মানুষের জীবন নিরাপদ ও সমৃদ্ধ করার উন্নয়ন চাই

আগামী ৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ঢাকায় প্রাণপ্রকৃতি মানুষের পক্ষে সারাদেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় কনভেনশন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই কনভেনশন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এমন একসময়, যখন উন্নয়নের নামে দেশ, প্রাণপ্রকৃতি পরিবেশ ও জনস্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার তৎপরতা কেমন হতে পারে, বাংলাদেশ তার অন্যতম দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। কনভেনশনে এসব বিষয় বিস্তারিত আলোচনা হবে, করণীয় নির্ধারিত হবে।

বিদ্যমান উন্নয়ন যাত্রার ঝুঁকির সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ সুন্দরবনের ধ্বংসযজ্ঞের ওপর ব্যবসায়িক মুনাফা আর রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎসব। সবাই জানেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ভয়ংকর আক্রমণের মধ্যে সুন্দরবনই উপকূলের মানুষের প্রধান ভরসা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদের মুখেও বড় ভরসা এই সুন্দরবন। এই সুন্দরবনের জন্যই বারবার বাঁচে কোটি মানুষের জীবন ও সম্পদ। গত ৯ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল আবারও প্রত্যক্ষ করেছে সুন্দরবনের এই শক্তি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘ঘূর্ণিঝড়ের তিন দিক জুড়েই ছিল সুন্দরবন। সুন্দরবনের কারণে ঘূর্ণিঝড়ের নিজস্ব শক্তি কমে আসে। ফলে তা দুর্বল হয়ে পড়ে।’ সুন্দরবন তাই এবারও বাঁচাল লাখ লাখ মানুষের জীবন ও সম্পদ। এ রকম বুক পেতে দেওয়া সুন্দরবনকে আমরা বহুবার দেখেছি। এর আগে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা একইভাবে সুন্দরবনে বাধা পেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। অথচ উন্নয়নের নামে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার যৌথভাবে আর তাদের দেশি-বিদেশি সহযোগীরা এই সুন্দরবনকেই নাই করে দিতে উদ্যত। রামপালসহ সুন্দরবনবিনাশী শত প্রকল্প ঘিরে ফেলেছে এই প্রাকৃতিক অসাধারণ রক্ষাবর্মকে।

সবাই বুঝলেও সুন্দরবনের গুরুত্ব বুঝতে সরকার অনিচ্ছুক। সরকারের কাছে মহাপ্রাণ সুন্দরবন রক্ষার চেয়ে ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসা দেওয়া, ভারত সরকারের কথামতো চলা বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। তাই গত ১০ বছরে বহুরকম তথ্য-প্রমাণ হাজির করা সত্ত্বেও সরকার বুঝতে অরাজি যে, সুন্দরবন বিনাশ মানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে বাংলাদেশ অরক্ষিত হয়ে যাওয়া। শুধু তাই নয়, পুরো উপকূলজুড়ে করা হচ্ছে একের পর এক কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র। ভারত ছাড়াও এসব প্রকল্পে যুক্ত আছে চীন ও জাপান। এসব দেশই নিজ নিজ দেশে কয়লা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে আর পরিত্যক্ত কয়লা বিদ্যুতের ভাগাড় তৈরি করছে বাংলাদেশের মতো দেশে। বাংলাদেশের বিভিন্ন কয়লা খনি নিয়েও চলছে চক্রান্ত। ফুলবাড়ীতে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিতাড়িত এশিয়া এনার্জি সরকারের প্রশ্রয়ে অবৈধভাবে লন্ডনে শেয়ার ব্যবসা করছে, চীনা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করছে, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে ফুলবাড়ী আন্দোলনের সংগঠকদের।

একদিকে সরকার যখন গ্যাস সংকটের অজুহাতে ব্যাপকভাবে প্রাণপ্রকৃতিবিনাশী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে উদ্যত, এমনকি দেশের প্রাকৃতিক রক্ষা বাঁধ সুন্দরবন ধ্বংস করতেও সরকারের দ্বিধা নেই, করছে রাশিয়ার ঋণ ও প্রযুক্তিতে এবং ভারতের ব্যবস্থাপনায় দেশবিনাশী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, অনেক বেশি দামে আমদানি করছে এলএনজি; তখন অন্যদিকে এই একই সরকার দেশের গ্যাস রপ্তানির আয়োজন করছে। সম্প্রতি সমুদ্রে ও স্থলভাগে তেল-গ্যাস সম্পদ নিয়ে বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির জন্য উৎপাদন অংশীদারী চুক্তির সর্বশেষ মডেল ‘পিএসসি-২০১৯’ অনুমোদন করেছে সরকার। এই মডেলে বিদেশি কোম্পানির জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে, তাদেরকে গ্যাস রপ্তানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে!

বাংলাদেশের শিল্প, কৃষি ও বিদ্যুতের চাহিদা না মিটিয়ে গ্যাস রপ্তানির অপচেষ্টা চলছে নব্বই দশকের শেষ থেকে। এর বিরুদ্ধে ‘তেল-গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’র নেতৃত্বে দেশের জনগণ গ্যাস সম্পদ রপ্তানির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, গ্যাস রপ্তানির একাধিক উদ্যোগ প্রতিরোধ করা হয়েছে। তার কারণেই এখনও দেশে শিল্পকারখানা চলছে, বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। পরবর্তীকালে জাতীয় কমিটির নেতৃত্বে আন্দোলন ও জনমতের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের পর পিএসসিতে রপ্তানির বিধান বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু ২০১২ সালের সংশোধিত পিএসসি মডেলে আবারও রপ্তানিসহ নানা সুবিধা বাড়ানো হয়। ২০০৯ সাল থেকে আমরা ‘খনিজসম্পদ রপ্তানি নিষিদ্ধ আইন’ করার দাবি জানিয়ে আসছি। এর জন্য এই আইনের খসড়াও তৈরি করে সরকারকে জমা দিয়েছি, পাস করা হয়নি। একদিকে প্রধানমন্ত্রী বলছেন, দেশে ৫০ বছরের গ্যাস মজুদ নিশ্চিত না করে গ্যাস রপ্তানি করা হবে না; অন্যদিকে বারবার রপ্তানিমুখী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ৫০ বছরের মজুদের বদলে গ্যাস সংকট বহাল থাকা অবস্থায় কী যুক্তিতে গ্যাস রপ্তানি চুক্তি হয়? কীভাবে সরকারের রপ্তানি নীতিতে খনিজসম্পদ রপ্তানিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়?

দায়মুক্তি আইন, যা ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০’ নামে পরিচিত, তাকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে, তার মেয়াদ বারবার বাড়িয়ে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সরকার একের পর এক যেসব চুক্তি করছে, সেগুলো প্রশ্নবিদ্ধ। এই দায়মুক্তি আইন দিয়ে অস্বচ্ছতা-দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে জবাবদিহির পথ বন্ধ করা হয়েছে। বাপেক্স যেখানে কম দামে দক্ষতার সঙ্গে গ্যাস খাতে কাজ করতে সক্ষম, সেখানে রাশিয়ান গাজপ্রমসহ বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানিকে কাজ দেওয়া হচ্ছে অনেক বেশি খরচে। রেন্টাল কুইক রেন্টাল চুক্তি করে তাদের অনেককে বসিয়ে রেখেও বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা গচ্চা দেওয়া হচ্ছে। গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের আয়োজন না করে সংকট সমাধানের নামে এলএনজি আমদানি শুরু হয়েছে। সংকট জিইয়ে রেখে এলপিজি বৃহৎ ব্যবসায়ীদের বাজার তৈরি করা হচ্ছে। সুন্দরবনকে বিপন্ন করে সেখানে ভারতে রপ্তানির জন্য এলপিজি প্ল্যান্ট করা হচ্ছে।

আমরা বরাবর দাবি জানিয়েছি, যেহেতু সমুদ্রের গ্যাস সম্পদের সম্ভাব্য বিশাল মজুদ দেশের ভবিষ্যতের বড় অবলম্বন, সেহেতু জাতীয় সংস্থার মালিকানায়, প্রয়োজনে বিদেশি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়ে বা কোনো নির্দিষ্ট কাজে দক্ষতার ঘাটতি থাকলে সাব-কন্ট্রাক্টর নিয়োগের মাধ্যমে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজ করা হোক। এভাবে জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর কর্মসূচি নিলে দেশের শতভাগ সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নয়নের শক্তিশালী ভিত নির্মাণ সম্ভব।

কিন্তু জাপানের একটি সংস্থা জাইকার মাধ্যমে ২০১৬ সালে প্রণীত মহাপরিকল্পনা (পিএসএমপি ২০১৬) অনুযায়ী সরকার দেশের বিদ্যুৎ খাতে কয়লা, এলএনজি ও পারমাণবিক নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। ব্যয়বহুল পথ গ্রহণ ও দুর্নীতির বোঝা জনগণের ওপর চাপাতে বারবার বাড়ানো হচ্ছে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম, গণশুনানিকে বানানো হয়েছে প্রহসন। পারমাণবিক বিদ্যুতের ঝুঁকি ও বিপদের যে কোনো সীমা-পরিসীমা নেই, তা সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশের মতো ঘন জনবসতি, পানি ও আবাদি জমির ওপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল একটি দেশে এই ঝুঁকি বিশ্বের যে কোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি। এই সত্য অগ্রাহ্য করে রূপপুরে বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প করা হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য তৈরি হচ্ছে মহাবিপর্যয় ও জাতীয় নিরাপত্তাহীনতার হুমকি।

অবশ্যই যত দ্রুত সম্ভব ঘরে ঘরে শিল্প-কৃষিসহ সর্বত্র নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য অনেক ভালো পথ নিশ্চয়ই আছে। নিজেদের গ্যাস ও নবায়নযোগ্য সম্পদ যথাযথভাবে ব্যবহারের জন্য জাতীয় সক্ষমতা বাড়ালে দেশে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সুলভ টেকসই সমাধান সম্ভব। সর্বজনের সম্পদে শতভাগ জাতীয় মালিকানা ও শতভাগ সম্পদ দেশের কাজে ব্যবহার, দুর্নীতি করার দায়মুক্তি আইন বাতিল করে ‘খনিজসম্পদ রপ্তানি নিষিদ্ধকরণ আইন’ প্রণয়ন, পিএসসি প্রক্রিয়া বাতিল করে স্থলভাগে ও সমুদ্রে নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে জাতীয় সংস্থাকে প্রয়োজনীয় সুযোগ, ক্ষমতা ও বরাদ্দ প্রদান, কম ব্যয়বহুল গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্টকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জ্বালানি জোগান, উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি নিষিদ্ধসহ ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন, জাতীয় সক্ষমতার বিকাশ, নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদের সর্বোত্তম মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি জ্বালানি নীতি প্রণয়ন, দীর্ঘমেয়াদে নবায়নযোগ্য জ্বালানি মূলধারায় নিয়ে আসা ইত্যাদিই যথাযথ পথ। এর মাধ্যমেই দীর্ঘমেয়াদে টেকসই, সুলভ, নিরাপদ ও জনবান্ধব উন্নয়ন ধারা তৈরি করা সম্ভব। ২০১৭ সালে এ জন্য তেল-গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি একটি বিকল্প খসড়া মহাপরিকল্পনাও প্রকাশ করেছে, সরকারের কাছেও তা জমা দেওয়া হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন করলে ক’দিন পরপর গ্যাস আর বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হয় না, রামপাল-মাতারবাড়ী-বাঁশখালী-পায়রা আর রূপপুরের মতো প্রকল্প দিয়ে বাংলাদেশকে মহাবিপদে ফেলতে হয় না। বরং সুলভে পরিবেশবান্ধব উপায়ে দেশের শতভাগ বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ সম্ভব হয়। এতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও কমবে, বিদ্যুতের নামে সারাদেশের মানুষকে মৃত্যুকূপে ঠেলে দেওয়ার দরকার হবে না। উন্নয়নের টেকসই ধারা তৈরি হবে।

কিন্তু সরকার যাচ্ছে উল্টোপথে। ব্যয়বহুল, ঝুঁকিপূর্ণ, বন-পানি-মানুষ-পরিবেশবিধ্বংসী এবং ঋণনির্ভর পথই সরকারের বর্তমান ‘উন্নয়ন’ পথ। এর মাধ্যমে কিছু দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর লাভের বিনিময়ে দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ভয়াবহ অনিশ্চয়তা, বিপদ ও বিপন্নতার দিকে। এগুলো মানববিধ্বংসী অস্ত্রের মতোই মানুষ ও প্রকৃতিবিধ্বংসী প্রকল্প। আমরা মানুষ মরার বা মারার উন্নয়ন নয়, মানুষ বাঁচার, তার জীবন নিরাপদ ও সমৃদ্ধ করার উন্নয়ন চাই।

(০৪ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে দৈনিক সমকালে প্রকাশিত)