ভেনেজুয়েলার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে ‘একনায়ক’ আখ্যা দিয়ে অনির্বাচিত একজন ব্যক্তিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, তাঁকে সমর্থন দিচ্ছে কানাডা, যুক্তরাজ্য ইত্যাদি দেশের সরকার। প্রচার, সামরিক হামলার হুমকি সব নিয়েই সক্রিয় ইঙ্গো-মার্কিন সন্ত্রাসী অক্ষ। এর কারণ কী? কারণ বুঝতে হলে দেখতে হবে ভেনেজুয়েলার সম্পদ ও দারিদ্র্য। দেখতে হবে এই দেশে জনপন্থী নেতা চাভেজের চেষ্টা এবং তাতে কার ক্ষতি কার লাভ।
সম্পদ এবং দারিদ্র্য কীভাবে পাশাপাশি থাকে, তার উদাহরণ বিশ্বের অনেক দেশেই আছে। বাংলাদেশও তার একটি দৃষ্টান্ত। ভেনেজুয়েলায় এটি আরও প্রকট হয়ে উঠেছিল। পশ্চিম গোলার্ধে প্রমাণিত তেল মজুত এ দেশেই সবচেয়ে বেশি। গ্যাস সম্পদেও এই দেশ অনেক সমৃদ্ধ, বিশ্বের নবম বৃহত্তম প্রমাণিত গ্যাস মজুত আছে এ দেশেই, দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে এটি বৃহত্তম। কয়লা সম্পদ তুলনায় কম হলেও তার মজুতও উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া আছে লোহা, বক্সনাইট, সোনা, নিকেল ও হীরা। প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে ভেনেজুয়েলার এই সমৃদ্ধিই তার কাল হয়েছে। দেশ–বিদেশের বিভিন্ন গোষ্ঠী এ থেকে লাভবান হয়েছে, দেশের জিডিপি, মাথাপিছু আয়, রপ্তানি বাণিজ্য—সবকিছুই বেশ রঙিন হয়েছে, কিন্তু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য তার সুফল তৈরি হয়নি দীর্ঘকাল।
সম্পদসমৃদ্ধ এই দেশে, চাভেজ সরকার ক্ষমতার আসার আগে, ১০০ জনের ৬৬ জনই প্রচলিত ‘দারিদ্র্যসীমা’র নিচে পড়ে ছিল। দেশের এই সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল বেশ কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির, তার সহযোগী ছিল দেশি ধনিকেরা। ১৯৯৮ সালে চাভেজ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের পর দেশের এই ক্ষমতা ভারসাম্যের আমূল পরিবর্তনের চেষ্টা নেন, সিমন বলিভারের বিপ্লবী ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত করেন দেশে জনক্ষমতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে, নাম দেন বলিভারিয়ান বিপ্লব। সব প্রতিকূলতার মধ্যে চাভেজের প্রথম দশকে ভেনেজুয়েলার গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো কমিউনাল কাউন্সিল, যা জনগণকে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সাংগঠনিক কাঠামো দিয়েছে, যার মধ্য দিয়ে চাভেজ বিদ্যমান রাষ্ট্রের সমান্তরাল রাষ্ট্র তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কৃষিভূমি মালিকানায় কিছু হাত দিয়েছিলেন, দেশের সম্পদের ওপর সর্বজনের মালিকানা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক নানা সংস্কার শুরু করেছিলেন। শহরের ভূমি সংস্কারের কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছিল। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হিসেবে ‘খাদ্য, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসা সর্বজনের অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা’ নির্ধারণ করে সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রয়োজনীয় পরিবর্তনও শুরু হয়েছিল।
যে পরিবর্তনগুলো গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো হলো: ১. সরকারের নীতি, কর্মসূচি ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের সঙ্গে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের সংযোগ স্থাপিত হওয়ার মতো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি। ২. দেশের নীতি প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ–প্রক্রিয়া বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, তেল কোম্পানিসহ সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য থেকে মুক্ত করা। ৩. দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর জাতীয় মালিকানা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করা। ৪. তেল–গ্যাসসহ প্রাকৃতিক সম্পদ কোম্পানির মুনাফা বাড়ানোর বদলে জনগণের জীবনমান উন্নয়নে ব্যবহার করা। ৫. উন্নয়ন ও রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে নারী, গরিব, আদিবাসী ও তরুণদের জায়গা তৈরি করা এবং ৬. বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বহুজাতিক কোম্পানি, যুক্তরাষ্ট্রসহ সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে পারস্পরিক
মর্যাদা ও স্বার্থের ভিত্তিতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংহতি গড়ে তোলা। ঋণের জন্য কোনো দুর্বল দেশ যেন এদের ওপর নির্ভরশীল না হয়, সে জন্য ঋণের তহবিল গঠন করা। কিউবা ও বলিভিয়ার সঙ্গে দৃঢ় ঐক্য গড়ে লাতিন আমেরিকায় পাল্টা ক্ষমতার ভিত্তি নির্মাণ।
সুতরাং খুব বোধগম্য কারণেই এই সরকারের সঙ্গে কনোকোফিলিপস, মনসান্টোসহ বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানির বিবাদ তৈরি হয়, বিশ্বের বৃহৎ আর্থিক সংস্থা বড় ব্যবসা হারায়, যুক্তরাষ্ট্র তাই প্রথম থেকেই ‘একনায়ক’ চাভেজবিরোধী প্রচারণা চালাতে থাকে। চাভেজ সরকার একের পর এক তাদের আক্রমণ, চক্রান্ত ও অন্তর্ঘাত মোকাবিলা করে অগ্রসর হয়েছে। গরিব সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে নিয়ে ক্রমান্বয়ে পাল্টা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানোর মধ্য দিয়েই এই চেষ্টা চলেছে। দারিদ্র্য অনুপাত দুই–তৃতীয়াংশ কমে যায়। গরিব মানুষের জীবনে যে পরিবর্তন হয়, তা শুধু দারিদ্র্য পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝা যাবে না। কিন্তু কোনো দেশ যদি নিজের সম্পদের ওপর নিজে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যদি জনস্বার্থকে প্রধান করে উন্নয়ন–দর্শন সাজাতে চায়, তাহলে বিশ্বের লুটেরা দুর্বৃত্তরা খেপে ওঠে। তাদেরই নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
তাই ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে হুগো চাভেজবিরোধী সামরিক অভ্যুত্থান হয়। বলাই বাহুল্য, লাতিন আমেরিকায় এ রকম ঘটনা বহু। যেমন পরিচিত ৯/১১–এর ১৮ বছর আগে ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর লাতিন আমেরিকার চিলিতে মার্কিন সন্ত্রাসী গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর পৃষ্ঠপোষকতায় সামরিক বাহিনী যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দের বিরুদ্ধে। এই নির্বাচিত প্রেসিডেন্টও জনসমর্থন নিয়ে চিলিকে বদলে দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি নিতে যাচ্ছিলেন। এসব কর্মসূচির অন্যতম ছিল মার্কিনকেন্দ্রিক বহুজাতিক সংস্থাগুলোর দাপট ও শৃঙ্খল থেকে চিলির সম্পদ ও মানুষকে মুক্ত করা, জনগণের অধিকার নিশ্চিত করতে ভূমি সংস্কারসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ। ভেনেজুয়েলার মতো এখানেও একটি ছোট কিন্তু ক্ষমতাশালী ধনিকশ্রেণি তৈরি হয়েছিল, যাদের স্বার্থ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ একাকার ছিল। তাই এই দুই দলের উদ্যোগে বিপুল অর্থ ব্যয় করে প্রথমে নানা সংকট এবং কিছু সংগঠিত বিক্ষোভ দাঁড় করানো হয়েছিল।
১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ জেনারেল পিনোশের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান হয়। এরপর গণহত্যা এবং নিষ্ঠুরতম নির্যাতনে চিলির কত মানুষ নিশ্চিহ্ন ও ছিন্নভিন্ন হয়েছে, তার হিসাব এখনো শেষ হয়নি। লাতিন আমেরিকার ইতিহাসে এ রকম নৃশংসতার ছাপ বহু। কিন্তু ইতিহাস বারবার একইভাবে ফিরে আসে না। ২০০২ সালে সামরিক বাহিনীর অস্ত্র আর আক্রমণ অস্বীকার করে কারাকাসের রাজপথ ভরে গেল গরিব নারী–পুরুষে। সারা দেশে গণ–অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো। আরও শক্তিশালী হয়ে চাভেজ ক্ষমতায় ফিরলেন।
এর মধ্যে বিশ্ব অনেক রক্তাক্ত হয়েছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে বিশ্বে ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ নামে সন্ত্রাস এবং নারকীয়তা বেড়েছে অনেক। ফ্যাসিবাদী সর্বব্যাপী আগ্রাসনের এই পর্বে বিশ্বের যে অঞ্চল আমাদের একটু স্বস্তি দিয়েছে, সেটি লাতিন আমেরিকা। যাঁদের বক্তব্যে আমরা আমাদের ক্ষোভের স্বর শুনেছি, তাঁরা হলেন ফিদেল কাস্ত্রো, ইভো মোরালেস এবং পরে প্রয়োজনীয় তীব্রতার সঙ্গে হুগো চাভেজ।
কিন্তু ২০১৩ সালে চাভেজের অকালমৃত্যুর পর সংকট তৈরির সুযোগ বাড়ল। মাদুরো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। কিন্তু তখন থেকে বিশ্বজুড়ে তেলের দামের অস্বাভাবিক পতন ভেনেজুয়েলার জন্য বড় বিপদ নিয়ে এল। ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি প্রধানত তেলনির্ভর, সেই আয় থেকেই শিক্ষা, চিকিৎসা, আশ্রয়, খাদ্যনিরাপত্তাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির খরচ নির্বাহ করা হতো। তেলের দাম দ্রুত কমে যাওয়ায় সব কর্মসূচিই ক্ষতিগ্রস্ত হলো। বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ল। দেশ–বিদেশের বহুমুখী বিরুদ্ধতা, অর্থনীতির একমুখিতা, বৈশ্বিক বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলায় মাদুরো সরকার যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। সেই সুযোগে ভেনেজুয়েলা পুনর্দখলে সক্রিয় হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের আড়ালে বহুজাতিক পুঁজি, যাদের এখানে ব্যবসায়িক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জনপন্থী নীতির কারণে।
মার্কিন মদদে জনশত্রুরা সংকটের সুযোগে, মিডিয়ার সমর্থনে বহু মানুষকে তাদের পক্ষে আনতে সক্ষম হয়েছে। তারা এখন রাস্তায়। রাস্তায় চাভেজ-মাদুরোর পক্ষের মানুষেরাও। মার্কিন ও বহুজাতিক পুঁজির স্বার্থ দেখতে সক্ষম এ রকম সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় মরিয়া বিশ্ব দুর্বৃত্তরা। বিশ্বের বহু দেশের মতো এই দেশ আবারও দীর্ঘস্থায়ী অশান্তি, সহিংসতা, লুণ্ঠন ও স্বৈরতন্ত্রে প্রবেশের হুমকির মধ্যে।
(৩১ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত)