‘কাঁটাতারে ঘেরা কেন, বন্ধু ভারত যদি বন হত মানুষ হত আরও হত নদী?’
বারবার জিজ্ঞাসা করেও এ সহজ প্রশ্নটির উত্তর আমরা এখনো পাচ্ছি না। উত্তর না পেলেও কাজ কিন্তু থেমে নেই।
১৫ মে ২০১৬ থেকে ‘ট্রানজিট’ নামে ভারতের পণ্যসামগ্রী বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে আবার ভারতেই নেয়ার আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা শুরু হয়েছে। পৃথিবীতে এ রকম দৃষ্টান্ত পাওয়া কঠিন হলেও এর আগে বাংলাদেশ অনেকবার ‘শুভেচ্ছাস্বরূপ’, ‘মানবিক’ কারণে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের অনুমতি দিয়েছে। তিতাস নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়েও ভারতের বিদ্যুৎ সরঞ্জাম নিতে দিয়েছে। এবারে শুরু হলো শুল্ক বা মাশুলের মাধ্যমে। বিশেষজ্ঞ কমিটি এর হার নির্ধারণ করেছিল টনপ্রতি ১ হাজার ৫৮ টাকা। ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পণ্য পরিবহন করলে প্রকৃতপক্ষে তার খরচ কমবে শতকরা ৫০ থেকে ৭৫ ভাগ। এ খরচ কমিয়ে যে পরিমাণ লাভ হবে তাদের সে তুলনায় টনপ্রতি ১ হাজার ৫৮ টাকা অনেক কমই ছিল। তবে সরকার তা গ্রহণ করেনি, চূড়ান্তভাবে এ হার নির্ধারিত হয়েছে এর শতকরা ২০ ভাগেরও কম, টনপ্রতি ১৯৮ টাকা। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান চেয়েছিলেন বিনা ফিতে এসব পণ্য যেতে দিতে, তাঁর ভাষায় এ রকম মাশুল চাওয়া অসভ্যতা! তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রানজিট উদ্বোধন অনুষ্ঠানেও ছিলেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতি, উন্নয়ন পথ নির্ধারণে ভারতের সঙ্গে যেসব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হচ্ছে, তার অনেক কিছুই প্রকাশ্য আলোচনায় আসেনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: (১) চট্টগ্রাম বন্দরে যাতে ভারত সরাসরি, ভিন্ন দেশ হওয়ার কারণে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া, প্রবেশ ও ব্যবহার করতে পারে তার আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা। (২) পারমাণবিক ব্যবস্থাপনায় ভারতের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করার আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। (৩) বঙ্গোপসাগরে ‘সমুদ্র অর্থনীতি’ বিকাশে ভারতের সঙ্গে যৌথ ব্যবস্থাপনা। (৪) মোদি সরকারের ঘনিষ্ঠ আদানি ও রিলায়েন্স গ্রুপ বিদ্যুৎ খাতে একাধিক প্রকল্পের অনুমোদন পাচ্ছে। নিয়মিত গ্যাস সরবরাহে বাধ্যবাধকতা এবং প্রায় তিন গুণ বেশি দামে বিদ্যুৎ ক্রয়ের ব্যবস্থা থাকছে তাতে। এসব চুক্তি হচ্ছে দায়মুক্তি আইন অনুযায়ী, কোনো স্বচ্ছ প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া ছাড়াই। (৫) বাংলাদেশের উপগ্রহ ব্যবস্থাপনায় ভারতকে যুক্ত রাখার ব্যবস্থা। এছাড়া (৬) সুন্দরবন প্রান্তের সমুদ্র এলাকায় ভারত বাংলাদেশের যৌথ সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটি হয়েছে গত মার্চে, যখন সুন্দরবনবিধ্বংসী রামপাল যৌথ বিদ্যুেকন্দ্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী লংমার্চ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। (৭) একই এলাকায় ভারতের জন্য একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে সংবাদপত্রের রিপোর্ট জানিয়েছে, ‘পারমাণবিক বিদ্যুৎ উত্পাদন ও পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে ভারতের সঙ্গে পারমাণবিক সহায়তা চুক্তি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। …গত ৬ জানুয়ারি ভারতের প্রস্তাবিত চুক্তির খসড়া নিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়।… এগ্রিমেন্ট অব বাইলেটারাল কো-অপারেশন অন পিসফুল ইউজ অব নিউক্লিয়ার এনার্জি নামে এ চুক্তির খসড়ার ওপর বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মতামত নিচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।… চুক্তির খসড়ায় ভারত ৪০ বছর মেয়াদি চুক্তি করতে প্রস্তাব করেছে। খসড়ায় মোট ১৩টি অনুচ্ছেদ রয়েছে।’ (মানবকণ্ঠ, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬)
এছাড়া সমুদ্র ঘিরে অর্থনীতিতে (ব্লু ইকোনমি) সহযোগিতার জন্যও বাংলাদেশ ও ভারতের কর্মকর্তারা শিগগির আলোচনায় বসছেন। গত বছরের ৭ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় দুই দেশ সমুদ্র ঘিরে অর্থনীতি ও সামুদ্রিক খাতে সহযোগিতার জন্য একটি সমঝোতা স্মারক সই করে। ওই সমঝোতা স্মারক বাস্তবায়নের জন্য দুই দেশের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। (প্রথম আলো, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬)
ভারতের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা ঋণচুক্তিতে প্রথম ঋণচুক্তির তুলনায় আরো কঠিন শর্তে গ্রহণ করা হচ্ছে ঋণ। এ পর্বে ঋণের পরিমাণ ২০০ কোটি ডলার। উল্লেখ্য, এর সমপরিমাণ বিদেশী মুদ্রা বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকরা প্রতি দেড় মাসে দেশে প্রেরণ করেন। এ ঋণের টাকায় ভারত থেকে ৫০০ ট্রাক ও ৫০০ বাস কেনা, ট্রানজিট রুটে অবকাঠামো উন্নয়নসহ ১৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। এ চুক্তির আওতায় বিভিন্ন নির্মাণ ও পণ্য ক্রয়ের শতকরা ৬৫ থেকে ৭৫ ভাগ কিনতে হবে ভারত থেকে। বিভিন্ন প্রকল্প পরামর্শকদের শতকরা ৭৫ ভাগ আসবেন ভারত থেকে। প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট ভারতীয় ব্যক্তিদের কর ও ভ্যাট পরিশোধ করবে বাংলাদেশ। বস্তুত বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণে ভারতের ট্রানজিট রুটই এখন সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। দেশের অন্য মহাসড়ক ও সড়কগুলোর দুর্দশা অব্যাহত আছে।
বলা বাহুল্য, ঋণচুক্তির এ মডেল বহু পুরনো। ‘বিদেশী সাহায্য’ নামে এ ধরনের ঋণ দিয়েই বিশ্বের পশ্চিমা দেশগুলো প্রান্তিক দেশগুলোয় নিজেদের পণ্যবাজার তৈরি করেছে, নাগরিকদের কর্মসংস্থান করেছে, বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর বিনিয়োগের পথ তৈরি করেছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির মতো সংস্থাগুলো এ ঋণের ফাঁদে ফেলেই বহুজাতিক পুঁজির পথ প্রশস্ত করেছে। ভারতের বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী সে রকম পরাশক্তির ভাব নিয়েই অগ্রসর হচ্ছে এখন। চীন, যুক্তরাষ্ট্র কখনো প্রতিদ্বন্দ্বী, কখনো একই পথে ঐক্যবদ্ধ। সম্প্রতি নেপাল বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের শক্তি প্রদর্শনের নমুনা দেখেছে, তাকে মোকাবেলাও করেছে।
যা-ই হোক খেয়াল করলে আমরা দেখব, ভারতের জনগণও সে দেশের বিদ্যমান উন্নয়ন পথের শিকার। বৃহৎ পুঁজির আত্মসম্প্রসারণের তাগিদ পূরণে ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী তত্পরতার একটি বড় ক্ষেত্র এখন ভূমি। কৃষকের জমি কিংবা সাধারণ সম্পত্তি হিসেবে এখনো টিকে থাকা জমি উন্নয়নের নামে ব্যক্তিমালিকানায় অর্থাৎ বৃহৎ করপোরেট গ্রুপের হাতে তুলে দেয়ার জন্য আইন সংস্কার থেকে বল প্রয়োগ— সবই চলছে। ভারতে ২০০৫ সালে গৃহীত সেজ (স্পেশাল ইকোনমিক জোন) অ্যাক্টের মাধ্যমে বৃহদায়তন কৃষিজমি খুব কম দামে বৃহৎ ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেয়ার আইনি ব্যবস্থা হয়। কর, শুল্ক ও বিধিমালা যতটা সম্ভব ছাড় দিয়ে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
ভারতে ‘জনস্বার্থে’ ভূমি অধিগ্রহণের নামে ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোর হাতে জমি তুলে দেয়ার নীতি ও কর্মসূচি বিষয়ে গবেষণা করে সমাজবিজ্ঞানী মাইকেল লেভিন দেখিয়েছেন, ‘রাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে বৃহৎ পুঁজিপতি গোষ্ঠীর জমির দালালে পরিণত হয়েছে’। কৃষকসহ গ্রামীণ মানুষকে উচ্ছেদ করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিলাসবহুল হোটেল, গলফ মাঠ, ক্যাসিনো, বহুতল আবাসিক ভবন, সুপারমার্কেট তৈরির মহাযজ্ঞ চলছে। গ্রামীণ বেকারত্ব বাড়ছে, তবে গ্রামীণ ধনীদের জমির মূল্যবৃদ্ধিতে লাভ হচ্ছে, গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশও অনুরূপ পথে অগ্রসর হচ্ছে, এখানে ভারতের ব্যবসায়ীরাও যুক্ত আছেন।
কৃষি, বন, নদী, পানি, শিক্ষা, চিকিত্সাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক-এডিবি সমর্থিত বিভিন্ন প্রকল্প ভারতের জনগণের সম্পদ বেসরকারীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের আয়োজন করেছে। এসব প্রকল্প ভারতের মানুষকে ছাপিয়ে এখন প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের জন্য ফারাক্কা বাঁধ সবসময়ই একটি মরণফাঁদ, আর এর সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে গজলডোবাসহ আরো অনেক বাঁধ এবং আরো ভয়ঙ্কর আন্তঃ নদী সংযোগ প্রকল্প। বাংলাদেশ অংশে তিস্তাসহ অনেক নদী এখন মরণাপন্ন। ব্রহ্মপুত্র নদীতে বাঁধ দেয়ার চীনা পরিকল্পনা ভারত ও বাংলাদেশ দুদেশের জন্যই হুমকি হয়ে উঠেছে। সুন্দরবন ধ্বংস করে হলেও ভারতের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি এনটিপিসি তার বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বন, নদী, জমি দখল এখন এ অঞ্চলের উন্নয়নের প্রধান ভাষা।
ভারতের এনটিপিসি পরিচালিত সুন্দরবনবিধ্বংসী রামপাল প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ সরকার আবার অনেক রকম ছাড়ও দিচ্ছে। ২০১৩ সালের ১ জুলাই ঘোষিত বাংলাদেশ সরকারের এসআরও অনুযায়ী কোম্পানি ১৫ বছরের জন্য আয়কর মওকুফ পাবে, এখানে কর্মরত বিদেশী ব্যক্তিবর্গের আয়কর দিতে হবে না কমপক্ষে তিন বছর, বৈদেশিক ঋণের সুদের ওপর কর প্রযোজ্য হবে না, প্রকল্প নির্মাণে নির্বাচিত ভারতীয় হেভি ইলেকট্রিক কোম্পানির যন্ত্রপাতি আমদানিতেও কোনো শুল্ক দিতে হবে না।
সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে ভারত বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী থাকবে। এটি কথার কথা নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি-রাজনীতির গতিমুখ নির্ধারণে ভারতের ভূমিকা, রাজনীতি ও অর্থনীতির গতি তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ; কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্ধারক। কাঁটাতার দিয়ে ঘেরাও হয়ে থাকলেও বাংলাদেশে ভারতের পণ্য আমদানি, নিয়োগ ও বিনিয়োগ বাড়ছে। বাংলাদেশ এখন ভারতের পঞ্চম বৃহত্তম প্রবাসী আয়ের উত্স। বাংলাদেশ থেকে ভারতের নাগরিকরা বছরে এখন প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা দেশে প্রেরণ করে থাকেন। সর্বশেষ ট্রানজিটের মধ্য দিয়ে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ভৌগোলিক অর্থনৈতিক মানচিত্র পরিবর্তিত হওয়ার পথে।
ভারতের বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোর জন্য বাংলাদেশকে নিজেদের পণ্যের বাজার, কর্মসংস্থান এবং অধিক মুনাফার বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসেবে নিশ্চিত করার ব্যবস্থা দরকার। দরকার বাংলাদেশের কৌশলগত সব ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ। দেখা যাচ্ছে, সেপথেই সাজানো হচ্ছে বাংলাদেশের উন্নয়ন পথ। নিরাপত্তার নামে উন্নয়নের নামে বাংলাদেশ তাই দ্রুত পরিণত হচ্ছে ভারতের বৃহৎ পুঁজির অগ্রযাত্রার অধীনস্ত প্রান্তে। ‘ট্রানজিট’ যাত্রা এ পথে এক বড় ধাপ।
[লেখাটি ২১ জুন ২০১৬ তারিখে বণিকবার্তায় প্রকাশিত]