ভারতের কারা আমাদের বন্ধু

বাংলাদেশের অর্থনীতি-রাজনীতির গতিমুখ নির্ধারণে এখন ভারতের ভূমিকা, তার রাজনীতি এবং অর্থনীতির অগ্রাধিকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা নির্ধারকও। এতটা গুরুত্ব থাকলেও ভারত নিয়ে বাংলাদেশে নির্মোহ আলোচনা-বিশ্লেষণ করা খুবই কঠিন। নানারকম বিধিনিষেধ ছাড়াও সমাজে বিদ্যমান প্রধান দুটি চিন্তার ধারা ভারত নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার পথে বাধা সৃষ্টি করে। একদল ভারতকে সময়-শাসক-দল-মতাদর্শ-নির্বিশেষে ‘বন্ধু’ বিবেচনা করে, অন্য দল ভারতকে সময়-শাসক-দল-মতাদর্শ-নির্বিশেষে ‘শত্রু’ বিবেচনা করে। এ দুই দলই যুক্তিতর্কের বাইরে এক কঠিন দেয়ালে নিজেদের চিন্তা আটকে রাখে। বস্তুত ‘বন্ধু ভারত’ কিংবা ‘শত্রু ভারত’ এ রকম পরিচয় কোনো অর্থ বহন করে না। কেননা, ভারত কোনো একক সমসত্ত্ববিশিষ্ট জনগোষ্ঠীর দেশ নয়। ভারতের ভেতরে বহুজাতি-বহু ধর্মের বাস, বিভিন্ন শ্রেণি ও বর্ণে বিভক্ত অধিকাংশ মানুষ বৈষম্যপীড়িত। রাষ্ট্র ও শাসকশ্রেণির নানা নীতি ও ভূমিকার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ-লড়াই সে দেশেরই বহু অঞ্চলে বহুভাবে চলছে, কোথাও কোথাও সশস্ত্র লড়াইও চলছে বহু দশক ধরে। কেউ যদি ভারতের শ্রেণিগত, জাতিগত, ধর্মীয়, আঞ্চলিক নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাহলে তাকে ভারত রাষ্ট্রের সমালোচনামূলক অবস্থান গ্রহণ করতেই হবে, তা সে ভারত বা অন্য দেশের অধিবাসী যে-ই হোক না কেন।

ভারত সম্পর্কে যেকোনো সমালোচনা বা পর্যালোচনামূলক বক্তব্যের বিরোধিতাকারী গোষ্ঠীর বক্তব্য হচ্ছে ভারত হচ্ছে বন্ধুরাষ্ট্র, তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, তারা কখনোই বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে পারে না। ‘তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা মানে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা’ এ রকম কথা বলার মানুষও এদের মধ্যে পাওয়া যায়। ভারত রাষ্ট্রের ভূমিকার সমালোচনা করলে এদেরই একটি শক্তিশালী অংশ তাকে ‘সাম্প্রদায়িক বক্তব্য’ বলেও অভিহিত করে। কেন তা হবে? ভারত কি হিন্দুরাষ্ট্র তবে? এই ধারার বক্তব্য শেষ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে মিলে যায়, যারা ভারতকে দেখে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে। যাদের মতে বাংলাদেশে ভারতের কোনো জনবিরোধী আধিপত্যবাদী তৎপরতা আসলে মুসলমানের বিরুদ্ধে হিন্দুর আক্রমণ। খুবই ভুল ধারণা।

ভারতে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মীয় পরিচয়ে হিন্দু ঠিক কিন্তু তার মধ্যে বহু জাতপাত, বিভেদ, বৈষম্যÑ লড়াই আছে। ভারত যদি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হতো এবং রাষ্ট্রের চরিত্র বর্তমানের মতো হতো, তাহলেও বাংলাদেশের সঙ্গে বর্তমান সমস্যাগুলো থাকত। বাংলাদেশ হিন্দু রাষ্ট্র হলে কি সমস্যা থাকত না? তাহলে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ নেপালের সঙ্গে ভারতের সমস্যা হচ্ছে কেন? কেন ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘হিন্দু’ মানুষ ভয়াবহ দারিদ্র্য ও বঞ্চনার শিকার? আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী এই দুই পক্ষের আলোচনার ধরনে তাই মূল প্রশ্নগুলো আড়াল হয়ে যায়।

এ রকম অবস্থানের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় ভারতের মূলধারার মিডিয়ারও। এসব মিডিয়ায় বাংলাদেশের ভেতর ভারতবিরোধী ক্ষোভকে ‘সাম্প্রদায়িক’ ও ‘মৌলবাদী’ মুসলিমসমাজের চিন্তার রোগ হিসেবেই চিত্রিত করার চেষ্টা দেখা যায়। এর প্রতিধ্বনি বাংলাদেশ থেকেও শোনা যায়। কিন্তু ভারত নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভ বায়বীয় নয়, বাধা দিলে বা শুনতে না চাইলেই এগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে না, এগুলোকে সাম্প্রদায়িক রং দেওয়ার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হবে না। এসব ক্ষোভ ও উদ্বেগের পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। বাংলাদেশ ঘিরে ভারতের কাঁটাতার, ফারাক্কার জন্য ক্ষতি, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর প্রবাহে বাধাদান, সীমান্ত হত্যা, ভারতে বাংলাদেশের পণ্যপ্রবাহে অযৌক্তিক সমস্যা সৃষ্টি, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগে প্রতিবন্ধকতা এবং সর্বশেষ সুন্দরবনধ্বংসী রামপাল প্রকল্প তার অন্যতম।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের ভূমিকা ভোলার কোনো সুযোগ নেই আমাদের। তখন বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক ভয়ংকর দানবীয় আক্রমণের মধ্যে পতিত হয়েছিল। সে সময় ভারত ছিল বাংলাদেশের মানুষের জন্য বড় ভরসা। ভারতেই মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল। অবশ্য সেই সরকার পরিচালনা খুব সহজ ছিল না। ভারত রাষ্ট্রের অনেক হিসাব-নিকাশের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে ওই সরকার অনেক ধরনের জটিলতায় পড়েছিল। রাষ্ট্রের এসব হিসাব-নিকাশের জন্য অপেক্ষায় না থেকে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি শরণার্থীর পাশে ভারতের মানুষ, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়সহ বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ যেভাবে নিঃস্বার্থভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তা অবশ্যই অবিস্মরণীয় ঘটনা। আমরা সব সময়ই তাদের সেই অবদান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করব।

মুক্তিযুদ্ধের বছরে ভারতে ছিল ইন্দিরা গান্ধী নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার। এই সরকার তখন দেশের ভেতর, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে বিপ্লবী বাম ধারার সঙ্গে যুদ্ধরত। এর কয়েক বছর আগে চারু মজুমদারের নেতৃত্বে নকশালী সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষিত তরুণরা দলে দলে এই আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে তখন। কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গ তখন যুদ্ধক্ষেত্র, ভারতের সরকার বনাম জনপ্রিয় সশস্ত্র অভ্যুত্থান। এই রাজ্যের কংগ্রেস সরকার এই আন্দোলন দমন করতে গিয়ে তখন এক নিষ্ঠুর অধ্যায় তৈরি করেছিল। জেল-জুলুম তো ছিলই, বিচারবহিভূত হত্যা, গুম ইত্যাদি ভয়ংকর মাত্রা নিয়েছিল। সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইন্দিরা গান্ধী সরকারের জন্য বড় এক নিস্তার ছিল।

যারা এখন ভারত রাষ্ট্রের ক্ষমতায়, মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার অজুহাতে তাদের মহিমা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ ১৯৭১ সালে বিজেপি বলে ভারতে কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। ২০১৪ সালে একচেটিয়াভাবে এবং ২০১৯ সালে আরও একচেটিয়াভাবে বিজয়ের মধ্য দিয়ে তারা এখন ভারতের একক কর্র্তৃত্বে। এই দলের ভিত্তি যারা তৈরি করেছে, সেই রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন সবগুলোই ঘোরতর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে ভরপুর এবং ধর্মান্ধ হিসেবে পরিচিত। ১৯৫১ সালে চরম সাম্প্রদায়িক নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনসংঘই বিজেপির আদি সংগঠন। ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারির পর আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে জনসংঘ এক হয়ে গঠন করে জনতা পার্টি। ১৯৭৭ সালে তারা ক্ষমতাসীন হয়। তিন বছর পর জনসংঘ ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি গঠন করে। ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে তারা মাত্র দুটি আসন লাভ করে। এরপর ক্রমাগত হিন্দুত্ববাদী প্রচারণা, সাম্প্রদায়িক উসকানিসহ রাম জন্মভূমি আন্দোলন থেকেই তার বিস্তার। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙা এই আন্দোলনের অংশ।

রাজ্য ও কেন্দ্রপর্যায়ে বেশ কয়েকবার ওঠানামার পর ১৯৯৮ সালে মোর্চার মাধ্যমে বিজেপি ক্ষমতাসীন হয়। অটল বিহারি বাজপেয়ি তখন প্রধানমন্ত্রী হন। ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’ প্রচারণায় ভারতের বৃহৎ পুঁজির আস্থা অর্জনের মতো কর্মসূচি নেয় বিজেপি। ২০০২ সালে গুজরাটে নৃশংস সাম্প্রদায়িক গণহত্যার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ব্যাপক কুখ্যাতি লাভ করেন গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী, কিশোর বয়স থেকে উগ্র সন্ত্রাসী আরএসএসের একনিষ্ঠ কর্মী, নরেন্দ্র মোদি। সাম্প্রদায়িক ভাবজমিনে সেটাই হয়তো মোদির শক্তিমত্তার প্রদর্শন হিসেবে স্বীকৃত হয়। গুজরাটে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ‘নয়া উদারতাবাদী’ বা পুঁজিমুখী মডেলে দৃঢ় অবস্থান মোদিকে ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিদের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য গড়ে তোলে। এই মডেলের প্রবক্তা কংগ্রেসের মনমোহন সিং হলেও এর বাস্তবায়নে আগ্রাসী ভূমিকা গ্রহণের কারণে মোদিকেই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করে তুলতে থাকে করপোরেট মিডিয়া। একসময়কার মহাঘৃণিত ব্যক্তি হয়ে ওঠেন ভারতত্রাতা, পুঁজির স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রও তার সমর্থনে মাথা নিচু করে। কংগ্রেস ও বিজেপি শ্রেণিগতভাবে এবং উন্নয়ন দর্শনের দিক থেকে অভিন্ন অবস্থানে থাকলেও সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়ে তাদের পার্থক্যও আছে। ভারতজুড়ে শিক্ষা পাঠ্যক্রম এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাম্প্রদায়িকীকরণ, সন্ত্রাসী বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতা এবং সেই সঙ্গে পুঁজিমুখী আগ্রাসী ভূমিকায় বিজেপির একচেটিয়া শাসন ভারতের জনগণের জন্য এক মহাবিপর্যয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তার যুক্তি তুলে এই শাসনকে মহান করে তোলার যুক্তি কী? কী করে তা ভারতের মানুষের প্রতি বন্ধুত্বের নিদর্শন হতে পারে?

দুই সরকারের পক্ষ থেকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যখন আরও উচ্চতায় নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তখন সংবাদপত্রের খবরে দেখা গেল আগরতলায় বিমানবন্দর সম্প্রসারণের জন্য ভারত জমি চাচ্ছে বাংলাদেশের কাছে (India wants Bangladesh land for Agartala airport expansion, New Age, 1 August, 2019)। বৃহৎ রাষ্ট্রের জমি কেন এ রকমভাবে কম পড়ে গেল, সেই প্রশ্ন কাকে করা যাবে জানি না। তবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের কথা থেকে মনে হচ্ছে, তারা আগে থেকেই রাজি হয়ে আছেন! সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এটা মনে রাখা যে, বন্ধুত্ব আর অধস্তনতা এক কথা নয়।

(২৭ আগস্ট ২০১৯ তারিখে দৈনিক দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত)