ভোটার এবং নাগরিক হিসেবে সক্রিয়তা চাই

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রাথমিক সোপান নির্বাচন। যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্ক জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নিজের শাসনক্ষমতা কোনো ব্যক্তি বা দলের ওপর ন্যস্ত করে। একাদশ জাতীয় সংসদ গঠনে আজ সেই ভোটাধিকার প্রয়োগের দিন। আমরা ভোট দিয়ে আগামী পাঁচ বছরের জন্য আমাদের নেতা নির্বাচন করব। আমরা চাই উৎসবমুখর পরিবেশে এই নির্বাচন সম্পন্ন হোক, শান্তিপূর্ণভাবে সবাই নিজ নিজ ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাক। সাধারণ জনগণের কাছ থেকে চাওয়াটা একান্ত হলেও এ দেশে নির্বাচনের পথ কখনোই সুগম ছিল না। নানারকম বাধার দেয়াল পথ আগলে দাঁড়িয়েছে, আবার জনগণই সে পথ পরিস্কার করেছে।

সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের নির্বাচন। আশা, প্রতিটি ভোটার তার ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন, তারা বুঝে-শুনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন এবং যে দলই জয়ী হোক তা মেনে নিয়ে নতুন বছরে নতুন সরকারকে স্বাগত জানাবেন। এই মেনে নেওয়াটা গণতন্ত্রেরই সংস্কৃতি। সেই প্রত্যাশা থেকে দেশের খ্যাতিমান লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে নতুন ভোটারের নির্বাচনী ভাবনায় আমাদের এ আয়োজন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে দলীয় সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সবই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বর্তমান সরকার দাবি করেছিল তাদের অধীনে নির্বাচন অবশ্যই সুষ্ঠু হবে। কিন্তু এজন্য সরকার, নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্নিষ্ট সবার যে ভূমিকা দরকার ছিল আমরা তার বিপরীতই দেখতে পেয়েছি। গত কিছুদিনে আমি আমার এলাকায় শুধু সরকারি দলের মিছিল ও পোস্টার দেখেছি। শুনেছি তাদের সুন্দর সুন্দর গান, ভুভুজেলার আওয়াজ, আর বেতার টিভিতে বিজ্ঞাপনী প্রচার। সংবাদপত্রে দেখেছি, শুনেছি সারাদেশে সরকারি দলের বাইরে বহু প্রার্থী তাদের নির্বাচনী প্রচারের সময় আক্রান্ত হয়েছে, পুলিশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করেছে, অসংখ্য মিথ্যা মামলা হয়েছে। রাষ্ট্রের সব শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের দমন করে এরকম একতরফা নির্বাচন সরকারের শক্তি প্রমাণ করে না। বরং এটাই প্রতিষ্ঠিত হয় যে, নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেতে সরকারি দল একেবারেই রাজি নয়। ২০১৪-র পর এবারের নির্বাচনও ক্ষমতাসীন দলের জন্য তাই একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকল।

সন্দেহ নেই যে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গত ১০ বছরে নানা তৎপরতা, প্রচার, পদক্ষেপ, দমন-পীড়ন, কৌশল ও চেষ্টায় নিজেদের ক্ষমতা অভূতপূর্ব মাত্রায় সংহত করতে সক্ষম হয়েছে।

আমলাতন্ত্র, বল প্রয়োগকারী সব সংস্থা, আইন আদালতসহ দেশের সব প্রতিষ্ঠানের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বর্তমান সরকার বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষমতাধর সরকার হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। কোনোরকম ঝুঁকি না নিয়ে নির্বাচনকে একদলীয় নির্বাচনে পরিণত করাই যে তাদের সিদ্ধান্ত ছিল এটা এর মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে।

তাই অবিরাম হামলা, মামলা, হুমকি দিয়ে সরকারি দলে নিশ্চিন্ত অবস্থা, উৎসবমুখর পরিবেশ, আর সর্বত্র উৎসবের বদলে ভয়ের পরিস্থিতি। নিরাপদে নির্ভয়ে ভোট প্রদানের বিষয়টিও অনিশ্চিত। কিন্তু দেশের মালিক দেশের মানুষ, সরকার নয়। অবাধে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা তাদের অধিকার, একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান রক্ষা করে দেশকে সত্যিকার সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়া সব নাগরিকের দায়িত্ব। তাই যত বাধা আসুক, যত ভয়ভীতি থাকুক ভোটার হিসেবে, নাগরিক হিসেবে স্বাধীন ও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

এবারের নির্বাচনে সরকারি দলসহ বিভিন্ন দলে মনোনয়ন নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি, ব্যাংক লোপাটকারী, শেয়ারবাজারে ধস নামিয়ে লাখ লাখ মানুষকে পথে বসিয়ে অর্থ লুণ্ঠনকারী, খুনি ও মাদক ব্যবসার মাফিয়া, নদী ও বন দখলদাররা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জন্য বড় আঘাত হলো এটাই, এই চেতনার মুখোশ ব্যবহার করে সমাবেশ ঘটছে ব্যাংক ও শেয়ারবাজারের লুটেরা, খুনি, কমিশনভোগী, দখলদার, সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর এমনকি মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগীদেরও। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের রায়ে, এরকম সব প্রার্থীর পরাজয় নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব।

আমরা চাই না দেশের আগামী সরকারও নদী, পাহাড়, বন দখলকারী, সাম্প্রদায়িক শক্তি দ্বারা পরিচালিত হোক। আমরা চাই আগামী সরকার ত্বকী, তনু, সাগর-রুনিসহ আরও অনেক শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ খুনিদের বিচার করবে। প্রতিবাদী কিশোর-তরুণদের দমন করতে হেলমেট আর হাতুড়ি বাহিনী জন্ম নেবে না। উন্নয়নের নামে প্রাণ প্রকৃতিবিনাশী প্রকল্প হবে না, সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্প আর দেশবিনাশী রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ হবে। সাম্প্রদায়িকতা আর জাতিবিদ্বেষ দূর করায় সক্রিয় থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংকসহ সব প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিবাজ/অদক্ষ/তোষামোদীদের আড্ডাখানায় পরিণত হবে না। সাম্য-ন্যায়বিচার-মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল তার নামে বৈষম্য, অবিচার ও গণতন্ত্র হরণের ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে না।

জানি, এই আকাঙ্ক্ষা পূরণ একটা ভোট দিয়ে হবে না; কিন্তু সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। ভোট দিয়ে, নাগরিক সক্রিয়তা দিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। না হলে দেশ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ছদ্মবেশে রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চলে যাবে। আমরা এমন রাষ্ট্র চাই না। এরকম ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেনি।