বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অনেক জটিল সমীকরণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ভারতের প্রভাব অনেক। শুধু তাই নয়, এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং সামগ্রিক শান্তি, সবদিকেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের মধ্যে অশান্তি ও টানাপড়েন থাকলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি তো বটে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনও দুষ্কর। এর জন্য পারস্পরিক মর্যাদা ও সহযোগিতা, দুই দেশের জনস্বার্থ বিবেচনার সঙ্গে এ সম্পর্কিত নীতি ও তার ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া গ্রহণ করা গেলে সম্মানজনক সম্পর্ক গড়ে তোলা খুব কঠিন নয়।
এটা বাংলাদেশ চাইলেই হবে না, এমনকি ভারতের জনগণ চাইলেও হবে না। এটি হচ্ছে রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের বিষয়। ভারত রাষ্ট্র তার নীতি, আদর্শ বা ভারতের নীতিনির্ধারকদের স্বার্থ কিংবা ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থ, বৃহৎ রাজনৈতিক দলের চিন্তা-ভাবনা বা তাদের নীতি এসব বিষয়ের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক।
ভারতের অর্থনীতির আকার, জনসংখ্যা, রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি এগুলো কোনো কিছুর সঙ্গেই বাংলাদেশের তুলনা চলে না। সবদিক দিয়ে ভারত অনেক শক্তিশালী, এমনকি বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতেও ভারত গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। সুতরাং শক্তির এই ভারসাম্যে সম্পর্ক নির্ধারণে ভারতের ভূমিকাই শেষপর্যন্ত নির্ধারক।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে গত প্রায় ৪৪ বছরে অনেকগুলো সরকার বাংলাদেশ শাসন করেছে যাদের সঙ্গে ভারত রাষ্ট্রের গোপন বা প্রকাশ্য নানারকম বোঝাপড়া সম্পর্ক বা লেনদেন ছিল। বাংলাদেশের অনেক মানুষ আওয়ামী লীগকে ভারতপন্থী, বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টিকে ভারতবিরোধী মনে করে। এভাবে সূত্রায়ন খুবই ভুল। কেননা তাদের কারও শাসনামলেই ভারতের বাণিজ্যিক স্বার্থ, এ অঞ্চলে ভারতের আধিপত্য প্রভৃতি রক্ষায় কোনো সমস্যা হয়নি। বরং তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থের বিকাশ ঘটেছে, বিভিন্ন ধরনের সুবিধা তারা আদায় করে নিতে পারছে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এডিবির কর্তৃত্বে অর্থনীতির যে গতিমুখ তৈরি হয়েছে, যেসব সংস্কার করা হয়েছে, তাতে ওপরের সব রাজনৈতিক দলই একমত, সেগুলোই ভারতের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারে সহায়তা জুগিয়েছে।
যা হোক গত ৪৪ বছরে যেসব সমস্যার সমাধান হয়নি বা যেসব ইস্যুর সমাধানের ওপর দুটো দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক অনেকখানি নির্ভর করে, সেগুলোর ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের দুই দফাতেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। বিএনপি যদি ভারত রাষ্ট্রের স্বার্থমতো চলতে সম্মত হয়, অন্যদিকে নেক নজর পাওয়ার প্রতিযোগিতায় আওয়ামী লীগ সরকার যদি ভারতকে আরও সুযোগ-সুবিধা দেয় বা দিতে সম্মত হয়, তাতে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারত সম্পর্কে ক্ষোভ-বিক্ষোভ কমবে না। যদি এ দেশের মানুষের ভেতর ক্ষোভ বা বৈরীভাব থেকেই যায়, তাহলে বিএনপি-আওয়ামী লীগ যতই সম্পর্ক স্থাপন করুক তাতে সামগ্রিকভাবে স্থিতিশীল সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনা তৈরি হবে না।
এই মুহূর্তে ভারতের প্রধান আগ্রহ বাংলাদেশের কাছ থেকে ট্রানজিট বা করিডোর আদায় করে নেয়া। বাংলাদেশের তিনদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে কীভাবে তারা এটা প্রত্যাশা করে সেটাই একটি বড় প্রশ্ন। ট্রানজিটের জন্য বাংলাদেশের বন্দর, নৌপথ, সড়কপথ, রেলপথ সব ক্ষেত্রেই তাদের আধিপত্য দরকার। তারা বাংলাদেশের কাছ থেকে সামগ্রিক ট্রানজিট চাইলেও নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের ট্রানজিট নিয়ে তারা মৌখিক প্রতিশ্রুতির বাইরে আর কিছুই করেনি।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্যের বাজার যথেষ্ট বিস্তৃত হয়েছে, সামনে আরও হবে। কিন্তু ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে ভারত সব সময় নানারকম বাধা সৃষ্টি করেছে। শুল্ক ও অশুল্ক বাধা অপসারণে তারা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়নি।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ ক্রমে বাড়ছে। নামে-বেনামে বা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অথবা সরাসরি ও যৌথভাবে ভারতের বিনিয়োগ বাড়ছে। কিন্তু ভারতে বাংলাদেশের বিনিয়োগে অনেক প্রতিবন্ধকতা আরোপ করে রাখা হয়েছে।
চতুর্থত, সীমান্তের তিনদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে ভারত, অন্যদিকে গুলি করে মানুষ হত্যা করছে। সে হত্যার দায়ও স্বীকার করছে না তারা।
পঞ্চমত, সীমান্তজুড়ে অনেক ফেনসিডিল কারখানা তৈরি করা হয়েছে। যেখান থেকে ফেনসিডিল বাংলাদেশের ভেতরে আসছে এবং সমাজের জন্য একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
ষষ্ঠত, কৃষি, অর্থনীতি, পরিবেশের ওপর ফারাক্কার যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে, তা নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বহুদিনের। ভারতের কথা উঠলেই ফারাক্কার কথা এসে যায়। এর কারণ হলো, এই বাঁধের প্রভাবে বাংলাদেশের নদীপ্রবাহে অনেক বিপর্যয় এসেছে। এ সমস্যা সমাধানের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বরং অভিন্ন ৫৪টি নদীর ওপর একের পর এক বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। নদীগুলোতে বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। এতে বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর ক্রমেই ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে। ইতোমধ্যে তিস্তার পানি শুকিয়ে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। উদ্যোগগুলো চলতে থাকলে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি, কৃষি জীবন-জীবিকায় ভয়াবহ ধস নামবে। আমাদের নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। আবার হঠাৎ বন্যায় আমাদের ফসল নষ্টও হচ্ছে অনেক সময়। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ভারত কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। সরকার জাতিসংঘের নদীবিষয়ক কনভেনশন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিচ্ছে না।
বর্তমান সরকারের মধ্যে কিছু লোকের কথাবার্তায় বোঝা কঠিন হয় তারা বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছে। যেমন টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ হলে বাংলাদেশের নাকি কোনো ক্ষতিই হবে না। কোনোরকম সমীক্ষা ছাড়াই বাংলাদেশ সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী-উপদেষ্টা প্রথম থেকেই এ ধরনের কথা বলে যাচ্ছেন। কিংবা কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই বলা হচ্ছে, ট্রানজিটে কোনো ক্ষতি হবে না। বরং লাভ হবে। এতদিন বলা হয়েছিল ট্রানজিটে বাংলাদেশের অনেক লাভ হবে, কিন্তু এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, কোনো ধরনের ফি না নিয়ে পণ্য পরিবহনের একেক পর্ব ছাড় করা হচ্ছে, কখনো ‘মানবিক’ কখনো ‘বন্ধুত্বসুলভ’ নাম দিয়ে।
ভারতের কাছ থেকে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়া হয়েছে, উন্নয়নের ক্ষেত্রে সেটাকে ভারতের ‘সহায়তা’ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও তা আসলে ভারতের ট্রানজিট পথ তৈরির জন্য বাংলাদেশের ঋণ! কাজ হচ্ছে ভারতের, ঋণের বোঝা তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশের। বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভারতের এনটিপিসি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, ভারতীয় কোম্পানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে অনেক বেশি দামে। এতে ভারতের কোম্পানির লাভ হবে কোনো সন্দেহ নেই আর বাংলাদেশের সুন্দরবন ধ্বংস হবে। বাংলাদেশ অনেক বেশি দামে কিছু বিদ্যুৎ পাবে, বিশ্ব ঐতিহ্য, কয়েক কোটি মানুষের প্রাকৃতিক রক্ষা বাঁধ সুন্দরবন ধ্বংসের বিনিময়ে।
ভারত চাইলে বাংলাদেশ সরকার কতদূর পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্ষতি করতে পারে তার একটা নমুনা হলো তিতাসের বুকে বালি-মাটি ফেলে তাকে ভরাট করে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের জন্য রাস্তা করে দেওয়া। সীমান্তে হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। কয়েক দিন পরপরই শোনা যায় বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি মারা যাচ্ছে। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছেই। আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের ক্ষমতা রাখতে ভারতকে পাশে রাখতে প্রাণান্ত করছে। বিএনপিও মনে করছে ভারতের সঙ্গে সমঝোতা বা নমনীয়তা ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না। এসবের মানে হলো, বাংলাদেশের সম্পদ ও জনগণের ক্ষতি করে ভারতের স্বার্থরক্ষার বিনিময়ে ক্ষমতায় আরোহণ বা থাকা নিশ্চিত করার চেষ্টা। এসব রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ক্ষমতায় যাওয়ার কাড়াকাড়ির বলি হচ্ছে দেশ নানাভাবে, এটি হচ্ছে তার একটি।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ব্যবধানও ক্রমে বাড়ছে। ভারত একটি বড় অর্থনীতির দেশ, সুতরাং বাণিজ্য ব্যবধান থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, এই বাণিজ্য ব্যবধান স্বাভাবিক নয়। ভারত থেকে এমন সব পণ্য বাংলাদেশে আসছে যেগুলো না আসাই উচিত যেমন ফেনসিডিল, অস্ত্র, ক্ষতিকর নানা কেমিক্যাল, বিষ প্রভৃতি। আবার গার্মেন্টসহ বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানির মতো অনেক পণ্য রয়েছে যেগুলো ভারতের বাজারে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে পারে সহজেই। কিন্তু ভারত সরকার নানাভাবে শুল্ক ও অশুল্ক প্রতিবন্ধকতা জারি করে রপ্তানির স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে বাজার অর্থনীতির নিয়ম বলি কিংবা এক রাষ্ট্রের সঙ্গে আরেক রাষ্ট্রের সম্পর্কের নিয়ম বলি কোনোটাই এখানে কাজ করছে না। এখানে কাজ করছে ভারত রাষ্ট্র বা তার শাসকশ্রেণির গায়ের জোর।
ক্ষমতাবান গোষ্ঠী ও বৃহৎ পুঁজির স্বার্থরক্ষায় ভারত রাষ্ট্র যেসব নীতি গ্রহণ করে সেটার দ্বারা সে দেশের জনগণ যে লাভবান তা নয়। বরং এসব নীতিমালার জন্য অনেক ক্ষেত্রে ভারতের জনগণও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার ভারতের বিভিন্ন ধরনের আধিপত্য বজায় রাখা ও কার্যক্রমে বাংলাদেশের জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কিছু গোষ্ঠী এখানে ঠিকই লাভবান হচ্ছে। এক ভারতের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে দুই দেশ। একটি শাসক, ক্ষুদ্র ধনিকবণিক গোষ্ঠী, অন্যটি বিশাল জনগণ যারা নানাভাবে নিজেদের রক্ষায় ওই ক্ষুদ্র অংশের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। বাংলাদেশও এ রকম দুই দেশের সমষ্টি। বিশাল জনগণের স্বার্থ আর ক্ষুদ্রগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষাকারী শাসকদের স্বার্থ এক নয়। সেই হিসেবে বাংলাদেশের স্বার্থ অনেকখানি নির্ভর করে ভারতের জনগণের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ কতটা স্থাপিত হচ্ছে তার ওপর।
জনস্বার্থে ভারতের অন্যায়ের প্রতিবাদ মানে ভারত বিদ্বেষ নয়। জনগণের ওপর ভরসা না করে, বিএনপি-জামায়াত বা আওয়ামী লীগ ক্ষমতার জন্য ভারতের কাছে আত্মসমর্পণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলে, দেশের স্বার্থ বিপর্যস্ত হওয়াই স্বাভাবিক। তারা যদি আত্মসমর্পণ করে বা নতজানু হয়, অথবা ভারতের আধিপত্য মেনে নিয়ে কিংবা নাকে খত দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে বা যেতে মরিয়া হয়ে ওঠে, তাহলে দুই দেশের মধ্যে সম্মানজনক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা কখনো সম্ভব হবে না। কেননা অধস্তনতা বা দাসত্বের মধ্য দিয়ে কোনো টেকসই স্থিতিশীল সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, যা দুই দেশের জন্যই খুব প্রয়োজন।
(১ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে আমাদের সময়ে প্রকাশিত)