[অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক। দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি করছেন। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বাজেটে প্রস্তাবিত মূসক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনের গ্রেড অবনমন, কানেকটিভিটি চুক্তি, বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে কথা বলেছেন দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শানজিদ অর্ণব]
প্রশ্ন : ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ওপর ১০ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাবকে কীভাবে দেখছেন?
আনু মুহাম্মদ : এমনিতে বাজেটে শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতের প্রতি একটি বৈরী ভাব আছে। শিক্ষা এবং চিকিৎসা খাত হচ্ছে জনগণের মৌলিক অধিকারের অংশ। এ খাতে সরকারের ভূমিকাই প্রধান- এ যে উপলব্ধি তা সরকারের মধ্যে নেই, সেটা স্পষ্ট। এ দুইটি খাতকে ক্রমান্বয়ে বাণিজ্যিকীকরণ করা এবং মুনাফামুখী খাতে পরিণত করার যে নীতিমালা কয়েক দশক ধরে চলছে সেটারই একটি প্রতিফলন আমরা বাজেটের মধ্যে পাই। যে কারণে শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দের অনুপাত কমে গেছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বরাদ্দটাও নেই। পাশাপাশি এ খাতগুলোকে বাণিজ্যিক খাত হিসেবে বিবেচনার উদ্যোগও আছে। বেসরকারি খাতটা তো সরকারের নীতিমালার কারণেই এসেছে। শিক্ষার মধ্যে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের যে আধিক্য সেটা শিক্ষা-সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন। এটা ঠিক যে বেসরকারি শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো অতি উচ্চ মুনাফা খাতে পরিণত হচ্ছে। সুতরাং এ মুনাফা খাতগুলোতে সরকার কর বসাতে চাইতে পারে। কিন্তু শিক্ষা এবং চিকিৎসা কেন মুনাফামুখী হবে, সেটা তো একটি মৌলিক প্রশ্ন। সে আলোচনাটা যদি আমরা এখানে স্থগিতও রাখি, তাহলেও দেখা যায়, সরকার এ মুনাফার ওপর কর বসাচ্ছে না। সরকার এমনভাবে কর বসাচ্ছে যাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একটি সাধারণ ধারণা আছে যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে আসে এবং তাদের আর্থিক ক্ষমতা বেশি, এ ধারণাটা আসলে ঠিক না। পাবলিক বা সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভর্তি ক্ষমতা যথেষ্ট না হওয়ায় মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত অনেক পরিবারের শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে। যারা ঋণ করে, জমি বিক্রি করে বেতন-ফি পরিশোধ করে, এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে। বেতন ফি কত হবে, সে বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে কোনো নীতিমালা বা তদারকি নেই। সরকারের এ কর সীমিত আয়ের পরিবারের শিক্ষার্থীদের ওপর একটি বড় বোঝা তৈরি করবে।
প্রশ্ন : অষ্টম পে-স্কেলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো কয়েক ধাপ অবনমন করা হয়েছে। এ নিয়ে আমরা শিক্ষকদের প্রতিবাদও দেখছি। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আনু মুহাম্মদ : শিক্ষকদের বেতন কমে যায়নি, সামাজিক অবস্থান নিচে নেমে গেছে। সামরিক জেনারেল, সচিব এদের তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অবস্থান নিচে নামিয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে তাদের বেতন স্কেল নিচে চলে গেছে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি দায়িত্বশীল এবং যোগ্য লোকজন শিক্ষক করতে হয় সেজন্য একদিকে দরকার তাদের আকর্ষণ করার মতো যুক্তিযুক্ত বেতন স্কেল করা, একইসঙ্গে তাদের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করা। এ দুইটি বিষয়কে সমন্বয় করে সামগ্রিক একটা কাঠামো পুনর্বিন্যাস দরকার। আর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চেয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের সমাজিক অবস্থান বা পেশাগত অবস্থান সরকারের দৃষ্টিতে উঁচু হলেও তাদের অবস্থান বা গুরুত্ব যে বেতন স্কেল দিয়ে খুব বেশি পরিবর্তন করা যাবে সেটা মনে হয় না। আমরা যদি পাশের দেশগুলোকে দেখি- ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন বাংলাদেশের তুলনায় দুই, তিন, চারগুণ বেশি। বেতনের এ ধরন রাখায় শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ অনেক বেড়ে গেছে আবার শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের কারণে শিক্ষকদের মধ্যে সামগ্রিকভাবে বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে যে অবস্থান গ্রহণ করা সেটা সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। শিক্ষকদের একটি অংশ, ডাক্তারদের একটি অংশ বাণিজ্যিকীকরণ থেকে সুফল নেয়ার কারণে দেখা যাচ্ছে সর্বজন প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, বেতন স্কেল যেমন হওয়া উচিত বা হলে প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকরী হয় সে বিষয়টা সামাজিক আলোচনায় আসে না। এখনও যে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে সেখানেও এ মৌলিক প্রশ্নটি আসেনি। এখন কথা হচ্ছে সামাজিক অবস্থান নিয়ে।
প্রশ্ন : ১৫ জুন ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান এবং নেপালের মধ্যে সড়কপথে সরাসরি পণ্য ও যাত্রীবাহী যান চলাচলের চুক্তি হয়েছে। এ কানেকটিভিটি চুক্তি বাংলাদেশের ওপর কেমন প্রভাব রাখবে?
আনু মুহাম্মদ : কানেকটিভিটির নামে যা করা হচ্ছে তার মধ্যে আমি অনেক সমস্যা দেখি। কিন্তু এটা বলে রাখা দরকার যে, আমাদের দিক থেকে আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় জনগণের মধ্যে যত যোগাযোগ বাড়াতে পারি, বিশ্বের জনগণের সঙ্গে যত বেশি যোগাযোগ বাড়াতে পারি, অর্থনীতিগুলোর মধ্যে যত যোগাযোগ বাড়াতে পারি তত বেশি ভালো। এটা আমরা সব সময়ই মনে করি। আমাদের কাছে এ যোগাযোগ বাড়ানো মানে প্রত্যেকটি দেশ তাদের সার্বভৌমত্ব এবং তাদের নিজের স্বার্থকে আরও নিশ্চিত করার জন্য, বিকাশকে আরও নিশ্চিত করার জন্য যোগাযোগটা বাড়াবে। সংযুক্তি বৃদ্ধি করতে গেলে প্রত্যেকটা দেশের একটা নিজস্ব উন্নয়ন দর্শন লাগবে, উন্নয়নের রূপকল্প লাগবে, ভিশন লাগবে। সেই উন্নয়ন ভিশনে সে অঞ্চলের জনগণের স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে। সে অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ এবং জনগণের স্বার্থ, ভবিষ্যতের উৎপাদনশীল খাতের বিকাশ- এগুলো একটি কেন্দ্রীয় বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে। এখন কানেকটিভিটির নামে যেটা করা হয়েছে তা হলো, ভারতের বৃহৎ পুঁজির স্বার্র্থে পুরো অঞ্চলটাকে পুনর্বিন্যস্ত করার একটি রোডম্যাপ তৈরি করা। বলা হচ্ছে, এ কানেকটিভিটির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আরও কানেকটিভিটি বাড়বে; কিন্তু এ কথাটা ভুল। কারণ ভারতের কলকাতা, আগরতলা, শিলংয়ের সঙ্গে তো বাংলাদেশের যোগাযোগের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগও এ কানেকটিভিটির মধ্য দিয়ে বাড়বে না। মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে চায়নার সঙ্গে যোগাযোগও এর মধ্য দিয়ে বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এর মধ্য দিয়ে ২৫ ভাগ খরচ এবং সময়ে ভারত তার এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যেতে পারবে। ভারত রাষ্ট্র ও তার বৃহৎ পুঁজির সচলতাটা বহুগুণে বাড়বে এবং তাদের বিনিয়োগ, পণ্য পরিবহন, জনবসতির বিন্যাসও বড় আকারে পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশ শুধু ভারতের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যোগাযোগের বাহন হিসেবে কাজ করবে। এ মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশ কোনো জটিলতার মধ্যে পড়বে কিনা, কোনো সঙ্কটে বা ক্ষতির মুখে পড়বে কিনা, সে বিষয়ে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা সমীক্ষা দেখি না। কিংবা যদি ক্ষতি হয়, তাহলে সেই ক্ষতি পূরণ বা ক্ষতির বিপরীতে বাংলাদেশ কী কী সুবিধা পাবে, সে সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো চিত্র আমরা পাইনি। দেশের অবকাঠামোতে যদি ভারতের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পণ্য পরিবহন, জনপরিবহন হয়, তাহলে যানবাহন বাড়বে। আমাদের দেশের অভ্যন্তরেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যানবাহন পণ্য পরিবহনে বিভিন্ন জটিলতায় পড়ে। তো এখন যানবাহন আরও বৃদ্ধি পেলে, তখন এটি যেহেতু আন্তর্জাতিক চুক্তির অংশ, সুতরাং এ সুবিধা দিতে গেলে তাদের অগ্রাধিকার পাওয়ার কারণে বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য পরিবহন ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা বা বাধাগ্রস্ত হবে কিনা কিংবা আমাদের কৃষি জমি বা অন্যান্য জিনিস ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা, সেগুলোর একটি হিসাব-নিকাশ তো আমাদের দরকার। নাগরিক হিসেবে এটি জানার অধিকার তো আমাদের আছে। বাংলাদেশ কী পাবে, সে বিষয়ে কোনো পরিষ্কার চিত্র বা তথ্য নেই। তাই মনে হচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের অর্থনীতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সড়ক যোগাযোগ, রেল যোগাযোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্র বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে থাকবে কিনা, সেটাই সন্দেহের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ভারত রাষ্ট্র এখন যে উন্নয়ন মডেলে অগ্রসর হচ্ছে সে উন্নয়ন মডেল যে গ্রহণযোগ্য কোনো মডেল না, সেটা আমরা ভারত রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এত বিপুল দারিদ্র্য, এত বৈষম্য এবং বিপুল সহিংসতা থেকেই বুঝতে পারি। সুতরাং ভারত যে পথে যাবে, সেই পথে ভারতের সঙ্গে আমরা যাব বা নরেন্দ্র মোদির আশ্বাস যে তিনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাবেন, এ আশ্বাস-প্রস্তাব তো খুব বিপজ্জনক। কারণ ভারতের এ মডেলটা তো সেই দেশের মানুষকে কোনো শান্তিও দিচ্ছে না, জনগণকে কোনো নিরাপত্তাও দিচ্ছে না। দারিদ্র্যমুক্তির কোনো আশ্বাসও দিচ্ছে না। ভারতের বৃহৎ পুঁজির স্বার্থ আরও বেশি রক্ষিত হবে বর্তমানের কানেকটিভিটির মডেল দিয়ে। কিন্তু এতে বাংলাদেশের জনগণের বা অর্থনীতির যে ধরনের ঝুঁকি তৈরি হবে তেমনি ভারতের জনগণেরও কী সুবিধা হবে, সেটা বলা মুশকিল। কানেকটিভিটি হচ্ছে কিন্তু আমাদের তো ডিসকানেক্ট করা হচ্ছে কাঁটাতার দিয়ে। একদিকে বলা হচ্ছে, কানেকটিভিটি অথচ আমাদের ডিসকানেক্ট করার চেষ্টা হচ্ছে। এ ডিসকানেক্ট অবস্থায় থেকে কানেকটিভিটির স্লোগান তো একটা আত্মপ্রতারণা। বাংলাদেশের সরকার যখন বলে আমরা কানেকটিভিটি বাড়াচ্ছি, অন্যদিকে কাঁটাতারের বিরুদ্ধে কিছু বলে না তখন এটি একটি বড় ধরনের আত্মপ্রতারণা হয়। কানেকটিভিটির আলোচনায় প্রথমেই বলা উচিত কাঁটাতারের বেড়া সরাতে হবে। আমাদের অভিন্ন নদীর ওপর বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে, সেখানেও তো কানেকটিভিটি নেই। এসব কারণেই এ কানেকটিভিটি খুব অস্বচ্ছ। এটা এ অঞ্চলে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে এবং বাংলাদেশের উৎপাদনশীল বিকাশে অনেক ধরনের ঝুঁকিও তৈরি করবে।
প্রশ্ন : ভারতের দুইটি বৃহৎ কোম্পানি রিলায়েন্স ও আদানি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ করবে। এ বিষয়ে সমঝোতা চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাংলাদেশে ভারতের এ দুই বৃহৎ কোম্পানির আগমনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আনু মুহাম্মদ : এখন যেটা হচ্ছে যে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহৎ পুঁজির একটি আত্মসম্প্রসারণের ক্ষুধা তৈরি হয়েছে। সুতরাং তাদের বিভিন্ন অঞ্চল দরকার। আমরা হয়তো সামনে দেখব যে, বাংলাদেশে ভারতের আরও অনেক বৃহৎ বিনিয়োগ আসবে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বা বাংলাদেশের যারা সহবিনিয়োগকারী এদের ভূমিকার কারণে এ বিনিয়োগগুলো কতটা উৎপাদনশীল হবে, সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যেমন রিলায়েন্স ও আদানির শক্তির উৎস হচ্ছে ভারত সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এবং বিজেপি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা। রিলায়েন্স ও আদানি দুইটি কোম্পানিরই ভারতে অনেক দুর্নাম আছে। পরিবেশ দূষণ, নিয়ম ভঙ্গ, অতিরিক্ত দাম আদায় করা, আর্থিক অনিয়ম এমনকি শ্রমিক নিপীড়ন থেকে অঞ্চলে ত্রাস সৃষ্টির মতো অভিযোগও আছে। এ ধরনের অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে আছে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশে আনা হচ্ছে নিয়মবহির্ভূতভাবে, মানে মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের মধ্যে তাদের যে সুযোগটা দেয়া হচ্ছে সেটা হলো, বাংলাদেশে জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে দায়মুক্তি আইন করা হয়েছিল সেই আইনের অধীনে তাদের আনা হচ্ছে মানে তাদের সঙ্গে যে চুক্তি করা হবে সেখানে যদি কোনো অনিয়ম হয় বা ভারতের এ কোম্পানি যদি নিয়ম ভঙ্গ করে এখানে কিছু করে, তাহলে সেটার বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়া যাবে না। নিয়মবহির্ভূতভাবে এ ধরনের চুক্তি করার অর্থই হচ্ছে যে, এর মধ্যে অনিয়ম আছে, জনস্বার্থবিরোধী উপাদান আছে। ভারত সরকার যেখানে রামপালে সুন্দরবন ধ্বংস করার মতো বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প নিয়ে জেদ করছে কিংবা এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ, ভারত, এমনকি আন্তর্জাতিক মহলে জনমত থাকলেও সেটা উপেক্ষা করে অগ্রসর হচ্ছে তাই এটা তো খুবই উদ্বেগের বিষয় যে, তাদের যদি কোনো নিয়মকানুনের মধ্যে না রাখা হয়, তাহলে এটা আমাদের জন্য কতটা বিপর্যয়ের সৃষ্টি করতে পারে।
প্রশ্ন : সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ভারত এবং চীনের বৃহৎ বিনিয়োগ প্রক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এ দুইটি দেশের বৃহৎ বিনিয়োগ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য কেমন ফল বয়ে আনবে বলে আপনি মনে করেন?
আনু মুহাম্মদ : বিনিয়োগ যদি উৎপাদনশীল খাতে হয়, সেটা ভারত হোক, চীন হোক বা বাংলাদেশ যে দেশেরই হোক, তার কিছু ইতিবাচক ফল তো থাকেই, কর্মসংস্থান হয়, প্রযুক্তির বিকাশ ঘটে, আয় বাড়ে ইত্যাদি হয়। কিন্তু বিনিয়োগ কোনো ধরনের শর্তে হচ্ছে, কোন খাতে হচ্ছে, কিসের বিনিময়ে হচ্ছে, সেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন যদি সুন্দরবনধ্বংসী রামপাল প্রকল্পকে আমরা বিনিয়োগ হিসেবে ধরি, তাহলে এটা হচ্ছে বাংলাদেশের সর্বনাশের বিনিয়োগ। এ ধরনের বিনিয়োগ যদি হয় যার কোনো জবাবদিহিতা নেই, স্বচ্ছতা নেই এবং যে বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে কস্ট বেনিফিট বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে বেনিফিটের চেয়ে কস্ট বেশি পড়ে, তাহলে সে বিনেয়োগ তো খুব বিপজ্জনক হবে। আমরা দেখছি যে, চীন এবং ভারত খুব এগ্রেসিভলি আসছে। বাংলাদেশের সরকারও দেখা যাচ্ছে বঙ্গোপসাগর থেকে এ পুরো অঞ্চল চীন, ভারত, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র- এ চারটি দেশের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করার একটা ব্যবস্থা করছে। আর বাংলাদেশের শিল্পপতি ব্যবসায়ী যারা তাদের পরিণতি খুব শিগগির হয়ে যাচ্ছে জুনিয়র পার্টনারের ভূমিকা। গতিটা হচ্ছে এদিকে। বাংলাদেশের শিল্পপতি-ব্যবসায়ীর ভারত বা চীনের জুনিয়র পার্টনার হয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের এ নিয়ে আপত্তি নেই, কারণ তাদের দিক থেকে তেমন কিছু শোনা যায় না। সে কারণেই আমি বলতে চাই যে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান দেখে উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। দেখতে হবে বিনিয়োগের গুণগত দিকটা। বিনিয়োগ দেশের হোক, বিদেশের হোক, গুণগত দিকটা দেখা উচিত এবং তার জন্য আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত কতটা ক্ষতি হচ্ছে এবং তার বিনিময়ে আমরা কী লাভ পাব- তার একটি যথাযথ হিসাব থেকেই বোঝা যাবে যে, সে বিনিয়োগ আমাদের অর্থনীতির জন্য গতি তৈরি করবে, না বড় ধরনের বিপর্যয় তৈরি করবে।