৬০ দশকে যে মধ্যবিত্তের গঠন ১৯৭১ সালে জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর তার সামনে বিত্ত ও ক্ষমতা অর্জনের অনেকগুলো সুযোগ উপস্থিত হয়, যেগুলোর জন্য তাদের কোন পূর্ব প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা ছিল না। এগুলোর মধ্যে দ্রুত ধনী হবার প্রধান উৎস ছিল দুটো (১) রাষ্ট্রীয় সম্পদ এবং (২) কমিশন। সরকারি প্রশাসনের লাইসেন্স ইজারা, রাষ্ট্রায়ত্ত্ব খাত (শিল্প, ব্যাংক বীমা) লুন্ঠন, খাস জমি সাধারণ সম্পত্তি দখল ইত্যাদির মাধ্যমে দ্রুত একটি মালিক ও কমিশনভোগী ধনীক গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটলো। সামরিক শাসন আমলে এই লুন্ঠন ও দখল প্রক্রিয়া প্রাতিষ্ঠানিককৃত হল। ‘বিদেশি সাহায্য’ নির্ভর প্রকল্পগুলো আমলা ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তের দ্রুত বিত্ত বানানোর একটি পথ হয়ে দাঁড়ালো।
এই প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সমাজে অনেক ভাংচুর হয়। দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিপুল সম্পদশালী একটি ক্ষুদে গোষ্ঠীর আবির্ভাব এবং নাগরিক মধ্যবিত্তের সম্প্রসারণ। এর আগে বাংলাদেশ সাধারণভাবে ক্ষুদে মালিক প্রধান একটি ‘পেটিবুর্জোয়া’ সমাজ ছিল। জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালের মতোই একটি আকস্মিক ‘শ্রেণী উত্তরণ’ ঘটলো, এবং প্রায় একই রকম অপ্রস্তুত অবস্থায়। বিনা পরিশ্রমে বিনা প্রস্তুতিতে এবারও এই অংশের অনেকের হাতে এল অভাবিত সম্পদ ও ক্ষমতা। বাঙালীদের মধ্যে যারা বিত্তবান শ্রেণীতে ‘উন্নীত’ হলেন সম্পদের মালিকানায় তাদের অবস্থান আগে ছিল ‘মধ্য’, আইনজীবী, ভূমি মালিক, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার প্রভৃতি। বৃহৎ বুর্জোয়া বা বিত্তবান এই সমাজে ছিল না। সে সময় ধনী বলতে কৃষি জোতদারকেই বোঝাতো। ব্যবসা বাণিজ্য বা শিল্পকারখানায় দুই একটি ছাড়া কোন ধনী পরিবার ছিলনা, তাও ছিল প্রধানত পাকিস্তান কেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের সহযোগী হিসেবেই। সুযোগসন্ধানীদের যে অংশ রাষ্ট্রের সঙ্গে ‘যোগাযোগ ও চুক্তির’ সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হলেন তাদের বিত্ত অবস্থানের পরিবর্তন ঘটলো স্থায়ীভাবে।
যে প্রক্রিয়ায় ৭০ দশক থেকে কোটিপতি বিত্তবান তৈরি শুরু হল তার প্রতিক্রিয়া সমগ্র সমাজেই পড়েছে। সে প্রতিক্রিয়ায় অনেককিছু ভেঙেছে, উদ্ভূত হয়েছে নতুন অনেক কিছু। এসব পথের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় ৭০ দশকের মধ্যেই বাঙালী মধ্যবিত্তের মধ্যে একটি বড় মেরুকরণ ঘটে। একদিকে গড়ে উঠলো এক নতুন বিত্তবান শ্রেণী, অন্যদিকে একই প্রক্রিয়ার ধাক্কায় মধ্যবিত্তের বৃহৎ অংশ হাবুডুবু খেতে লাগলো। পেশাজীবী সীমিত আয়ের মানুষদের প্রকৃত আয়ে ধ্বস নামলো। একদিকে দিশেহারা অন্যদিকে আকাঙ্খা তাদের নতুন নতুন পথ খুঁজবার দিকে তাড়িত করলো। এই প্রক্রিয়ায় অনেক পেশাজীবী তার কর্মসময় বাড়ালেন; নতুন কোন কাজ ধরলেন, আর অন্যদিকে পরিবারের একাধিক সদস্যকে আয় উপার্জনে নামতে হলো। বাড়ির বউ, মেয়ে, বোনকে কর্মজীবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে যে মানসিক বাধা ছিল তা এই চাপেই অনেক শিথিল হয়ে পড়ে। পরিবারে একাধিক আয়ের উৎস তৈরি হয়। টিকে থাকতে পারেন তারাই যারা নতুন উপার্জনের জায়গাগুলো সনাক্ত ও গ্রহণ করতে পারেন।
গত চার দশকে বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে অনেক বেশি অঙ্গীকৃত হয়েছে, অনেক বেশি উন্মুক্ত হয়েছে অর্থাৎ আমদানি রফতানি বেড়েছে অনেক। কিন্তু প্রান্তস্থ পুঁজিবাদের একটি ধরন হিসেবে এর উৎপাদনশীল ভিত্তি দৃঢ় ও টেকসই হয়নি। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাহেতু রফতানিমুখি শিল্প ও তৎপরতার অনেক বিস্তার ঘটেছে, তার প্রবৃদ্ধি বেড়েছে; কিন্তু রাষ্ট্রীয় বৈরিতা হেতু বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে নেমেছে ধ্বস। উৎপাদনের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীনভাবে বিস্তার ঘটেছে শপিংমলের, প্রায় সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর। অট্টালিকা বহুতল ভবন নির্মাণ বেড়েছে পারিপার্শ্বিকতার বিবেচনা ছাড়াই। দ্রুত টাকা বানানোর জন্য এই অস্থির সমাজ ও অর্থনীতি, দোকানদারি এবং দুর্বৃত্ত চেহারা নিয়েছে।
পুঁজির আদিম সংবর্ধন অর্থাৎ দুর্নীতি, লুন্ঠন, দখল এখন মূল প্রবণতা। নদী নালা খালবিল বন এমনকি তেলগ্যাস কয়লা সম্পদ ইত্যাদি সকল সাধারণ সম্পত্তি এখন লুন্ঠনের আওতায়। এসবের মাধ্যমে অর্জিত চোরাই অর্থ এখন অর্থনীতি আর সমাজের শাসক শ্রেণীর মূল শক্তি। আর এসব তৎপরতায় সহিংসতা, অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তা বেড়েছে সর্বস্তরে। সামাজিক খাত বিকাশের বদলে বিপর্যস্ত। অন্যদিকে শিক্ষা স্বাস্থ্যসেবা সর্বত্র বাজার তৎপরতা প্রাধান্যে। ব্যয়বহুল স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ডায়াগনস্টিক সেন্টার ক্লিনিক হাসপাতাল বেড়েছে। বেড়েছে এনজিও সংখ্যা। পরিষেবা খাত অর্থাৎ বিপনন তৎপরতা প্রসার লাভ করেছে। মধ্যবিত্তের কর্মসংস্থান সুযোগ এসব ক্ষেত্রেই। ভোক্তা পর্যায়ে সবকিছুর ব্যয় বেড়েছে। কোটি টাকার গাড়ি আর ফুটপাতে মানুষ দুটোই বেড়েছে। নিপীড়ন নির্যাতনে এমনকি বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডে রাষ্ট্রীয় সক্রিয়তা বেড়েছে। একইকারণে শিক্ষা ও চিকিৎসায় জনগণের অধিকার নিশ্চিত করা, জাতীয় সম্পদ রক্ষা এবং নীতিমালা প্রণয়ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা বৈরী বা অথর্ব।
এগুলোই এদেশে বিশ্বায়নের চেহারা। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এখন প্রত্যক্ষ কর্তৃত্বে। তাদের পরিচালিত ‘সংস্কার’ কার্যক্রমের আসল অনুবাদ হল দেশের সম্পদ ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিপূর্ণভাবে দেশি বিদেশি, প্রধানত আন্তর্জাতিক বৃহৎ সংস্থার, কাছে উন্মুক্ত করবার জন্য দখল কার্যক্রমের সম্প্রসারণ। তাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে সাধারণ সম্পত্তি বেদখল হয়েছে, পানি বাতাস দূষিত হয়েছে, জলাবদ্ধতা প্রকট হয়েছে, শিল্পখাতে ধ্বস নেমেছে, শিক্ষা স্বাস্থ্য সহ সর্বজনের খাত বিপর্যস্ত হয়েছে। টাকা জমেছে বিদেশি কনসালট্যান্ট আর দেশি প্রভাবশালী একাংশের হাতে। সর্বনাশ হয়েছে সর্বজনের।
মধ্যবিত্ত এখন আগের যেকোন সময়ের চাইতে অনেক বেশি অস্থির, দ্বিধাগ্রস্ত, প্রতিযোগিতাক্লিষ্ট এবং বহির্মুখী। ৬০ বা ৭০ দশকের মতো নির্বিবাদী পেশাজীবী জীবন এখন চলে না। টাকার অংকে বেতন বাড়লেও রাষ্ট্রীয় (সরকারি, স্বায়ত্ত্বশাসিত, আধা-স্বায়ত্ত্বশাসিত) প্রতিষ্ঠানে পেশাগত প্রকৃত আয় বাড়েনি, কিন্তু বেড়েছে ভোগ্যপণ্য চাহিদা। স্যাটেলাইট প্রযুক্তি মানুষকে এখনও দুনিয়ার সকল সুযোগ সম্ভাবনা কাছে পাওয়া নিশ্চিত করতে পারেনি, পারেনি দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ঐক্যসূত্র তৈরি করতে। যা করেছে তা হল ভোগ্যপণ্য চাহিদার এক একক বৈশ্বিক চেহারা দান করতে। বিজ্ঞাপন এখন ‘শিল্পচর্চার’ প্রধান মাধ্যম। বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাজ হল শিল্প প্রতিভার সৃজনশীল সব ক্ষমতাকে পণ্য চাহিদা সম্প্রসারণে নিয়োগ করা। সাধ ও চাহিদা জগতে এখন নতুন অনেক পণ্য যোগ হয়েছে, বেশিরভাগই আমদানিকৃত। তাছাড়া সমাজে এই পণ্য সমাহার সুলভ হয়েছে শপিংমলের বিস্তারের মধ্য দিয়ে। এগুলোর ক্রয় সবক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় না হলেও প্রতিযোগিতার কারণে কিনতে হয়, অনেকক্ষেত্রেই সামাজিক মর্যাদার প্রতীক।
মধ্যবিত্ত জগতের অনেক আকাঙ্খা এখন চোরাই অর্থের বিত্তবানদের জগতের ছায়ায় উৎপন্ন। তার মতো হবার বাসনা ঋণ বা দুর্নীতি বা উভয়কে নিকটবর্তী করে, এই পথে বেপরোয়া হতে প্ররোচিত করে। পরিবারের একাধিক সদস্যকে কাজ করতে হবেই, তারপরও কর্মঘন্টা বাড়াতে হয়, আয়ের নানাপথের সন্ধানে থাকতে হয়। আমলারা তো বটেই বেশিরভাগ সাংবাদিক, শিক্ষক, লেখক, শিল্পীরাও বোধশক্তি আর সংবেদশীলতার ইন্দ্রিয়কাজ স্থগিত রেখেছেন। প্রবল প্রাইভেট সেক্টর দাপটে এখন সাংবাদিক, শিক্ষক, লেখক, শিল্পীরা স্বাধীনভাবে নিজ বিবেচনা দিয়ে কাজ করছেন তার দৃষ্টান্ত খুব কম। গবেষণা জগত আর এনজিও জগত কপটতা আর প্রতারণার নতুন দিগন্ত তৈরি করেছে। এদুটো জগত এখন অনেকের বাড়তি জীবিকা আর স্বাচ্ছন্দ্যের প্রধান উৎস। শিক্ষিত বেকারদের বিপুল যোগান এর উপর এনজিওগুলো দাঁড়িয়ে আছে। এখন ইসলামী এনজিও প্রবেশ করেছে দৃশ্যপটে।
ঢাকা মহানগরী এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি আলোকোজ্জল। বহুতল ভবন, সুপারমার্কেট, ভবনে ভবনে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আর ক্লিনিক, দামি দামি খাবার দোকান, ফ্যাশন সুন্দরের অবিরাম প্রদর্শনী, নতুন নতুন গাড়ি, মোবাইল, টিভি আর বিশাল বিলবোর্ডে আনন্দ উচ্ছ্বাস। চারিদিকে শুধু কেনার লোভনীয় আমন্ত্রণ। বেচা আর কেনা। কেনা আর বেচা। মানুষ তার নীচ দিয়ে চলে; মধ্যবিত্ত তার মধ্যে ঘোরে, বিষাদ আক্ষেপ আর অস্থিরতা নিয়ে। খেলার মাঠ বন নদী নালা খালবিল তেল গ্যাস সব দখল হতে থাকে, বহুতল ভবনে ভরে যায় খোলামাঠ জলাভূমি নদী। বিজ্ঞাপনে অস্থিরতা তৈরি হতে থাকে, টাকা নাই কিন্তু কেনো আরও নতুন নতুন জিনিষ। প্রয়োজনীয় খাদ্য নাই, কিন্তু খাও আরও খাও আমেরিকান ইউরোপীয়ান ডিশ। নিয়মিত পোশাক নাই, নতুন নতুন ফ্যাশনে এসো। বিশুদ্ধ পানি নাই, কোক আছে ভার্জিন আছে…। সন্তান পড়ানোর পয়সা নাই, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান আছে লক্ষ টাকার। চিকিৎসার অভাবে হাজারো শিশু ও মার মৃত্যু হচ্ছে, আছে লক্ষ টাকার ক্লিনিক। ঘর নাই, ফুটপাত ভরে যায় মানুষে। আছে এপার্টমেন্ট, কিস্তি,ব্যাংক ঋণ! নারকীয় বৈপরীত্য আমাদের চারদিকে!!
এতসব ঝকমকে উন্নয়ন, রঙীন সিরিয়াল আর বড় বড় বিলবোর্ড দিয়েও তাই মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের অনিশ্চয়তার অবসান ঘটেনি। ঘটবার কথা নয়। না চাইলেও জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠের সাথেই তার এই অনিশ্চয়তা বাঁধা। আর সেই জনগোষ্ঠীর সঙ্গেই মধ্যবিত্তের নিয়ত বিরোধ, ঘরে রাস্তায় কর্মস্থলে মনোজগতে। যে বিত্তবান চোর ডাকাতদের কাছে তার অপমান তার প্রতিই মধ্যবিত্তের অপার ভক্তি। অস্থিরতায় অনিশ্চয়তায় ধর্ম অবলম্বন। ব্যক্তিক রাস্তায় সমাধান খোঁজার কয়েকটি পথ: বিদেশ, চোরাই টাকা আর ধর্ম। ব্যক্তিক সমাধানে বিদ্যমান অনিশ্চয়তার সংকট থেকে পার হয় কিছুলোক। মধ্যবিত্তের বাকি সবাই প্রতিযোগিতায় অনিশ্চয়তায় অস্থির দিশেহারা।।
(জুন ২৩, ২০১৪ আমাদের বুধবারে প্রকাশিত)