বাংলাদেশের অর্থনীতি-রাজনীতির গতিমুখ নির্ধারণে ভারতের ভূমিকা, রাজনীতি এবং অর্থনীতির গতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্ধারক। কাঁটাতার দিয়ে ঘেরাও হয়ে থাকলেও বাংলাদেশে ভারতের পণ্য আমদানি, নিয়োগ ও বিনিয়োগ বাড়ছে। বাংলাদেশ এখন ভারতের পঞ্চম বৃহত্তম প্রবাসী আয়ের উত্স। ট্রানজিটের মধ্য দিয়ে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ভৌগোলিক অর্থনৈতিক মানচিত্র পরিবর্তিত হবার পথে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, জলে স্থলে অন্তরীক্ষে ভারত বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী থাকবে। গত ২৩ মার্চ ভারত থেকে তেল আমদানি এবং বাংলাদেশ থেকে ব্যান্ডউইথ রপ্তানি অনুষ্ঠানে তিনি এই কথা জানান। বাংলাদেশের মিডিয়াতে ভারত থেকে এদেশে তেল আমদানির বিষয়টি সেদেশের সহযোগিতা হিসেবে চিত্রিত করে বারবার প্রচার করা সত্ত্বেও কেনো বিশ্ববাজারে তেলের দাম এতো কমে যাওয়া সত্ত্বেও বেশি দামে ভারত থেকে তা কেনা হচ্ছে তার কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। আর কেনো বাংলাদেশে ভবিষ্যতে ইন্টারনেট চাহিদা বৃদ্ধির বিষয়টি উপেক্ষা করে কম দামে ব্যান্ডউইথ রপ্তানি করা হচ্ছে তার ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়নি।
চারিদিকে নানাবিধ হট্টগোলের ভেতর কয়েকটি কাজ তাই বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে: (১) চট্টগ্রাম বন্দরে যাতে ভারত সরাসরি, ভিন্ন দেশ হবার কারণে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া, প্রবেশ ও ব্যবহার করতে পারে তার ব্যবস্থা হচ্ছে। (২) পারমাণবিক ব্যবস্থাপনায় ভারতের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা হচ্ছে। (৩) বঙ্গোপসাগরে ‘সমুদ্র অর্থনীতি’ বিকাশে ভারতের সাথে যৌথ ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কাজ চলছে। (৪) ট্রানজিটের বিষয়ে সকলদিকে অগ্রগতি হচ্ছে দ্রুত। (৫) মোদী সরকারের ঘনিষ্ঠ আদানি ও রিলায়েন্স গ্রুপ বিদ্যুত্ খাতে একাধিক প্রকল্পের অনুমোদন পাচ্ছে। নিয়মিত গ্যাস সরবরাহে বাধ্যবাধকতা এবং প্রায় তিনগুণ বেশি দামে বিদ্যুত্ ক্রয়ের ব্যবস্থা থাকছে তাতে। এসব চুক্তি হচ্ছে দায়মুক্তি আইন অনুযায়ী, কোনো স্বচ্ছ প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া ছাড়াই। (৬) বাংলাদেশের উপগ্রহ ব্যবস্থাপনায় ভারত যুক্ত থাকতে আগ্রহী বলে জানা গেছে। (৭) সুন্দরবনবিধ্বংসী যৌথ বিদ্যুত্ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে নেবার পাশাপাশি এই এলাকায়, প্রতিবাদী জনযাত্রা চলাকালীন সময়ে, ভারত বাংলাদেশের যৌথ সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে। (৮) একই এলাকায় ভারতের জন্য একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
গত মাসে সংবাদপত্রের রিপোর্ট জানিয়েছে, ‘পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পাদন ও পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে ভারতের সাথে পারমাণবিক সহায়তা চুক্তি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। গত ৬ জানুয়ারি ভারতের প্রস্তাবিত চুক্তির খসড়া নিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়।.. এগ্রিমেন্ট অব বাইলেটারাল কো-অপারেশন অন পিসফুল ইউজ অব নিউক্লিয়ার এনার্জি নামে এই চুক্তির খসড়ার ওপর বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মতামত নিচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। চুক্তির খসড়ায় ভারত ৪০ বছর মেয়াদি চুক্তি করতে প্রস্তাব করেছে। খসড়ায় মোট ১৩টি অনুচ্ছেদ রয়েছে।’ (মানবকণ্ঠ, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬)
এছাড়া সমুদ্রকে ঘিরে অর্থনীতিতে (ব্লু ইকোনোমি) সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের কর্মকর্তারা শিগগির আলোচনায় বসছেন। ২ ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লিতে সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক। গত বছরের ৭ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরের সময় দুই দেশ সমুদ্রকে ঘিরে অর্থনীতি ও সামুদ্রিক খাতে সহযোগিতার জন্য একটি সমঝোতা স্মারক সই করে। ওই সমঝোতা স্মারক বাস্তবায়নের জন্য দুই দেশের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। (প্রথম আলো, ৩ ফ্রেব্রুয়ারি, ২০১৬)
বাংলাদেশ শিগগিরই ভারতের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা ঋণ চুক্তি করতে যাচ্ছে। প্রথম ঋণ চুক্তির তুলনায় আরো কঠিন শর্তে গ্রহণ করা হচ্ছে এই ঋণ। এই পর্বে ঋণের পরিমাণ ২০০ কোটি ডলার। উল্লেখ্য যে, এর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকেরা প্রতি দেড় মাসে দেশে প্রেরণ করেন। এই ঋণের টাকায় ভারত থেকে ৫০০ ট্রাক ও ৫০০ বাস কেনা, ট্রানজিট রুটে অবকাঠামো উন্নয়নসহ ১৩টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। এই চুক্তির আওতায় বিভিন্ন নির্মাণ ও পণ্য ক্রয়ের শতকরা ৬৫ থেকে ৭৫ ভাগ কিনতে হবে ভারত থেকে। বিভিন্ন প্রকল্প পরামর্শকদের শতকরা ৭৫ ভাগ আসবেন ভারত থেকে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ভারতীয় ব্যক্তিদের কর ও ভ্যাট শোধ করবে বাংলাদেশ। বস্তুত বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণে ভারতের ট্রানজিট রুটই এখন সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। দেশের অন্য মহাসড়ক ও সড়কগুলোর দুর্দশা অব্যাহত আছে।
বলাবাহুল্য যে, ঋণ চুক্তির এই মডেল বহু পুরনো। ‘বিদেশি সাহায্য’ নামে এই ধরনের ঋণ দিয়েই বিশ্বের পশ্চিমা দেশগুলো প্রান্তিক দেশগুলোতে নিজেদের পণ্য বাজার তৈরি করেছে, নাগরিকদের কর্মসংস্থান করেছে, বৃহত্ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর বিনিয়োগের পথ তৈরি করেছে। বিশ্বব্যাংক আইএমএফ এডিবির মতো সংস্থাগুলো এই ঋণের ফাঁদে ফেলেই বহুজাতিক পুঁজির পথ প্রশস্ত করেছে। ভারতের বৃহত্ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী সেরকম পরাশক্তির ভাব নিয়েই অগ্রসর হচ্ছে এখন। চীন, যুক্তরাষ্ট্র কখনো প্রতিদ্বন্দ্বী কখনো একই পথে ঐক্যবদ্ধ। সম্প্রতি নেপাল বৃহত্ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের শক্তি প্রদর্শনের নমুনা দেখেছে, তাকে মোকাবিলাও করেছে।
যাইহোক খেয়াল করলে আমরা দেখবো, ভারতের জনগণও সেদেশের উন্নয়ন পথের শিকার। বৃহত্ পুঁজির আত্মসম্প্রসারণের তাগিদ পূরণে ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী তত্পরতার একটি বড় ক্ষেত্র এখন ভূমি। কৃষকের জমি কিংবা সাধারণ সম্পত্তি হিসেবে এখনো টিকে থাকা জমি উন্নয়নের নামে ব্যক্তিমালিকানায় অর্থাত্ বৃহত্ কর্পোরেট গ্রুপের হাতে তুলে নেবার জন্য আইন সংস্কার থেকে বল প্রয়োগ—সবই চলছে। ভারতে ২০০৫ সালে গৃহীত সেজ (স্পেসিয়াল ইকোনমিক জোন) অ্যাক্টের মাধ্যমে বৃহদায়তন কৃষি জমি খুব কম দামে বৃহত্ ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেবার আইনি ব্যবস্থা হয়। কর, শুল্ক ও বিধিমালা যতটা সম্ভব ছাড় দিয়ে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
কংগ্রেস আমলে এ বিষয়ক একটি বিল সংসদে পাস হয়েছিল। ২০১৫ সালে তার সংস্কার করে ভূমি দখল বা অধিগ্রহণকে আরো নিরাপদ করার চেষ্টা করা হয়েছে। আগে রুটিনমাফিক জনসম্মতি এবং সামাজিক অভিঘাত সমীক্ষা যা কিছু বিধান রাখা হয়েছিল, সেগুলোও তুলে নেয়া হয়েছে। এনিয়ে সারা ভারত জুড়ে একদিকে দখলদার বা অধিগ্রহণের সুবিধাভোগীদের উন্মাদনা, অন্যদিকে কৃষক গ্রামীণ মজুরদের আর্তনাদ, প্রতিবাদ ও সংঘাত চলছে।
ভারতে ‘জনস্বার্থে’ ভূমি অধিগ্রহণের নামে ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোর হাতে জমি তুলে দেয়ার নীতি ও কর্মসূচি বিষয়ে গবেষণা করে সমাজবিজ্ঞানী মাইকেল লেভিন দেখিয়েছেন, “রাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে বৃহত্ পুঁজিপতি গোষ্ঠীর জমির দালালে পরিণত হয়েছে”। কৃষকসহ গ্রামীণ মানুষদের উচ্ছেদ করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিলাসবহুল হোটেল, গলফ মাঠ, ক্যাসিনো, বহুতল আবাসিক ভবন, সুপারমার্কেট তৈরির মহাযজ্ঞ চলছে। গ্রামীণ বেকারত্ব বাড়ছে, তবে গ্রামীণ ধনীদের জমির মূল্যবৃদ্ধিতে লাভ হচ্ছে, গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
কৃষি, বন, নদী, পানি, শিক্ষা, চিকিত্সাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক-এডিবি সমর্থিত বিভিন্ন প্রকল্প সেদেশের জনগণের সম্পদ বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের আয়োজন করেছে। এসব প্রকল্প ভারতের মানুষকে ছাপিয়ে এখন প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের জন্য ফারাক্কা বাঁধ সব সময়ই একটি মরণফাঁদ, আর এর সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে গজলডোবাসহ আরো অনেক বাঁধ এবং আরো ভয়ংকর আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প। বাংলাদেশ অংশে তিস্তাসহ অনেক নদী এখন মরণাপন্ন। ব্রহ্মপুত্র নদীতে বাঁধ দেবার চীনা পরিকল্পনা ভারত ও বাংলাদেশ দুইদেশের জন্যই হুমকি হয়ে উঠেছে। সুন্দরবন ধ্বংস করে হলেও ভারতের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি এনটিপিসি তার বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বন, নদী, জমি দখল এখন এই অঞ্চলের উন্নয়নের প্রধান ভাষা।
নিজদেশে ভূমির ওপর ভারতের বড় ব্যবসায়ীদের এই আগ্রাসন এখন সীমান্ত অতিক্রম করতে ছটফট করছে। বাংলাদেশে দেশি বড় ব্যবসায়ী দখলদাররা ইতোমধ্যে নদী, বন, পাহাড়, জমি দখলে অনেক এগিয়ে। দুই দেশেই এক্ষেত্রে বহুজাতিক পুঁজি, বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠী, দেশি বৃহত্ ব্যবসায়ী, ভূমিদস্যু, আমলা, সন্ত্রাসী, কনসালট্যান্ট এবং সরকার—সবাই একাকার।
ভারতের বৃহত্ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোর জন্য বাংলাদেশকে নিজেদের পণ্যের বাজার, কর্মসংস্থান এবং অধিক মুনাফার বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসেবে নিশ্চিত করবার ব্যবস্থা দরকার। দেখা যাচ্ছে সেপথেই সাজানো হচ্ছে বাংলাদেশের উন্নয়ন পথ।
ভারতের সহযোগী উন্নয়ন পথ
[লেখাটি মার্চ ২৯, ২০১৬ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত]