যখনই আমরা অসংখ্য প্রাণের আধার মহাপ্রাণ সুন্দরবনের জন্য ধ্বংসাত্মক রামপাল এবং ওরিয়ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাতিলের দাবি জানাই, যখনই দেশের সমৃদ্ধ পানিসম্পদ, আবাদি জমি ও বিশাল জনবসতি ধ্বংস করে ফুলবাড়ী উন্মুক্ত খনি প্রকল্প বাতিলের দাবি করি, যখনই নদী নষ্ট করে বাঁধ বা দখল করে হাউজিংয়ের বিরোধিতা করি, তখনই সরকারি কর্তাব্যক্তি বা তথাকথিত কোম্পানিবাদী বিশেষজ্ঞরা সমস্বরে বলতে থাকেন, উন্নয়ন করতে গেলে তো পরিবেশের কিছু ক্ষতি হবেই। সুন্দরবনের ওপর তেল ঢেলে দেওয়ার এই ‘দুর্ঘটনা’, এই উন্নয়নবাদীদের ‘কিছু ক্ষতি’র খুবই সামান্য নমুনা। আরও বড় ক্ষতি করে ‘উন্নয়ন’ ঘটাতে কিংবা নিজেদের পকেট ভারী করতে যারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তাদের বোধোদয় হবে কীভাবে?
৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী জাহাজ ডুবে গিয়ে জয়মনি, নন্দবালা, আন্ধারমানিক, মৃগমারী এলাকায় সাড়ে তিন লাখ লিটার তেল ছড়িয়ে পড়ে। ওই জাহাজ ফার্নেস তেল নিয়ে যাচ্ছিল একটি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে। জোয়ার-ভাটার টানে এই তেল ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। দুর্ঘটনার পর ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কোনো উদ্ধারকাজ শুরু হয়নি। ডুবে যাওয়া জাহাজের উদ্ধারকাজে জাহাজ এসেছে ১১ ডিসেম্বর, উদ্ধারও হয়েছে। কিন্তু এই ছড়িয়ে পড়া তেল যে অপূরণীয় ক্ষতি করল, তার নিরসনে কোনো প্রস্তুতি বা ব্যবস্থা যে সরকারের নেই, তা-ও পরিষ্কার হয়েছে।
এর আগে গত ১২ ও ৩০ সেপ্টেম্বর সিমেন্টের কাঁচামাল বহনকারী দুটি জাহাজ ডুবে গিয়েও অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এগুলোর পরিণতি কী হলো, তা নিয়ে সরকারি রিপোর্ট দেখিনি, সরকার এগুলো ধামাচাপা দিতেই ব্যস্ত থাকে। সে জন্য ওই সব ঘটনার পরও সরকার এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
কীভাবে সুন্দরবনের পাশ দিয়ে তেলবাহী জাহাজ যাওয়ার অনুমতি পায়? পায় ‘উন্নয়নের’ আরও ঘটনার কারণে। মংলা বন্দর থেকে বহু রকম পণ্য পরিবহনের নৌপথ ছিল সুন্দরবন থেকে আরও দূর দিয়ে, মংলা-ঘসিয়াখালী চ্যানেল হয়ে বলেশ্বর নদ দিয়ে। ওই পথ এখন বন্ধ, কারণ এখানেও অপরিণামদর্শী উন্নয়নবাদীদের উৎসাহী আরও ‘উন্নয়ন’ কর্মসূচি। এর একটি হলো: পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বিচার বাঁধ-পোল্ডার নির্মাণ। এগুলোর ফলে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে, বিপুল পলি জমে নদী ভরাট হয়েছে। এসব নির্মাণ হয়েছে উন্নয়নের নাম করে, বিদেশি ঋণ নিয়ে, জনগণের অর্থ ব্যয় করে, কনসালট্যান্টদের সুপারিশক্রমে এবং দেশের নির্মাণ ব্যবসায়ীদের প্রবল উৎসাহে। এর পরিণতি কী হবে তার কোনো হিসাব করা হয়নি তখন। ‘কিছু ক্ষতি তো হবেই’—এই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সব ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যোগ হয়েছে অনিয়ন্ত্রিত চিংড়িঘের, যার স্বার্থে অনেক সংযোগ খাল বন্ধ করা হয়েছে। পরিণতির কথা চিন্তা হয়নি। শুধু হিসাব করা হয়েছে ব্যক্তির মুনাফা আর বৈদেশিক মুদ্রা।
সবকিছু মিলিয়ে প্রায় ১০ বছর ধরে ওই নৌপথ বন্ধ। প্রথমে অবৈধভাবে সুন্দরবন দিয়ে জাহাজ চলাচল শুরু হয়। পরে ২০১১ সালে বিআইডব্লিউটিএ আনুষ্ঠানিক অনুমতি দেয়। প্রথমদিকে ২০-২৫টি নৌযান চললেও এখন দিনে ১৫০টিরও বেশি নৌযান এ পথে চলাচল করে। দুর্ঘটনা ছাড়াই এসব যান চলাচল যে প্রতিদিন বনের বাস্তুতন্ত্র, পশুপাখিসহ তার অন্তর্গত প্রাণশক্তিকে আঘাত করেছে, তা যেকোনো বুঝদার মানুষই বুঝতে পারবেন। সর্বশেষ এ দুর্ঘটনা শুধু নদীর মৎস্য ও জলজ সম্পদ নয়, লক্ষাধিক মানুষের জীবিকার ওপরও আঘাত করেছে। আর এটি সুন্দরবনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি যে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে, তা বহু বছর ধরে আমরা জানতে থাকব।
তেল-গ্যাস–খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির মাধ্যমে আমরা কয়েক বছর ধরে বিশ্বের এই বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, প্রাণীবৈচিত্র্যের অসাধারণ আধার এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাকৃতিক রক্ষাবর্ম হিসেবে সুন্দরবনের অতুলনীয় গুরুত্ব সম্পর্কে বিশেষভাবে বলে আসছি, আবেদন করছি, চিৎকার করছি, সভা-সমাবেশ করছি, লংমার্চ করছি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর অসাধারণ বাস্তুতন্ত্রের কথা, এর গভীর সংবেদনশীলতার কথা। ইতিমধ্যে জাতিসংঘের ইউনেসকো ও রামসারও সুন্দরবন ঘিরে একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন মুনাফামুখী তৎপরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি, সুন্দরবনের সুরক্ষার জন্য ক্ষতিকর সব পরিবহন ও প্রকল্প বন্ধ করতে। কিন্তু সরকার সুন্দরবনের গুরুত্ব সম্পর্কে নির্লিপ্ত থেকে তার সুরক্ষার পরিবর্তে নিকটবর্তী নৌপথে বৃহৎ নৌপরিবহনের অনুমতি দিয়েছে, বিশাল কয়লা পরিবহনের ওপর নির্ভরশীল একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ করছে, নানা ধরনের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের নামে ভূমিদস্যুদের জমি দখলের সুযোগ করে দিয়েছে। সুন্দরবন অঞ্চলে সরকারি ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের আরও বনজমি দখলের তৎপরতা জোরদার। বিশ্বব্যাংক ও ইউএসএইডের তহবিলে তৈরি হচ্ছে এমন সব ‘উন্নয়নমুখী’ প্রকল্প, যা দখলকে বৈধতা দেবে আর কৃত্রিম জৌলুশে ঢাকবে বিবর্ণ ভবিষ্যৎকে।
প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক বাঘ সম্মেলনে সুন্দরবন বাঁচানোর কথা বলেছেন, দুর্ঘটনার পরও বললেন, ‘সুন্দরবন রক্ষায় সরকার সবকিছুই করবে!’ অন্যদিকে তিনি উদ্বোধন করেছেন সুন্দরবনঘাতী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। ভারতের এনটিপিসি যেখানে নিজ দেশের আইন ভঙ্গ করে এখানে বসেছে চালকের ভূমিকায়। শুধু এটাই নয়, দেশি কোম্পানি ওরিয়নকে এখন আরেকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সুন্দরবনধ্বংসী অন্যান্য তৎপরতার পৃষ্ঠপোষকও সরকারের বিভিন্ন বিভাগ। সব যুক্তি ও আবেদন উপেক্ষা করে সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ অব্যাহত রেখেছে। দেশি-বিদেশি বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের ‘বিশেষজ্ঞ’ কনসালট্যান্টরা নির্বোধের মতো বলেই যাচ্ছেন, ‘সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না’, ‘আমরা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করব’, ‘কয়লা ভরা জাহাজ আপাদমস্তক ঢাকা থাকবে’, ‘চিমনি থাকবে অনেক ওপরে’ ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগে দূষণ কেটে যাবে’ ইত্যাদি!
এই তেলবাহী জাহাজের দুর্ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষিত এবং বাংলাদেশের জন্য অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ সুন্দরবন কী মাত্রায় অরক্ষিত, ‘উন্নয়নবাদী’দের দাপটে কতটা বিপদগ্রস্ত এবং এর নিকটবর্তী নদী দিয়ে তেল, কয়লা বা বিষাক্ত বর্জ্যবাহী পরিবহন কতটা ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসতে পারে।
তদন্ত কমিটি হয়েছে, ভরসা নেই। তার পরও এই ক্ষতি মোকাবিলায় সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের কাছে আমাদের সবারই দাবি জানাতে হবে। একই সঙ্গে এনটিপিসি ও ওরিয়নের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সুন্দরবনধ্বংসী সব তৎপরতা বন্ধ, সরকারি দাপটে সুন্দরবনের জমি দখলের উৎসব বন্ধ করতে জাতীয় ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ জোরদার করতে হবে। গত বছরে ঢাকা–সুন্দরবন লংমার্চ শেষ হয়েছিল বৃহত্তর সুন্দরবনের দিঘরাজে। সেখানে এসব দাবিই উত্থাপিত হয়েছিল। আরও বলা হয়েছিল, সুন্দরবনের পুনরুৎপাদন ক্ষমতা সম্প্রসারণের জন্য অবিলম্বে ‘সুন্দরবন নীতিমালা’ প্রণয়ন করতে হবে, শুধু রক্ষা নয়, এর বিকাশে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
উন্নয়নের নামে লোভের আগ্রাসন থেকে সুন্দরবন বাঁচার লড়াই করছে, সুন্দরবন মরলে আমাদেরও অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। লাতিন আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে বহুল প্রচলিত একটি মন্ত্র ধার করে বলি, ‘মুনাফার লোভে আমরা একে একে আমাদের পানি, আমাদের বন, আমাদের ভূমি, আমাদের বাতাস বিষাক্ত করার পর দেখব, টাকা ছাড়া আমাদের কাছে আর কিছুই নেই। কেবল তখনই আমরা বুঝব, টাকা খেয়ে আমরা বাঁচতে পারব না।’ বাঁচতে গেলে আমাদের বিশুদ্ধ পানি লাগবে, খাদ্য লাগবে, শ্বাস নেওয়ার জন্য বিশুদ্ধ বাতাস লাগবে, আমাদের অস্তিত্বের জন্য বন লাগবে, জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থান লাগবে। অসংখ্য প্রাণবিনাশী কাজ করে মানুষ প্রাণী বাঁচতে পারবে না।
(১৩ ডিসেম্বর, ২০১৪ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত)