বাংলাদেশে গত এক দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে দ্রুত। কিন্তু শিক্ষা, গবেষণা, শিক্ষক নিয়োগ, পড়াশোনা, হলের অবস্থা, ক্লাস, গণরুম, পরীক্ষা নিয়ে সমস্যা কমেনি; বেড়েছে। এরপরও নানা রকম দুরবস্থা, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা সত্ত্বেও দেশে স্বাধীনভাবে (যা ফরমায়েশি নয়) যতটুকু গবেষণা হয়, তার অধিকাংশ হয় সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়েই, প্রধানত পুরোনোগুলোতে। বিশেষত এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি সূত্রে এসব প্রতিষ্ঠানে বহু বিষয়ে গবেষণার কাজ একটা অব্যাহত প্রক্রিয়া। তবে এগুলোর একটি বড় অংশ প্রকাশিতই হয় না, আর যেগুলো প্রকাশিত হয়, তার সিংহভাগই ইংরেজি ভাষায়। বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে পিএইচডি করেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে গবেষণা করেন। সেগুলো তো অনিবার্যভাবে ইংরেজিই। এসব গবেষণার বেশির ভাগই দেশের মানুষের কাছে পৌঁছায় না, বাংলায় অনুবাদ হয়েও নয়। তার মানে উদ্বেগের বিষয় হলো যে বাংলাদেশ নিয়ে, বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে বিজ্ঞান-সমাজবিজ্ঞান-মানবিক বিভিন্ন শাখায় দেশে-বিদেশে ভালো-খারাপ যত গবেষণা হচ্ছে, তার বিরাট অংশ দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ থেকে বহুদূরে, শুধু ভাষার কারণে।
কার্যত ইংরেজি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার অবস্থানে নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার সব নীতিমালা প্রণয়ন করছে, দেশ ও জনগণ সম্পর্কে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। এর অংশীদার বাঙালি উচ্চ ডিগ্রিধারী সমাজ তার শিক্ষা, গবেষণা, উপার্জন ও জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে তৈরি করছে এক সংখ্যালঘু জগৎ, যার পা মাটিতে নেই। এসবের মধ্য দিয়ে যে জ্ঞানের জগৎ তৈরি হচ্ছে, তা দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন। ভাষার দেয়াল টানা দুই জগতে জ্ঞানের বা চিন্তার বা ভাবের বা কল্পনার বা পরিকল্পনার এই বিভেদ দিন দিন বাড়ছেই কেবল। এই বিভেদ বাড়ানোর প্রধান কারিগর রাষ্ট্র নিজেই। আমরা দেখছি ‘উন্নয়নের’ তোলপাড়। কিন্তু তার নীতিমালা প্রণয়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং তার পরিণতি কোনো কিছুই জনগণের জানা নেই।
শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ আর বাজারের চাহিদার ক্রম শক্তি বৃদ্ধিতে সব পর্যায়েই ইংরেজির আধিপত্য দ্রুত বেড়েছে। সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়েও পাঠদানের সময় শিক্ষার্থীদের জন্য রেফারেন্স হিসেবে প্রধানত ইংরেজি বই-ই দেওয়া হয়। দিতেও হয়। কেননা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় মানসম্মত পাঠ্যবই, সম্পর্কিত গবেষণামূলক গ্রন্থ পাওয়া যায় না। অর্থনীতি বিভাগসহ সমাজবিজ্ঞান, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শনসহ সব ক্ষেত্রেই এটি সত্য। শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে ১২ বছর ইংরেজি পড়ে আসার পরও সবচেয়ে কাবু থাকে এ ভাষা নিয়েই। ১২ বছর ধরে ইংরেজি পড়লেও সেই ভাষায় লিখতে বা বলতে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাও বিপন্ন বোধ করেন, কিন্তু এই দেশেরই অনেক শিক্ষার্থী জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশে গিয়ে দ্রুত সে দেশের ভাষা শিখে ফেলতে পারেন, অনেকে সে ভাষায় পিএইচডি পর্যন্ত করেন। ইংরেজি শেখার ব্যর্থতার কারণ প্রজাসুলভ ভীতি এবং শিক্ষার ভুল ধরন ছাড়া আর কী হতে পারে? ইংরেজি নিয়ে এত আয়োজন যে ভেতর থেকেই ত্রুটিপূর্ণ এবং অসফল, তা এখান থেকেই বোঝা যায়।
শিক্ষার্থীদের তাই ধস্তাধস্তি করতে হয় বিষয়বস্তু নিয়ে নয়, যতটা বিদেশি ভাষা ইংরেজি নিয়ে তার থেকে অনেক বেশি। হাতে গোনা কয়েকজন বাদে অন্যরা তাই কার্যত অনুসন্ধান করতে থাকে বাংলা বই। তারা পেয়ে যায় কিছু বই, যেগুলোর বেশির ভাগ গাইড বই ধরনের, নিম্নমানের কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে সফল। অর্থাৎ ইংরেজি চাপিয়ে দিয়ে ফলাফল দাঁড়ায় এই যে এতে না ভাষাশিক্ষা হয়, না বিষয়বস্তু যথাযথভাবে জানা যায়। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করে গভীর হীনম্মন্যতা নিয়ে। তারাই আবার পরে প্রশাসনে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দেয়। পুনরুৎপাদিত হতে থাকে হীনম্মন্যতা-অজ্ঞতার দুষ্টচক্র। এই চক্রের চাপে স্বাভাবিক জ্ঞানের নতুন নতুন জগৎ নিয়ে কৌতূহলও মরে যায়, প্রশ্ন আসে না। কৌতূহল আর প্রশ্ন না থাকলে আর কী অবশিষ্ট থাকে, যা দিয়ে জ্ঞানচর্চা অগ্রসর হতে পারে?
বহু বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে আমি নিশ্চিত যে যদি শিক্ষার্থীদের ওপর ‘ভয় পাওয়া’ ভাষার চাপ না থাকত, যদি তারা নিজ ভাষায় ভালো মানের পাঠ্যবই পেত, তাহলে টেক্সট পড়া নিয়ে ভয় এই মাত্রায় থাকত না। রেফারেন্স দেওয়া ইংরেজি বইয়ের বদলে নিম্নমানের বাংলা বই বা নোট বই বা গাইড বই বা বড় আপা বা ভাইদের করা নোটের ফটোকপি নিয়ে তাদের ছোটাছুটি এবং নিরানন্দের পড়াশোনার বোঝা বইতে হতো না। তাদের চাপিয়ে রাখা মেধা হয়তো প্রকাশের পথ করে নিতে পারত এবং আমরা আরও আত্মবিশ্বাসী, কৌতূহলী, সৃজনশীল মানুষ পেতাম।
আরজ আলী মাতুব্বর বলেছিলেন, ‘বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রি আছে, কিন্তু জ্ঞানের কোনো ডিগ্রি নাই। জ্ঞান ডিগ্রিবিহীন ও সীমাহীন।’ খুবই ঠিক কথা। শুধু শিক্ষা-গবেষণা প্রতিষ্ঠানে নয়, শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিধারীদের মধ্যে নয়, জ্ঞান বিচরণ করে সর্বত্র। সব স্তরের মানুষ তার নিজ নিজ পথে, নিজ নিজ উপায়ে জ্ঞান অর্জন করে, জ্ঞানচর্চা করে। একটি জনপদে পরম্পরায় তা প্রবাহিত হয়, কাল থেকে কালে, স্থান থেকে স্থানে তা ছড়াতে থাকে। জ্ঞান থেকে ডিগ্রি আসতে পারে ঠিকই, কিন্তু ডিগ্রি মানেই জ্ঞান নয়। আমাদের চারপাশে একই সঙ্গে উচ্চ ডিগ্রি আর অচল মস্তিষ্ক নিয়ে বহু মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইতিহাস সাক্ষী, ক্ষমতাবানেরা জ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে, কিন্তু তার উৎপাদন, পুনরুৎপাদন কখনোই বন্ধ করে দিতে পারে না। তবে শিক্ষাব্যবস্থা বিকলাঙ্গ করলে যেকোনো দেশের জাতীয় সামগ্রিক বিকাশ মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। আমরা সেই পরিস্থিতির মধ্যেই হাবুডুবু খাচ্ছি।
সমাজের বিভিন্ন সীমারেখা ধরে জ্ঞান চলে না, যদিও এসব সীমা জ্ঞানচর্চা প্রভাবিত করে। কোনো রাষ্ট্রীয় সীমা ধরেও জ্ঞান তৈরি হয় না, সে সীমায় আটকেও থাকে না, কোনোকালেও তা সীমিত থাকে না। জ্ঞানের মালিকানা, কর্তৃত্ব তাই কোনো রাষ্ট্র, জাতি, গোষ্ঠী দাবি করতে পারে না। সে জন্য কোনো জনগোষ্ঠী যদি জ্ঞানের সঠিক সন্ধান পেতে চায়, তাহলে একদিকে তার নিজের জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানচর্চা সামনে আনতে হবে। আর তার সঙ্গে যোগ করতে হবে বিশ্বের নানা প্রান্তের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সার। শুধু নিজেদের মধ্যে আটকে থাকলে যেমন হবে না, তেমনি নিজের শিকড় অগ্রাহ্য করে ঝুলে থেকেও নিজের শক্তি দিয়ে তার সমগ্রটা ধরা তার পক্ষে সম্ভব হবে না।
সে জন্যই জ্ঞানচর্চাকে একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর কাজ বা তার সীমানায় আটকে রাখা বা শুধু সেটাকেই জ্ঞান হিসেবে মান্য করে কোনো জনগোষ্ঠী তার সমগ্র নিয়ে দাঁড়াতে পারে না। যদি দাঁড়াতে হয়, তাহলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে সব নাগরিকের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তার জন্য যা করণীয়: প্রথমত, সব পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম প্রধানত বাংলা করতেই হবে। এর বাইরে অন্যান্য জাতির ভাষার স্থানও নিশ্চিত করতে হবে। তার জন্য সামগ্রিক প্রস্তুতি দরকার। পাঠ্যপুস্তক তৈরি করতে হবে, প্রশিক্ষণ লাগবে। সেই সঙ্গে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ইংরেজিসহ বিদেশি ভাষাশিক্ষা বিশেষ গুরুত্ব ও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বিশ্বের সব জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রকাশনা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। বাংলা প্রকাশনাও অনুবাদ করতে হবে অন্যান্য ভাষায়। ব্যক্তিপর্যায়ে এসব কাজ কিছু কিছু হচ্ছে, কিন্তু জাতীয় প্রয়োজন মেটাতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগই হতে হবে চালিকা শক্তি। অভিন্ন মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থায় মাতৃভাষায় শিক্ষার মধ্য দিয়ে সর্বজনের যে দৃঢ় ভিত্তি তৈরি হবে, তার ওপর দাঁড়িয়েই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সঙ্গে অর্থবহ কার্যকর যোগসূত্র স্থাপন সম্ভব হবে।
এগুলো বর্তমান পরিস্থিতিতে অসম্ভব প্রস্তাব মনে হলেও বিশ্বের কোনো অঞ্চলেই এই পথের কোনো ব্যতিক্রম নেই।
[২১ ফেব্রুয়ারী ২০২২ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত]