ধি করেছে। বৈষম্যের মাত্রাও এখন আগের যেকোন সময়ের তুলনায় বেশি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাত্র কদিন আগে নিউইয়র্ক, নিউজার্সির অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষ ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডির আঘাতে বিপদগ্রস্ত হলেন। স্থায়ী, নিয়মিত বেতন বা মজুরি পান তার তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। অস্থায়ী, খন্ডকালীনও অনেকে। স্বাস্থ্য বীমা হীন, খাদ্য, আশ্রয় ও চিকিৎসার সমস্যায় যারা আগেই ছিলেন তাদের নাজুক অবস্থা আরও বাড়লো। নিউ অরলিন্সএ বুশ আমলের ঘটা কাটরিনার ক্ষত অনেকের জন্য এখনও পুরোপুরি সারেনি। প্রায় লক্ষাধিক মানুষ তখন গৃহহীন হয়েছেন। এই দরিদ্র মানুষের জন্য কোন জাতীয় পরিকল্পনা তখন দেখা যায়নি। ঋণের বোঝা বেড়েছে তাদের। কিন্তু পুনর্গঠনের নামে ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনীর হেলিবার্টনসহ কয়েকটি কোম্পানি ঠিকই বিলিয়ন ডলার কন্ট্রাক্ট পেয়েছে।
বাংলাদেশে এই নির্বাচন কি কোন পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা দেখায়? বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসের ভ’মিকার ধরন দেখে তার কিছু আাঁচ করা যায়? গত ১০/১২ বছরও যদি দেখি তার ধরন বোঝা যাবে। ২০০১ সালের ১৫ মে ঢাকায় এক বক্তৃতায় তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মেরী এ্যান পিটার্স কয়েক মাস পরে অনুষ্ঠিতব্য বাংলাদেশের নির্বাচনে যারা ক্ষমতায় আসবেন তাদের প্রথম ১০০ দিনে করণীয় ঠিক করে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিল মার্কিন কোম্পানি ইউনোকালের প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতে গ্যাস রফতানি, চট্টগ্রাম বন্দরকে মার্কিন এক কোম্পানির হাতে দুশ বছরের জন্য ইজারা দেয়া। সেটা ছিল জুনিয়র বুশ আমল। সেই বুশ আমলের আটবছর এই একই ধারায় আরও তৎপরতা চলেছে। এরপর ২০০৮ সালে শুরু হল ওবামা আমল। উইকিলিকস সূত্র পরিষ্কার করেছে, এই আমলের রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়াটি জ্বালানী উপদেষ্টাকে বিশেষভাবে ধরেছেন কনকো ফিলিপসের সঙ্গে গ্যাস রফতানিমুখি চুক্তি সম্পাদন করতে। একইসঙ্গে তিনি বিশেষ জোর দিয়েছেন, এশিয়া এনার্জির উন্মুক্ত খনি অতিশীঘ্র অনুমতি দেবার জন্য। লন্ডনে তালিকাভুক্ত, জনপ্রতিরোধের মুখে বিতাড়িত, একটি অনভিজ্ঞ কোম্পানির মাধ্যমে মাটি পানি মানুষ বিনাশী একটি ধ্বংসযজ্ঞের প্রকল্প বাস্তবায়নে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কেন এতো আগ্রহ? উত্তর আসে উইকিলিকসে পাওয়া তাঁর বক্তব্য থেকেই। তিনি বলেছেন, এতে তাদের শতকরা ৬০ ভাগ স্বার্থ আছে। এটি ছিল ২০০৯ সালের জুলাই মাসের ঘটনা। তিনি গেলেন। এরপর বর্তমান রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা গত কিছুদিনে অনেক বক্তব্য রেখেছেন। কয়েকদফায় তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, অবশ্যই ফুলবাড়ী উন্মুক্ত খনির প্রকল্প তাড়াতাড়ি চালু করতে হবে। বঙ্গোপসাগরের গ্যাসব্লকসহ আরও সর্বনাশা চুক্তি করাসহ তিনি বাংলাদেশ থেকে গ্যাস, কয়লা এমনকি বিদ্যুৎও রফতানি নিয়েও তিনি চাপ দিচ্ছেন (ডেইলী সান, ১২ অক্টোবর, ২০১২)। নিরাপত্তার নামে নানা সামরিক চুক্তির বিষয়েও একই ধারাবাহিকতা দেখা যায়। ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতির’ সব নিয়মনীতি ভঙ্গ করে মার্কিন সকল সরকারই বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য আমদানির ওপর উচ্চ শুল্কহার বসিয়ে রেখেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘বিদেশি সাহায্য’ নাামে যে পরিমাণ অর্থ আসে তার ৪ গুণ তারা আয় করে বাংলাদেশের গার্মেন্টস এর ওপর আরোপিত উচ্চ হারের শুল্ক থেকে। এসব দৃষ্টান্ত দেখিয়েই বললাম, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে কোন পার্থক্য আমরা টের পাই না। এসব দূতাবাস যার করের পয়সায় চলে সেই মার্কিন জনগণের প্রতিনিধিত্ব তারা করে না। তারা আসলে বৃহৎ করপোরেট স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকে!
মার্কিন জনগণ ওবামার ওপর অনেক ভরসা করেছিলেন। পরিবর্তনের কথা বলেই তিনি প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসেছিলেন। নির্বাচনের আগে আগে তাঁর লেখা ‘অডাসিটি অব হোপ’ গ্রন্থটি তরুণদের মধ্যেও আশার সঞ্চার করেছিল। মানুষ তখন বুশ চেনী রামসফেল্ড রাইস চক্রের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য মরিয়া। ক্ষমতায় এসেছিলেন ওবামা। তিনি পরিবর্তন করতে পারেননি, নিজেই পরিবর্তিত হয়েছেন মেশিনের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য। যতটুকু ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তাতেই রিপাবলিকানদের প্রচারণায় তিনি বামপন্থী! এবারে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সাথে কথা বলে দেখেছি ওবামার এককালীন সমর্থকেরা সাধারণভাবে হতাশ, কিন্তু রমনির ভয়েই শেষপর্যন্ত তাদেরকে ওবামাকেই ভোট দিতে হবে। কেননা দেশের ভেতরে ওবামা কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না আনতে পারলেও রমনি যে রিপাবলিকানদের প্রতিনিধিত্ব করেন তাদের নীতি ও কর্মসূচি বৃহৎ ধনিক শ্রেণীর পক্ষে; শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, অশ্বেতাঙ্গ, ইমিগ্রান্ট ও নারীর জন্য আরও প্রতিকূল। সেটাই ব্যর্থতা বা প্রতিশ্রুতিভঙ্গ সত্ত্বেও ওবামার প্রধান ভরসা।
শিল্পায়িত বিশ্বের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রেই শ্রমজীবী মানুষ সবচাইতে অসংগঠিত। ইমিগ্রান্টদের দেশ হবার কারণে বিভক্তি বজায় রাখা খুব সহজ। শতকরা মাত্র ৭ জন সেখানে ইউনিয়ন ভুক্ত। বাকি সকলেই অসংগঠিত। নানা ধরনের শ্রমিকেরা সংখ্যায় গরিষ্ঠ হলেও তাদের অস্তিত্ব ঢেকে ফেলার চেষ্টাই বরাবর সফল হয়েছে। মে দিবস তৈরি হয়েছিল এই যুক্তরাষ্ট্রেরই শিকাগো শহরে, অথচ মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্র শাসিত দেশগুলির বাইরে যুক্তরাষ্ট্রই হচ্ছে উল্লেখযোগ্য দেশ যেখানে মে দিবস সরকারিভাবে স্বীকৃত নয়। শ্রমিকদের লড়াইএর ধারাবাহিকতা ভুলিয়ে দেবার জন্যই এই আয়োজন। মিলান কুন্ডেরার ভাষায়, মানুষের লড়াই আসলে ভুলিয়ে দেবার জাল থেকে নিজেকে উদ্ধার করা। সেজন্যই যুক্তরাষ্ট্রে ‘আমরা ৯৯%’ নামে নতুন পরিচয়ের উদ্ভব হয়েছে। রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তা এখনও স্পষ্ট রূপ নেয়নি। তারফলে নির্বাচনের নামে ১% ধনপতিদের মুখপাত্র বাছাইএর এই বছরের পর্বেও মানুষের সামনে অপশন বা বাছাই করবার সুযোগ সীমিত – ‘বিগ অর বিগার ডেভিল’!