মানুষ তার জীবন যাপন করে অনেকের মধ্যে, অনেকের সঙ্গে। জীবন যাপন জীবিকা অর্জন, তার ভালো লাগা মন্দ লাগা, তার ঠিক-বেঠিক বোধ, নিজেকে নিয়ে অন্যকে নিয়ে তার ভাবনা, আনন্দ বেদনার অভিব্যক্তি, সৌন্দর্যবোধ, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চিন্তা, খাদ্য সবই তার জীবনের পরিচয়, তার সংস্কৃতি।
মানুষের তো অনেক রকম পরিচয় থাকে। ভাষা বা জাতিগত নৃতাত্ত্বিক পরিচয় দিয়ে তার একটি সম্প্রদায়গত অবস্থান তৈরি হয়। আবার যে ধর্মীয় পরিবারে তার জন্ম তা দিয়ে সম্প্রদায়গত আরেকটি পরিচয় তৈরি হয় তার। লিঙ্গীয় গঠন তার জৈবিক পরিচয় নির্ধারণ করে। দেশ তো বটেই অঞ্চল এমনকি গ্রামও অনেকসময় সম্প্রদায়গত পরিচয়ের একটি অবলম্বন হয়। এছাড়া গোত্র, বংশও অনেক ক্ষেত্রে সম্প্রদায়গত পরিচয়ের ক্ষেত্রে কারও কারও কাছে কখনও কখনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। আর সামাজিক শ্রেণীগত অবস্থান থেকে তার যে পরিচয় তৈরি হয় তা ভাষা জাতি ধর্ম বর্ণ লিঙ্গকে ছাপিয়ে ওঠার শক্তি ধারণ করে।
২.
ধর্মীয় পরিচয় বলতে গিয়ে আমরা অনেক সময় গড়ে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান বলি বটে কিন্তু এই পরিচয় প্রায়শই একজনের ধর্মীয় পরিচয়ের শেষ কথা হয় না। মুসলমান সমাজে সুন্নী-শিয়া, সুন্নীর মধ্যে আবার মাজহাবী-লামাজহাবী, এর বাইরে আহমদিয়া-মোহাম্মদীয়া, এছাড়াও শরিয়তী-মারফতী, পীর মাজার ধরে বহুবিধ বিভাজন হতে পারে। এসব পরিচয় সাধারণভাবে কোনো জটিলতা তৈরী না করলেও কখনও কখনও এগুলোও সাম্প্রদায়িক সংঘাত দাঙ্গা তৈরি করতে পারে তার বহু দৃষ্টান্ত আমাদের সামনেই আছে। এখনও এই সম্ভাবনা সবসময়ই জারী আছে। পাকিস্তানে খুব বড় আকারে আহমদিয়া আক্রমণ হয়েছিল ৫০ দশকে। এখনও তার অবসান ঘটেনি। শিয়াদের ওপর আক্রমণ প্রায়ই হয়ে থাকে। সবগুলোতেই শুধু সম্পদ ধ্বংস নয় মানুষের খুনে ভেসে যায় মসজিদ। গত কিছুদিনেই অনেকে এসব আক্রমণে হতাহত হয়েছেন। সেকারণে পাকিস্তানে আহমদিয়া ও শিয়া সম্প্রদায়ের নিরাপত্তাহীনতা, আক্রান্ত ও খুন হবার আশংকা অমুসলিমদের থেকে কোনো অংশে কম নয় বরং দৃশ্যমান ঘটনাবলীর বিচারে বেশি।
হিন্দু সমাজে একটি বড় বিভাজন হল বর্ণপ্রথা। বর্ণ বলতে রং বোঝায় আবার বর্ণ বলতে বোঝায় বর্গ। এর একটি ইংরেজিতে কালার বা রেস এবং অন্যটি কাস্ট। মানুষের শরীরের চামড়ার রং এর ওপর ভিত্তি করে যে বৈষম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গী ও ব্যবস্থা সেটাই বর্ণবাদ (রেসিজম) নামে সমধিক পরিচিত। এর সূত্রপাত ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দখল ও আধিপত্যের মধ্য দিয়ে। ‘ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গরা জন্মগতভাবেই উৎকৃষ্ট’ এই মতাদর্শ তৈরি করা হয়েছে ইউরোপের বাইরে ঔপনিবেশিক দখল, অশ্বেতাঙ্গদের শৃঙ্খলিতকরণ এবং শোষণশাসন নিশ্চিত করবার জন্য। পঞ্চদশ শতকের শেষ থেকে ক্রমান্বয়ে আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়া ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে আসে। আমেরিকায় এই দখল নিশ্চিত করবার জন্য সেখানকার উচ্চ সভ্যতার নির্মাতা আদিবাসীদের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ মানুষকে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে আফ্রিকার কালো মানুষদের দাসে রূপান্তর করা হয় এবং তাদের নিয়ে যাওয়া হয় আমেরিকায়। ইউরোপীয় বণিকদের জন্য দাসবাণিজ্য খুবই লাভজনক হয়ে ওঠে। বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গীও সেসময় থেকে তার ডালপালা ছড়িয়েছে।
কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের ‘নিকৃষ্ট মানুষ’ কিংবা সবাক জীব হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গীও সেসময় থেকেই ইউরোপীয় মননে দৃঢ়ভিত্তি লাভ করে। কালো মানুষদের ওপর সবরকমের নৃশংসতা এই দৃষ্টিভঙ্গী দ্বারাই সমর্থিত হয়। কয়েকশো বছরে এটি বহু বহু বর্বরতার জন্ম দেয়। এই দৃষ্টিভঙ্গীর শেকড় এতটাই গভীরে প্রোথিত যে, এখনও এর অবসান হয়নি। উনিশ শতকে দাসপ্রথা রদ হলেও কয়েকদশক আগে পর্যন্তও যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের প্রতি বিদ্বেষ ও বৈষম্যমূলক বিধিব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই কার্যকর ছিল। বহু জায়গায় লেখা থাকতো ‘কুকুর ও কৃষ্ণাঙ্গ প্রবেশ নিষেধ’। বর্ণবাদী নির্যাতনের ইতিহাস ভয়াবহ। এর অর্থ এটা নয় সকল শ্বেতাঙ্গ এর সহযোগী কিংবা এই ব্যবস্থার সুবিধাভোগী। বৈষম্য ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের আন্দোলন সবরকম বৈষম্য-নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক বড় অনুপ্রেরণা। সেই আন্দোলন নতুন ঐক্য ও পরিচয় তৈরি করেছিল যার সাথে মুক্ত শ্বেতাঙ্গরাও ছিলেন।
শরীরের রংভিত্তিক এই বর্ণবাদের বহু আগে থেকে ভারতবর্ষে জারি ছিল ঐশ্বরিক বিধানের নামে পেশাভিত্তিক বর্ণবাদ বা কাস্ট সিস্টেম। এই বর্ণপ্রথা অনুযায়ী মানুষকে কয়েকটি বর্গে বা বর্ণে ভাগ করা হয়। এদের মধ্যে সবার ওপরে ব্রাহ্মণ, সবার শেষে শুদ্র। মানুষের শরীরের সঙ্গে এই তুলনা করে বলা হয়, ব্রাহ্মণ হল মাথা আর শুদ্র হল পা। শুদ্র যারা তারা কায়িক শ্রম করবে, পদতলে থাকবে উচ্চবর্ণের মানুষদের, তাদের সবরকম সেবাযত্ন করবে। এটাই ঐশ্বরিক বিধান। আর এই বিধান বলেই আর একটি বড় জনগোষ্ঠীকে সকল বর্ণের বাইরে রাখা হয়, তার মানে তারা আরও নিকৃষ্ট। তারা অচ্ছুৎ, অস্পৃশ্য এবং অভিশপ্ত। এম. কে. গান্ধী এদের নাম দিয়েছিলেন ‘হরিজন’। কিন্তু নাম পাল্টালেও অবস্থানের কোন পরিবর্তন হয়নি তাদের। শুদ্র এবং হরিজন মিলেই এই অঞ্চলের হিন্দু সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। দাসের জীবনের মতোই যারা হাজার হাজার বছর ধরে ভয়াবহ বৈষম্য, নিপীড়ন এবং অপমানের মধ্য দিয়ে জীবন পার করেছেন। দাসপ্রথার অবসান হয়েছে কিন্তু ধর্মীয় বিধানের নামে প্রতিষ্ঠিত এই বর্ণপ্রথা দুর্বল হলেও বিলুপ্ত হয়নি, এখনও একটি ভয়ংকর ব্যবস্থা হিসেবে টিকে আছে। সেকারণে ভারতে এই বিশাল জনগোষ্ঠী অহিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তুলনায় কম আক্রান্ত বা নিপীড়িত নন। বরং তাদের ওপর যে বৈষম্য ও নিপীড়নের ব্যবস্থা তা এমনভাবে ধর্মীয় আবরণে বৈধতা ও সম্মতি লাভ করেছে যে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিদ্রোহও কঠিন।
বর্ণপ্রথার প্রভাব অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও দেখা যায়। মুসলমানদের মধ্যে শাস্ত্রীয় বিধান অনুযায়ী কোন বর্ণপ্রথা থাকার কথা নয়। কিন্তু দেখা যায় পেশা, সামাজিক অবস্থান, সম্পত্তি মালিকানার পার্থক্যে যারা নিম্নবর্গের মুসলমান তারাও মুসলমান সমাজে প্রায় নিম্নবর্ণ হিসেবে পরিগণিত হন। মুসলিম সমাজে আশরাফ (অভিজাত) ও আতরাফ (অনভিজাত সাধারণ) বিভাজন এভাবেই তৈরি হয়েছিল। শ্রেণীবৈষম্য এখানে অন্যরূপে বৈধতা লাভের চেষ্টা করে।
খ্রীস্টান ধর্মের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বিভাজন আছে। ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্ট পরিচয়েই এই বিভাজন শেষ হয় না। এর মধ্যে ও এর বাইরেও আছে তার অনেক শাখা প্রশাখা। এই বিভাজন শুধু বিশ্বাসের বা কিছু আচারের তফাৎ নয়, এই বিরোধ এতদূর তীব্র ও স্থায়ী রূপ লাভ করে যে তা পরস্পরের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ করে। ইউরোপের বহু স্থানে এই পরিচয়ের তফাৎ ভিত্তি করে চাপা বিরোধ ছাড়াও যুদ্ধ সংঘাতের ঘটনাও ইতিহাসে অনেক পাওয়া যাবে।।
৩.
এই সত্যটুকু অনেকে ভুলে যান যে, বাঙালি মুসলমানদের সংখ্যা বাংলাদেশে গরিষ্ঠ হলেও বাংলাদেশ কেবল বাঙালির বাসভূমি নয়, বাংলাদেশ কেবল মুসলমানেরও দেশ নয়। এখানে কোনো কোনো অ-বাঙালি এবং অ-মুসলমান জনগোষ্ঠীর বয়স বরং অনেক দীর্ঘতর। এই অঞ্চল শাসন করেছে উচ্চবর্ণ হিন্দু (যাদের আদিভূমি এই অঞ্চল নয়), বৌদ্ধ (যারা এই অঞ্চলেরই মানুষ), মুসলমান (তুর্ক, মোগল, পারসীয়; বাইরে থেকে এসেছেন রাজ্য শাসন করতে, এবং অনেকে ধর্মপ্রচার করতে এসে স্থায়ীভাবে বসতি গেড়েছেন) এবং খ্রীষ্টান (ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি এবং মিশনারী)। ভারত বিভাগের সময় সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে ক্ষতবিক্ষত হয়ে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে জনস্থানান্তর ঘটেছে, যে সাম্প্রদায়িকতার রেশ এখনও কাটেনি। ভারতের বিহার সহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলমানরা তৎকালীন পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে আশ্রয় নিয়েছেন। বর্তমান বাংলাদেশেও তাঁদের একটি অংশ বসতি গেড়েছেন। তাঁরা প্রধানত উর্দুভাষী।
বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের জীবনপ্রথা, বিশ্বাস প্রথা, খাদ্যরীতি, পোষাকরীতি, এই অঞ্চলের আদি প্রথা এবং রীতিনীতির সঙ্গে মিশে গেছে। যেসব ভাষা ক্ষমতার ভাষা ছিল সেগুলো হলো -সংস্কৃত, ফারসী, উর্দু এবং ইংরেজি। লিখিত ও মান বাংলা হিসেবে যে ভাষা আমরা এখন দেখছি তার মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েছে বহুভাষার শব্দ ও ধারণা। আরব, পারস্য, মধ্য এশিয়া, উত্তর ভারতসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এখানে বসতি গেড়েছেন। দেহের গড়ন, চেহারা, দৈর্ঘ্য, চুল ইত্যাদিতেও তাই বহু জনগোষ্ঠীর স্বাক্ষর। এই অঞ্চলে বাংলাভাষাভাষী ছাড়াও অন্যান্য ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর বাসও দীর্ঘদিনের। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, সাঁওতাল, গারো প্রভৃতি। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে আছে মহাবিশ্বের বৈচিত্র। এই বৈচিত্র তার দুর্বলতা নয়, শক্তি।
বাংলাদেশে ‘বাঙালী সংস্কৃতি’ বলতে যাকে নির্দেশ করা হয়, তা প্রকৃতপক্ষে সমতলের গ্রামীণ কৃষক সংস্কৃতি। ‘মাছে ভাতে বাঙালী’ এই অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্যপ্রাপ্তির ধরণই নির্দেশ করে। কৃষিকাজ, নদী, বন্যা, পশুপাখি, বৃক্ষ, ভূত-প্রেত-জ্বীন-পরী, দেও-দানব-সাধু-সন্তু-পীর-মুর্শিদ ইত্যাদির ওপর যে লোক-জীবন দাঁড়িয়ে আছে সেখানকার লোককথা, লোকবিশ্বাস, লোকচর্চা, গান পালা বাদ্যযন্ত্র তার জীবন সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর মধ্যে ধর্মবিশ্বাস নানাভাবে উপস্থিত। কিন্তু তাকে একটি নির্দিষ্ট শাস্ত্রীয় কাঠামোয় বাধা যায় না। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে বিশ্বাসচর্চা বিশ্লেষণ করলে নানা ধর্মমতের সহজ সহাবস্থান দেখা যায়। বাংলাদেশের সমাজের এ এক অসাধারণ শক্তি, সন্দেহ নাই। কিন্তু ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের অনেক ঘটনায় এই শক্তি বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে।
৪.
বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রদায়িকতা নিয়ে কথা বলতে গেলে সময় ও স্থান অনেক বিস্তৃত হয়ে যায়। আমাদের ইতিহাস টানতে হয়। বাংলাদেশ ছাড়িয়ে পূর্ববর্তী রাষ্ট্র পাকিস্তান এমনকি তার পূর্ববর্তী রাষ্ট্র/সাম্রাজ্য ভারতকে টানতে হয়। যতদিন যাচ্ছে ততই সীমানা আরও বিস্তৃত হচ্ছে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের মতো দেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ধরণ, শেকড়, শক্তি যথাযথভাবে খুঁজতে গেলে বিশ্বব্যবস্থা, পুঁজিবাদী কেন্দ্র রাষ্ট্র এবং সাম্রাজ্যবাদী কৌশলে, যুদ্ধসহ আগ্রাসনী তৎপরতার দিকেও নজর দিতে হয়।
সেন আমলে বৌদ্ধদের ওপর ব্রাহ্মণ্যবাদী নৃশংস আক্রমণের কাহিনী প্রাক-ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের সবচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের ঘটনা। এর ফলাফল ছিল ভারতের বহু অঞ্চলে বৌদ্ধদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া এবং ভারতের বহু প্রান্তে কিংবা ভারত সীমানা পার হয়ে গিয়ে বসতি স্থাপন। অনেক বৌদ্ধ পরে হিন্দু ধর্মে ফিরে আসেন কিন্তু তাদের অনেক প্রায়শ্চিত্ত করে নিম্ন বর্ণে স্থান নিতে হয়। একসময় পাল ছিলেন বৌদ্ধ শাসক, পরে পাল হয়ে যায় গালি, হিন্দুসমাজের নিম্নবর্ণের মানুষ। পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর লেখায় এই ইতিহাস উদ্ধারের চেষ্টা আছে।
এই অঞ্চলে মুসলিম আগমনের দুটো প্রধান ধরণ আছে। একটি যোদ্ধা ও আক্রমণকারী হিসেবে অন্যটি ধর্ম প্রচারক হিসেবে। প্রথম ধারা এই অঞ্চলে হিন্দু মন্দির ধ্বংস দখল ও তার ওপর মসজিদ নির্মাণ করেছে। মোগল আমলে অবশ্য সাম্প্রদায়িক সমাঝোতার চেষ্টা দীর্ঘসময় বলবত ছিল। তার সাফল্যের দিকটিও উল্লেখযোগ্য। তবে সম্রাট আওরঙ্গজেরের আমলে শাসনের সাম্প্রদায়িক প্রবণতা স্পষ্ট আকার নেয়।
কয়েকশো বছর মুসলিম শাসন ও ইসলাম ধর্ম প্রচার সত্ত্বেও তা সমাজে বর্ণহিন্দুদের আধিপত্য খর্ব করেনি। মুসলমানদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটলেও সামাজিক ক্ষমতা, আচার অনুশাসন, প্রথা ইত্যাদিতে বর্ণ হিন্দুদের কর্তৃত্বই বহাল থাকে। এমনকি মুসলিম শাসকদের দরবারেও হিন্দুদের অবস্থান ছিল শক্তিশালী। দিল্লিতে ও বাংলার মুসলিম শাসকেরা ক্ষমতাবান হিন্দুদের সঙ্গে একধরনের সমাঝেতার মাধ্যমেই স্থিতিশীলতা তৈরি করেছিলেন।
মুসলিম শাসনের সঙ্গে মানিয়ে চললেও অভিজাত প্রভাবশালী হিন্দু মহলে মুসলমানদের প্রধানত বিদেশী আগ্রাসী হিসেবেই বিবেচনা করা হয়েছে। চিন্তার এই ধারাটি উচ্চকিত না থাকলেও এই কালেও তা প্রভাবশালী। মুসলমান শাসনকে ‘ঔপনিবেশিক শাসন’ হিসেবে অভিহিত করবার তাত্ত্বিক বয়ানও তাই দুর্লভ নয়। উনিশ শতকে অনেকের মধ্যে এই বিষয়ে তাত্ত্বিক নেতৃত্ব দান করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। বর্তমানে হিন্দুত্ববাদী দর্শনের মুখ্য সুর তাই।
১৭৮৭ থেকে ১৮৫৭ সময়কালে ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন বিস্তৃত করার মধ্য দিয়ে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। এর মধ্য দিয়ে হিন্দু অধিপতি গোষ্ঠী নিজেদের ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস করতে সক্ষম হয়। ইংরেজ শাসকদের ক্ষমতার অংশীদারে পরিণত হয়। অন্যদিকে, মুসলমানদের মধ্যে সাধারণভাবে ক্ষমতা হারা অভিমানী মনস্তত্ত্ব তাদেরকে ক্ষমতা থেকে আরও দূরে ঠেলে দেয়।
উনিশ শতকের শেষ থেকে মুসলমানদের শিক্ষা ও কর্মজীবনে প্রবেশের চেষ্টা শুরু হয়। এবং ক্রমে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমানরা হিন্দুদের প্রতিদ্বন্দী হয়ে ওঠে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাই নতুন পর্বের সম্প্রদায়িক বিভেদের সূচনা ঘটায়। কারণ ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ ও সেই অনুযায়ী কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র আগে ছিল এককভাবে হিন্দুদের হাতে, সেখানে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাব হয়। মুসলিম মধ্যবিত্তের উদ্ভব ঘটে, নিজেদের অবস্থান ও পরিচয় সনাক্ত করা ও সেই জায়গা তৈরিতে তার মনোযোগী হতে হয়। মুখোমুখি দাঁড়ায় হিন্দু ও মুসলমান মধ্যবিত্ত। ভারত বিভাগ বা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা যার অন্যতম পরিণতি। তবে বলাই বাহুল্য তা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটায়নি বরং দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে তার বিস্তার ঘটিয়েছে।
যাইহোক, সুমিত সরকার তাঁর মডার্ন ইন্ডিয়া গ্রন্থে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ আলোচনা করতে গিয়ে বিশ শতকের বিশ দশকে কয়েকটি দাঙ্গার উল্লেখ করেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, ১৯২৩ থেকে ১৯২৭ সালে উত্তর প্রদেশে ৯১টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গরু কোরবাণী কিংবা মসজিদের সামনে বাজনা বাজানো নিয়ে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। ১৯২৪ সালের সেপ্টেম্বরে কোহাটে দাঙ্গা হয়, মৃত্যুবরণ করেন ১৫৫ জন। ১৯২৬ সালের এপ্রিল-জুলাই মাসে মারা যান ১৩৮ জন। ১৯২৬ সালে ঢাকা, পাটনা, রাওয়ালপিন্ডি এবং দিল্লীতে দাঙ্গার ঘটনা ঘটে।।
৫.
বাংলাদেশ এবং বর্তমান ভারত বিভিন্ন দিক থেকে দীর্ঘকাল এক অভিন্ন ইতিহাসের অংশ ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত বাংলা ছিল অভিন্ন। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ করেছিল, প্রশাসনিকভাবে পূর্ববঙ্গকে আলাদা একটি ইউনিট ঘোষণা করা হয়েছিল। এর সঙ্গে ছিল যুক্ত করা হয়েছিল আসাম। রাজধানী করা হয়েছিল ঢাকা। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা মিলে যে ইউনিট করা হয়েছিল তার রাজধানী করা হয়েছিল কলকাতা। সেসময় এর পক্ষে বিপক্ষে বিতর্ক হয়েছিল অনেক। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পুরো বঙ্গ জুড়ে কমবেশি ঘটলেও কলকাতাতেই ছিল তা সবচাইতে জোরদার। এর কারণ বঙ্গভঙ্গের কারণে কলকাতাকেন্দ্রিক ব্যবসা, বাণিজ্য, ওকালতি প্রকাশনা এবং বিদ্যাচর্চা সবই হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে ঢাকা বঙ্গভঙ্গের ফলে নতুন করে দীর্ঘদিন পর চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটে, আইন আদালত প্রশাসনিক তৎপরতা বাড়ে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটে।
শহর হিসেবে কলকাতার তুলনায় ঢাকা অনেক পুরনো হলেও প্রথমে কোম্পানি শাসন ও পরে ব্রিটিশ শাসনকালে ক্রমে কলকাতা শুধু বাংলার নয় পুরো ভারতেরই কেন্দ্র হয়ে ওঠে। পরিকল্পিতভাবে মসলিন ধ্বংস প্রথমে ঢাকাকে ম্লান করে দেয়, প্রশাসনিক গুরুত্বহানি তাকে একেবারেই নি¯প্রভ করে তোলে। বঙ্গভঙ্গ সেই ঢাকাকে আবার একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত হবার সুযোগ এনে দেয়। সেকারণে ঢাকা থেকে এই বঙ্গভঙ্গ সমর্থনও পায়। এই সমর্থন আসে ঢাকাকেন্দ্রিক নবাব, ব্যবসায়ী এবং পেশাজীবীদের মধ্য থেকে। কলকাতা থেকে এর বিরোধিতা করেন ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ছাড়াও বিদ্বৎসমাজ। রবীন্দ্রনাথ এক্ষেত্রে খুবই সক্রিয় ভুমিকা নিয়েছিলেন। তাঁর দেশাত্মবোধক গানগুলি প্রধানত এসময়েই লিখিত।
পূর্ববঙ্গ মুসলিম প্রধান হওয়ায় বঙ্গভঙ্গ সমর্থনকারিরা প্রধানত ছিলেন মুসলমান আর কলকাতা হিন্দু প্রধান হওয়ায় বিরোধীরা ছিলেন হিন্দু ও ব্রাম্মসমাজের সদস্য। এই বিরোধিতার সময়ই হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যেকার বিরোধ অনেক সামনে আসে। হিন্দু নেতাদের অনেকেই বলেন যে, ইংরেজ শাসকেরা মুসলমানদের ব্যবহার করছে। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ১৯০৭ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘….আমাদের মধ্যে যেখানে পাপ আছে শত্রু সেখানে জোর করিবেই– আজ যদি না করে তো কাল করিবে, এক শত্রু যদি না করে তবে অন্য শত্র“ করিবে – অতএব শত্র“কে দোষ না দিয়া পাপকেই ধিক্কার দিতে হইবে।…হিন্দু মুসলমান সম্মন্ধ লইয়া আমাদের দেশে একটা পাপ আছে; এ পাপ অনেক দিন হইতেই চলিয়া আসিতেছে। ইহার যে ফল তাহা না ভোগ করিয়া আমাদের কোনমতেই নিষ্কৃতি নাই।…এবার আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে হিন্দু-মুসলমানের মাঝখানে একটা বিরোধ আছে।..আমরা বহুশত বৎসর পাশে পাশে থাকিয়া এক খেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলোক ভোগ করিয়া আসিয়াছি; আমরা এক ভাষায় কথা কই, আমরা এক সুখে দুখে মানুষ; তবু প্রতিবেশীর সাথে প্রতিবেশীর যে সম্মন্ধ মনুষ্যচিত, যাহা ধর্মবিহিত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই।…আমরা জানি, বাংলাদেশের অনেক স্থানে এক ফরাশে হিন্দু মুসলমানে বসে না – ঘরে মুসলমান আসিলে জাজিমের একাংশ তুলিয়া দেওয়া হয়, হুঁকার জল ফেলিয়া দেওয়া হয়।….মানুষকে ঘৃণা করা যে দেশে ধর্মের নিয়ম, প্রতিবেশীর হাতে জল খাইলে যাহাদের পরকাল নষ্ট হয়, পরকে অপমান করিয়া যাহাদিগকে জাতি রক্ষা করিতে হইবে পরের হাতে চিরদিন অপমানিত না হইয়া তাহাদের গতি নাই, তাহারা যাহাদিগকে ম্লেচ্ছ বলিয়া অপমান করিতেছে সেই ম্লেচ্ছের অবজ্ঞা তাহাদিগকে সহ্য করিতে হইবে।’ (রবীন্দ্র রচনাবলী, ৫ম খন্ড, বিশ্বভারতী)
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রবল চাপে বঙ্গভঙ্গ রদ হয় ১৯১১ সালে। কিন্তু একবার ভঙ্গ একবার রদ এই ঘটনাবলীর মধ্যে বাংলার মানুষের মধ্যেকার চাপা থাকা বিরোধ প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। এই বিরোধ একদিকে হিন্দু ও মুসলমান এবং অন্যদিকে পূর্ব বাঙলা ও পশ্চিম বাঙলার মানুষ অর্থাৎ বাঙাল ও বাঙালীর মধ্যে। হিন্দু মুসলমানের বিরোধ নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা অনেকেই করেছেন কেননা সেটা অনেক স্পষ্ট। কিন্তু বাঙাল ও বাঙালীর মধ্যেকার বিরোধ, পরিচয়ের টানাপেড়েন নিয়ে তুলনায় আলোচনা হয়েছে কম। অনেকসময় এই বিরোধও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার আকারে হাজির হয়েছে।
৫.
১৯৪৭ সালে এই এলাকায় ভারতীয় উপনিবেশ থেকে ভারত এবং পাকিস্তান নামে দুই রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। এর মধ্য দিয়ে পাঞ্জাব ও কাশ্মীরের পাশাপাশি বাংলাও বিভক্ত হয়। বর্তমান বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসের নতুন পর্বে প্রবেশ করেন। তাদের স্বপ্ন, সমস্যা, ভাষা, লড়াই সবই এরপর আলাদাভাবে গড়ে উঠে। মুসলমানদের জন্য ভিন্ন রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে যে মুসলমানদের সমস্যার সমাধান হয় তা নয়, বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের জীবন নতুন মুসলমান শাসকদের দাপটে প্রায় অপরিবর্তিতই থাকে। তাছাড়া যত মুসলমান পাকিস্তানে ছিলেন তার থেকে বেশি সংখ্যক মুসলমান ভারতেই থেকে যান। তাছাড়া পাকিস্তানের দুই প্রান্তেই অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী নিজ বাসভূমি ত্যাগ না করে থেকে যান এখানেই। সাম্প্রদায়িকতার কারণে দেশভাগ হলেও দুই দেশেই হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক সংঘাতও অব্যাহত থাকে। ১৯৪৭ সালে যারা নিজেদের মুসলমান পরিচয়কে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন তাদের অনেকে জাতিগত নিপীড়নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ১৯৭১ সালে বাঙালী পরিচয়কেই মুখ্য ধরেছিলেন। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে এদেশের মানুষ মুক্ত হল অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার অঙ্গীকার করে। সেই অঙ্গীকার থেকে বাংলাদেশ এখন অনেক দূরে।
বাংলাদেশে গত ৪১ বছরে বহুরকম সরকার ক্ষমতায় থেকেছে, সামরিক বেসামরিক, রাষ্ট্রপতি কেন্দ্রিক বা সংসদীয়। তবে এসব শাসনের মধ্য দিয়ে দেশে লুটেরা ধনিক শ্রেণীর সম্পদ কেন্দ্রীভবন বেড়েছে। দেশে চোরাই টাকার মালিক কোটিপতিদের সংখ্যা, তাদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ক্ষমতা সম্প্রসারিত হয়েছে। সম্পদ সংবর্ধনের প্রধান উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে সর্বজনের সম্পদ- জমি, পাহাড়, জঙ্গল, খাল, জলাশয়, নদী দখল। বিশ্বব্যাংক আইএমএফ নির্দেশিত ‘ওয়াশিংটন ঐকমত্য’ অনুযায়ী ‘অর্থনৈতিক সংস্কার’ এবং ব্যক্তির আওতায় সর্বজনের সম্পদ নিয়ে আসার জন্য লুন্ঠন দখল খুবই সঙ্গতিপূর্ণ। এসবের মধ্য দিয়েই শাসক শ্রেণী দল নির্বিশেষে লুটেরা দখলদার শ্রেণী হিসেবে এখন অনেক সংহত। বিভিন্ন দল বা জোটের নামেই তারা দেশের শাসন ক্ষমতার অংশীদার। এই সময়কালেই নিপীড়ন, শোষণ ও আধিপত্য বৈধ করতে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার বেড়েছে, সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে বাঙালী মুসলমানের রাষ্ট্রে। তারপরও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী মুসলমান নারীপুরুষ শ্রেণীগত ও লিঙ্গীয় নিপীড়ন বৈষম্যের শিকার। আর জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পদ হয়ে দাঁড়িয়েছে দখল ও লুন্ঠনের আরও সহজ ক্ষেত্র।।
তাছাড়া মার্কিনীদের নেতৃত্বে সন্ত্রাসী সাম্প্রদায়িক দখলদার ফ্যাসিবাদী বিশ্বব্যবস্থা চলছে এখন। আমরা তার মধ্যেই আছি। বাংলাদেশে সমুদ্র ও স্থলভাগে তাদের যে আগ্রাসী তৎপরতা, সেখানে সম্পদ ও ভৌগোলিক গুরুত্ব ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। ইতিহাসের এই পর্বে ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী তাদের আধিপত্য বিস্তারের মডেলে অত্যন্ত সুবিধাজনক। যুক্তরাষ্ট্র-চীন-ভারত ঐক্য ও বিবাদ দুটোই বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য বড় ঝুঁকির বিষয়। বন্দর ও ট্রানজিট ঘিরে ভারতের আঞ্চলিক কৌশলও বিশেষ মনোযোগের দাবিদার। এর সাথে মায়ানমার নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী নতুন মনোযোগ, সেখানে জাতিগত দাঙ্গা, উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ‘রিজার্ভ আর্মি’ হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়া এগুলোও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
৬.
রামুতে বৌদ্ধ মন্দিরে হামলার ঘটনার কথা যখন প্রথম জানি, আরও অসংখ্য মানুষের মতো তা আমার কাছেও অবিশ্বাস্য ঠেকেছিল। এটা ঠিক যে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার নানা বহি:প্রকাশ ও উস্কানির নানা ঘটনার সাথে আমরা পরিচিত। সাংস্কৃতিকভাবে সাম্প্রদায়িকতার নানা উপাদান সমাজে বিভিন্ন মাত্রায় এখনও শক্তিশালী তো বটেই, তা সহিংস আকারে প্রকাশিতও হচ্ছে নানাসময়।
হিন্দু জনগোষ্ঠী, অ-বাঙালী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন সংখ্যালঘু বিশেষত আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, সম্পদ লুন্ঠন, খুন ও ধর্ষণের কিছু কিছু ঘটনা আমরা জানি, হয়তো অনেকগুলো জানাই হয় না। সমাজের মধ্যে থেকে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধও আছে। কিন্তু নির্বাচনের সময় চাপে রাখা ছাড়া বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর এরকম হামলার কোনো ঘটনা কখনও ঘটেনি। রামুর এই হামলা সেইকারণে সারাদেশকে হতবুদ্ধি করেছে। আর এর মধ্য দিয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ও সম্প্রদায়গতভাবে ভীতি, নিরাপত্তাহীনতা ও আতংকের মধ্যে প্রবেশ করেছেন – যা তাদের কাছে এই মাত্রায় পরিচিত ছিলো না। অনেক তথ্য প্রমাণই জানাচ্ছে যে, স্বতস্ফূর্ত বা অপরিকল্পিতভাবে এই হামলার ঘটনা ঘটেনি। এর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে নানাভাবে প্রতিবাদও হয়েছে। ফেসবুকে ও রাজপথে দিনের পর দিন এই ঘটনায় তরুণদের ক্ষোভ, নিন্দা আর ধিক্কার দেখে ভরসা পেয়েছি।
সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, গ্রুপ, সাংবাদিক, গবেষক এলাকা সফর করেছেন, কথা বলেছেন, সত্য উদঘাটনের চেষ্টা করেছেন। তাঁদের অনেক রিপোর্ট প্রকাশিতও হয়েছে। এগুলো থেকে যে তথ্যগুলো পরিষ্কারভাবে পাওয়া যায় সেগুলো হল:
১. উত্তম বড়ুয়ার ফেসবুকে কোরান অবমাননার একটি ছবি লাগানো হয় এবং সেটি হাজার হাজার মুদ্রণ করে এলাকায় ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। ঘটনার ধরন, প্রচারের আয়োজন ও ত্বড়িৎগতি থেকে এটা বুঝতে কারও বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় যে, মুসলিম ধর্মানুভূতিতে প্রবল খোঁচা দিয়ে তাদের আক্রমণাত্মক ভূমিকায় টানার জন্য এটা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই করা হয়েছিল।
২. এই উদ্দেশ্য সফল হয়েছিলো, কিছু মানুষ পূর্বাপর না জেনে উত্তেজিত হয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা এতো ছিল না যে, তা ভয়ংকর কোনো ঘটনা ঘটাতে পারে। বিশেষত যেখানে আলেমসহ গণ্যমান্য অনেক ব্যক্তি এর প্রতিরোধে দাঁড়িয়েছিলেন।
৩. যেভাবে এলাকার বাইরে থেকে কয়েক ঘন্টার মধ্যে ট্রাকে বাসে করে মানুষ আনা হয় তা মোটেই স্বতস্ফূর্ত ছিলো না। এটা যে যথেষ্ট পরিকল্পিত ছিলো সেটাই বরং স্পষ্ট হয়। আর যারা এই উদ্যোগ গ্রহণ করে তাদের প্রভাব ও অর্থব্যয়ের ক্ষমতা আছে এটাও বোঝা যায়।
৪. হামলার উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টিতে যেসব দলের নেতাদের সক্রিয় ভূমিকা দেখা গেছে সেগুলো হল: সরকারি দল আওয়ামী লীগ, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। একটি প্রভাবশালী পরিবারের অন্তর্কলহ এখানে রাজনৈতিক মেরুকরণে উপাদান হিসেবে কাজ করেছে।
৫. হামলার সময়ে অনেকগুলো বহুমূল্য বুদ্ধমূর্তি চুরি গেছে।
৬. পুরো ঘটনার সময় পুলিশ ও প্রশাসন নিষ্ক্রিয় ছিলো। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, যেকোনো ঘটনা বোঝার জন্য পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও সক্রিয়তা দুটোই খুব গুরুত্বপূর্ণ।
৭.
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যেসব সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে সবচাইতে বেশি ঘটেছে বৃহত্তম ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর। ঐতিহাসিক বিভিন্ন উপাদান ও ভারতে মুসলিম বিরোধী সাম্প্রদায়িকতা এর পেছনে শক্তি যুগিয়েছে। এরশাদ আমলের শেষদিকে কিছু ঘটনা ঘটে যেগুলোতে সরকারের হাত ছিলো বলে প্রমাণিত হয়েছে। ব্যাপক আন্দোলনে পতনের মুখে এটাকে এরশাদ সরকারের একটা চাল বলেই সবাই ধারণা করেছেন। প্রতিরোধের শক্তির কারণে এটা ছড়াতে পারেনি। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি ও অন্যান্য সংগঠনের নেতৃত্বে অযোধ্যায় কথিত রামমন্দিরের স্থানে নির্মিত বাবরী মসজিদ ভাঙার পর ‘প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা ও উত্তেজনার ঘটনা ঘটে। ১৯৯২ সালের শুরু থেকেই ৭১ এর ঘাতক দালাল যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন দেশব্যাপী বিস্তৃত হয়েছিল। এই বছরের মার্চ মাসে ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে গণআদালত হয় এবং তাতে গোলাম আজমের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। বাবরী মসজিদ ভাঙার ঘটনায় জামায়াতে ইসলামী নতুন প্রাণ ফিরে পায়, রাস্তায় নেমে আসে। পুরো যুদ্ধাপরাধী বিরোধী আন্দোলনটিকে দুর্বল করবার সুযোগ হিসেবে এটিকে ব্যবহার করতে চেষ্টা করে। আন্দোলনের মধ্য থেকে তখন নতুন শ্লোগান তৈরি হয়েছিল, ‘গোলাম আজম আদভানী, দুই দেশের দুই খুনী’। আদভানী ছিলেন বিজেপির নেতা।
২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনের পর বেশকিছু হিন্দু প্রধান অঞ্চলে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটানো হয়। এটা ছিল বিএনপি জামায়াতের প্রতিহিংসামূলক আক্রমণের ঘটনা। সাধারণভাবে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই ধারণা সকলক্ষেত্রে ঠিক না হলেও আক্রমণ ও নৃশংসতা সেকারণেই ঘটানো হয়েছিল। আওয়ামী লীগের ‘ভোট ব্যাংক’ হিসেবে পরিচিত বলে কি ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগের সরকার বা দলীয় ক্ষমতাবানদের কাছ থেকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা পান? ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, কিংবা ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘুদের সামাজিক অবস্থানের নাজুকতা কাজে লাগিয়ে জমি বা সম্পদ দখলের ঘটনা পর্যালোচনা করলে আক্রমণকারী বা দখলদার ভূমিকায় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী লোকজনদেরও একইভাবে সনাক্ত করা যায়।।
দখলদার বা আক্রমণকারীরা কোথাও কোথাও যেমন দলনির্বিশেষে মুসলমান হয়ে যায়, আবার যেখানে শিকার জাতিগত সংখ্যালঘু,সেখানে দলনির্বিশেষে হয়ে যায় বাঙালি। পার্বত্য চট্টগ্রামে তাই জাতিগত সহিংসতা, সামরিকীকরণ, নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ, জমি-পাহাড় দখল ইত্যাদিতে কখনও বাঙালি কখনও মুসলমান হবার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টির ঐক্য ঠিকই টিকে থাকে।
মুসলিম সমাজের মধ্যে ভিন্ন বিশ্বাসের কারণে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেকার বিভিন্ন সংখ্যালঘুদের সামাজিক নানা নিপীড়ন ও চাপের কাহিনী সমাজের মনোযোগ না পেলেও এর তিক্ত অভিজ্ঞতায় বহু পরিবারই বিপর্যস্ত। আহমদিয়াবিদ্বেষ এবং তাদের ওপর আক্রমণ এদিক থেকে সবচাইতে উচ্চকিত। প্রকাশ্যে ওয়াজে, রাজনৈতিক বক্তৃতায় ‘ধর্মদ্রোহী’ ঘোষণা করে তাদের নির্মূলের কিংবা তাদের বিরুদ্ধে জেহাদের ঘোষণা আসে।
৮.
সাম্প্রদায়িকতা একটা বিভেদ ঘৃণা আর গ্লানিকর মন আর তৎপরতার নাম। সাধারণভাবে ধর্মীয় এক সম্প্রদায়ের প্রতি অন্য সম্প্রদায়ের ঘৃণা, বিদ্বেষ, বৈষম্য, সহিংসতা বোঝাতেই এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়। তবে আগেই বলেছি, সম্প্রদায়ের পরিচয় কেবল ধর্ম দিয়ে হয় না। জাতি, ভাষা, বর্ণ, অঞ্চল নানাভাবে একটি সম্প্রদায় পরিচিত হতে পারে। এরকম কি কোনো সমাজ আমরা পাবো যেখানে ধর্মীয় পরিচয়ে সংঘাত হচ্ছে, কিন্তু অন্যান্য জাতি, ধর্ম, ভাষা বা লিঙ্গীয় পরিচয়ে ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোন সংঘাত বা বৈষম্য নাই? বা শ্রেণীগত শোষণ নিপীড়ন নাই? না, এরকম পাওয়া যাবে না। বৈষম্যের শেকড় যদি সমাজে থাকে,তা বহুভাবে প্রকাশিত হয়। বৈষম্য ঘৃণা, বিদ্বেষ, ডালপালা ছড়ায়। এক বৈষম্য ঢাকতে গিয়ে অন্য বৈষম্য বা বিভেদ সামনে আনতে সবসময়ই তৎপর থাকে, এই বিভেদ বা বৈষম্য থেকে সুবিধাভোগী ক্ষমতাবানরা।
সম্প্রদায়গত বোধ মানুষের থাকেই। একজন ব্যক্তি এককভাবে চলতে পারে না, সবসময় সমষ্টিকে খোঁজে। শ্রেণী, ভাষা, জাতীয়তা, বর্ণ, লিঙ্গ, গোত্র, অঞ্চল, দেশ, ধর্মবিশ্বাস ইত্যাদি নানা পরিচয়ে মানুষ আরও অনেকের সঙ্গে নিজের যুক্ততা বোধ করে। কিন্তু সবপরিচয় একসাথে একইধরনের সামষ্টিক বোধ তৈরি করে না বলে পারিপার্শ্বিকতার কারণে, একটাকে ভেদ করে অন্যটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কোনটি সমাজে প্রাধান্য বিস্তার করবে তা নির্ভর করে, ঐ সমাজের রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক চেতনা ও সক্রিয়তার ওপর। সমাজ ও রাষ্ট্রে যারা ক্ষমতাবান তাদের জন্য ধর্ম, জাতি, বর্ণগত এমনকি আঞ্চলিক বিভেদ বা সংঘাত প্রায়ই একেকটি সুযোগ হিসেবে কাজ করে। নিপীড়িত মানুষের মুক্তির লড়াইকে মোকাবিলা করতে গিয়ে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে, বিভিন্ন দেশে তারা এসব বিভেদকে উস্কানি দিয়েছে, ঢাল হিসেবেও ব্যবহার করেছে। শ্রেণী লিঙ্গ তো বটেই, জাতি ধর্ম পরিচয়ে কেউ নির্যাতিত হলে, তার বিরুদ্ধে লড়াই আর নিপীড়নের জন্য জাতি ধর্ম পরিচয়কে উস্কানি দিয়ে সংঘাত তৈরি করা এককথা নয়।
মানুষের মধ্যে কোনো কোনো পার্থক্য বিভেদ বা বৈষম্য তৈরি করে। আবার কোনো কোনো পার্থক্য আনে বৈচিত্র। পার্থক্য বা বৈচিত্র মানেই তা বৈষম্যের কারণ হতে পারে না। প্রাকৃতিক ভাবে বা জন্মগতভাবে মানুষ যেসব পরিচয় লাভ করে অর্থাৎ গায়ের রং, গঠন, লিঙ্গ, ধর্মবিশ্বাস, জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদিতে একজন ব্যক্তির কোনো হাত নাই, এসব ক্ষেত্রে পার্থক্য মানুষের মধ্যে বৈচিত্র আনে। এই বৈচিত্র সমাজকে সমৃদ্ধ করে।
কিন্তু পার্থক্যকে ভর করে কোনো সম্প্রদায়ের যদি অধিকার ও ক্ষমতা সংকোচন করা হয়, তাহলে এই পার্থক্যই বৈষম্যের আকার নেয়। আবার একই ভাষাভাষী বা ধর্ম বা লিঙ্গের মধ্যেও বৈষম্য আসতে পারে। মালিকানা, সম্পদের ওপর অধিকার, শিক্ষা চিকিৎসা জীবন ও জীবিকা, স্বাধীনতা, সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ক্ষমতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যখন সমাজে গভীর পার্থক্য তৈরী হয় তখনই দেখা দেয় শ্রেণীগত বৈষম্য। এসব বৈষম্য যখন থেকে তৈরি হয়েছে,তখন থেকে এর বিরোধী লড়াইও সমাজের অবিচ্ছেদ্য ভাষায় পরিণত হয়েছে, যা তৈরি করে মানুষের মানবিক সংহতি, নারী পুরুষ ধর্ম জাতি ভাষাগত পার্থক্য সাথে নিয়েই। বৈষম্য নিপীড়ন আধিপত্য বিরোধী সেই সংহতি সম্প্রদায়গত সংহতি থেকে মৌলিকভাবেই ভিন্ন এক বিকশিত ঐক্য, যা অপ্রযোজনীয় বিভেদকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়। সাম্প্রদায়িকতার ঘৃণ্য মন ও অপশক্তি পরাজিত করতে মানুষের সেই ঐক্য ও সংহতির বিকাশে রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শিক সক্রিয়তাই একমাত্র রক্ষাকবজ হতে পারে। এক্ষেত্রে যেদেশে যারা ধর্মীয় বা জাতিগতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ তাদেরই দায়িত্ব বেশি।।
(১৫ জানুয়ারি ২০১৩ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, ধারাবাহিকভাবে ‘আমাদের বুধবারে’ প্রকাশিত)