ভারতের মূলা বাংলাদেশের সেবা

গত কয়েকবছর ধরেই আমরা শুনছি, ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে। লোডশেডিংএর মধ্যে এই খবরটা প্রচারিত হয় বেশি। এমনি এমনি আসা নয়। ভারতের এনার্জি রেগুলেটরী কমিশন নির্ধারিত দামে, নগদ অর্থে সবরকম শর্ত পালন শেষেই এই বিদ্যুৎ পাবার কথা। তারপরও এই লোডশেডিংএর মধ্যে এরকম খবর শোনার জন্যও মানুষ উন্মুখ হয়ে থাকে। এই খবর আরও জোর পায় যখন ভারত সরকারের কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি এই দেশ সফর করেন তখন। পত্রপত্রিকা টিভি সর্বত্রই এই খবর মানুষ মুগ্ধতার সঙ্গে দেখে, শোনে। সর্বশেষ খবর হলো, অবকাঠামো নির্মাণসহ আরও প্রস্তুতি কাজ বাকি আছে। সেজন্য শীগগিরই বিদ্যুৎ আসছে না। (www.samakal.net/2013/05/21/3716) কিন্তু এই বিদ্যুৎ বিক্রি ভারতের বদান্যতা হিসেবেই উপস্থাপিত হয়েছে বরাবর। এবং ভারতের চাহিদা মেটানোর কাজে নানা তৎপরতা অগ্রসর হয়েছে ঠিকই, সেখানে এরকম কোনো বিলম্ব দেখা যায়নি।

এরকম বহুবছর গেছে চাল আমদানি বিষয়ে। বাজার দরেই ভারত থেকে ৫ লাখ টন চাল আমদানি করবার চুক্তি ছিলো। ২০০৮ সালে যখন খাদ্য সংকট তীব্র হচ্ছে তখন ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী। ‘ভারতের চাল কেনো আসছে না’ সাংবাদিকদের এরকম প্রশ্নের উত্তরে টিভি ক্যামেরার সামনে তিনি বললেন, ‘আমরা তো দেশের মানুষকে না খাইয়ে আপনাদের চাল দিতে পারি না।’ প্রকৃতপক্ষে যে দামে চাল দেবার চুক্তি হয়েছিল আন্তর্জাতিক বাজারে দাম সেসময় উঠে গিয়েছিলো তার চাইতে অনেক বেশি। ভারতের পিছিয়ে আসার কারণ সেটাই।

বাংলাদেশে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে ভারতের বৃহৎ পুঁজির তৎপরতা বাড়ছে। এর মধ্যে হাজির হয়েছে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ব বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠান, ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানি বা এনটিপিসি। যে ভারতীয় এনটিপিসি বাংলাদেশের সুন্দরবন ধবংস করে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে চাইছে, সেই ‘ভারতেরই ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশান এ্যাক্ট ১৯৭২ অনুযায়ী, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১৫ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে কোন বাঘ-হাতি সংরক্ষণ অঞ্চল, জৈব বৈচিত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান, বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য কিংবা অন্য কোন ধরণের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা চলবে না’। এই কারণে ভারতে তাদের একটি প্রকল্প সরকার বাতিল করেছে। রামপালে, সুন্দরবনের ওপর, সেই ভারতীয় কোম্পানির কর্তৃত্বেই বিদ্যুৎ প্লান্ট হচ্ছে। ইআইএ বা পরিবেশ সমীক্ষা না করে এরকম কোনো প্রকল্প ভারতেও গ্রহণ করা হয় না। আর বাংলাদেশে ইআইএ না করেই প্রকল্প কাজ অগ্রসর করা হয়েছে, চুক্তি হয়েছে। পরে ইআইএ নিয়ে লোকদেখানো বিশেষজ্ঞ সংলাপ করা হয়েছে। লোকদেখানো বলছি এই কারণে যে, বিশেষজ্ঞরা সেই ইআইএ প্রত্যাখ্যান করবার পরের সপ্তাহেই ভারতের সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ।

এই চুক্তি অনুযায়ী, ভারতীয় কোম্পানির মুনাফা হবে অনেক উঁচু হারে, সেই মুনাফার ওপর বাংলাদেশ করও নেবে না বলে জানিয়েছে। অন্যদিকে, বিদ্যুতের দাম, ব্যয় নির্বাহ ইত্যাদি কারণে, বাংলাদেশের অনেক আর্থিক ক্ষতি হবে। কিন্তু তার চাইতেও বড় সর্বনাশ হবে বাংলাদেশের, যার কোনো ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয়। আমাদের একমাত্র সুন্দরবন বাংলাদেশের সর্বশেষ বন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে সফল প্রাকৃতিক রক্ষাবর্ম, জীববৈচিত্রের অসাধারণ আধার এবং বিশ্ব ঐতিহ্য। এই প্রকল্পের কারণে সেই সুন্দরবন ধ্বংস হবে! নিজেদের এই অতুলনীয় এবং অনবায়নযোগ্য সম্পদ ধ্বংস করে, মানুষের জীবন বিপন্ন করে, দেশি কিছু লুটেরার স্বার্থ রক্ষা আর ভারতীয় কোম্পানির মুনাফার ব্যবস্থা করতে বাংলাদেশ সরকার উদগ্রীব।

বাংলাদেশের সরকার ভরসা পাচ্ছেন কোথায়? ভরসা হল, ‘গায়েবী’ আশ্বাস! ভারতের সরকারের লোকজন বলেছেন, রামপাল বিদ্যুৎ প্লান্টে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। খুলনা ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটো বিশেষজ্ঞদলসহ বহু বিশেষজ্ঞ হুশিয়ারি দিচ্ছেন, কিন্তু তাতে কোনো কর্ণপাত নাই। টিপাইমুখ নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না। বাংলাদেশের ক’জন সংসদ সদস্য আর সরকারি প্রতিনিধি হেলিকপ্টারে করে ওপর থেকে বর্তমান টিপাইমুখ স্থল দেখে নিশ্চিত হয়েছেন, কোনো ক্ষতি হবে না! বাংলাদেশ ও ভারতের বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন, এতে বাংলাদেশের নদী প্রবাহে ভয়াবহ সংকট তৈরি হবে। তাদের কথা শোনার কেউ নেই।

তিস্তাসহ সকল অভিন্ন নদীর ওপর বাংলাদেশের অধিকার ভারত যে স্বীকার করে তার প্রমাণ কখনো পাওয়া যায়নি। এসব বিষয় ফয়সালা না করে ভারত বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আন্তনদী সংযোগ পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তিস্তা নদী নিয়ে চুক্তিও আরেকটি মূলা। রাষ্ট্রপতিসহ কতজন এলেন, প্রতিশ্রুতি দিলেন, কিন্তু কিছু হল না। আর চুক্তি হলেই তো হল না, চুক্তির বিষয়বস্তু আর তার বাস্তবায়ন ধরণই শেষ পর্যন্ত নির্ধারক। ফারাক্কা নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা তিক্ত। এর ক্ষতি পরিমাপ করা কঠিন।

সীমান্ত হত্যাকান্ড নিয়ে গত কয়েকবছরে আমরা বহুবার কথাবার্তা বৈঠকের কথা শুনলাম, সবাই নিশ্চিন্ত হবার প্রস্তুতি নিতে নিতেই আবার হত্যাকান্ড। কখনোই এই হত্যা থামে নাই। কাঁটাতার দিয়ে বাংলাদেশকে ঘিরে ফেলার কাজও থামেনি কখনো। এজন্য ভারত খরচ করছে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার। এখন মানবিক কারণে বাংলাদেশ ভারতকে খাদ্যশস্য পরিবহণে আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার করে ট্রানজিট সুবিধা দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ‘এই সুবিধার আওতায় আগামী মাস থেকেই ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় খাদ্য সরবরাহ করবে। এর মধ্যে পণ্য পরিবহনের জন্য দরপত্র আহবান করেছে এফসিআই।’ (www.bonikbarta.com/first-page/2013/05/26/1614)

ভারত এর এককণা ‘মানবিকতা’ বাংলাদেশকে দেখালে সীমান্তে কদিন পরপর হত্যাকান্ড দেখা যেতো না। একের পর এক নদীর তথা অসংখ্য প্রাণবিপর্যয়ের ঘটনা কমতো। আসলে দুই রাষ্ট্রের সম্পর্ক বা সিদ্ধান্ত মানবতা দিয়ে হয় না। ভারতকে ট্রানজিট দেবার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বহুদিক থেকে কাজ চলছে। এটি তারই অংশ। ট্রানজিট নিয়ে সবকিছুই অস্বচ্ছ। যদিও যে দেশের সন্ত্রাসীদের ভয়ে ভারত বিপুল অর্থব্যয়ে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরাও করছে সেই দেশের ভেতরে একমাথা থেকে আরেকমাথা পার হতে নিরাপত্তা কে দেবে সে প্রশ্নের উত্তর এখনও জানা যায়নি।

কয়েকবছর আগে থেকেই আমরা শুনে আসছি ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ লাভবান হবে। কিন্তু কীভাবে লাভবান হবে তার কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এমনকি সরল বিবৃতিও সরকার থেকে এখনও পাওয়া যায়নি। কিন্তু রেলপথ, সড়কসহ নানাকাজ হয়ে যাচ্ছে। ভারত থেকে কঠিন শর্তে ১০০ কোটি ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে প্রধানত ট্রানজিটের অবকাঠামো তৈরির জন্য। আর সেই কাজ করবার জন্য আবার ভারত থেকেই পরিবহণ ও যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ বেশি দামে।

সম্ভবত এরই অংশ হিসেবে ‘সরকারের অগোচরে নারায়ণগঞ্জে অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারত সরকার। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের ৪৪ একর জমি নির্ধারণ করা হয়েছে এর স্থাপনস্থল। এরই মধ্যে দেশটির বিদেশ মন্ত্রণালয় কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণে কারিগরি ও বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য দরপত্রও আহবান করেছে।…তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়, সমুদ্র পরিবহণ অধিদফতর (ডিজি শিপিং) ও বিনিয়োগ বোর্ডের অনুমোদন নেয়নি ভারত সরকার।..জানা গেছে, কয়েক বছর আগে নারায়ণগঞ্জে কনটেইনার টার্মিনাল তৈরির পরিকল্পনা করে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট।.. চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের পাশাপাশি ভারতীয় আমদানি-রফতানিকৃত পণ্য লোড-আনলোডে নারায়ণগঞ্জ কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপনই এর প্রধান উদ্দেশ্য।..’

২৮ মে ২০১৩ তে বাসস পরিবেশিত সংবাদে বলা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জে এরকম কোনো টার্মিনালের জন্য বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় সরকার বা কোনো ব্যক্তি বা কোনো সংগঠনকে অনুমতি দেয়নি। কীভাবে সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানকে না জানিয়ে, যথাযথ অনুমতি না নিয়ে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দরপত্র আহবান করছে সেটা ব্যাখ্যার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু এতটুকু বোঝা যাচ্ছে যে, কোনো না কোনোভাবে নিশ্চিত না হয়ে তারা এতদূর অগ্রসর হয়নি।

সেবা দেবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো ঘাটতি আসলে কখনোই দেখা যায়নি। তিতাস নদীর প্রবাহ বন্ধ করে আড়াঅড়ি রাস্তা বানিয়ে ভারতের ভারী মালপত্র পরিবহণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর তুলনীয় দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই। তখনও বিদ্যুতের কথা বলা হয়েছিলো।

গাধা ও চতুর ব্যবসায়ীর গল্প আমরা জানি। চতুর ব্যবসায়ী সেবাদানে পরিশ্রমী গাধার পিঠে চড়ে তাকে ইচ্ছামতো চালানোর জন্য একটা বাঁশের আগায়, গাধার খাদ্য, মূলা ঝুলিয়ে রেখেছিলো। মূলা যেদিকে যায়, গাধাও সেদিকে যায়। এভাবে চতুর লোক তার যেদিকে দরকার সেদিকে নিয়ে যাচ্ছে গাধাকে। পরিশ্রম করে সেবা দিয়ে মরে যাচ্ছে গাধা, কিন্তু মূলা আর জুটছে না। কেউ যদি গাধার ভূমিকায় নিজেকে স্থাপন করে, তার পক্ষে হয়তো এটা বোঝাই কঠিন যে, মূলার সঙ্গে তার দূরত্ব কখনো কমবে না।।

(মে ২৯,২০১৩ তারিখে আমাদের বুধবার এ প্রকাশিত)